ভুত বলতে আসলেই কিছু আছে? এর উত্তর মানুষভেদে দুরকম হতে পারে। প্রথমত, যারা বিশ্বাসী তাদের মতে ঈশ্বর শয়তানকেও সৃষ্টি করেছেন। দ্বীতিয়ত, যারা অবশ্বিাসী তাদের মতে সবকিছুই কল্পনা মাত্র অথবা হেলুসিনেশন। প্রথমেই বলে রাখি আমি প্রথম দলের অন্তর্ভুক্ত। যদিও ভুত বিষয়ক কল্পনা অথবা হেলুসিনেশনকে অগ্রাহ্য করি না। মানুষ কোন আদি-ভৌতিক পরিস্থিতিতে পড়লে হেলুসিনেশন বা অস্বাভাবিক কল্পনা করাটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে কিছু ঘটনা ঘটেছে যেগুলোর ব্যাখ্যা আজও খুজে পাইনি। সেরকম কিছু ঘটনা শেয়ার করব।
সালটা সম্ভবত ২০০২/২০০৩ আমি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। ময়মনসিংহে মেসে থাকি, জায়গাটার নাম সানকিপাড়া। এটাই ছিল আমার প্রথম মেসজীবন। শুরুতে মেসের জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট করতে হয়েছে। মেসের পরিবেশ, খাওয়া-দাওয়া ভালো লাগতো না। তার উপর বাড়ির সবার থেকে বিচ্ছিন্ন একলা জীবন, সব মিলিয়ে শুরুর অভিজ্ঞতা খুব বেশি সুখকর ছিল না। মেসটার ঠিক পিছনে ছিল রেললাইন, বলা যায় মেসের ধার ঘেসে চলে গেছে। এজন্য রাতে ঘুমাতে সমস্যা হতো ট্রেন আসলে প্রচন্ড শব্দ হতো আর পুরো মেস ভুমিকম্পের মতো কাঁপতো। এত কিছুর মাঝেও কষ্ট করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। মাসে-দুমাসে একবার বাড়ি যেতাম। শুরুতে বাড়ি গেলে আর মেসে ফিরতে ইচ্ছে করত না। বাড়ি থেকে ফেরার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম। আর আমি বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর আম্মা কাঁদত।
আমাদের মেসটা দেখতে অনেকটা এরকম ছিল।
এইভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর আবিস্কার করি, আমি মেসের জীবনের সাথে খুব ভালভাবে মানিয়ে নিতে পারছি। মানিয়ে নেওয়ার পেছনে আরেকটা কারণ ছিল। আমাদের এলাকার ৩ জন খুব কাছের বন্ধু একসাথে একরুমেই থাকতাম, একই কলেজে পড়তাম। তাছাড়া, এই মেসটার অধিকাংশ মেস মেটই ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র ছিল। তাই সবার সাথে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। একসাথে কলেজে যা্ওয়া, ঘুরাঘরি, এমনকী প্রাইভেটও একসাথেই পড়তাম। এছাড়া, সিনেমা দেখার ব্যাপার তো ছিলই। ঐ সময়টায় বাংলা সিনেমার ভগ্নদশার শুরুমাত্র। প্রচুর পরিমাণে নিম্নমানের অশ্লীল বি গ্রেডের ছবি বের হত। আমাদের টার্গেটও ছিল ঐসব ছবি দেখা। এখনও মনে পড়ে চাল বিক্রী করে সিনেমার টাকা যোগার করতাম। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি, আমাদের মেসে যারা থাকতাম তাদের সবার বাড়িই গ্রামে এবং সেই গ্রামের বাড়ি থেকই সবার চাল আসত। এজন্য মেসে যে ভাত রান্না হতো তা ছিল পাঁচমিশালি চালের। কারও চাল ভাল, কারওটা একটু খারাপ। এগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। সবার জন্যই সারা মাসের খরচের টাকা খুব হিসেব করে বাড়ি থেকে পাঠানো হতো। সেই টাকার