ইসলামি জ্যোতির্বিদ্যা গঠিত হয় ইসলামি বিশ্বে সৃষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত অগ্রগতি নিয়ে বিশেষত ইসলামি স্বর্ণযুগে ৯ থেকে ১৩শ শতাব্দী এবং সেসময় বেশিরভাগ লেখাই হয় আরবি ভাষায়। সেসব অগ্রগতির বেশিরভাগ সঙ্ঘটিত হয় মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া, আল-আন্ডালুস, এবং উত্তর আফ্রিকায়, ও পরবর্তীতে দূর প্রাচ্য এবং ভারতে। এর বহিরাগত দ্রব্য এবং সেসব দ্রব্যের বিসদৃশ উপাদানের সংমিশ্রনে ইসলামি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটি বিজ্ঞান সৃষ্টি করে যা ঘনিষ্ঠভাবে অন্যান্য ইসলামি বিজ্ঞানের জন্মের সাথে সমান্তরাল। এসবের অন্তর্ভুক্ত হয় বিশেষত গ্রিক, সাসানীয়, এবং ভারতীয় রচনাসমূহ, যেগুলো অনুবাদ হয়েছিল এবং ভিত্তিস্বরূপ হয়েছিল।
মধ্যযুগের গোড়ার দিকে জ্ঞানহ্রাসের পর ইসলামি জ্যোতির্বিজ্ঞান বাইজেন্টাইন এবং ইউরোপীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানকে পুনর্জীবিত করতে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে বিশেষ করে বারো শতকে আরবি রচনাগুলো ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করার মাধ্যমে। ইসলামি জ্যোতির্বিজ্ঞানের চীনা জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং মালিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপরও প্রভাব ছিল।আকাশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণের তারকা , যেমন আল্ডেবারান, অল্টেয়ার এবং ডিনেব, জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষা যেমন এলিডাড, আজিমুথ এবং নাদির, এখনও তাদের আরবি নামে উল্লেখিত হয়।বর্তমানে ইসলামিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাহিত্যের এক বিশাল সংকলন বিদ্যমান আছে, সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রায় ১০,০০০ সংখ্যার পাণ্ডুলিপি, যাদের বেশির ভাগই পঠিত বা তালিকাভুক্ত হয়নি। তারপরও, জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইসলামি সক্রিয়তার এক ন্যায্য নির্ভুল চিত্র পুনর্নির্মিত করা যায়।
ওপরের ইমেজটি ১১৯৭ হিজরি/১৭৮২-৩ সালে হাদি ইস্ফাহানির কৃতিত্ব সমেত প্রচলিত গোলাকার গঠনে নির্মিত একটি বৃহৎ ইরানি ব্রাস ভূগোলক, ভূগোলকটিতে নির্দেশক চিহ্ন, ব্যক্তিত্ব এবং জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক প্রতীকসহ বিস্তারিত বিবরণ খচিত রয়েছে।ইসলাম বিজয়ের পর খেলাফতের শুরুর দিকে মুসলমান বিদ্বানরা গ্রিসদেশীয় এবং ভারতীয়জ্যোতির্বিদ্যার জ্ঞান আত্মভূত করে নিতে লাগলেন ফার্সির এবং আরবি অনুবাদের মাধ্যমে।সর্বপ্রথম যেসব জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত রচনা আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল সেগুলো ছিল ভারতীয় এবং ফার্সি উদ্ভূত।রচনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল জিজ আল-সিন্ধহিন্দ ৮ম শতাব্দীর এক ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যার রচনা যা মুহাম্মদ ইবনে ইব্রাহিম আল-ফাজারি এবং ইয়াকুব ইবনে তারিক অনুবাদ করেন ৭৭০ এর পরে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সহায়তায় যারা খলিফা আল-মনসুরের দরবারে এসেছিলেন ৭৭০ সালে। আরেকটি অনূদিত রচনা হচ্ছে জিজ আল-শাহ, জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত সারণীর এক সংকলন যা ভারতীয় স্থিতিমাপকের উপর ভিত্তি করে দুই শতাব্দীর বেশি সময় ধরে সাশানিড ফার্সিতে রচিত হয়। সেই সময়ের রচনাসমূহের অংশবিশেষ ইঙ্গিত করে যে আরবদেশীয়রা সাইন অপেক্ষকটি গ্রহণ করেছিলেন গ্রিক ত্রিকোণমিতিতে ব্যবহৃত বৃত্তের পরিধির জ্যা'র বদলে।আহমেদ দাল্লাল উল্লেখ করেন যে ব্যাবিলনিয়ান, গ্রিক এবং ভারতীয়রা, যারা গাণিতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান অধ্যয়নের বিশদ পদ্ধতি উন্নয়ন করেছিলেন তাদের চেয়ে ভিন্নভাবে প্রাক-ইসলাম আরবেরা পুরোপুরি অভিজ্ঞতালব্ধ পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করতেন। এই পর্যবেক্ষণগুলো নির্দিষ্ট নক্ষত্রের উদয় এবং অস্ত উপর ভিত্তি করত এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের এই ক্ষেত্রটি আনওয়া নামে পরিচিত ছিল। আরবদের দ্বারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর আনওয়া বিকশিত হতে লাগল যেখানে ইসলামি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তাদের অভিজ্ঞতালব্ধ পর্যবেক্ষণের সাথে গাণিতিক পদ্ধতি যোগ করলেন।ডেভিড কিং-এর মতে ইসলামের উত্থানের পর কিবলা এবং নামাজের সময় নির্ধারণ করার বাধ্যকতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জ্যোতির্বিজ্ঞানে অগ্রগতিতে অনুপ্রাণিত করে।
