দ্রষ্টব্য:
সন্মানিত পাঠকদের ধৈর্য সহকারে পুরো লেখাটি পড়ার অনুরোধ করছি। কারণ, রাসুলুল্লাহ সা: এর প্রতি বিয়ের বিশেষ বিধান ইসলামবিরোধীরা রাসুলুল্লাহ সা: ও ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে ব্যবহার করেন। তাই একজন সাধারণ মুসলিম হিসেবে এ বিষয়ে আমাদের পরিস্কার ধারণা থাকা উচিত।
-------------------------------------------------------------------------------
-০-
আয়াত সমূহ:
সুরা আহযাব এর ৫০-৫২ নং আয়াতের বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদ এখানে দেখে নিন:
১. ইউসুফ আলীর ইংরেজী অনুবাদ এবং
২. মারেফুল কোরআনের বাংলা ও ইংরেজী অনুবাদ।
--------------------------------------------------------------------------------
-১-
উপরের আয়াতগুলোর মুল বক্তব্য:
৫০-৫২: রাসুলুল্লাহ সা: এর জন্য বিয়ের বিশেষ বিধান নাযিল হয় যা অন্য সাধারণ মুমিনদের থেকে কিছুটা আলাদা।
-২-
সুরা আহযাব নাযিলের সময়কাল:
৫ হিজরী সন। কারন, এতে নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে:
ক. আহযাব যুদ্ধ (৫ হিজরী সনের শাওয়াল মাস),
খ. বনী কুরাইজার যুদ্ধ (৫ হিজরী সনের যিলকাদ মাস), এবং
গ. রাসুলুল্লাহ সা: এর সাথে যায়নাব রা: এর বিয়ে (একই সময়: ৫ হিজরী সনের যিলকাদ মাস)।
-৩-
আহযাব যুদ্ধের আগের যুদ্ধ গুলো:
এর আগে নিকটতম সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হল উহুদ (৩ হিজরী সনের শাওয়াল মাস)। এছাড়া উহুদ ও আহযাবের মাঝখানে একাধিক ছোট ছোট যুদ্ধ বা সৈন্যদল প্রেরণের প্রয়োজন হয়েছিল।
-৪-
সামাজিক সংস্কার:
উহুদ থেকে আহযাব যুদ্ধের মধ্যকার দু'বছরে যুদ্ধের ডামাঢোলের মাঝেও মদীনার নতুন মুসলিম সমাজটির গঠন এবং সংস্কার ও সংশোধন অব্যাহত ভাবে চলছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল: বিয়ে ও তালাকের পূর্ণ আইন, উত্তরাধিকার আইনের আবির্ভাব, মদ ও জুয়াকে হারাম, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্হার আরো অন্যান্য দিক।
এর মধ্যে আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংশোধনযোগ্য বিষয় হলো দত্তক গ্রহণ। এর একটি দিক ছিল দত্তক পিতার কাছে দত্তক ছেলের স্ত্রীকে আপন ঔরসজাত ছেলের স্ত্রীর মতো মনে করা হতো। আরবের সমাজে শত শত বছর ধরে এ রীতিটি চলে আসছিল এবং এ রীতিটি বিয়ে, তালাক, ও উত্তরাধিকারের যেসকল আইন সুরা বাকারা ও নিসায় আল্লাহ বর্ণনা করেছেন সেগুলোর সাথে পদে পদে সংঘর্ষশীল ছিল। আল্লাহর আইনে উত্তরাধিকারের যারা প্রকৃত হকদার তাদের থেকে এ রীতি সম্পদ এমন এক ব্যক্তিকে দিতো যার প্রকৃতপক্ষে কোন অধিকারই ছিল না। এছাড়া এরীতি সুরা আহযাবের পর্দার বিধানের সাথে সংঘর্ষশীল ছিল।
এ শক্ত ও ঐতিহ্যবাহী রেওয়াজটি ভেঙ্গে ফেলার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ রাসুলুল্লাহ সা: এর নিজের হাতে সম্পন্ন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। তাই আহযাব যুদ্ধের আগে আল্লাহ রাসুলুল্লাহ সা: কে ইংঙ্গিত করেন তাঁর পালক পূত্র যায়েদ রা: এর তালাক দেয়া স্ত্রী কে বিয়ে করার জন্য। বনী কুরাইযাকে অবরোধ করার সময় তিনি এ হুকুমটি তামিল করেন।
-৫-
যায়নাব রা: কে বিয়ে করার পর তুমুল অপপ্রচার:
রাসুলুল্লাহ সা: ও মুসলমানদের সাফল্যের প্রকৃত শক্তি ছিল চারিত্রিক শ্রেষ্ঠত্ব। একে খতম করার জন্য গল্প ফাঁদা হয়, (নাউযুবিল্লাহ) রাসুলুল্লাহ সা: নিজের (পালক) পুত্রবধুকে দেখে আসক্ত হয়ে পড়েন! পুত্র এ প্রেমের কথা জানতে পেরে নিজের স্ত্রীকে তালাক দেন ও এর পর রাসুলুল্লাহ সা: তাকে বিয়ে করে ফেলেন। নিম্নলিখিত কারণে এ গল্পটি ভিত্তিহীন:
ক. যায়নাব রা: ছিলেন রাসুলুল্লাহ সা: এর আপন ফুফাতো বোন। তাঁড় শৈশব থেকে যৌবনের সময়টা রাসুলুল্লাহ সা: এর সামনে কাটে। বিয়ের পরে কোন একসময় তাঁকে দেখে আসক্ত হবার প্রশ্ন কোথা থেকে আসে?
