মসজিদুল আকসা এর ইতিহাস (প্রথম পর্ব)
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২১ আগস্ট অস্ট্রেলীয় পর্যটক ডেনিস মাইকেল রোহান কর্তৃক মসজিদে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। রোহান ওয়ার্ল্ডওয়াইড চার্চ অফ গড নামক এভাঞ্জেলিকাল খ্রিষ্টান গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন। তার ধারণা ছিল যে মসজিদুল আকসা পুড়িয়ে ফেলার মাধ্যমে তিনি যীশুর দ্বিতীয় আগমনকে ত্বরান্বিত করতে পারবেন এবং ইহুদি মন্দির তৈরীর পথ করতে পারবেন। রোহানকে তারপর একটি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে সেই বছর রাবাতে মুসলিম দেশগুলোর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সৌদি আরবের সেসময়ের বাদশাহ ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজ এর উদ্যোক্তা ছিলেন। সেই অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ও আইসি গঠনের ক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে।
এরপর ১৯৮০ দশকের দিকে গুশ এমুনিম আন্ডারগ্রাউন্ড নামক সংগঠনের সদস্য বেন শোশান এবং ইয়েহুদা এতজায়ন আল-আকসা মসজিদ এবং কুব্বাত আস সাখরা উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। এতজায়ন বিশ্বাস করতেন যে স্থাপনা দুটি উড়িয়ে দিলে তা ইসরায়েলের আধ্যাত্বিক জাগরনে ভূমিকা রাখবে এবং ইহুদি জনগণের সকল সমস্যা সমাধান করবে। তারা আরো ধারণা করতেন যে তৃতীয় মন্দির মসজিদের স্থানে নির্মিত হতে হবে। প্রথম ইন্তিফাদা চলার সময় ১৯৮৮ সালে ১৫ই জানুয়ারি ইসরায়েলি সেনারা মসজিদের বাইরে বিক্ষোভকারীদের উপর রাবার বুলেট এবং টিয়ার গ্যাস ছোড়ে এবং এতে ৪০ জন মুসল্লি আহত হন। ১৯৯০ সালে ৮ই অক্টোবর দাঙ্গায় ইসরায়েলি সীমান্ত পুলিশ কর্তৃক ২২ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১০০ জনেরও বেশি আহত হন। টেম্পল মাউন্ট ফেইথফুল নামক ইহুদি ধর্মীয় গোষ্ঠী তৃতীয় মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করতে যাচ্ছে ঘোষণা করলে সেই প্রতিবাদ শুরু হয়।
২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলের তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা এরিয়েল শ্যারন এবং লিকুদ পার্টির সদসরা ১০০০ সশস্ত্র রক্ষীসহ আল আকসা এর চত্বর পরিদর্শন করেন। ব্যাপক সংখ্যক ফিলিস্তিনি এর প্রতিবাদ করেন। শ্যারন এবং লিকুদ পার্টির সদস্যরা স্থানত্যাগ করার পর হারাম আল শরিফের প্রাঙ্গণে ইসরায়েলি দাঙ্গা পুলিশের উপর পাথর নিক্ষেপের মাধ্যমে বিক্ষোভ শুরু হয়। পুলিশ টিয়ার গ্যাস এবং রাবার ছুড়লে ২৪ জন আহত হন। এই পরিদর্শনের ফলে পাঁচ বছরব্যপী আন্দোলন চলে সাধারণভাবে আল আকসা ইন্তিফাদা নামে পরিচিত। তবে কিছু ধারাভাষ্যকার ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা যেমন ইমাদ ফালুজি এবং আরাফাতের উদ্ধৃতি দিয়ে দাবি করেন যে ইন্তিফাদা কয়েক মাস আগে ইয়াসির আরাফাতের ক্যাম্প ডেভিড আলোচনা থেকে ফেরার পর থেকে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ২৯ সেপ্টেম্বর ইসরায়েলি সরকার মসজিদে ২,০০০ দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করে। জুমার নামাজের পর একদল ফিলিস্তিনি মসজিদ ত্যাগ করার পর তারা পুলিশের উপর পাথর নিক্ষেপ করে। পুলিশ তারপর মসজিদ চত্বরে প্রবেশ করে গুলি এবং রাবার বুলেট ছোড়া শুরু করে ফলে চারজন নিহত এবং প্রায় ২০০ জন আহত হন।
২০১৪ সালের ৫ই নভেম্বর ইসরায়েলি পুলিশ ১৯৬৭ সালে জেরুজালেম দখল করার পর প্রথমবার আল আকসায় প্রবেশ করে বলে ইসলামিক ওয়াকফের পরিচালক শাইখ আজ্জাম আল-খতিব উল্লেখ করেছেন। পূর্ববর্তী মিডিয়া রিপোর্টে বলা হয়েছে পুলিশ হারাম আল শরিফ চত্বরে প্রবেশ করেছে, মসজিদে নয়।আয়াতাকার আল আকসা মসজিদ এবং এর পরিপার্শ্ব মিলিয়ে আকার ১,৪৪,০০০ বর্গমিটার ১৫,৫০,০০০ ফু২, তবে শুধু মসজিদের আকার প্রায় ৩৫,০০০ বর্গমিটার ৩,৮০,০০০ ফু২ এবং ৫,০০০ মুসল্লি ধারণ করতে পারে।মসজিদ ৮৩ মি ২৭২ ফু দীর্ঘ, ৫৬ মি ১৮৪ ফুট প্রশস্ত. সম্মুখবর্তী কুব্বাত আস সাখরায় ধ্রুপদি বাইজেন্টাইন স্থাপত্য দেখা গেলেও মসজিদুল আকসায় প্রথম দিককার ইসলামি স্থাপত্য দেখা যায়।