লুনা ছোট বেলা থেকেই জানতো তার এরেঞ্জড ম্যারেজ হবে। প্রেম টেম করে বিয়ে করে পচা মেয়েরা। লুনা পচা মেয়ে নয়। সে খুবই সিরিয়াস টাইপের মেয়ে। সিরিয়াস টাইপের মেয়ে হিসেবে তার চোখে চশমা আছে এবং তার রেজাল্ট অস্বাভাবিক ভালো। অস্বাভাবিক ভালো রেজাল্ট করতে থাকা মেয়েটি একদিন সকাল বেলা ঘুম ভেংগে জানতে পারলো আমেরিকার ডেট্রয়টে সেটল এক ছেলের সাথে তার বিয়ের কথাবার্তা প্রায় চূড়ান্ত। ছেলেপক্ষ নাকি বহু আগে থেকেই লুনাকে পছন্দ করে রেখেছে, ছেলে দেশে ফিরলেই বিয়েটিয়ে করে মেয়েকে নিয়ে চলে যাবে। লুনার বাবা মা তাকে এ ব্যাপারে শুরুতে কিছু জানাবার প্রয়োজনই মনে করেননি। বিয়ের ব্যাপারে তাঁদের মেয়ের কিছু বলার থাকতে পারে, এটা তাঁদের কল্পনাতেও নাই।
লুনা অবাক হয়ে আবিষ্কার করলো, একটা একদমই অপরিচিত ছেলের সাথে তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, বাকিটা জীবন তাকে বাবা মা ছোট বোনটার কাছ থেকে বহুদুরে অচেনা একদেশে অপরিচিত একটা মানুষের সাথে সাথে থাকতে হবে- এ ব্যাপার গুলো তাকে স্পর্শ করছে না। তার কষ্ট লাগছে সে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষাটা দিতে পারবে না এই ভেবে- গতবার অল্পের জন্য সিজিপিএ ৪ মারতে পারে নাই, এইবার সে ঠিকই ফাটিয়ে ফেলতো। কিন্তু তার বাবা-মায়ের তাড়াহুড়া দেখে তার মনে হচ্ছে মেয়েকে দ্রুত আমেরিকাগামী প্লেনে উঠিয়ে দিতে পারলে তাঁরা শান্তি পান।
লুনাদের বাসায় আত্মীয় স্বজনদের আনাগোনা বাড়ছে। তারা লুনার আড়ালেই গুজগুজ ফুসফুস করেন, নানা রকম লম্বা চওড়া লিস্ট বানান ও নিজেরা নিজেরা কি কি বলে বলে মাথা নাড়েন। লুনা তাদের ভাব সাব দেখে ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে নিজের মতই আছে। ক্লাসটাস করে, গল্পের বই পড়ে, পড়াশুনা করে। মাঝে মাঝে খালা-ফুফুদের সাথে শপিং এ যায়। তাঁরা হৈচৈ করে দুনিয়ার জিনিসপত্র কিনে। সে ভ্রু কুঁচকে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। লুনার মাঝে মাঝে মনে হয় তার ফ্যামিলির মানুষজনের মাথায় ভালো ঝামেলা আছে।
গায়ে হলুদের তারিখ ঠিক হয় হয় যখন অবস্থা তখন লুনা একটা অসম্ভব সাহসের কাজ করলো। সে একদিন সন্ধ্যায় তার বাবার রুমে গিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে সকালের বাসি পেপার পড়তে থাকা গম্ভীর মানুষটার সামনে নিঃশব্দে বসে খুব স্বাভাবিক গলায় বললো, "বাবা, বিয়ের আগে আমি ছেলেটার সাথে দেখা করতে চাই একবার"
লুনার বাবা, সোবহান সাহেব পেপার সরিয়ে চশমার উপর দিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে খুব অবাক হয়েছেন এরকম ভংগিতে জিজ্ঞেস করলেন "দেখা করে কি হবে?"
"যার সাথে আমি তোমাদের সবাইকে ছেড়ে অন্য একটা দেশে চলে যাবো একাএকা তাকে বিয়ের আগে আমি দেখবো না একবার ছেলেটা কেমন?"
"তোমার বড় মামা ছেলের ফ্যামিলিদের খুব ভালো মত চেনেন। ছেলের সেখানে তিনটা রেস্টুরেন্ট আছে, গ্রীনকার্ডও হয়ে গেছে। এখানে দেখা দেখির কিছু নাই"
লুনা মাটির দিকে তাকিয়ে হাসলো অল্প করে। তারপর চোখ উঠিয়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে বললো "বাবা, বিয়ে তো বড় মামা করছেন না, আমিও ছেলের রেস্টুরেন্ট কিংবা গ্রীনকার্ডকেও করছি না। আমার ছেলের সাথে দেখা করাটা জরুরি। তুমি আয়োজন করো। হলুদ-ফলুদ এসবের ডেট ঠিক করার আগেই,ঠিকাছে?"