খ. ইসলামের সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য রাসুলুল্লাহ সা: এর আযাদকৃত গোলামের সাথে আরবের শ্রেষ্ঠ বংশের কন্যাকে রাসুলুল্লাহ সা: স্ব-উদ্যোগে বিয়ে দেন। অথচ, যায়নাব রা: নিজে এতে অখুশী ছিলেন। যায়নাব রা: এর প্রতি রাসুলুল্লাহ সা: এর আকর্ষণ থাকলে যায়েদ রা: এর সাথে বিয়ে দেবার কি প্রয়োজন ছিল। রাসুলুল্লাহ সা: নিজেই বিয়ে করে ফেলতে পারতেন, তা নয় কি?
-৬-
মুসলমানদের মাঝেও সন্দেহের উদ্রেক:
যায়নাব রা: কে যখন বিয়ে করেন,তখন রাসুলুল্লাহ সা: এর চার স্ত্রী জীবিত ছিলেন। তারা হলেন:
ক. হযরত সাওদা রা: (বিয়ে: ৩ হিজরী পূর্ব)
খ. হযরত আয়েশা রা: (বিয়ে: ৩ হিজরী পূর্ব, কিন্তু ১ হিজরী সনে তিনি স্বামীগৃহে আসেন)
গ. হযরত হাফসা রা: (বিয়ে: ৩ হিজরীর শাওয়াল মাস)
ঘ. হযরত উম্মে সালামা রা: (বিয়ে: ৪ হিজরীর শাওয়াল মাস)
তাই যায়নাব রা: হলেন তাঁর পঞ্চম জীবিত স্ত্রী। একসাথে চার স্ত্রীর অধিক রাখা ইসলামী শরিয়ায় জায়েজ নেই। এতে সাধারণ মুসলমানদের মাঝেও সন্দেহ সৃষ্টি হয়। আমাদের আলোচ্য সুরা আহযাবের ৫০-৫২ আয়াতে রাসুলুল্লাহ সা: এর জন্য বিয়ে ক্ষেত্রে বিশেষ বিধানের কথা নাযিল করে আল্লাহ মুসলমানদের নিশ্চিত করেন।
-৭-
সুরা আহযাবের ৫০ নং আয়াতে রাসুলুল্লাহ সা: এর জন্য বিয়ের বিশেষ বিধান:
ক. চারের অধিক স্ত্রী রাখা: যায়নাব রা: ৫ম স্ত্রী হিসেবে বিবাহ।
খ. আল্লাহ প্রদত্ত নিজের মালিকাধীন বাঁদী: তাঁর মালিকাধীন বাঁদীদের মধ্যে ছিলেন: রাইহানা রা: (বনী কুরাইযার যুদ্ধবন্দিনী), যুহাইরা রা: (বনিল মুসতালিকের যুদ্ধবন্দিনী), সাফিয়া রা: (খয়বরের যুদ্ধবন্দিনী), এবং মারিয়া কিবতী রা: (মিসরের মুকাউসিস প্রেরিত)। এর মধ্যে প্রথম তিনজনকে তিনি মুক্ত করে মোহরানা দিয়ে বিয়ে করেন। মারিয়া কিবতী রা: এই আয়াতের ভিত্তিতে তাঁর জন্য হালাল ছিলেন।
গ. চাচাত, মামাত, ফুফাত, খালাতো বোনদের যারা রাসুলুল্লাহ সা: এর হিজরতের সহযোগী: ৭ হিজরী হনে উম্মে হাবিবা রা: কে তিনি বিয়ে করেন।
ঘ. যে সকল মুমিন নারী স্বেচ্ছায় রাসুলুল্লাহ সা: কে মোহরানা ছাড়াই বিয়ে করতে চান: ৭ হিজরীর শাওয়াল মাসে মায়মুনা রা: কে বিয়ে করেন। তিনি মহর দাবী না করলেও রাসুলুল্লাহ সা: মোহর আদায় করেছেন।
-৮-
রাসুলুল্লাহ সা: ও তাঁর উম্মাতের মুমিনের সাথে শরিয়াতের বিধানের কতিপয় পার্থক্য:
