আমার একটা অপারগতা বলা যায় কি_না জানিনা , আমি লিখতে তো পারি , কিন্তু গল্প গুলোর নাম দিতে পারিনা । আবার নামহীন গল্পের শেষটার জন্য সেগুলো কেমন যেন বেওয়ারিশ-ই থেকে যায় ..
তাই শিরোনাম টা বেওয়ারিশ ই থাকল .....
***************************************************
সেদিন সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমীতে অনুষ্ঠান ছিল । অচলার তাতে নাচার কথা । নাচের পোশাক পরে খুব সেজেগুজে বের হয়েছিল সে ; সঙ্গে মা-বাবা আর ছোট ভাই পল্টু । সোনারগাঁও থেকে রওয়ানা হয়েছিল খুব ভোরে । গাড়ি চালাচ্ছিলেন বাবা নিজেই । মা বসেছিল বাবার পাশে । আর দুই ভাই-বোন পিছনের সিটে ।
কাচপুর ব্রিজটা তখনও জমজমাট হয়নি । খুব হাসি-তামাশা করেই ঢাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল এই ছোট্ট পরিবারটা । হঠাৎ গাড়ির সামনে ছোট্ট একটা কুকুর ছানা চলে আসে । সিরাজ সাহেব ব্রেক কষেন । গাড়ি ঘুরাতেই সজোরে মাঝারি সাইজের একটা মালামাল ভর্তি ট্রাকের সাথে সংঘর্ষ ... !!
রক্তাক্ত সিরাজ সাহেব পাশে তাকিয়ে দেখেন নিলার কিছু হয়নি । অজ্ঞান হয়েছে বোধহয় , চোখ বন্ধ । মাথায় খানিক্টা চোট । কিন্তু বাচ্চারা ? পিছে তাকিয়ে দেখেন পল্টুর মাথার ভিতরে কাঁচ ঢুকেছে । আর অচলা উল্টে পড়ে আছে । জ্ঞান হারালেন তিনি ।
সাত দিন পর সিরাজ সাহেব চোখ খুলেছিলান হাসপাতালের বেডে । বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াতে আরও সাতদিন । কিন্তু আজ সাত বছরেও সেই ঘটনা ভুলতে পারেননি তিনি । কিভাবে ভুলবেন ; এতকিছু কেড়ে যে নিয়েছে ! মিসেস নিলা আর পল্টুর চোখ চিরতরে সেখানেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো । আট বছরের অচলার কণ্ঠে জ্ঞান বেজে ওঠেনি আর । গানের তালে তালে মেতে ওঠেনি তার দুই পা । কিছুদিন চেষ্টা করা হয়েছিল ঠিকই , কিন্তু পায়ের আঙ্গুল পর্জন্তই । ডাক্তার বলেছিলেন , এই বাচ্চা নিজে থেকে জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছে । কি চেষ্টা করেননি সিরাজ সাহেব তার মেয়ের জন্য , কোথায় নিয়ে যাননি ... তবুও কেন যে মেয়েটা ... কার যে নজর লেগেছিল এই সুখী পরিবারটায় !!!
অচলার জন্মের আগে তার বাবা কোন এক উপন্যাস পড়েছিলেন যার প্রধান চরিত্র কে এতই পছন্দ হয়েছিল যে তার নামেই মায়ের নাম রেখে দিলেন অচলা । কিন্তু যেইদিন তার হাঁটা বন্ধ হল , সেদিন মনে একটা প্রশ্ন বারবার ঝড় তুলে দিচ্ছিল ; " অচলা কি আসলেই অচল ??? "
গ্রামের বাড়িতে পুকুর ঘাটে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন সিরাজ সাহেব এইসব । আকাশের এক কনায় কালো মেঘ দেখা গেলো । তারপর দেখতে দেখতে পুরো আকাশটাই কালো হয়ে উঠল ...
অচলা নিঃশ্বাস বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে । সে আগে কখনও এমন আকাশ দেখেনি । কিছুক্ষনের মাঝে আকাশ চিরে বিদ্যুৎ ঝল্কে উঠতে থাকে , সাথে সাথে মেঘের গুরুগম্ভীর গর্জন । প্রথমে এতটুকু বাতাস নেই , তারপর হঠাৎ কোথা থেকে যেন এক দমকা হাওয়া এসে গাছের পাতা , খড়কুটো সব উড়াতে থাকে । ধুলায় চারদিক ঢেকে যায় । গরু-বাছুর সব গলা ছেড়ে ডাকতে থাকে । এরপর শুরু হয় বৃষ্টি । প্রথমে বড় বড় কয়েকটা পানির ফোঁটা , তারপর আরো কয়েকটা , তারপর আরও কয়েকটা ; তারপর নামলো ঝুম বৃষ্টি । টিনের মাঝে কেমন যেন অদ্ভুত ঝঙ্কার অচলা কে উন্মাদ করে তুলে ।
ক্র্যাচে ভর করে বের হয়ে আসে সে । বৃষ্টির জন্য সব ঝাপ্সা দেখাচ্ছে । তাও সে দূরে তার মা'কে দেখছে । মা ঝুব বৃষ্টিতে নাচছে _ ঠিক যেমন টা আগে নাচত । মায়ের কণ্ঠে বেজে উঠছে রবি-ঠাকুরের সেই বৃষ্টির জ্ঞান ...
তার তালে তালে নাচছে সব পশুপাখি , গাছপালা আর বনলতা ।
অচলাও এগিয়ে গেলো । নাচতে গিয়ে পড়ে গেলো । কিন্তু আজ সে নাচবেই । ক্র্যাচে ভর করে উঠে দাঁড়ালো সে । কিন্তু এই-ই শেষ , আর সাহায্য নিতে চায় না । ফেলে দিলো ওই কাঠের টুকরা । মায়ের সাথে গানের তালে তালে সে ও দুলছে । আজ কোন বাধাই মানবে না সে । তার অদম্য ইচ্ছাশক্তির সাথে বেজে উঠলো আনন্দের ধ্বনি ; বাঁধ ভেঙ্গে দেওয়ার আওয়াজ ...
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে , ১৫ বছরের এক প্রানবন্ত কিশোরী নাচছে । তার তালে তাল মিলিয়ে নেচে উঠছে প্রকৃতিও । চারেদিকে বয়ে যাচ্ছে আনন্দের ধারা ।
প্রথমে ধীরে ধীরে , তারপর চেঁচিয়ে গাইতে লাগলো __
" মম চিত্তে নিতি নৃত্তে কে যে নাচে ,
তাতা থৈ থৈ , তাতা থৈ থৈ , তাতা থৈ থৈ ।
তারই সঙ্গে কি মৃদঙ্গে সদা বাজে ,
তাতা থৈ থৈ , তাতা থৈ থৈ , তাতা থৈ থৈ । "
( ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থী )