হটাৎ ঝোড় হাওয়া বইতে শুরু করল। চলন্ত ট্রেনে আমি আর আমার পরকীয়া প্রেমিকা মেঘলা। আমরা পালিয়ে যাচ্ছি। বাস্তবতা ভুলে গিয়ে আমরা মিশে যাব আদিম রতি খেলায়। কক্সবাজারে আমাদের হোটেল বুকিং করে রেখেছে মেঘ। কিন্তু তুফান শুরু হয়ে যাওয়ায় আমরা ভয় পেয়ে গেছি। আমার মনে হচ্ছে প্রকৃতি আমাদের মেনে নেয়নি। যাই হোক ট্রেন আগের মতোই ছুটে চলছে।
বাতাসের গতি বাড়ার সাথে সাথে মেঘের বুকের ওঠানামা বাড়তে লাগল। আমিও ভয় পেতে শুরু করলাম। ওকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলাম।
সবার চোখেমুখে আতন্ক।তুফানের চরম পর্যায়ে ট্রেন হেলে পড়ল পাশের ক্ষেতে। আমরা ছিটকে পড়লাম: কেউ ক্ষেতে , কেউ রেলের জানালায়, কেউ স্লিপারে। আমি ঠিক রেললাইনের পাশেই পড়ছি আর মেঘ স্লিপারে। আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। এখনো অনেক বাতাস আর বাতাসে ভাসমান ধুলিকনা, উড়ে যাওয়া চালের টিন, গাছের ঝরা পাতা, ব্যানার আরো অনেক কিছু। আমি আস্তে আস্তে উঠতে যাব, এমন সময় একটা ভেসে আসা টিন আমার মাথা দু ভাগ করে দিল। আমার মাথার অর্ধেক মগজ, একটা কান আর একটা চোখ নিয়ে এক অংশ আলাদা হয়ে গেল। অবশ্য আমার পাশেই পড়েছিল, কিন্তু ওটা তুলে আমার পক্ষে জোড়া দেয়ার ক্ষমতা ছিল না।
আমার কাছ থেকে দু-তিন হাত দুরে মেঘ পড়ে আছে। তাকে মৃত দেখাচ্ছে। আমি কাঁদতে পারছি না। ওর মাথা মনে হয় স্লিপারে খুব জোরে লেগেছে, বৃষ্টির পানিতে রক্ত ধুয়ে যাওয়ায় তাকে খুব রক্তশূন্য ফ্যাকাশে লাগছে। আমার হাতে জোর নেই, থাকলে ওর মাথা আমি আমার কোলে তুলে নিয়ে ওর ভিতরে প্রাণ ফিরিয়ে আনতাম। হটাত তুফান থেমে গিয়ে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হতে লাগল। বৃষ্টির ফোঁটা মেঘের গায়ে পড়ে লাল হয়ে রেললাইনের পাথর গুলোকে লাল করে দিচ্ছে। আসার আগে কেনা নতুন শাড়ির রঙ উঠছে মনে হয়। লাল, লাল, লাল রঙ।
এদিকে বৃষ্টি কমার সাথে সাথে আশেপাশের মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে লাগল। গ্রামের লোকজনও মনে হয় খবর পেয়ে চলে এসেছে। আমার দুচোখের মাঝখান দিয়ে একজন দৌড়ে গেল টের পেলাম । মানে আমার বাম আর ডান চোখের মধ্যবর্তী জায়গা দিয়ে কেউ গেল। আমার ডান কান মাটির সাথে লাগানো থাকায় আমি খুব কম কম্পাঙ্কের শব্দও শুনতে পাচ্ছিলাম। ডান দিকে মেঘ আর বাঁ দিকে ট্রেন। ট্রেনের ভিতরে থেকে মাথা বের করে থাকা একজনের চিৎকারে মাথা গরম হয়ে গেল। আহ, আহ, করে চিল্লায়ে যাচ্ছিল। মনে হয় পা আটকা পড়েছে। তাই বলে এমন চিল্লাতে হবে? আমার যে চোখ আলাদা হয়ে গেল আমি কি চিল্লাচ্ছি নাকি? আজব!