কথাটা বলেই লুনা মিষ্টি করে হেসে বাবার সামনে থেকে উঠে চলে গেলো। সোবহান সাহেব চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর হঠাৎ মনে হচ্ছে তিনি তার বড় মেয়েকে চিনেন না। কখনই চিনেন নি।
লুনা রেস্টুরেন্টের এসির হাওয়া গিলছে দশমিনিট হলো। বাইরে ভয়াবহ রোদ। লুনার সামনে একটা ডিউ এর কাঁচের বোতল রাখা। সে স্ট্রতে অল্প অল্প টান দিচ্ছে আর ঘড়ি দেখছে। ছেলেটা আসছে মিরপুর থেকে ঢাকার জ্যাম সম্পর্কে আইডিয়া না থাকায় জ্যামে আটকা পড়েছে নিশ্চয়ই। গতকাল রাতে ছেলেটার সাথে তার মিনিট পাঁচেক কথা হয়েছে। পুরোটা সময় ভুলভাল ইংলিশের সাথে ছেলেটা দুর্বোধ্য অদভুত বাংলা বলে গেছে। লুনা কিচ্ছু বুঝে নাই। সে কোনরকমে দেখা করার জায়গা আর সময়টা বলে ফোন কেটে কয়েকবার শিউরে উঠেছে। কি ভয়ানক ভাষারে ভাই!!
আরো মিনিট বিশেক পর ছেলেটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। এই ভয়াবহ গরমে তার পরনে কোট এবং চোখের সানগ্লাসের জন্য তাকে অন্ধের মত লাগছে। লুনার হাসি পেয়ে গেলো। ছেলেটা সম্ভবত লুনার ছবি দেখেই তাকে চিনে ফেললো, হন্দদন্ত হয়ে ছুটে এসে লুনার সামনে বসতে বসতে অদ্ভুত উচ্চারণে "শরি শরি অনেখখন বশিয়ে রাখলাম" বলতে লাগলো।
লুনা হালকা গলায় বললো "নাহ, ঠিকআছে, ঢাকায় অনেক দিন পর তাই জ্যাম সম্পর্কে ধারণা ছিলো না নিশ্চয়ই?"
"ওহ, ইটস লাইখ আ ব্লাডি হেল আউট দেয়ার, ইশটুপিড পিউপল অফ ইশটুপিড খান্ট্রি!!" ছেলেটার মুখ বিকৃত হয়ে গেলো ঘৃণায়। লুনার মনে হলো সামনে সাক্ষাৎ জ্বলন্ত জলিল বসে আছে!! সে কিছু বললো না আর।
ছেলেটা এরপর কিছুক্ষন লুনা কোথায় পড়ে কিসে পড়ে এইসব হাবিজাবি জিজ্ঞেস করলো বাংলা ইংলিশ মিলিয়ে, লুনার মনে হলো আসলে এসব ব্যাপারে তার কোন আগ্রহ নাই। লুনার উত্তর গুলো শুনে শুধু মাথা নাড়ছে আর চোখ দিয়ে তার শরীর মাপছে। হঠাৎ নিতান্তই অপ্রাসংগিক ভাবে বলে উঠলো "আচ্ছা, টুমি বুরখা পড়োনা?"
"কেন?" লুনার ভ্রু কুঁচকে গেলো
"মেয়েডের বুরখা পড়া উচিট"
"তাই?"
" বুরখাটেই মেয়েডের প্রকৃটো সোন্ডর্য" ছেলেটা বিজ্ঞের মত মাথা নাড়লো।
ততক্ষনে ওয়েটাররা খাবার সার্ভ করে গেছে। ছেলেটা সাথে সাথে খাবারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, কড়মড় করে মুরগী চিবুচ্ছে। লুনা কিছুক্ষণ ছেলেটার খাওয়া দেখলো চুপচাপ, তারপর শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো, "আচ্ছা আপনি এত অল্প সময় গ্রীনকার্ড কিভাবে পেলেন?"
ছেলেটা প্রশ্নটা হাত দিয়ে মাছি তারাবার মত করে উড়িয়ে দিয়ে বললো, "আড়ে এইটা টেমন কথিন কিছু না"
"তাও শুনি" লুনা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। ছেলেটা কিছু না বলে চুপচাপ খেতে লাগলো মনোযোগ দিয়ে। লুনা মুখে হাসি নিয়ে বললো, "আমাকে বিয়ে করার আগে আপনি কি আরেকজন আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন?"
