একেই কি বলে লু হাওয়া? ভীষণ উত্তপ্ত, প্রায় দাহ্য। শরীরের প্রতিটি লোমকুপ ভেদ করে ঢুকে যেতে চাইছে যেন। যেন শিরা উপশিরায় প্রবাহমান উষ্ণ লোহিতের সাথে আশৈশব সখ্যতা পুন:প্রতিষ্ঠার অদম্য আয়োজন। আমি হাঁসফাস করি। বিদ্যুৎহীন গ্রীষ্মের উত্তপ্ত দুপুর অসহ্য লাগে। কোথায় যেন আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ খাতে তার সরকারের অভাবনীয় সাফল্যের তুমুল বর্ণনা দেবেন। সেখানে নিরবিছ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতেই এ ব্যবস্থা। আমাদের রক্ত আর ঘামে তৃষ্ণা মিটিয়ে তবেই না বক্তৃতা দেবেন তিনি। ততক্ষণ পর্যন্ত তীব্র গরমের অসহনীয় এ অনুভূতিকে যে করেই হোক অগ্রাহ্য করতে হবে। ভাবি আমি। পড়ার টেবিল হাতড়ে হাতে তুলে নেই অনেকদিন অনাদরে পড়ে থাকা 'কবিতার জন্য সাত সমুদ্র'। টেমস্ নদীর তীরবর্তী শহরে কবিতা পড়তে যাওয়ার দিনগুলো নিয়ে লেখা। গরমের অসহনীয়তা ভোলার অদম্য চেষ্টারত আমি ডুবে যেতে থাকি লেখায়।
লন্ডনের কোন এক হল বিপুল স্বদেশীর সরব উপস্থিতিতে মুখরিত। কবি পাঠ করা শুরু করেন তাঁর লেখা-
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে
স্তব্ধ হলঘরের শান্ত দেয়াল জুড়ে প্রতিধ্ধনিত হয় কবির উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ।
হলভর্তি বিহব্বল প্রতিটি চোখের কোণে টলটলায়মান অশ্রুবিন্দু।
হাজার মাইল দূরের মাটির সোঁদা গন্ধ সহসাই তীব্র হয়ে লাগে প্রতিটি নাকে।
অদ্ভূত নিস্ত:ব্ধতায় ডুবে যেতে থাকে গোটা হলঘর।
কি এক মোহময়তায় কেটে যায় সময়। একী? তপ্ত দুপুরে হঠাৎ ঠান্ডা কিছুর পরশ লাগে আমার গালে । সর্বনাশ। অপ্রস্তুত আমি ইতিউতি তাকাই ভাল করে। কেউ দেখল না তো? আমি সন্তর্পণে চোখ মুছে ভেজা হাত ঘষি আমার শার্টে। বাদিকটায় বুক পকেটের উপর, হৃৎপিন্ডের কাছে। স্বদেশ থেকে অনেক দূরে অনেকগুলো হৃদয়ের হাহাকার একই সুরে বেজে ওঠে আমার গহীনে। আমি আবার আপ্লুত হই।
এরপর কেটে কেছে অনেকগুলো গ্রীষ্মের দুপুর, অনেকগুলো বসন্ত।
কাল সকালে প্রফেসর মরিয়ার্টির দেয়া ডিসপুট রেজ্যুলেশন এ্যান্ড লিগাল এথিক্সের ওপর একটা এ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়ার কথা।
"Dear fellas, Moriarti knows what does it take to be a real
legal professional.The one will fail to submit this
assignment the day after tomorrow, will be considered a
worthless hypocrite who had nothing to do with legal
profession.."
খুব শান্ত আর রক্ত হিম করা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শেষ এই কথাগুলো বলে ক্লাস শেষ করেছিলেন তিনি। আজ দুপুরের মধ্যে এ্যাসাইনমেন্টটা শেষ করব ভেবেও করতে পারিনি। এ মাসের বাড়ি ভাড়া কাল দিতে হবে। হাতে কিছু পাউন্ড কম আছে। দেশ থেকে টাকা পাঠানোর কথা আরো দু'দিন পর। একবার যেতে পারবনা জানিয়েও তাই আবার কাজে যেতে হল দুপুরে। সন্ধ্যের কিছু পরে ভার্সিটি লাইব্রেরিতে এসে তাই পড়তে বসি আমি।
কটা বাজে? নিস্পৃহ চোখ নিয়ে হাতঘড়িতে তাকাই। খানিক বিষ্মিত হবার পালা এবার। ১২ টা চল্লিশ! সকাল ৮ টায় মরিয়ার্টির ক্লাস। বাসায় ফেরার তাড়া বোধ করি হঠাৎ। হেটেই ফেরা যাক না হয় আজ। বিশ মিনিটেরই তো পথ। ছোট্ট নিউক্যাসল শহরের কোচ লেনে নর্দামব্রিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে খাঁনিক আকাবাকা পথ পেরিয়ে হয়লেক এভিন্যুতে বাসার দিকে হাঁটতে থাকি আমি।
চারিদিক নিস্ত:ব্ধ অনেকটা। বন্ধ দোকানপাটগুলোয় মৃদু আলো জ্বলছে। বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ। অনতিদূরের পাহাড়ের গা বেয়ে বয়ে আসা বাতাসে কেঁপে উঠি আমি। পাতলা ওভারকোটের পকেটে হাত ঢুকাই। কিসের জন্য যেন এই মধ্যরাতের জনহীন রাস্তায় হঠাৎ অস্থির বোধ করি। বৃষ্টির একটা ফোঁটা পরে আমার চোখের নিচে। হাতের তালু দিয়ে মুছে সে হাত ঘষি বাদিকটায় বুক পকেটের উপর, হৃৎপিন্ডের কাছে। কি যেন এক অতি পরিচিত স্মৃতিতে কেঁপে কেঁপে উঠি আমি। অনেক আগের গ্রীষ্মের দুপুরের কথা মনে ঝড় তোলে। উদভ্রান্ত আমি ঝাপসা চোখে দু' হাত শূণ্যে ছুড়ে দিয়ে গগনবিদারী চিৎকার করে উঠি
বাংলাদেশ...আমার বাংলাদেশ
ছোট্ট শহরের বন্ধ দোকানগুলোর শান্ত দেয়ালে প্রতিধ্ধনিত হয়ে আমার কানে ফিরে ফিরে আসে...বাংলাদেশ......আমার বাংলাদেশ....
পরিশিষ্ট: সেদিন রাতে কোচ লেন ধরে হেঁটে যাওয়া যুবকটি আমি নই। আমার শৈশবের সুহৃদ সাকীব। তার অনুভূতিগুলোকে ভাষা দেয়ার চেষ্টা করলাম মাত্র। গল্প তাকে উৎসর্গ করা হল। পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আরেক সুহৃদ সোহায়লাকেও উৎসর্গের অংশীদার করলাম। আর লেখার সময় আমার মনে ছিলেন সেই সব মানুষেরা...জন্মভূমি থেকে অনেক দূরে প্রতিনিয়ত যাদের বুকের বামপাশে ধ্ধক ধ্ধক করে বাংলাদেশ নামক হৃৎপিন্ড, জানান দেয় প্রতিবার, আমি আছি...আমি আছি...।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:১৫