ঢাকায় টি-শার্টের শীত সাথে প্রিয় ঋতু শীতের বিদায় বিরহ। বিরহ বেদনা আরও উসকে দিল পাহাড়। মনে পড়ে গেল, দু’বছর ওমুখো হওয়া হয়নি। প্রস্তাব তুললাম বন্ধুমহলে। রাজি আমিসহ ৫ জন (যদিও বিজোড়)। যাত্রার তারিখ ঠিক হলো পহেলা ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
নির্ধারিত দিনে ঢাকা থেকে ৭ ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম প্রাথমিক গন্তব্য বান্দরবান শহরে। উদ্দেশ্য- এখান থেকে থানচি হয়ে তাজিংডং। আগে-পরে সম্ভব হলে আরও কিছু স্পট ঘুরে দেখা। ৫ বন্ধুর হাইকিং প্ল্যান হলেও শেষ পর্যন্ত স্পটে কেবল আমি আর আমাদের প্রকৌশলী বন্ধু মঞ্জু। পাহাড়ের নিরাপত্তা আর এই রুটের ছোটখাট সব কারণে সবাই পিছু হটলেও মঞ্জু একপ্রকার অদম্য। সে রাজি বিজয় পাহাড়ের চূড়ার অভিযানে। অগত্যা বান্দরবান শহরে সাবেক সহকর্মী সাংবাদিক ফরিদুল আলম সুমনের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে উঠে পড়লাম থানচির বাসে। সম্ভবত ৮৮ কিলোমিটারের পাহাড়ি আকাবাঁকা পথ পাড়ি দিতে চালক জানালো, সময় লাগবে ২ ঘণ্টা। শুক্রবারের দিনের দুপুর, উঠে পড়লাম। পথে চিম্বুক বিরতিতে দেখলাম বাসের সবাই পোলাও আর ডিম ভুনা খাচ্ছে ধীরেসুস্থে। ভাবলাম খাবারের এই গতি নিশ্চয়ই চালকের সময় হিসাবের অন্তর্ভূক্ত নয়। হলোও তাই। বিরতি শেষ হলো পাক্কা ৩০ মিনিট পর। আবারো শুরু যাত্রা। ক্লান্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরই পেলাম না।
চিম্বুক ছেড়ে থানচির পথে যাচ্ছি অনেকক্ষণ; ঘড়ি বলছে আড়াই ঘণ্টার যাত্রা শেষ। আবারো বিরতি। যথারীতি আধাঘণ্টা নষ্ট এখানে। ধীরে ধীরে বাস ভরলো মানুষে তবেই যাত্রা শুরু। আবারো ঘুমিয়ে পড়লাম। থানচি বাজারে পৌঁছলাম সন্ধ্যা নাগাদ। অর্থাৎ চালকের দুই ঘণ্টা যাত্রার হিসাব মিললো সাড়ে চার ঘণ্টায়। কথা বলারও মুড হারিয়ে ফেলেছি ততক্ষণে।
সোজা গিয়ে উঠে পড়লাম বুকিং দিয়ে রাখা থানচি রেস্ট হাউসে। খুবই সাধারণ। দোতলার ঘরটা স্যাতস্যাতে, মিটিমিটি আলো। শীতের সন্ধ্যায় অন্যরকম এক আবহ তৈরি করলো ঘরটা। গোসল শেষে ৮ টার পর রুম থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ঘুটঘুটে অন্ধকার রাস্তা ধরে বাজারে গেলাম। সেখানে ১০ টাকার বিনিময়ে মোবাইল ফোন চার্জে দিয়ে ৯ টার মধ্যে রাতের খাবার সেরে নিলাম। পেটপূজার পর মন চাইলো, বিশুদ্ধ বায়ুর অধিক সেবন। থানচি ব্রিজের উপর এসে চোখ চড়কগাছ ! উপরে বেড়ালের চোখের মত স্বচ্ছ আকাশ। তাতে ফুটে আছে লক্ষ-কোটি ফুল। তারার এমন বড় আর অবাক করা মেলা শেষবার দেখেছিলাম, বান্দরবানের লামায়।
