আমি কাঁচের দেয়ালের এপাশে থাকি, তোমরা ওপাশে। তোমরা আমাকে দেখতে পাওনা, আমি তোমাদের দেখি। তোমাদের জীবন আমাকে বিস্মিত করে। অস্থির, ছটফটে, খুনশুটে জীবন। ছোট ছোট মুহূর্তে কত শত সুখ দুঃখ আনন্দ অনুভুতির জীবন।কেউ কোরবানি ঈদের সুযোগে বাজার থেকে সস্তায় বোয়াল মাছ কিনে খুশি। ফেবুতে সে মাছের ছবি দেখে ১৬৮ জন খুশি। আমিও খুশি।গল্পকারের হৃদয়ে ঘণ্টা পরায় বিড়ালের মা। সেটা দেখে ১৯৯ জন খুশী। আমি হলাম ২০০তম খুশী। আমার পরের জন হয় ২০১ তম। খুব মজা পাই সেটা।কেউ বা ইডেন কলেজের কাছের কলেজে ক্রিকেট ম্যাচ নিয়ে ব্যাস্ত। তাতে আবার আগে থেকেই শুরু হয় ফিক্সিং। কেউ মানে কেউ মানে না। আমিতো এসব দুস্টমি দেখে অস্থির!
একজন মাঝরাতে ক্ষোভে ফেটে পড়ে কেন তার পোস্ট নির্বাচিততে যায়না। সবাই তাকে ম্যানেজ করতে তটস্থ। আমি ভয়ে সেখানে যাইনা। কারোও পোষ্টে দেখি রাত জাগা পাখিরা আড্ডা জমায়। আমি সেখানে যেয়ে ভিড় জমাই, চুপচাপ কারো দশ বছর পর ডক্টর হবার স্বপ্ন শুনতে থাকি।
.. উহ্ , নার্স আবার কিছু না জিজ্ঞেস করেই হাতে সুই ফুটিয়ে দিয়েছে। সে কখনই ইঞ্জেকশন দেবার আগে জিজ্ঞেস করে না। যত্তসব।।
হ্যাঁ, যা বলছিলাম, কখনো দেখি কেউ ভালবাসার মানুষের গলা টিপে দিতে চায়। কত শত অভিশাপ দেয়! কেউ বা প্রেমিকের সাথে তুই তোকারি করে ঝগড়া বাধায়। বন্ধুত্বে তুই তোকারি হয় জানতাম। আমি নিজে সাক্ষী। আমার যে বন্ধু প্রতি সপ্তাহে একবার দেখা করতে আসে, সে আমাকে তুই করে বলে। কিন্তু ভালবাসার মানুষকেও যে তুই করে বলা যায় সেটা জানতাম না। কিভাবে জানব? কেউ আমাকে জানায়নি। আপনারা কেন বোঝেন না কেউ আমাকে কিছু না জানালে আমি জানতে পারিনা। কেউ এটা কেন বোঝেনা? কেন?
এদিকে আবার কে একজন জেনারেল হয়।খুশীতে সে সবাইকে ভার্চুয়াল মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। কি সুন্দর তেলতেলে মিষ্টির ছবি। আমার কৃত্তিম চিনির মিষ্টি খেতে ভালো লাগে না। আমার আসল চিনির মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করে। আমি দোকানে যেয়ে এলুমিনিয়ামের পিরিচে স্টিলের চামচ দিয়ে মাছি ভনভন করা মিষ্টি খেতে চাই। হ্যাঁ, আমি আপনাদের মতো জীবন চাই।
আমি সবার কাছে যেয়ে বলতে চাই আমি কে ............
আমি ফেসবুকে আমার ৬ ফুট ১ ইঞ্চির এই শরীরের ছবি আপলোড করতে চাই..
সবাইকে চিৎকার করে বলতে চাই এই যে দেখ আমি কত সুস্থ সবল, একদম তোমাদের মতো, তোমাদের চেয়েও বেশী। তোমরা ভাব আমি অসুস্থ তাইনা, দাড়াও দেখাচ্ছি আমি কত সুস্থ।এই যে দেখ এই.............