মাঝে হাত খরচের জন্য হয়তো মাসিক ২০০-৩০০ টাকা পাঠানো হতো। এই হাত খরচের টাকা দিয়েই সন্ধ্যার নাস্তা বা কলেজের সমুচা-সিঙ্গারা কিংবা কাচিঝুলির মোড়ের মামার টং হোটেলের দুপুরের গরুভুনা-হালুয়া খাওয়া আর সিনেমা দেখার টিকিট কাটতে হতো। মাসের শেষদিকে কারো হাতই খুব একটা টাকা থাকতো না। একদিন শরীফকে (ধলা বিলাই, প্রচুর পরিমাণে ফর্সা হওয়ার কারণে তাকে এই নামে ডাকা হতো।) দেখি চাল নিয়ে পাশের দোকানে যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম চাল দিয়ে কী করস্। জানালো টাকা নাই তাই বিক্রী করতে নিয়ে যাচ্ছে। রাতে সিনেমা দেখার প্ল্যান, কিন্তু হাতে টাকা নাই তাই চাল বিক্রী করছে। এরপর থেকে আমাদের মেসে বাড়ি থেকে চাল আমদানির পরিমাণ বেড়ে গেল। বাড়ির মা-বাবারা ভাবলো তাদের ছেলে রাত জেগে পড়াশোনা করে, তাই ক্ষুদার পরিমাণ বেড়ে গেছে। প্রায় সবারই কমবেশি ৪-৫ কেজি করে বেশি আনা শুরু হলো। আর মাসের শেষে সেটা বিক্রী করে সিনেমা চলত দেখা। সুখেই চলছিল দিনকাল, এর মাঝেই ঘটল ঘটনাগুলো।
আমাদের মেসে কোন টেপের লাইন ছিল না। টিনশেড মেসের ঠিক সামনেই টিউবয়েল। সেটার পানিই আমাদের খাওয়া-গোসল থেকে শুরু করে সকল কাজের উৎস্য। টিউবয়েলের পাশেই একটু দুরে ছিল একমাত্র টয়লেট। টয়লেট টা ছিল একটা বরই (কুল) গাছের নিচে। রাতে ছোট কাজের জন্য অনেক সময় টয়লেটের ভিতরে না ঢুকে টিউবয়েলের ড্রেনেই সেরে ফেলতাম। একদিন আনুমানিক রাত এগারোটার দিকে ছোট কাজের জন্য বের হয়েছি। হালকা চাঁদের আলো ছিল। টয়লেটের ভিতরে না ঢুকে টিউবয়েলের ড্রেনেই বসে পড়লাম। গুন গুন করে গান গাইছি আর কাজ সারছি। এই সময় হঠাৎ বরই গাছে চোখ গেল। চাঁদের আধো আলোতে দেখি একটা বাচ্চা গাছের মগডালে বসে আছে। হঠাৎ দেখে একটু ভয় পেয়ে যাই। পরে মনে হলো মনে হয় বরই চুরির জন্য গাছে উঠেছে। তখন আমার মাথায় কাজ করে নি, যে এইটুকুন পিচ্চি বাচ্চার গাছ বেয়ে উপরে উঠার কথা না। "কে বরই চুরি করে" বলে আমি দিলাম বিশাল ধমক। দেখি বাচ্চাটার কোন বিকার নেই। আবছা আলোতে মনে হলো আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আমার একটু ভয় ভয় শুরু হলো। সেটা বুঝতে না দিয়ে আমার গলার স্বর আরও একটু বাড়িয়ে আবার দিলাম ধমক। এর পর দেখি বাচ্চাটা ধীরে ধীরে নিচে নামতে শুরু করেছে। কিন্তু একী, কোন ডাল বা গাছ না বেয়ে শুন্য হাওয়ায় ভেসে ভেসে নামছে। এটা দেখার পর আমার গলার স্বর যতটুকু ছিল পুরাটা ব্যবহার করে যতটা জোরে সম্ভব চিল্লাতে চিল্লাতে ঘরের ভেতর ঝড়ের বেগে ঢুকি। আমার রুমমেট রাশেদ আর আমিনুল হন্ত-দন্ত হয়ে উঠে জিজ্ঞেস কী হয়েছে। ঘটনা বললাম। পরে একসাথে মেসের প্রায় সবাই বের হলাম। গিয়ে দেখি সব শুন্য। না বরই গাছে না নিচে, কোথাও কোন বাচ্চার চিহ্ণ নেই। সিনিয়র ভাইরা বলল চোখে ভুল দেখছি বা হ্যালুসিনেশন জাতীয় কিছু হতে পারে। আবার বন্ধুদের অনেকেই আমার আগের কথার সাথে একমত, হয়ত বরই চুরি করতে এসেছিল। তাদের বোঝানোর চেষ্টা করলাম এত ছোট বাচ্চা