পরদিন সকালে থানচির একমাত্র সাংবাদিক অনুপম দা’র তথ্য ও সাহায্য নিয়ে গাইড জোগাড় হলো। ছেলে অতিমাত্রায় ভালো, সহজ সরল, নাম- জয় (পুরো নাম খুব কঠিন)। জয় আগের দিনই রেমাক্রি, তিন্দু থেকে ফিরেছে। এবার আমাদের সাথে অতদূর যেতে পারবে তো ! পাহাড়ি ছেলেটা জানালো- ব্যাপার না। ওর কথা শুনে আশ্বস্ত হলাম, ভাবলাম তাহলে খুব একটা দুর্গম নয় তাজিংডং। আবার সন্দেহ হলো- তাহলে এই পথে কেন তাজিংডং যায় না অভিযাত্রীরা। যা হোক চাল, ডাল, ডিমসহ বাজার-সদাই করে শেষ পর্যন্ত সকাল সাড়ে ৮ টা নাগাদ রওয়ানা দিলাম বিজয় পাহাড়ের উদ্দেশে। পথে পড়বে দুটি জনপদ- বোর্ডিং পাড়া আর শেরকর পাড়া।
শীতের পথে ব্যাকপ্যাক নেব না ভেবেও আমার আর মঞ্জুর- একেজনের ব্যাগের ওজন দাড়ালো ১২ কেজি করে।
সেপথে নামতেই ট্রেইলে গয়ালের উপস্থিতি। পাহাড়ি গয়াল, শান্ত, সুবোধ। কোন কারণে ভয় পেলে বা ক্ষেপে গেলে এরাই ভীতিকর হয়ে ওঠে। বৈশাখৈর দিন, শেষ বিকেলে স্যাতস্যাতে পাহাড় কাঁপন ধরাচ্ছে গা’য়। এ অবস্থায় আরো ঘণ্টা দুয়েক হাটার পর সন্ধ্যা নাগাদ দেখা পেলাম কাঙ্খিত শেরকর পাড়ার। যেখান থেকে পরের দিন তাজিংডং চূড়ার উদ্দেশে যাত্রা করবো আমরা।
শেরকর পাড়া পৌঁছে নিচের ঝরণায় গোসল করলাম। শান্ত প্রকৃতির কোলে সঁপে দিলাম নিজেকে। চুপচাপ উপভোগ করলাম বুনো আমন্ত্রণ। আলো নিভে আসলে উঠে পড়লাম শেরকর পাড়ার প্রথম বাড়িটাতে। সারাদিনের ক্লান্তি এড়াতে গা এলিয়ে দিলাম। রান্নার কাজ শুরু করলো জয় আর বাড়ির মালিক (নাম জানা নাই)। জানালো বিকেলে একটা বনমুরগী শিকার করেছে সে। আমরা টাকা দিলে আমাদের রান্না করে দিতে পারে। সত্যিই এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।
এখান থেকে দেখা মেলে মিয়ানমারের সুউচ্চ পাহাড় আর কেওক্রাডংয়ের পথ হয়ে তাজিংডং আসতে গেলে সবশেষ যে জনপদ সেই সিমপ্লাম্পি পাড়া আর বিজিবির ক্যাম্প। অদ্ভুত ব্যাপার, দৃষ্টিসীমা এখানেও আটকে যাচ্ছে পাহাড়ের কারণে। চূড়ায় ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে অর্ধেক সময়ে ফিরে এলাম শেরকর পাড়ায়। এবার ফেরার পালা। যাওয়ার পথে পাহাড় চড়ার বদলে নামতে হবে বেশি। ভাবতে গিয়ে কিছুটা মানসিক শক্তি পেলাম। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সকাল ১১ টার দিকে রওয়ানা হলাম আমরা ৫ জন। অবাক ব্যাপার যে পথ চড়তে তিন ঘণ্টা লেগেছিল অনেকটা আরামে সেই পথ নেমে এলাম সোয়া একঘণ্টায়। এভাবে পথ চলে তিনটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম বোর্ডিং পাড়ায়। এখানে এবার অপেক্ষার পালা। কেন ? যাবার সময় দেখেছি পাহাড়ের এই চূড়া থেকে কাঠ কেটে নামাতে বিশেষ এক ধরণের ট্রাক সর্বোচ্চ সীমায় ওঠে। সেগুন, গজারি, গামারী কাঠ নিয়ে এই ট্রাক যায় থানচি। খবর নিয়ে রেখেছিলাম, কয়েকদিন পরপর আসা ট্রাক আসবে আজ এবং বিকেল ৩ টার মধ্যে। যদি তাই হয় তবে বাকি পথটা বিপদজনক হলেও ট্রাকে যাওয়ার পক্ষে সবাই। কেননা হাটতে রাজি নয় কেউই। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। ট্রাকের শব্দে সজাগ হয়ে গেলাম সবাই। এক দৌড়ে বোর্ডিং পাড়া থেকে এক পাহাড় উপড়ে উঠলাম। দেখলাম সেখানে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। ওরা জানালো ভবিষ্যতে এই পথে আসতে পারবে পর্যটকরা, যাতে কষ্ট বারো আনা কমে যাবে। আমাদের অফার করা হলো কাঠ বোঝাই ট্রাকে যেতে হবে।
চ্যালেঞ্জটা নিলাম সবাই। অবশ্য পড়ে দেখা গেল কাঠ বোঝাই ট্রাক ওপথে ফিরতে পারবে না। তাই খালি ট্রাক আমাদের নিয়ে রওয়ানা হলো। সত্যি এ এক অসাধারণ যাত্রা। এর আগে রোয়াংছড়িতে এমন দুর্গম পথে চান্দের গাড়িতে একবার ভ্রমন করেছিলাম। শত প্রতিকূল এসব পথ পর্যটকদের জন্য মোটেই নিরাপদ নয়। তবুও জান হাতে নিয়ে রওয়ানা হলাম আমরা সবাই। ট্রাকের পেছনে সর্ব শক্তি দিয়ে কোনমতে আকড়ে থাকার চেষ্টায় একজন আরকেজনকে দেখে হেঁসেই খুন। শেষ বিকেলে পাহাড়ি পথে দেখলাম বিশেষ ট্রাকটি ৭০-৮০ ডিগ্রি খাড়া পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে। আবার নামছে দুর্বার গতিতে। এভাবে চলে মাত্র দুই ঘণ্টায় চলে এলাম থানচি বাজারে। হালকা কিছু খেয়ে আপাতত রেস্টহাউসের উদ্দেশে ছুট দিলাম দুই জন।
বাকি দুইজন গেল পরের দিন বান্দরবানের উদ্দেশে সকালের টিকিট কনফার্ম করতে। এরমধ্যে জয়কে ওর প্রাপ্য মিটিয়ে বিদায় দিলাম। এবার ফেরার পালা। বিশ্রাম হবে রাতভর। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম- থানচির জনপদে এসে সমতলের কিছুটা হলেও পরিবেশ পাওয়া যাচ্ছে। বান্দরবানে এসে নীলগিরি পাহাড়ের কোনায় ডুবতে বসা সূর্য দেখছিলাম।
ভাবছিলাম জমজমাট বাজার, সাজিয়ে রাখা পসরা, মানুষের হাঁকডাক এই সবই রাজধানী ঢাকার তুলনায় নিরিবিলি। তারপরও নিরবতার যে ঐকতান মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে পেছনে ফেলে এলাম শেরকর পাড়ার কোলে তার সাথে আর কীসের তুলনা চলে ?