এখানে চারের অধিক বিয়ে রাসুলুল্লাহ সা: এর জন্য শুধু জায়েজ করা হয়েছে। এছাড়া আরো যেসব পার্থক্য আছে সেগুলোর কয়েকটি:
ক. রাসুলুল্লাহ সা: এর জন্য তাহাজ্জুদ নামাজ ফরজ আর তাঁর উম্মাতের মুমিনের জন্য নফল,
খ. তাঁর ও তাঁর পরিবারের জন্য সাদকা নেয়া হারাম, অন্যদের জন্য নয়,
গ. তাঁর মীরাস বন্টন হবে না, অন্যদের হবে,
ঘ. তাঁর জন্য স্ত্রীদের মধ্যে সমতাপূর্ণ ব্যবহার ওয়াজিব করা হয়নি, অন্যদের জন্য হয়েছে, [যাতে রাসুলুল্লাহ সা: কে তাঁর স্ত্রীরা কলহের মাধ্যমে নব্যুয়তের কাজে বিঘ্ন ঘটাতে না পরেন। এর পরেও তিনি স্তীদের মধ্যে পূর্ণ সমতা ও ইনসাফ কায়েম করেন। পালা করে তিনি তাদের কাছে যেতেন।]
ঙ. তিনি স্বেচ্ছায় বিয়ে করতে চাওয়া নারীকে মোহরানা ছাড়া বিয়ে করতে পারবেন, অন্যরা নয়,
চ. তাঁর ইন্তিকালের পরে তাঁর স্ত্রীরা অন্য মুমীনদের জন্য হারাম,
ছ. আহলি কিতাবদের কাউকে তিনি বিয়ে করতে পারেন নি, অন্যদের জন্য জায়েজ।
-৯-
(নাউযুবিল্লাহ) রাসুলুল্লাহ সা: এর প্রবৃত্তির লালসা কি খুব বেড়ে গিয়েছিল?:
(নাউযুবিল্লাহ) রাসুলুল্লাহ সা: এর প্রবৃত্তির লালসা খুব বেড়ে গিয়েছিল বা আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তাঁর প্রতি অন্যায় পক্ষপাতিত্ব করেছেন - এরকম অভিযোগ শুধু তারাই করতে পারেন যারা বিদ্বেষ ও সংকীর্ণ স্বার্থপ্রীতিতে অন্ধ। কারন,
রাসুলুল্লাহ সা: জীবন-যৌবনের বেশিরভাগ সময় (রাসুলুল্লাহ সা: এর বয়স ২৫-৫৩ বছর) বয়স্ক মহিলাদের স্ত্রী হিসেবে রেখেছেন। তিনি ২৫ বছর বয়সে ৪০ বছর বয়স্ক বিধবা খাদিজা রা: কে বুয়ে করেন। পুরো ২৫ বছর (রাসুলুল্লাহ সা: এর বয়স ২৫-৫০ বছর) ইনার সাথে সংসার করেন যখন অন্য কোন স্ত্রী ছিলনা। ৬৫ বছর বয়সে খাদিজা রা: মারা গেলে (রাসুলুল্লাহ সা: এর বয়স ৫০ বছর) আরেকজন বিগত যৌবনা নারী হযরত সাওদা রা: কে বিয়ে করেন। ইনার সাথে পুরো চার বছর সংসার করেন (রাসুলুল্লাহ সা: এর বয়স ৫০-৫৩ বছর)। উল্লেখ্য হযরত আয়েশা রা: কে তিনি ৩ হিজরী পূর্বে বিয়ে করলেও ১ হিজরী সনে তিনি স্বামীগৃহে আসেন (রাসুলুল্লাহ সা: এর বয়স ৫৩-৫৪ বছর)।
এখন কোন বুদ্ধিমান ও বিবেকবান ব্যক্তি কি বলতে পারেন, ৫৩ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরে সহসা তাঁর যৌন কামনা বেড়ে যেতে থাকে ও তাঁর একাধিক স্ত্রীর প্রয়োজন হয়ে পড়ে?