আবার একজন দেখি আটকে যাওয়া লোকটার পকেটে হাত দিচ্ছে। মনে মনে বলছি যে একদম উচিত কাজ করছে। আরেকজন বউয়ের শাড়ীর আঁচল ধরে টানাটানি করছে; ঠিক বুঝলাম নাঃ নিজে বাঁচার জন্য নাকি বউকে বাচানোর জন্য?
ডানদিকে তাকিয়ে দেখি শুকনো একটা লোক মেঘের পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল যে আমার জান কে একটু তুলে নিয়ে বাঁচাও। লোকটা চারপাশ দেখে নিয়ে মেঘের শাড়ি সরিয়ে দিল বুক থেকে, তারপর ব্লাউজের উপর হাত রাখল। আমার মাথা তখন ফুল স্পিডে গরম হয়ে গেছে, কিন্তু কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে, সে পানি মাটিতে লেগে ঘোলা হয়ে গেছে, যার ফলে আমি এখন আর কিছুই দেখতে পারছি না। যখন কিছুই দেখছি না তখন একটা কথা মনে পড়ল। আমাদের বাড়িতে জায়গির থাকত এক হুজুর। উনি একদিন আল্লাহর ক্ষমার সর্বোচ্চ সীমা প্রসঙ্গে একটা কাহিনী বলেছিলেন যে ঃ একলোক কাফনের কাপড় চুরি করত, তো একদিন ওই গ্রামে এক সুন্দরী যুবুতি মারা গেল।যথারীতি ও গেল কাপনের কাপড় চুরি করতে, গিয়ে ও দেখল যে মেয়েটা অনেক সুন্দরী ।সে তার ভিতরের সংযম হারিয়ে ওই মৃত মেয়ের সাথে যৌনকর্ম করল। করার পর তার মনে হতে লাগল যে সে অনেক বড় পাপ করে ফেলছে।পরে নবীজির কাছে ওই লোক জিজ্ঞেস করল যে আল্লাহ কত বড় গুনাহ ক্ষমা করতে পারে? তখন নবীজি উত্তর দিল যে ক্ষমা চাইতে জানলে আল্লাহ যত বড় গুনাহই হোক না কেন ক্ষমা করে দেয়।
এই ছিল তার গল্পটা। হুট করে আমার মনে হল, 'কি হচ্ছে জানি?' তাহলে কি আমার মেঘও আর নেই? না থাকাই ভাল বলে মনে হয়।
মানুষের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। আমার নাক ঠোটের অবস্থা কেমন হইছে তা দেখার ইচ্ছে ছিল ,কিন্তু আয়না না থাকায় দেখতে পারি নাই। হটাত আমার বাঁ চোখের উপর শক্ত সোলের চাপা অনুভব করলাম আর সাথে সাথে আমার চোখ রাবার বলের মত লাফাতে লাফাতে ক্ষেতের কাদা মাটিতে গিয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে কাদায় ঢুকে গেল। কিছুই দেখছি না আর। আমি মরে গেছি, আমি আর নেই। একটা মাইক থাকলে এনাউন্স করে দিতাম যে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী , মহৎ প্রাণ জনাব হিল্লোল সাহেব ট্রেন দুর্ঘটনায় আজ বিকেলে ইন্তেকাল করিয়াছেন( ইন্নালিল্লাহে অইন্না ইলাইহে রাজেউন)।
এক।
