যদিও এখন ঈদের সময় না তবে টানা চারদিন সরকারী ছুটি পড়াতে সবারই যেন ঢাকার বাইরে যাবার ধুম পড়েছে, টিকেটের ক্রাইসিস চরমে, কোন রকমে একটা নন এসি ট্রেনের টিকেট পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবান ভাবার অবস্থা আমার। ট্রেন জার্নি আমার চরম অপছন্দ কিন্তু কি আর করা!
কমলাপুর রেলস্টেশনে এসে ঘন্টাখানেক অপেক্ষার পর ট্রেন এল, প্রথমেই না বুঝে সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে পুরো বগিতে চক্কর লাগানোর পর সবার পেছনে ধাক্কাধাক্কি করে নিজের আসন গ্রহণ করলাম।
ট্রেন চলতে শুরু করেছে, মানুষের ভিড় সবসময় ই বিরক্ত লাগে, মোবাইলের হেডফোন কানে লাগিয়ে সব বিরক্তি অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা করছি। কিছুক্ষণ পর ট্রেন এয়ারপোর্ট স্টেশনে এসে পৌঁছালো, আরো অনেক লোক উঠছে, কেউ কেউ দরজা দিয়ে ঢুকতে না পেরে জানালা দিয়ে উঠছে, কেউ কেউ দরজা আটকে বসে আছে অন্যরা উঠতে পারছে না সেটা নিয়ে ক্যাচাল, অনেক হাঙ্গামা চলছে।
বাসায় ফোন করলাম, কোন সমস্যা নেই জানালো কাজের মেয়েটা।
টাঙ্গাইলের কাছাকাছি চলে এসেছে, ভিড় যেন একটু একটু কমতে শুরু করেছে, হঠাৎ খেয়াল করলাম দুতিন সিট সামনে দাঁড়িয়ে কেউ একজন বিশেষ দৃষ্টি আকষর্ণের চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং তার দিকে চোখ পড়তেই জীবুদার কথা মনে পড়লো,
' চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।'
মনে মনে হতাশাগ্রস্ত হয়ে গেলাম কেন যে কবিতা লিখতে পারি না, তাহলে আজ হয়তো দুলাইন লিখে ফেলতাম যেভাবে তার সুন্দর সিল্কি চুলে বারবার হাত দিয়ে একবার ডানপাশে আরেকবার বাম পাশে নিচ্ছে!
ভাব দেখালাম খেয়াল করিনি, বড় করে মাথায় কাপড় দিয়ে দেখছি কি করে। কিছুটা হতাশ হয়ে সে কিছুক্ষণ উশখুশ করে সিট পেয়ে বসে গেল।
যারা সৌখিন পর্দানশীন তাদের ঘোমটা আবার বেশিক্ষণ থাকে না, আমারও একই অবস্থা। ঈশ্বরদী আসতে আসতে ভিড় তেমন নেই তবে দুয়েকজন দাঁড়িয়ে তখনও। কি উপলক্ষ্যে সে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকালো আর আমার সাথে চোখে চোখ পড়লো। এবার সে সিট ছেড়ে দিয়ে আরেকজনকে আরেকটু কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো, ততক্ষণে ব্যাপারটা আমার কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে, আমি না চাইতেও যেন হাসি ঠেকাতে পারছি না। এবার সে সিল্কি চুলের এপাশ ওপাশ আরো বাড়িয়ে দিলো। একবার ভাবছি এত উৎসাহী! কোন শ্যাম্পু ব্যবহার করে এইটা নিয়ে আলাপ শুরু করি, পরে মনে হল থাক মাথায় তোলার দরকার নেই।
মেহেরপুর স্টেশনে আসতে আসতে ট্রেনের অনেক সিট ফাঁকা হতে শুরু করেছে, কিন্তু তারপরও সে দাঁড়িয়ে তখনও, মনে হচ্ছে আজকে আর না বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে নিজের মোবাইল নম্বর লিখে মোবাইলের স্ক্রিনটা আমাকে বারবার দেখাচ্ছে আর কল মি হাত ইশারা করে দেখাচ্ছে। বাংলালিংক ফোন নম্বরটা বেশ সহজ শেষ ছয় ডিজিট ১৭৫৭৭১ অর্থাৎ পলাশীযুদ্ধের পর মুক্তিযুদ্ধ। এজাতীয় কোন সংখ্যা চোখে পড়লে আমার ভীষণ মাথায় ঘুরে।
যশোরে ট্রেন থামলে সে নেমে গিয়ে আমার জানালার সামনাসামনি একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে। ফোন করলাম রিংটোন যেন কানে যাচ্ছে না, ফোনটা দেখিয়ে ইশারা দিয়ে ধরতে বললাম।
ওপাশ থেকে ফোন ধরে খুবই আবেগ নিয়ে বললো, যদি আসতে চাও খোলা আছে আমার দুহাত, এখানে কোন হিসেব নেই, শুধু আছে নীল আকাশ আর লাগাম ছেড়া স্বপ্ন বুকের ভেতর...
রূপঙ্করের গান না?
একটু থতমত খেয়ে বলল, হুমম।
কি পড়েন?
আমি বিবিএ সেকেন্ড ইয়ারে, আর তুমি?
আমি ওসব অনেক আগেই শেষ করেছি।
মানে?
মানে আমি একটা কলেজে পড়াই।
মজা নাও না?!
মজা নেবার কি আছে?
বিশ্বাস করি না।
কিছু যায় আসে না ছোট্ট বাবু! আমি খুলনা সিটি কলেজে ফিজিক্স পড়াই, আমার নাম ফারহানা আহমেদ। যদি কখনো খুলনাতে আসা হয় দাওয়াত রইল।
ছেলেটার চেহারা দেখে মনে হল কাচ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল।
স্যরি... আমি... মানে...আপনাকে দেখে বোঝা যায় না... আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার... ছোট... মানে সমবয়সী...
আমি হাসতে হাসতে বললাম, ইটস ওকে! নেক্সট টাইম যাহার জন্য প্রযোজ্য সেটা কনফার্ম হয়ে নিয়ে সিল্কি চুলের বাহার আর ফোন নম্বর বিতরণ করো!
ফোন রেখে দিলাম। ট্রেন চলতে শুরু করেছে আবার...