জ্ঞানের গৃহ ছিল আব্বাসিয় খলিফা আল-মামুনের আমলে ৯ম শতকের শুরুর দিকে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত একটি শিক্ষায়তন। সে সময় থেকে টলেমীয় ব্যবস্থার স্বাধীন অনুসন্ধান সম্ভবপর হয়ে উঠে। দাল্লাল ২০১০ এর মতানুসারে, অপেক্ষকের ব্যবহার, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রথার উৎস এবং হিসাবপদ্ধতি টলেমীয় প্রথাকে একেবারে প্রথম থেকে পর্যবেক্ষণীয় পরিশোধনের এবং গাণিতিক পুনর্গঠনের সম্ভাবনার জন্যে গ্রহণক্ষম করে তোলে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণা আব্বাসিয় খলিফা আল-মামুনের দ্বারা জ্ঞানের গৃহের মাধ্যমে অত্যন্ত সহায়তা পায়। এ ধরণের কাজের কেন্দ্র হয়ে উঠে বাগদাদ এবং দামেস্ক। খলিফারা এই কাজগুলো শুধুমাত্র আর্থিকভাবেই সহায়তা করেননি বরং আনুষ্ঠানিক মর্যাদা দিয়ে তারা কাজটিকে ভূষিত করেছেন।জ্যোতির্বিজ্ঞানে সর্বপ্রথম প্রধান মুসলিম রচনা ছিল ৮৩০ সালে আল-খোয়ারিজমি কর্তৃক রচিত জিজ আল-সিন্ধ। রচনাটি সূর্য, চাঁদ এবং সেই সময়ে জ্ঞাত পাঁচটি গ্রহের চলনের সারণী সম্বলিত ছিল। সেই রচনাটি তাৎপর্যপূর্ণ যেহেতু তা ইসলামিক বিজ্ঞানে টলেমীয় ধারণাসমূহ অন্তর্ভুক্ত করে। সেই রচনাটি ইসলামিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে এক সন্ধিক্ষণও চিহ্নিত করে। এযাবতকাল, মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এক প্রাথমিক গবেষণার পথ অবলম্বন করেছিলেন এই ক্ষেত্রে, অন্যদের রচনাসমূহ অনুবাদ করে এবং ইতিমধ্যেই আবিষ্কৃত জ্ঞানার্জন করে। আল-খোয়ারিজমি র রচনা অধ্য্যয়ন এবং হিসেবনিকেশের অপ্রথাগত পদ্ধতির প্রারম্ভ সুচনা নির্দেশ করে।৮৫০ সালে, আল-ফারগানি রচনা করেন কিতাব ফি জাওয়ানি অর্থাৎ তারকা বিজ্ঞানের এক সারমর্ম। বইটি প্রাথমিকভাবে টলেমীয় মহাবিশ্ববিবরনের একটি সারাংশ উপস্থাপন করে। যাইহোক পূর্বের আরবদেশীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের আবিস্কারের উপর নির্ভর করে তা টলেমীকেও সংশোধন করে। আল-ফারগানি সূর্যের পরিক্রমণের বক্রতার চাঁদ এবং সূর্যের পৃথিবী থেকে দূরবর্তী বিন্দুর অয়নচলনের এবং পৃথিবীর পরিধির পুনঃপরিক্ষিত মান দেন। বইটি মুসলিম বিশ্বে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পরে এমনকি ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদও হয়।জ্যোতির্বিজ্ঞানের সেই যুগ যখন এক স্বতন্ত্র ইসলামি ব্যবস্থা বিকশিত হয়। যুগটি শুরু হয় যখন মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা টলেমীর জ্যোতির্বিজ্ঞানের ব্যবস্থার কাঠামোকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। এইসব সমালোচনা, তৎসত্ত্বেও, ভূকেন্দ্রিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত থাকল এবং টলেমীর জ্যোতির্বিজ্ঞানসংক্রান্ত উদাহরণ অনুসরণ করল একজন ঐতিহাসিক তাদের রচনাকে বর্ণনা করেছেন এভাবে এক সংস্কারক প্রকল্প টলেমীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানকে দৃঢ় করতে চায় তার নিজের তত্ত্বের সাথে একই সারিতে এনে।
১০২৫ এবং ১০২৮ সালের মধ্যে ইবনে আল-হাইথেম তার আল-শুকুক আলা বাতলামিয়ুস অর্থাৎ টলেমীর উপর সন্দেহ রচনা করেন। ভূকেন্দ্রিক আদর্শের ভৌত বাস্তবতা বজায় রেখে তিনি টলেমীয় আদর্শের উপাদানগুলোর সমালোচনা করেন। অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী এই কাজে উপস্থিত চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করলেন অর্থাৎ এইসব কষ্টকর কাজের সমাধানে বিকল্প আদর্শের সম্প্রসারিত করা। ১০৭০ সালে আবু উবায়াদ আল-জুযজানি তারিক আল-আফলাক প্রকাশ করেন। তার রচনায় তিনি টলেমীয় আদর্শের তথাকথিত ইকুয়েন্ট সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করেন। আল-জুযজানি সমস্যাটির একটি সমাধানও প্রস্তাব করেন। আল-আন্দালুসে অজ্ঞাতনামা রচনা আল-ইস্তিড্র্যাক আলা বাটলামিয়ুস অর্থাৎ টলেমী সংক্রান্ত অনুচিন্তন টলেমীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিরোধিতার এক তালিকা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তথ্যসূত্র ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইট থেকে সংগ্রহ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৮ বিকাল ৫:৪০