আমি বিয়ে করেছি আজ প্রায় ১২ বছর হল। আমার বউ রোশণি। তার বর্ণনা দিতে গেলে শুধু এটাই বলব,'তাকে পেয়ে আমি স্বর্গে যাবার সপ্ন দেখেছি'। তারকাছে আমার চাওয়া পাওয়ার কিছু ছিল না, যা আমি চাইতাম তা সে দিতে পারত না কখনো। "একটা সন্তান"। আমার মেয়ে রোহি । (রোশনি আর হিল্লোলের প্রথম শব্দ নিয়ে) । ক্লাস ফোরে পড়ে। অসাধারণ মেধা তার। আর ওর আম্মুর সাথে আমার ছোটখাট ঝগড়া ওই সামলাত। বিনিময়ে ওকে অনেক গিফট দিতাম। আমদের ভালই চলছিল। সমস্যা বাঁধল যখন আমার পারসোনাল সেক্রেটারী মেঘলা সরকার জয়েন্ট করল। প্রথম কদিন কিছুই দেখলাম না, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ওর বেহায়াপনা বাড়তে লাগল। দেখা গেল ওড়না ছাড়া অফিসে আসতে শুরু করল, কোন দিন তার শার্টের উপরের বোতাম খোলা থাকত, মানে অনেক উত্তেজিত অবস্থা। আমি তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম যে আমি ম্যারিড আর ও যেন এসব না করে। তারপর ও স্যরি বলে চলে গেল। আমি উদ্ধার হলাম ভবিষ্যৎ বিপদের সম্ভাবনা থেকে।
কিছুদিন পর সে আমাকে অনেক কাকুতি মিনতি করে অফার করল বাইরে খেতে যাওয়ার। আমি না করতে পারলাম না। আমার রোশ্নির দেয়া খাবার আমি রেখে দিলাম। গেলাম বাইরে খেতে, ধানমন্ডি জিগাতলা 'লাইলাতি' রেস্টুরেন্টে । কি খেলাম তা কোন কথা নয়, সে কি বলল তা বলছিঃ
আমার বাবা একজন সরকারি চাকুরীজীবী ছিলেন, মা গৃহিণী। ভাই বোন কেউ ছিল না, আমার ১৬ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয় আমার গ্রামের বাড়ির এক ছেলের সাথে যার বাবা বিদেশ থাকত, সে সুবাদে সে অনেক টাকার মালিক ছিল। আমার বাসররাত ছিল পৃথিবীর যে কোন মেয়ের জন্য কষ্টের রাত। আমি বসে আছি খাটে, সে রুমে ঢুকল একটা মেয়ে নিয়ে। আমি ভেবেছিলাম ওর বোন অথবা ভাবি টাবি হবে, কিন্তু যখন দেখলাম সে মেয়েটাকে রুমে ঢুকিয়েই কিস করল, আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। অজ্ঞান হয়ে গেলাম। জ্ঞান ফিরে দেখি আমি হাসপাতালে। আমার বাবা মা পাশে, আমার স্বামী নেই । আমি বাবাকে সব কিছু খুলে বললাম। বাবা আমাকে আর ও বাড়িতে যেতে দিলনা। আমিও যেতে চাইনি। তারপর দুবছর কেটে গেল। আমি বাবার কাঁধে বোঝা হয়ে দিন পার করছিলাম। খুব কষ্ট করে দিনগুলি ভুলে যাচ্ছিলাম, কিন্তু;
এটুকু বলে ও থামল। আমি তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। বয়স কত হবে মেয়েটার?এই উনিশ কি বিশ। যথেষ্ট সুন্দরী বলা যেতে পারে। ছিমছাম ফিগার। গালের উপর অশ্রু যেন মুক্তার কনা। চোখের দিকে তাকিয়ে আমি ওকে বললাম,'কিন্তু কি?'
