সত্যকে জানিবার ও ধারণ করিবার সুযোগ ও ক্ষমতার সহিত যুগপৎ সখ্য ও দ্বন্দ্ব রহিয়াছে চিন্তা, বুদ্ধি ও যুক্তির; কেহ স্থির বিশ্বাসকে, কেহ স্থির যুক্তিকেই ধর্মরূপে গ্রহণ করিয়া থাকে, এইখানে বিশ্বাস ও যুক্তি বিপরীত দিক হইতে ধর্মান্ধ হইয়া উঠিতে পারে। কেমন করিয়া? যেমন করিয়া বিশ্বাসের সহিত সমর্পণ ও আস্থার অভাব ঘটে, যুক্তিও অসমর্পণ ও অনাস্থাকে স্থিররূপে সত্য বলিয়া মানিতে থাকে। মানুষের জীবনে সমর্পণ ও আস্থার কি প্রয়োজন? শিশুর মাতৃত্বের বা পিতৃত্বের যে প্রয়োজন; মাতৃত্ব ও পিতৃত্বহীন শিশুও বিকশিত হইতে পারে কহিতে পার, কিন্তু সে ঘটনাচক্র, মানদণ্ড নহে।
এই যে চারিদিকে এখন সত্য সত্য রব উঠিতেছে মিথ্যার বাতাসে, যেন #সত্য আসিয়া সহসা বাতাসকে শুদ্ধ করিয়া লইবে, দূর করিবে চেতনাহীন লৌহসমাজ ও আচারের মরিচা, কেহ ভাবিতেছে ধর্মশাস্ত্র, কেহ ভাবিতেছে বুদ্ধি-চিন্তা-দর্শনের শিরিষ দ্বারা ঘসিয়া ঘসিয়া। কিন্তু কী সে শাস্ত্র? কী সে বিধান? কী সে বুদ্ধি ও চিন্তার দর্শন? আচারধর্মে যেমন দর্শন ধীরে ধীরে বিধানে পরিণত হইয়াছে, বিপরীতে বুদ্ধি-চিন্তার দর্শনও যেন বিধানরূপে গ্রাহ্য হইতেছে। ধর্মের বর্ম দীর্ঘকাল ধরিয়া বিধানে বৃহৎ হইয়াছে, রাষ্ট্র-ক্ষমতা-প্রতিপত্তির আদরণীয়রূপে বরণ হইয়াছে, সুযোগ পাইয়াছে বহিরঙ্গের পোশাকী চেতনার বিকাশে, কিন্তু তাহার বিরুদ্ধমত তথাকথিত ‘মুক্তচিন্তা ও প্রগতি’ সেই সুযোগ অধিকতর পায় নাই, তাই সে দূর্বল, জনপ্রিয় নহে। কিন্তু আমরা দেখিয়াছি, তাহার যৎসামান্য সুযোগের দারুণ অসদ্ব্যবহার! আত্মপরিচয়ের বদলে সম্মুখ লড়াই আর প্রতিরোধই যেন মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তার ধর্ম! যে লড়াই অবশেষে বুদ্ধি-চিন্তা-যুক্তি-অনুমানের শরিয়তরূপে আরেকখানি আচারধর্মকেই প্রতিষ্ঠা করে।
বুদ্ধি ও চিন্তা যতদূর আত্মঘনিষ্ট না হইবে ততখানি তাহার ঘেরাটোপ। এই ঘেরাটোপ ও প্রতিষ্ঠার ব্যুহ যখন আক্রান্ত হয় তখন সে নাঙা তলোয়ারে পরিণত হয়, আর তাহার চারিদিকে ধর্মান্ধ কাণা-মূঢ়-অচেতন শত্রুরা শকুণের মতো তাহাকে দেখিতে থাকে; সমাজধর্মের হাতে সে পরাভূত হয়, কিংবা ঘটে তাহার বলিদান।
সত্য ইহার ভিতরে আছে কিংবা নাই সে তর্ক নাই করিলাম, কিন্তু সত্য যে আত্মপরিচয়ের তালাশহীন ধর্ম বা প্রগতিতে নাই ইহা বুঝিতে পারি। তাই, আত্মসংস্কৃতির বিনিময়ে ধর্ম ও প্রগতিকে পাঠ করিতে চাহি, বিশ্বাস বা অবিশ্বাসের কাঠকুঠুরীতে বন্দী হইয়া নহে...
View this link