গাছের এত উচুতে উঠার কথা না। কিন্তু আমার যুক্তি হালে পানি পেল না। বড় ভাইরা বলল "চান্দের আলোতে অনেকেই ধরা খায়। আবছা আলোতে বুঝতে পার নাই বাচ্চা না বুড়া ধামড়া।" অনেক কথাবার্তা-তর্কাতর্কীর পর সবাই একমত হলো বাচ্চাটা (বা বড় কেও) সত্যিই বরই চুরি করতে এসেছিল। আমিও মেনে নিলাম হয়ত তাই হবে। তখনই ইমতিয়াজ (মেসমেট বন্ধু) বলল, "এই ভাদ্রমাসে তাল পাকার কথা। এইটা তো বরইয়ের সময় না।" এই কথা শুনে শুধু আমার না আরও অনেকেরই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।
এই ঘটনাটা শুরু ছিল মাত্র। এরপর আরও অনেক ঘটনাই ঘটেছে, যার ব্যাখ্যা আজও খুজে বেড়াই। ওই এলাকার এক দোকানির সাথে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তিনিই একদিন জানালেন, ঐ এলাকার রেল লাইনে বছরে-ছয় মাসে মানুষ কাটা পড়ে। কেউ করে আত্মহত্যা, কেউবা মারা যায় দুর্ঘটনায়। তাই সেখানে এরকম ব্যাখ্যাতীত ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু না। এরকম নাকি আরও অনেকের সাথেই হয়েছে।
এই ঘটনার কিছুদিন পরে আরেকদিনের ঘটনা বলি। রুমের দরজা বন্ধ করে খুব মনোযোগ সহকারে পড়ছিলাম। আমার অন্য রুমমেটরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে বিধায় টেবিল ল্যাম্পের আলোয় পড়ালেখা করছিলাম। হঠাৎ আমার নাম ধরে কেও ডাকল শুনলাম। আমি ভাবছি রাশেদ বা আমিনুলের (রুমমেট) ঘুম ভেঙে গেছে, তাদের কেউই ডাকছে। পিছন ফিরে দেখি তারা দুজন দিব্বি ঘুমাচ্ছে। চিন্তা করলাম ডাকলো কে? ঠিক এসময় দরজায় টোকা পড়ল। তখন বুঝতে পারলাম দরজার বাইরে থেকে কেউ ডাকছে। আবার স্পস্ট শুনলাম আমার নাম ধরে ডাকছে আর দরজায় টোকা দিচ্ছে। গলাটা পরিচিত মনে হল না। রাত প্রায় ১২ টা, এত রাতে কে ডাকবে। তারচেয়ে বড় ব্যাপার বারান্দার মেইন গেইটে তালা দেওয়া থাকার কথা। প্রতিদিন রাত ১১ টার দিকে ওই গেইটে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়। সুতরাং বাইরের কেউ ডাকার কথা না। মেসের ভিতরেরই কেউ। কিন্তু কন্ঠটা অপরিচিত। কিছুক্ষণ দ্বিধাদন্দ্বে থেকে দরজা খুলে দিলাম। খুলে দেখি কেউ নেই। ভয় পাওয়ার বদলে আমার হাসি পেল। বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা শফী বা ইমতিয়াজের (পাশের রুমে থাকে) কাজ। আমাকে ভয় দেখানোর জন্য করছে। আমি ওদেরকে না দেখেই ওদের নাম ধরে বললাম, শফী-ইমতিয়াজ তোদের দেখছি। কিন্তু তারা কোন সাড়া শব্দ করল না। এরপর আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। ১ বা ২ মিনিট পর আবার দরজায় টোকা, এবার আর নাম ধরে ডাকছে না। আমি মনে মনে ভাবলাম বেশি ডাকতে গেলে হয়তো গলার স্বর চিনে ফেলতে পারি তাই এবার আর ডাকছে না। তবে এবার আমি আর দরজা খুললাম না, দেখি কতক্ষণ দরজায় দাড়িয়ে থাকতে পারিস। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমিই বিরক্ত হয়ে গেলাম। দেখি দরজায় শুধু টোকা দিচ্ছে না, রীতিমত ধাক্কা দিচ্ছে। বিরক্ত হয়ে আবার দরজা খুললাম। এবারও একই ঘটনা কেউ নেই। বিরক্তির মাত্রা বেড়ে গেল, আবার হাসিও পাচ্ছিল। আমার দরজা থেকে ওদের রুমের দরজা প্রায় ১৪-১৫ ফিট দুরে, এইটুকু পথ এত অল্পসময়ে নিঃশব্দে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার না। শফি ছাড়া এই কাজ আর কারও হতে পারে না। ইমতিয়াজ বেশ মটুসটু কিন্তু শফী বেশ হ্যাংলা-পাতলা। শফীর পক্ষে এই দুরত্ব দ্রুত পার হওয়া সম্ভব, তাই বলে নিঃশব্দে? মনে একটু খটকা লাগল। তাই বারান্দার গেইটের তালা আবার চেক করলাম। দেখি তালা ঠিক ঠিক লাগানো আছে। আবার দরজা বন্ধ করে দেওয়ার অভিনয় করলাম। আসলে দরজা পুরোপুরি ভেজিয়ে দিয়ে দরজা ধরে দাড়িয়ে রইলাম। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে দরজা ভিতর থেকে পুরোপুরি লক করা। এমন ভাবে দরজা ধরে দাড়ালাম যাতে টোকা পড়া মাত্রই মাইক্রোসেকেন্ডের মাঝে খুলে ফেলতে পারি। যাকে বলে হাতে-নাতে চোর ধরা। এল সেই মক্ষম সময়। দরজায় টোকা পড়ল মাইক্রোসেকেন্ডেরও কম সময়ের মধ্যে দরজা খুললাম। এবারও পুরো করিডোর ফাকা। এত অল্পসময়ের মাঝে এইটুকুন দুরত্ব কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব না। স্বয়ং উসাইন বোল্টের পক্ষেও সম্ভব না। আমার একটু ভয় শুরু হলো। তারাতারি দরজা বন্ধ করে শুয়ে গেলাম। সে রাতে আরও অনেকবার দরজায় নক করার শব্দ পেলাম, কিন্তু আর দরজা খোলার সাহস পাইনি।
আরেকদিনের ঘটনা। মাঝে মাঝে মেসের সব সিনিয়র জুনিয়র মিলে বেশ আড্ডা দিতাম অনেক রাত পর্যন্ত। তেমনি একদিন রাতে বেশ জম্পেস আড্ডা হলো রাত প্রায় ১২ টা পর্যন্ত। ইন্টারে পড়াকালীন সময়ে রাত ১২ টা আমাদের কাছে অনেক রাত। সেরাতে হালকা বৃষ্টি পড়ছিল। আড্ডার মাঝে কিছুক্ষণ ভুত বিষয়ক কথাও হলো। যখন ঘুমুতে যাব তখন বৃষ্টির কিছুটা মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে সেলিম ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করল
"এত রাতে তোমার কোন গেস্ট আসছিল?" এই কথা শুনে তো আমি অবাক।
- "কই আমার তো কোন গেস্ট আসে নাই" বললাম আমি
তিনি অবাক হয়ে বললেন,
-তাহলে তুমি কি গেট খুলো নাই।
-না গেট খুলব কেন?
-রাত আনুমানিক ২ টার দিকে তোমার নাম ধরে কেউ জোরে জোরে ডাকতেছিল। আমার খুব ঘুম পাইছিল আর আমি ভাবছি তুমি গেট খুলবা এজন্য আমি আর উঠি নাই।
-কী বলেন।
-হ। বারবার তোমার নাম ধরে ডাকতেছিল আর বলতেছিল তারাতারি দরজা খুলো ভিজে গেলাম তো। অনেকক্ষণ ধরে ডাকছে।
আমাদের মেসের সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন সেলিম ভাই। সেলিম ভাই তখন আনন্দমোহন কলেজের মাস্টার্সে পড়তেন। অতি ভদ্র এই মানুষটাকে কখনো ভুলব না। আমরা যারা জুনিয়র ছিলাম তাদের সবাইকেই অনেক স্নেহ করতেন। পড়াশোনা বা অন্য যেকোন সমস্যাতে গাইডও করতেন। তার মত ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলবে বা আমাকে ভয় দেখানোর জন্য এসব বলবে, এটা তার শত্রুও হয়ত বিশ্বাস করবে না। আমাদের মেসের সবাই অবাক। টক অব দ্য মেস "আমাকে কে এইরকম ভাবে ডাকে"?