-১০-
রাসুলুল্লাহ সা: এর একাধিক স্ত্রী রাখার কারণ:
রাসুলুল্লাহ সা: এর প্রতি নব্যুয়তের মতো বিশাল যে কাজ আল্লাহ সম্পাদন করার দায়িত্ব দেন, এ কাজের মেজাজ ও প্রকৃতির প্রতি দৃষ্টি দেয়া আবশ্যক:
ক. রাসুলুল্লাহ সা: ছিলেন উম্মাতের ডাইরেক্ট শিক্ষক। কিন্তু পর্দার বিধান আসার করনে (সুরা আহযাবে প্রথম আসে, ৫ হজরী সন, ১ বছর পরে সুরা নূরের ৩০-৩১ আয়াতে পূর্ণ আইন) তিনি উম্মাতের মহিলাদের সামনাসমানি শিক্ষা দিতে পারেন নি। তাই যোগ্যতা সম্পন্ন মহিলাদের বিয়ে করে তাদেরকে শিক্ষা ও প্রচারের কাজে নিয়োগ করেন।
খ. বিভিন্ন পরিবার ও বংশে বিয়ে করে বন্ধুত্ব স্হাপন ও শত্রুতার সম্পর্ক খতম করা। উম্মে সালামা রা: এমন এক পরিবারের মেয়ে যার সাথে আবু জেহেল ও খালিদ বিন ওয়ালিদ রা: (পরে ইসলাম গ্রহণ করেন) এর সম্পর্ক ছিল। উম্মে হাবিবা রা: ছিলেন আবু সুফিয়ানের মেয়ে। আবু সুফিয়ান রাসুলুল্লাহ সআ: এর সাথে উম্মে হাবিবা রা: এর বিয়ের পরে আর অস্ত্র ধরেননি। রাইহানা রা:, যুহাইরা রা:, ও সাফিয়া রা: ছিলেন ইহূদী পরিবারের মেয়ে। এর ফলে ইহূদীদের অপতৎপরতাও স্তিমিত হয়ে যায়।
গ. জাহিলিয়াতের রসম রেউয়াজ সংশোধন। যেমন, যায়নাব রা: কে দত্তক সম্পর্কীয় বিষয় সংশোধনের জন্য বিয়ে।
-১১-
মালিকনাধীন নারীদের সাথে মিলনের অনুমতি ও তাদের কোন সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়নি:
উম্মাতের জন্যও এ বিধান। এর পরিস্কার নির্দেশের জন্য আরো দেখুন: সুরা নিসার ৩, মু'মিনূনের ৬, মা'আরিজের ৩০ আয়াত সমূহ।
যুদ্ধ বন্দিনীদের ব্যাপারে ইসলামের নিয়ম হচ্ছে, ক. তাদেরকে মুসলিম বন্দী বিনিময়ের মাধ্যমে শত্রুদের ফেরত দিতে হবে, অথবা, খ. মুক্তিপণ নিয়ে ফেরত দিতে হবে, অথবা, (উপরের দুটি কাজ না করলে) গ. ইসলামী সরকারের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে মুসলমান মুজাহিদের মাঝে বন্টন করা হবে।
এই তৃতীয় অপশনটি শুধুমাত্র এজন্য যে, এহেন বন্দিনীরা যদি ১ম ও ২য় অপশনের মাধ্যমে তাদের আগের সমাজে ফিরে যেতে না পারেন তবে মুসলিম সমাজে তারা যেন বিপর্যয় সৃষ্টি ও নৈতকতা পরিপন্হী কোন কাজ করতে না পারে। তাদের বিয়ে করা ছাড়া ব্যবহার করার অনুমতি থাকলেও মুক্তি দিয়ে মোহরানা পরিশোধের মাধ্যমে পূর্ণ স্ত্রী হিসেবে গ্রহণই সর্বোত্তম পন্হা, যেমনটি রাসুলুল্লাহ সা: করেছেন।
কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ইসলামী শরিয়াত ধনীদের অসংখ্য বাঁদী কিনে আয়েশ করার সুযোগ দিয়েছে। কোন প্রবৃত্তির পূজারী এরকম করলে, সে এর জন্য দায়ী থাকবে, আইন নয়। আইন করা হয়েছে মানুষের সুবিধার জন্য, অপব্যবহারের জন্য নয়। যেমন, চারটি বিয়ের অনুমতি পেয়ে যদি কেউ চার বিয়ে করে কিছুদিন পরে তালাক দিয়ে আবার চার বিয়ে করে এবং এভাবে চালিয়ে যেতে থাকে, তবে এজন্য সে ব্যক্তি দায়ী, আইন নয়।