একটা গল্প নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম ছোটবেলায়। গল্পটা ছিল এরকম রাজশাহী’তে এক লোকের মার্ডার হয়েছে। সরকার তাই ঢাকায় ২০ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে তাদের আরজেন্ট মিটিং কল করতে বলল। সবাই তিনদিন মিটিং করে সুরাহা করলে পারল না দেখে আমেরিকায় গেল। ওখানে ১০ দিন তদন্ত কাজ করে শেষে তারা রিপোর্ট দিল ঐটা আসলে সুইসাইড ছিল। উল্লেখ্য, রিপোর্টে ‘রাজশাহী’ শব্দটাই কোথাও ছিল না। ইদানিং এই টাইপ ঘটনায় আশপাশ ভরে যাচ্ছে। আমাদের সমস্যার শেষ নেই, কিন্তু সমস্যার মূল কারণ নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমরা বুঝে না বুঝে কারণ ছাড়াই যার যার মত চিৎকার করতে করতে এক সময় সমস্যাটা থেকেই সরে যাচ্ছি, আর জন্ম দিচ্ছি নতুন নতুন সমস্যার। এ মুহুর্তে এরকম একটি সমস্যা হল টাঙ্গাইলের ধর্ষণের ঘটনাটি। বেশীরভাগই আমরা ঠিক মত জানি না কি হয়েছিল আসলে মেয়েটির সাথে। কিন্তু আমাদের তর্ক এরপরে ও থেমে নেই। আমরা হই হই করেই যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত আমি যাদের দেখেছ তাদের মধ্যে তিন ক্যাটেগরি’র উপরে মেজাজ চরম গরম হচ্ছে। একটু ডেস্ক্রাইব করলাম। তবে পড়ে ভাল না লাগার সম্ভাবনা আছে। কারণ কথাগুলো আপনাদের অনেকের গায়েই লেগে যাবে।
বকধার্মিকঃ ইদানিং সমাজে নতুন এক শ্রেণীর ধার্মিক গোষ্ঠী পয়দা হইছে। তেনারা রাইতের বেলায় ব্রাউজারের এক ট্যাবে ইউটিউওবে জাকির নায়েকের ভিডিও দেখে আর লোডিংযের টাইমে অথবা পজ কইরা কইরা আর এক ট্যাবে ফেইসবুকে মাইয়াগোরে পোক মাইরা আর চ্যাট কইরা টাইম কাটায়। এনাদের আযান পড়লে নামাজের জন্য দশ মিনিট টাইম থাকে না, কিন্তু কেউ ইসলাম নিয়া কিছু কইলে প্রয়োজনে জীবন দিতে প্রস্তুত। রমজান মাসে উপবাস কইরা ও ফার্মগেট কিংবা ধানমন্ডির মোড়ে রিকশায় হুড তুইলা গার্লফ্রেন্ড’রে চুমাইয়া বেড়াইলে ও এদের রোযা ভাঙ্গে না। কারণ এদের দিল পরিষ্কার। যাহোক এনাদের নতুন এডিশন হইল মাইয়া’রা নাকি ইদানিং কাপড় চোপড়ের সাইজ কমাইয়া দিছে। এর লাইগ্যা মাইয়ারা দেদারসে ধর্ষিতা হইতেছে। ১৪৪ ধারা বইলা একটা আইন আছে জানতাম। ঐটা জারি হইলে নাকি পুলিশ বন্দুক উঠাইয়া বইয়া থাকে। রাস্তায় কাউরে পাইলেই নাকি গুলি মারে। আপনেদের দেইখা ও মনে হইতেছে সমাজ রক্ষায় আপনেরা ১৪৪ ধারা জারি কইরা পুরুষাংগ খাড়া কইরা বইয়া আছেন আর বেপর্দা নারী পাইলেই তারে শুট কইরা দিতেছেন। আপনেগো লাইগ্যা ভাই আসলে ভাই শ্রদ্ধা হওয়া উচিত, কিন্তু ক্যান জানি আমার ঘৃণা হয়। আমি সাধারণ মানুষ, ইসলাম সম্পর্কে খুব বেশী জানি না। কিন্তু এটা পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে জানি যে ইসলাম যেমন নারীদের পর্দার আড়ালে যাওয়ার আদেশ দিয়েছে তেমনি পুরুষদের ও দৃষ্টি সংযত রাখতে বলেছে। আর ধর্ষনের শাস্তি হিসেবে মৃত্যু দন্ডের কথা বলেছে। কখনো এক সাইড থেকে কোন হাদীস কিংবা কুরআনের আয়াত নাজিল হয় নি। তাই হুজুগে কিছু বলার আগে একটু ভেবে দেখবেন। শুধু শুধু নিজের মূর্খতার কারণে একটা ধর্মকে হাসির খোরাক বানানোর অধিকার আপনাদের নেই।