আমার চোখে সব ঝাপসা হয়ে আসে,কিছু দেখতে পাইনা।চোখের সামনে এখন শুধু হলুদ রং, মাঝে সাদা সাদা ছোপ , দখল করে নিচ্ছে ছড়িয়ে পড়া কালো কালো বিন্দুগুলো। শরীরে তীব্র ব্যাথা। তীব্র....।একসময় আর সহ্য হয়না।
**
বাড়ির ড্রয়িং রুম। সবাই সোফায় বসা। তাদের সামনে আমি হুইল চেয়ারে ঘাড় ফেলে বসে আছি। ঘরের কাউকে সেভাবে দেখতে পাচ্ছিনা। সবাই সামনে বসা। আমার গলায় আজ কাফলার নেই। আমার ঘাড় একপাশে ঝুলে আছে, সামনে বসা মানুষদের দেখার সুযোগ নেই।
"এসব কিভাবে হল?" কারো গুরুগম্ভীর আওয়াজ।
"সারাদিন ল্যাপটপে পড়ে থাকে" নার্সের সরল দায়সারা জবাব।
"ল্যাপটপে কি করে?"
"ব্লগ করে"
"ব্লগ কিহ?"
"ওইযে!, বাংলা ফেসবুক, সবাই যে শাহবাগ করল!!"
"এটার দরকার কি? ফেসবুকে প্রবলেম কোথায়?"
"ওইটাও করে, দেড়মাস ধরে", আরেকপাশ থেকে আয়ার হাসিচাপা উত্তর।
"এই যে শোনহ, তুমি কে, তোমার শরীরের কি অবস্থা, এসব অনলাইনে বলেছ? কেউ জানে?"
"কেউ জানেনা ... সবাই জানে চাচ্চু একটা ভাল্লুক, হি হি!"
চোখ তুলে দেখি আমার প্রিয় ভাতিজিটা ফোকলা দাঁতে ললিপপ চিবুচ্ছে, আমায় দেখে ফিক করে হাসছে।
আমার কষ্ট বোধহয় কারো সহ্য হয়না। কে যেন আমার সামনে ঝুকে আসে হিস্ট্রিয়াগ্রস্থের মতো চিৎকার করলো " তুমি জাননা তোমার স্ট্রেস নেয়া নিষেধ? ..... তুমি জাননা ডক্টর কি কি নিষেধ করে রেখেছে..... , সমস্যা কি তোমার হ্যা? .... কেন এমন শুরু করেছ, কি পেয়েছ তুমি, তোমার এত্তবর সাহস............ "
**
ধমকের জোরে বুকে ধক ধক করে ধাক্কা খেলাম, চোখের সামনে আবার ঝাপসা, হলুদ, সাদা, কালোর সাথে এবার লাল রঙের ফুলকি। কিন্তু এসব নিয়ে ভাবলে এখন চলবে না। আমি জানি আমার হাতে সময় নেই। আমি আঁচ করে ফেলেছি কি হতে যাচ্ছে, .. আমি বাধা দিতে চাইলাম, সমস্ত শক্তিতে চেঁচাতে লাগলাম "আমি স্ট্রেস নেই নাই, আমি কোন স্ট্রেস নেই নাই, তোমরা বিশ্বাস করো ......... তোমরা বিশ্বাস করো প্লীজ, আমি শুধু বুকমার্কের কিছু লিঙ্ক কাট পেস্ট করেছি, আমি কোন কষ্ট করি নাই, আমার কোন পরিশ্রম হয় নাই, তোমরা প্লীজ আমাকে বিশ্বাস করো, প্লীজ প্লীজ প্লীজ"।
কে যেন আমার মাথায় ক্রমাগত হাত বুলাচ্ছে, আর কে জন বুকে, একজন কেদে কেদে সূরা পড়ছে যেন এ যাত্রায় বেচে যাই, ... আমার আজ কিছুই সহ্য হয়না, নানা রঙের প্রলেপ দেখতে দেখতে মনে মনে বলে উঠি, তোমরা আমাকে জন্মের পর কেন মেরে ফেলোনি, কেন বাঁচিয়ে রেখেছিলে। .. পরক্ষনেই চিৎকার, ঝাঁকুনি আর কান্নার রোল বাড়তে থাকে ... বুঝি আরেকটা ভুল করে ফেলেছি .... মনে মনে বলতে যেয়ে কথাগুলো মুখে ফুটে বলে ফেলেছি ..... শুনতে থাকি কে যেন কাকে ধমকাচ্ছে ডক্টরকে ফোন করতে এত দেরী হচ্ছে কেন....
ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যায়, আমি আবার বেঁচে উঠি। আবার সবার সামনে কাঠগড়ায় দাড়াই। কিছুটা আঁচ করতে পারি কি রায় হতে পারে। কেউ একজন আমার ঠোটের লালা কাপড় দিয়ে মুছে দেয়, চোখ মুখ মুছে দেয়,মুখে পানির গ্লাস তুলে দেয়। গ্লাসের পানিতে এবার গায়ের কাপড় ভিজে যায়। আমার প্রস্তুত হতে বড় সময় লাগে।
**
ড্রয়িং রুমটা বড় শান্ত, নিশ্চুপ। একজন নরম গলায় বলতে থাকে, ভাই শোন, ডক্টর আগেই না করেছিল তোমাকে ল্যাপটপ দিতে। আমরা তবু দিয়েছি। কাজটা ঠিক হয়নি। তোমার নার্ভ সিস্টেম কম্প্রোমাইজড, তোমার এখন হার্টের অবস্থাও ভালো না। ব্রেনেও ঠিকমত সুগার যায় না। তোমারতো কোনরকম স্ট্রেস নেয়া ঠিক না।
কিছুক্ষন সব চুপচাপ। শান্ত।
"তোমার ল্যাপটপ টা নিয়ে যেতে হবে।ওটা তোমাকে আর দেয়া হবেনা।"
এটাই আমি আগে আঁচ করেছিলাম।আগেই। আমি অনেক কষ্টে আমার ঘাড়ের কাপুনি থামাই। শরীর মনে যতটুকু শক্তি ছিল সব মুখে জড়ো করি। মুখটা হাসি হাসি করি। হাসি মুখে বলি, “শেষবারের মতো আধা ঘণ্টা ব্যাবহার করতে দেবে? আসলে এই কয়েক সপ্তাহে বেশ কয়েকজন বন্ধু হয়ে গেছে। তাদের একবার বাই বলা দরকার। নয়ত অভদ্র ভাববে, তাইনা।"
"যাস্ট আধাঘণ্টা?” সবাই নিশ্চুপ দেখে আর পারলাম না, চোখের পানি আটকাতে, চেহারায় অনুনয় ভাব লুকাতে।চোখের পানির স্রোত নাকের জলে এসে মিশে। বুকটা আমার কষ্টে ভেঙ্গে আসে।
"নার্স, ঠিক আধা ঘণ্টা পর ল্যাপটপ ওর কাছ থেকে নিয়ে আমার ঘরে রেখে আসবে।" সবাই যার যার ঘরে চলে যায়।
নার্স আর আয়া আমায় রুমে নিয়ে যায়। খাটে শুইয়ে দেয়। দুপাশে কাপড় গুজে ঘাড় সোজা করিয়ে ল্যাপটপটা আমার বুকে রেখে দেয়।
আমার চোখ ফেটে পানি বেরুতেই থাকে।আজ আর নিজেকে বাঁধা দেই না। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে থাকি। কাঁদতে কাঁদতে তোমাদের প্রোফাইল পিকে হাত বুলাই,তোমাদের জীবনগুলো দেখতে থাকি। ঘরের বাইরে জীবন কাকে বলে তা জীবনে শুধু তোমাদের কাছ থেকে দেখেছি। এখনও শেষ বারের মতো দেখতে থাকি।
৮ মিনিট শেষ।হাতে সময় আছে আর মাত্র ২২ মিনিট।আমাকে শেষবারের মতো লিখতে হবে। শেষ কথাগুলো লিখে শেষ করতে হবে। আমি প্রবলবেগে কি বোর্ডে হাত চালাই। প্রবল বেগে, সময় চলে গেলে আমি হারিয়ে যাব। তোমাদের আমার কথাগুলো বলে শেষ করতে পারবনা। আমার লেখা শেষ।নার্স কঠোর মুখে ঘড়ির দিকে চেয়ে আছে। আমিও ঘড়ির দিকে চেয়ে আছি।৩০ মিনিট শেষ হতে আর ১০ সেকেন্ড বাকি। আমার কার্সর এখন "ব্লগে প্রকাশ করুন" এর উপর।
আমি তোমাদের সাথে থাকা শেষ সেকেন্ডের জন্য অপেক্ষা করছি, তার আগে বলে যাচ্ছি, তোমরা ভালো থেকো বন্ধুরা, ভালো থেকো ....