প্রশ্নটা ছেলেটার কানের বাইরে কোন অদৃশ্য দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এলো। পুরাই জেনারেল আলাদীন!! প্রশ্নটা শুনেইনি এরকম ভাব করে সে হঠাৎ পানির গ্লাস হাতে নিয়ে ওয়েটারের উদ্দেশ্যে ষাঁড়ের মত চেঁচাতে লাগলো, "ওয়েটার, ওয়েটার এইটা কি ঠান্ডা পানি? এই ব্লাডি ফাকিং ডেশে কি একটা ফ্রিজ নাই?"
লুনার কাছে হঠাৎ মনে হলো এত চমৎকার বিফ চিলি কারি সে আগে কখনো খায়নি। এখানে আবার আসতে হবে তো!!
সেদিন বিকেলে সোবহান সাহেব হুড়মুড় করে মেয়ের রুমে ঢুকলেন। লুনা কানে হেডফোন গুঁজে পা দুলিয়ে দুলিয়ে গল্পের বই পড়ছিলো। সে চমকে উঠে তার বাবার দিকে তাকালো। তার বাবার মুখ লাল টকটকে হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যে কোন মুহুর্তে ঠাস করে ফেটে যাবে।
"তুই ফাহিমকে কি বলেছিস? কি বলেছিস তুই ছেলেটাকে? ছেলের বাবা কেন আমাকে ফোন দিয়ে এত্ত গুলো কথা শুনালেন?" সোবহান সাহেবের গলা শুনে লুনার মনে হলো তার সামনে মানুষের ছাল পড়া একটা বুড়ো বাঘ দাঁড়িয়ে আছে!
"তুমি কথা শুনো কেন?"
"মানে?"
"তুমি জানো তুমি কার বাবা?"
সোবহান সাহেব হকচকিয়ে গেলেন। কি অদ্ভুত টাইপের কথা বলছে মেয়েটা!!
লুনা হঠাৎ গলা চড়িয়ে বললো," তুমি জানো তুমি কার বাবা?"
সোবহান সাহেব রোবটের মত বললেন "আমি কার বাবা?"
"তুমি বাংলাদেশের সবচেয়ে সেরা ভার্সিটির সবচেয়ে টপ সাব্জেক্টের সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করা মেয়েটার বাবা। যাকে কিনা বাঘা বাঘা টিচাররাও সমীহের চোখে দেখেন। মাথায় হাত বুলিয়ে কথা বলেন। যার নাম ভার্সিটির প্রতিটা ছেলেমেয়ে জানে। যে মেয়েটা চাইলেই পাশ করার পর দেশের সেরা প্রতিষ্ঠানটার টিচার হতে পারে, চাইলেই যে কোন দেশে স্কলারশিপ নিয়ে চলে যেতে পারে, চাইলেই যে কোন কোম্পানিতে লক্ষটাকার বেতনে যে কোন পদে ঢুকতে পারে, তুমি সেই মেয়েটার বাবা!! তুমি কেন একটা অশিক্ষিত লম্পট ছেলের বাবার কাছ থেকে কথা শুনবা? একটুও লজ্জা করলোনা তোমার? কেন তুমি তোমার মেয়েটাকে এভাবে #বস্তা বেঁধে অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছো বাবা? কেন তুমি নিজের মেয়েটাকে চিনোনা বাবা?" বলতে বলতে লুনা বসে পড়লো, তার চোখের পানিতে গাল মুখ মাখামাখি হয়ে গেছে।
সোবহান সাহেব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার বুকের ভেতর কেমন জানি একটা কষ্ট মাখানো ভালোলাগা। কষ্টের কারনটা দুর্বোধ্য। সম্ভবত এতদিনের গাম্ভীর্যের উপর তার মেয়ের ভয়ানক আঘাত মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু ভালো লাগার কারণটা পরিষ্কার। সেদিন তিনি তার মেয়েকে চিনেন নি। কিন্তু আজ ঠিকই চিনতে পেরেছেন। এবং তার ভেতর গর্বের একটা অচেনা অনুভুতি বিশাল ঢেউএর মত আছড়ে পড়ছে। লুনাকে অবাক করে দিয়ে সোবহান সাহেব এক পা এগিয়ে গিয়ে মেয়েকে তুলে বুকে জড়িয়ে নিলেন। মেয়েটা একদম ছোট্ট বেলার মত বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে ভেউভেউ করে কান্না করে বাবার পাঞ্জাবিটা চোখের পানি নাকের পানি দিয়ে ভিজিয়ে ফেলতে লাগলো।।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১০:১০