সীসার প্লেট দিয়ে গঠিত রূপালি গম্বুজ।আবদুল মালিকের নির্মিত গম্বুজ বর্তমানে নেই। বর্তমান গম্বুজটি আজ-জাহির নির্মাণ করেছিলেন এবং এটি সীসার এনামেলওয়ার্ক আচ্ছাদিত কাঠ দ্বারা নির্মিত। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে কংক্রিটে গম্বুজ পুনর্গঠিত হয় এবং সীসার এনামেলওয়ার্কের পরিবর্তে এনোডাইজড এলুমিনিয়াম দ্বারা আচ্ছাদিত হয়। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে আজ-জাহিরের সময়কারমূল নকশা ফিরিয়ে আনার জন্য এলুমিনিয়ামের কভারের বদলে পুনরায় সীসা স্থাপন করা হয়।উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলে মিহরাবের সম্মুখে নির্মিত গম্বুজগুলোর মধ্যে টিকে রয়েছে এমন কয়েকটি গম্বুজের মধ্যে আল-আকসার গম্বুজ অন্যতম। অন্যগুলো হল দামেস্কের উমাইয়া মসজিদ ৭১৫ এবং সুসার জামে মসজিদ ৮৫০। গম্বুজের ভেতরে ১৪শ শতাব্দীর অলংকরণ রয়েছে। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের অগ্নিকান্ডের সময় এসকল অলংকরণ চিরতরে হারিয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়েছিল কিন্তু ট্রাটেগিও প্রক্রিয়ায় তা ফিরিয়ে আনা হয়।১২৭৮ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত আল-ফাখারিয়া মিনার আল-আকসা মসজিদের চারটি মিনারের মধ্যে প্রথম নির্মিত হয়।
দক্ষিণ, উত্তর ও পশ্চিম পাশে মোট চারটি মিনার রয়েছে। প্রথম মিনারটি আল-ফাখারিয়া মিনার নামে পরিচিত যা ১২৭৮ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণপশ্চিম অংশে নির্মিত হয়। মামলুক সুলতান লাজিন এটি নির্মাণের আদেশ দিয়েছিলেন। এটি নির্মাণের তত্ত্বাবধায়ক আল-দিন আবদুর রহমানের বাবা ফখরউদ্দিন আল-খলিলির নামে নামকরণ করা হয়েছে। প্রথাগত সিরিয়ান শৈলীতে এটি নির্মিত হয়। এর ভিত্তি ও উলম্ব অংশ বর্গাকার এবং এটি তিনতলা বিশিষ্ট। মুয়াজ্জিনের বারান্দা দুই লাইন বিশিষ্ট মুকারনাস দ্বারা অলঙ্কৃত করা হয়েছে। কুলুংগি ঘিরে রয়েছে একটি বর্গাকার অংশ যা একটি সিসা আচ্ছাদিত পাথরের গম্বুজে শেষ হয়।[৪৪]
গাওয়ানিমা মিনার।
দ্বিতীয়টি গাওয়ানিমা মিনার বলে পরিচিত। এটি ১২৯৭-৯৮ সালে স্থপতি কাজি শরফউদ্দিন আল খলিলি কর্তৃক নির্মিত হয়। সেটিও সুলতান লাজিনের আদেশে নির্মিত হয়েছিল। এটি ছয় তলা উচু এবং হারাম আল শরিফ প্রাঙ্গণের সর্বোচ্চ মিনার। এই দুটি টাওয়ার সম্পূর্ণভাবে পাথরের তৈরি শুধু মুয়াজ্জিনের বারান্দার শামিয়ানা কাঠের তৈরি। শক্ত কাঠামোর কারণে গাওয়ানিমা মিনার ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। মিনারটি পাথরের ছাচ এবং গ্যালারির মাধ্যমে কয়েকটি তলায় বিভক্ত। প্রথম দুই তলা প্রশস্ত এবং টাওয়ার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। পরের চারটি তলা সিলিন্ডার আকৃতির ড্রাম এবং কন্দ আকৃতির গম্বুজ নিয়ে গঠিত। প্রথম দুই তলায় সিড়ি বাইরে অবস্থিত। কিন্তু তৃতীয় তলা থেকে মুয়াজ্জিনের বারান্দা পর্যন্ত সিড়ি মিনারের ভেতরে পেচানোভাবে অবস্থিত।
১৩২৯ সালে সিরিয়ার মামলুক গভর্নর তানকিজ তৃতীয় মিনার নির্মাণের আদেশ দেন যা বাব আল সিলসিলা নামে পরিচিত। এটি মসজিদের পশ্চিমে অবস্থিত। এই মিনার ঐতিহ্যবাহী সিরিয়ান বর্গাকার টাওয়ার রীতিতে নির্মিত এবং সম্পূর্ণ পাথর দ্বারা তৈরি।
সর্বশেষ মিনারটি ১৩৬৭ সালে নির্মিত হয়। এটি মিনারাত আল-আসবাত নামে পরিচিত। এটি সিলিন্ডার আকৃতির পাথরের উত্থিত অংশ দ্বারা গঠিত যা পরবর্তী কালের উসমানীয় সুলতানরা নির্মাণ করেছিলেন। এটি মামলুক নির্মিত বর্গাকার ভিত্তির উপর ত্রিকোণাকার রূপান্তরের অংশ থেকে উঠেছে। মুয়াজ্জিনের বারান্দায় উত্থিত অংশ সরু হয়ে যায় এবং এটি বৃত্তাকার জানালা যুক্ত যার শেষপ্রান্তে কন্দ আকৃতির গম্বুজ রয়েছে। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে ভূমিকম্পের পর গম্বুজটি পুনর্নির্মাণ করা হয়।
ছবি তথ্য সূত্রঃ গুগল এবং ইন্টারনেট ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৪৮