সময়টা বোধহয় মাঝরাত। বোধহয় বলছি তার কারণ কয়টা বাজে সেটা ঠিক জানিনা। এবং দেয়ালে ঝুলতে থাকা ঘড়ি দেখেও লাভ হবে না। কারণ জানি তাতে কয়টা বাজছে, সাতটা আঠারো। গত পাঁচ মাস ধরে এই সাতটা আঠারোই বেজে আছে। আসলে মোবাইলেই সবসময় সময় দেখা হয় বলে এই দেয়াল ঘড়ির দিকে খেয়ালই করা হয় না। আর এটা জন্মদিনে বন্ধুদের দেয়া গিফট বলে খুল ফেলতেও ভালো লাগে না।
যাইহোক, খুব ক্লান্ত থাকার কারণে আজ বেশ আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তাই হয়ত মাঝরাতে হঠাত্ই ঘুম ভেঙে গেল। এমনিতে তো এক ঘুমেই রাত পার হয়ে যায়। তা ঘুম একটু কাটতেই চোখে পড়লো যে জানালাটা খোলা। ঘুমানোর আগে জানালা বন্ধ করেই ঘুমাই, তবে আজকে করা হয়নি। আর হয়নি বলেই বোধহয় এমন সৌন্দর্য দেখতে পেলাম।
আমার খুব পছন্দের সময় হলো রাত, আর রাত্রির সাথে যদি চাঁদনি থাকলে তো কথাই নেই। মানে চাঁদনি রাত আরকি। এবং আজকের রাতটা তেমনি রাত। অস্বাভাবিক সুন্দর আলো চারদিকে। হালকা হলুদাভ সাদা আলো। আর ঐ যে চাঁদটা, শিমুল গাছের পাশদিয়ে উঁকি দিচ্ছে যেটা, ধবধবে সাদা। কি চরম সুন্দর! আর তার উপর আবার মাঝরাতের হালকা বাতাস। পুকুরের পানিতে অল্প ঢেউ উঠেছে সে বাতাসে। তাতে চাঁদের আলো পড়ে হীরের মত চিকচিকে ছটা দিচ্ছে। কি অপার্থিক সৌন্দর্য! এমন পরিবেশ এতটাই সুন্দর যে ভালো লাগার সাথে মন খারাপ মিশে যায়। আনন্দময় বিষাদে মন ভরে যায়। আর মনেহয় এমন সৌন্দর্য তো আজীবন উপভোগ করা যাবে না।
এমন কথা যখন ভাবছি তখন হঠাত্ই একটা কুকুর ডেকে উঠলো। একবার। আমি এরআগেও গভীর রাতে কুকুরের বিলাপ শুনেছি। একসঙ্গে অনেক কুকুর ডেকে উঠেছে, কিংবা একটা কুকুরই অনেকক্ষণ ধরে ডেকে গেছে। কিন্তু শুধুমাত্র একটা কুকুর একবার ডেকে ওঠা, কেমনযেন। মনেহয় যেন কেউ তার গলা চেপে ধরে ডাক বন্ধ করে দিয়েছে। আপনারা বুঝবেন না, ভাববেন স্রেফ এটা কুকুরেরই তো ডাক। কিন্তু এমন অপার্থিব আলোয় এমন ডাক মনের মধ্যে ভয়ের অনুভূতি এনে দেয়, নির্মল ভয়, আর কোনোকিছু না। আমিও ভয় পেলাম, নির্মল ভয়। জ্যোত্স্না বিলাশ করে আর লাভ নেই। জানালা বন্ধ করতে গেলাম। তখনি চোখে পড়ল তাকে। আমার বারান্দার সামনে, উবু হয়ে কেউ পাতা কুড়াচ্ছে। খুবই সাধারণ, কিন্তু স্বাভাবিক যে না! সাধারণ কারণ অনেকেই আমার বারান্দার সামনের এই আমগাছের পাতা কুড়াতে আসে। আর স্বাভাবিক না কারণ এখন গভীর রাত। আমি ভয়ঙ্কর রকমের ভয় পেলাম এই অস্বাভাবিক-সাধারণ ঘটনা দেখে। দ্রুত জানালা লাগাতে গেলাম, কিন্তু তখনি যে পাতা কুড়াচ্ছিল সে মুখ তুলে তাকালো। একটা মেয়ে। খুবই সাধারণ এক মেয়ে। এমন অবস্থায় হয়ত দেখা উচিত ছিল এমন এক মেয়েকে যার ঠোঁটে রক্ত লেগে আছে, বা যার চোখ দিয়ে রক্ত পড়ছে বা অন্য ভয়ঙ্কর কিছু। কিন্তু এই মেয়ে খুবই সাধারণ। এতই সাধারণ যে হয়ত তাকে একবার দেখে দ্বিতীয়বার দেখলে আর চেনা যাবে না। শুধু তার কাজের সময়টা অস্বাভাবিক, এবং এরপর যা ঘটলো সেটা। তারদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সে আমার বারান্দায় জালানার সামনে চলে এলো। আর আমি নিশ্চিতভাবেই জানলাম যে এই অপার্থিব সৌন্দর্যের মধ্যে আক্ষরিকভাবেই অপার্থিব কিছুর সম্মুখীন হয়েছি আমি। এরপর সেই মেয়েটা আরো কাছিয়ে এসে তার হাত জানালার দিকে বাড়িয়ে দিল। এতক্ষণ যেখানে পাতা ছিল সেটা খেয়াল করে দেখলাম অন্য কিছু হয়ে গেছে। গোলাকার। হাতটা আরেকটু আগিয়ে আসতে বুঝতে পারলাম গোল জিনিস যেটা সেটা আসলে একটা ছোটো বাচ্চার মাথা। এবং আরো আগাতেই বাচ্চার মাথাটাকে চিনতে পারলাম, আমাদের ফ্যামিলি এলবামে অনেক দেখেছি একে, খুব ভালোভাবে চিনি, কারণ এটা যে আমিই। তখনই সেই মাথাটা চোখ খুলে তাকালো এবং আমারো ঘুম ভেঙে গেল।
উফ! কি স্বপ্ন ছিল। বেশ ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল। গলা শুকিয়ে গেছে। ভালোভাবে চোখ না খুলেই পাশের টেবিলে রাখা বোতল থেকে পানি খেয়ে গলাটা একটু ভেজালাম। মোবাইল টেনে নিয়ে সময় দেখলাম বারোটা ছাব্বিশ (হ্যাঁ, আমার দেয়াল ঘড়িটা আসলেই নষ্ট হয়ে ঝুলে আছে)। মাঝরাত। এবং তখনই খেয়াল হলো যে জানালার এক পাল্লা খোলা। সেখান দিয়ে চাঁদের আলো আসছে। আলো দেখে মনে হচ্ছে আজ বোধহয় ভরা পূর্ণিমা। স্বপ্নে দেখা আলোর মত হলুদাভ সাদা আলো। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম। হ্যাঁ, এইতো একটা কুকুর ডেকে উঠলো। একবার। আমি অপেক্ষা করতে থাকলাম। হ্যাঁ, ঐতো শব্দ হচ্ছে। পাতা কুড়ালে যেমনটা হয়। জানালাটা বন্ধ করা দরকার। দ্রুত বন্ধ করার জন্য উঠলাম। অবশ্য তারআগে দেখেনিলাম বোতলে কতটুকু পানি আছে। কারণ এই স্বপ্নটা যখন ভাঙবে তখন তো আবার গলা শুকিয়ে যাবে। পানি না থাকলে শুকনা গলায় নতুন স্বপ্নে যাওয়াটা বেশ কষ্টকর হবে। কি বলেন? শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলা নিয়ে কষ্ট হবে না?
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১২:১৬