তার কিছুদিন পর চুড়ান্ত একটা ঘটনা ঘটল যেটাকে কল্পনা বা হ্যালুসিনেশন বলার কোন কারণ আজও খুজে পা্ইনি। রাত খুব বেশি না। ৯ টা থেকে ১০ টার মাঝে। কারেন্ট চলে গেছে। পড়াশোনা বাদ দিয়ে আমরা রুমমেট তিনজন গল্প করতে বসছি। আমি, রাশেদ আর আমিনুল। রুম অন্ধকার কিন্তু বাইরে মায়াবী চাঁদের আলো। নানা গল্প শেষে আমাদের মেসের অবধারিত টপিক চলে আসল। "আমাকে কে ডাকে?" এর উত্তর তো অনেকভাবেই খোজার চেষ্টা করেছি, কিন্তু মিলেনি। রাশেদের থিওরি কোন পরী আমার পেছনে লাগছে। আমিনুল বলল পরী হইলে পুরুষের কন্ঠে কথা কয় কে? আমিনুলের মতে কোন প্রেতের কাজ। তার আরও ধারণা প্রেতটা ভাল ধরণের প্রেত, না হলে এত দিনে কোন ক্ষতি করে ফেলত। আমি তাদের দুজনের তর্ক উপভোগ করি। আসলেই কি কোন অশরীরির কাজ এটা? ভেবে কূল পাইনা। ঠিক এই মুহুর্তে একটা ঘটনা ঘটল। চাাঁদের আবছা আলোয় আমরা তিনজনই দেখলাম বারান্দার গেট দিয়ে কেউ একজন ঢুকল আর আমাদের খোলা দরজা দিয়ে রুমে প্রবেশ করল। রুমে ঢুকেই আমার নাম ধরে ডাকল আর মোমবাতি জালাতে বলল। আমরা তিনজনই ভেবেছি হামিদ ভাই এসেছে। হামিদ ভাই আমাদের মেসের একমাত্র সিঙ্গেল রুমের অধিবাসি। তিনিও আনন্দমোহন কলেজের মাস্টার্সে পড়েন। খুবই গম্ভীর প্রকৃতীর মানুষ। তার আসা-যাওয়ার নির্দিষ্ট কোন টাইম-টেবিল নাই। কোনদিন তিনি মেসে থাকতেন আবার কোনদিন থাকতেন না। আমিনুল মোম নিয়ে আসল আর রাশেদ দেয়াশলাই দিয়ে জালালো। পুরো রুমে আমরা তিনজন ব্যতীত আর কেউ নেই। নেই মানে নেই। আমরা তিনজনই দরজার কাছাকাছি বসেছিলাম। সুতরাং কেউ দরজা দিয়ে বের হলে অবশ্যই অবশ্যই আমাদের চোখে পরবে। একটা জলজ্যান্ত মানুষ আমাদের চোখের সামনে ঘরে ঢুকল, আমাকে ডাকল আর এখন পুরো হাওয়া!!! আমনিুল আর রাশেদ খাটের নিচে চেক করল কেউ লুকিয়ে আছে কিনা? না কোথাও নেই। আমি হামিদ ভাইয়ের সিঙ্গেল রুম দেখলাম, সেটি তালা মারা। আমরা তিনজনই থ মেরে রইলাম। সেরাতে আর কারও পড়াশোনার মুড ছিল না। তারাতারি ঘুমিয়ে পড়লাম।
আমার সাথে এইসব ঘটনা ঘটেছে, সেটা আম্মাকে কে যেন বলে দিয়েছিল। ফলাফল, একমাসের মধ্যে মেস বদলালাম। আমরা তিনজনই একসাথে মেস বদলালাম। আপাতত ওইসব ঘটনা থেকে মুক্তি পেলাম। সত্যিই কি মুক্তি পেয়েছিলাম? নতুন মেসে উঠার পরে প্রায় ৫-৬ মাস কোন উল্টা-পাল্টা ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এরপর একদিন যা হলো সেটা ছিল তখন পর্যন্ত আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর অভিজ্ঞতা।
সেটা নিয়ে না হয় আরেকদিন বলব।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০২০ দুপুর ১২:২৬