বইঃ রাত্রির তপস্যা
লেখকঃ গজেন্দ্রকুমার মিত্র
ধরণঃ সামাজিক
প্রকাশকালঃ জানিনা
প্রচ্ছদ দেখে বই হাতে নেয়া হয়েছে এমনটা তো হয়ই, কিন্তু এই বইটা হাতে নিয়েছিলাম ( ঠিক করে বলতে গেলে পিডিএফ ওপেন করেছিলাম) এর নাম দেখে। আর যাই হোক, রাত্রির সাথে আমারো একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে কি না! তবে বইটার নাম "রাত্রির তপস্যা" কেন সেটা একদম বইয়ের শেষে গিয়েই জানা যায়। বাংলা পরীক্ষার প্রশ্নের মত নামকরণের সার্থকতা বিশ্লেষণ করতে দিলে বলতেই হবে যে নামকরণ যথার্থই হয়েছে। যদিও আমি ঠিক যেমনটা মনেকরেছিলা তেমনটার ধারে কাছে দিয়েও যায়নি।
যাইহোক, গজেন্দ্রকুমার মিত্রের বই এটাই প্রথম। তাকে চিনি "পৌষ ফাগুনের পালা" র লেখক হিসেবে। "পৌষ ফাগুনের পালা" কেনা তাও বছর খানেক হয়ে গেল, আশা করি সেটা শুরু করার আগেই মিত্র মশাইয়ের ফ্যান হয়ে যাবো। কারণ ঐটা পড়ার আগে এখন তাঁর আরো কিছু বই পড়বো।
যঠেষ্ট প্যাঁচাল হয়েছে, এখন আসল কথায় আসি। অন্য কোন বই পড়ে এতটা মিশ্র অনুভূতি খুব কমই হয়েছে। মানে ভালো লাগা আর পড়া থামিয়ে দেয়ার অনুভূতির সংমিশ্রণ। কারণ বইটায় একিই সাথে মেলোড্রামা আর বর্বর বাস্তবতার বেশ দারুণ সহাবস্থান আছে। শুরু করার সময় মনেহয়েছিল যেন পুরাতন বাংলা মুভির চিত্রনাট্য পড়ছি। চেনানাই জানানাই, হুট করেই একটা মেয়ে গাছতলায় ভিজতে থাকা এক ছেলেকে গাড়িতে করে বাড়িতে তুলে এনে একদম প্রাইভেট টিউটর বানিয়ে ফেলবে, এমনটা তো উত্তম কালের (মানে উত্তম কুমারের যুগের আর কি) মুভিতেই সম্ভব নাকি? তাও আবার মেয়েটা ধনী দাদুর একমাত্র নাতনী, যার পড়াশোনাই হয় প্রাইভেট টিউটরের কাছে, স্কুলের কোন বালাই নাই। আর ছেলেটা গরীব ঘরের, টিউশনি করেই চলে। কি কম্বিনেশন! বোঝাই যায় কি থেকে কি হবে। এখানে সম্ভাব্য দুটি ঘটনা ঘটতে পারে, এবং সেই দুটি ঘটনার থেকে একটি-ই ঘটে, যদিও কোনটা ঘটে সেটা এখন বলবো না। পড়ে নেবেন। এ তো গেল ড্রামাটিক পার্ট, এটুকু পড়েই ঠিক করে নিয়েছিলাম যে বইটা ছেড়ে দিব। দিতামও, যদি না লেখক ভূপেন্দ্র, মানে সেই গাছতলায় ভিজতে ভিজতে টিউশনি পেয়ে যাওয়া ছেলেটাকে সম্মানের সাথে সম্মান পাশ করিয়ে তারপর অসম্মানের সাথে স্কুল মাস্টারের চাকরি দিয়ে গ্রামে না পাঠাতেন। একানেই শুরু হয় স্কুল, শিক্ষাব্যবস্থা আর শিক্ষকদের আসল কাহিনী। ভূপেন্দ্র যেহেতু নায়ক, সেহেতু অবশ্যই সে নীতিবান এবং নীতির ভারে পদে পদে তাকে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এখানে অবাক লাগে যে শিক্ষাব্যবস্থার যে ঘুণেধরা অবস্থার কথা বর্ণনা করা হয়েছে, সেটা যেন বর্তমান সময়েরই প্রতিচ্ছবি। এত বছর আগে লেখা বইতে শিক্ষকদের স্বল্প বেতন, প্রাইভেট টিউশন, ক্লাসে পড়ানোর অনীহা, প্রকাশকদের কমিশনের যেই বর্ণনা আছে, তা কপি করে এখনকার কোন লেখায় পেস্ট করে দিলেও কেউ ধরতে পারবে না। মূলত এই অংশের জন্যেই বইটা আর রাখা হয়নি। শুরুর নাটুকে ঘটনা বাদ দিলে পরবর্তী অংশগুলো বেশ ভালোভাবেই এসব বাস্তবতা নিয়েই নাড়াচাড়া করেছে। বিশেষ করে ভূপেনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও প্রেমঘটিত সমস্যার সঙ্গে শিক্ষাব্যস্থাকে যেভাবে জড়িয়েছেন এবং এক হাত নিয়েছেন তাতে মিত্র মশাইকে বাহবা দিতেই হয়। আর তাঁর বর্ণনাভঙ্গিট অনেকটা গ্রামের এক রেখায় চলা মেঠোপথের মত। সহজ সরল, কোন বাঁক চোক নেই, একটানা হেঁটে জাওয়া যায়, মানে পড়ে ফেলা যায় আর কি। ও আচ্ছা, বলা হয়নি, স্কুলে পড়াতে পড়াতে ভূপেন্দ্র আরেকটা ঘটনায় অনিচ্ছায় জড়িয়ে যায়, তাতে করে একজন শিক্ষককে কি পরিমাণ আর্থিক কষ্টের মধ্যদিয়ে যেতে হয় সেটার কাহিনী শুরু হয়। এসবের মধ্যে আবার প্রেম ট্রেমের কাহিনীও আছে (এটা গল্পের টার্নিং পয়েন্ট, বেশিকিছু বোল্লাম না, সব আমি বলে দিলে আপনি কি পড়বেন?)। যারা শক্তিশালী সামাজিক সমালোচনার সাথে ব্যক্তিগত, প্রেম ও আর্থিক টানাপোড়নের কাহিনী পড়তে চান তারা নিশ্চিন্তে পড়ে ফেলতে পারেন। আশাকরি ভালো লাগবে।
পুনশ্চঃ যেমনভাবে ভেবেছিলাম, তেমনভাবে গল্পটা শেষ হয়নি। অবশ্য যেভাবে শেষ হয়েছে তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। এটাই ভালো হয়েছে। রাত্রির তপস্যা কেন করতে হবে তা একদম এই শেষে এসেই বোঝা যাবে কি না।
রেটিংঃ ৩.৫/৫ (অতিনাটকীয় অংশগুলো না থাকলে ৪ দিতাম)
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০১৯ রাত ৮:৪২