ও আবার শুরু করল, ভেবেছিলাম আপনার সান্নিধ্যে থেকে জীবনটা কাটিয়ে দেব আপনার দাসী হয়ে কিন্তু আপনি আমাকে খারাপ মেয়ে হিসেবেই ভেবে নিলেন।
আমি বললাম,' দেখ, আমি বিবাহিত, আর আমি তোমাকে বেতন বাড়িয়ে দিতে পারি কিন্তু আমার সাথে রাখা সম্ভব না।
মেঘলাঃ জানি স্যার, আসলে আমাদের জীবন এমনি, দুঃখে দুঃখে কেটে যায়। আমি আপনাকে বলছি না যে আমাকে আপনার সাথে রাখেন কিন্তু খারাপ চোখে দেখবেন না।
বাসায় ফিরে চিন্তা করতে লাগলাম। রোশনি আর রোহি দুজনেই ব্যস্ত । আমি সোফায় শুয়ে ভাবছি। মানুষ কত কষ্টে থাকে? মেয়েটা আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছে না তো?নাহ, এতো অশ্রু ছলনার হতে পারে না।
আস্তে আস্তে ওর সাথে আমার সম্পর্ক গভীর হতে লাগল, আমি নিজেকে বাধা দিয়ে রাখতে পারলাম না। আমরা অফিসেই আমার প্রেমালাপ, রতিক্রিয়া শুরু করে দিলাম।
আর তর সইছে না দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম আমাদের দুজনের ব্যাংক ব্যালেন্স নিয়ে আমরা হারিয়ে যাব। যেদিন আমি বের হয়ে আসব সেদিন ছিল শনিবার। মেয়ে রোহিকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে আমি গাড়িতে উঠতে যাব, এমন সময় পিছে তাকিয়ে দেখি রোহি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মায়ায় পড়ে যাব দেখে দ্বিতীয়বারের মত ফিরে তাকাই নি। বাসা থেকে বের হয়ার সময় রোশনি বললঃ এই শোনো, সন্ধ্যায় আমরা বাইরে খেতে যাব। তুমি পারলে একটু আগে আগে এস।আমি মুচকি হেসে ওকে আশ্বস্থ করলাম।
অফিসে এসেই দেখি মেঘলা পরীর মত সেজে এসেছে, লাল বেনারসি, কপালে কালো টিপ, বুকের একপাশে কাপড় পেছান । তাকে অনেক আবেদনময়ী লাগছিল। আমার চোখ আর পিছে ফিরে তাকাতে চাইল না।
বিমান বন্দর স্টেশন থেকে কক্সবাজারের টিকেট কেটে রেখেছিল মেঘ। তারপর আমাদের যাত্রা শুরু।আমি চিন্তা করতে লাগলাম। আমি কি করলাম? কি করতে যাচ্ছি? আবার নিজেকে নিজেই বুঝাতে লাগলাম , আমি পুরুষ, আমি আদিম আহ্ববানে সাড়া দিতেই পারি, অথবা আমার মেয়েটাকে সুখে রাখার দরকার ছিল, আমি অন্যভাবেও পারতাম, কিন্তু এখন যেভাবে হচ্ছে তাই সবচে আনন্দ দিবে আমাকে। বলা হয় নি একটা কথা, মেঘ যত খুশি তত মা হতে পারবে, কিন্তু রোশনি কখনই পারবে না , পারেনি। রোহিকে আমরা দত্তক এনেছিলাম। রোশনির ১৪ বছর বয়সে ওর ওভারিয়ান ক্যান্সার হয়েছিল। ও বেঁচে গেলেও ,ওর দুটো ওভারিই নষ্ট হয়ে যায়। আমি এই ব্যাপার নিয়া কখনোই ভাবি নি যতক্ষণ না আমার সামনে মেঘ আসে নি। তারপরও নিজের মধ্যে একধরনের অপরাধবোধ কাজ করছে। কিছুতেই নিজেকে বোঝাতে পারছি না।
ভাবতে ভাবতে পৌছে গেলাম কুমিল্লা রেলওয়ে স্টেশন। আবার ট্রেন চলা শুরু হল আর সাথে সাথে শুরু হল তুফান, আস্তে আস্তে বেগ বাড়ছিল, আখাঊড়া স্টেশন পার হয়েই মনে হল আজ আর বাঁচব না।
প্রকৃতি আমাদের ভুল ধরিয়ে দিচ্ছে, চিৎকার করে বলছে "তোমাদের আমি মেনে নেইনি, ভুল করছ তোমরা, যা তোমাদের জন্য ভালো ছিল তা তোমাদের জন্য আমি করেছি, করব"।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০১৪ দুপুর ২:২৩