ভাবের মুক্তমনাঃ ছোট থেকেই মুক্তমনা শব্দটার প্রতি আমার আলাদা একটা আকর্ষণ ছিল। কারণ মুক্তমনা বলতে বুঝতাম কিছু একপন্থী লোক যারা সকল গোড়ামির বাইরে সবার জন্য চিন্তা করবে। তাদের চিন্তা ভাবনা হবে বৈশ্বিক। তারা কোনো জাতির জন্য চিন্তা করবে না, কোন নির্দিষ্ট গোত্রের জন্য চিন্তা করবে না। তাদের চিন্তার একটাই বিষয় হবে সেটা হবে মানব ধর্ম। কিন্তু এই মুহুর্তে অনলাইন এবং অফলাইনে কিছু নও মুক্তমনাদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছি। এদের বেশীরভাগই আসলে মুক্তমনা না। শুধুমাত্র ফ্যাশন করার জন্য নামটা ব্যবহার করে। এদের কাজই হচ্ছে সবকিছু নিয়া উলটা নাচানো। নিজেদের অসাম্প্রদায়িক দাবি করতে করতে কখন যে নিজেরাই একটা আলাদা সম্প্রদায় তৈরী করে ফেলেছে এরা নিজেরাই জানে না। মুক্তমনার যে আসল কন্সেপ্ট সেটাও এরা প্রায় ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে। তবে এ মুহুর্তে ধর্ষণ সমস্যার একটা ভাল সমাধান দিচ্ছে এরা। এদের মতে নারীদেরও নাকি পুরুষদের উপরে ঝাপিয়ে পড়া উচিত, পুরুষ’কে ধর্ষণ করা উচিত। হায়রে মুর্খের জাত। কথা তো ছিল ধর্ষণ বন্ধ করা। আপনারা তো দেখা যাচ্ছে আরো উৎসাহিত করছেন। একবার ভাবুন তো আপনার সামনে আপনার বোন আপনার’ই কোনো বন্ধুর উপরে ঝাপিয়ে পড়ছে ধর্ষণ করার জন্য। কেমন লাগবে তখন? নাকি নিজের মা’কে পাশের বাড়ির আঙ্কেলের উপরে শুয়ে থাকতে দেখার অনেক শখ। যাহোক ধর্ষণ একটি জাতীয় সমস্যা। তাই এটা নিয়ে ভায়োলেন্সে না গিয়ে আমার মনে হয় এর মূল কারণগুলো চিন্তা করা উচিত। তাহলেই এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
মেয়েদের পোষা কুত্তাঃ এবার কিছু নির্লজ্জ বাষ্টার্ডের কথায় আসা যাক। এরা হল পুরুষ সমাজের রাজাকার। নারীদের কাছে হিরো হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় নিবেদিতপ্রাণ কিছু জ্ঞানহীন বাষ্টার্ডের সম্মিলনে এই গোত্রের আবির্ভাব। নারীদের কাছে তারা হিরো হোক আর যাই হোক প্রয়োজনে সানি লিওনের কোলে উইঠা গিয়া বইসা থাকুক তাতে কারো কিছু আসে যায় না। কিন্তু এদের সমস্যা হল মাইয়াগোরে চাটার মাধ্যম হিসেবে এরা সব সময় ছেলেদের ব্যবহার করে। যেমনঃ এই মুহুর্তে এরা বলে বেড়াচ্ছে টাঙ্গাইলের ধর্ষণের ঘটনায় নাকি পুরা পুরুষ জাতি কলঙ্কিত। আকাম করছে দশজন আর তাই বইলা নাকি কলঙ্কিত ৩০০ কোটি পুরুষ। গত সপ্তাহে আমার এক বন্ধু আসাদ গেটে ঠ্যাক খাইয়া মোবাইল মানিব্যাগ সব’ই হারাইছে। যতদূর শুনলাম ঠ্যাক বাবাজি তারে শুদ্ধ বাংলা ভাষায় বলছে, “যা আছে সব দিয়া ফুট এইখান থেকে”। তাহলে আপনাদের কথা অনুযায়ী তো পুরা বাংগালি জাতি কলঙ্কিত; কলঙ্কিত আসাদ, জব্বার, শফিউর; কলঙ্কিত আমাদের ভাষা আন্দোলন সর্বোপরি সমগ্র বাংলাদেশ। তাই তো হওয়ার কথা, তাই না? কিন্তু কেউ কি নিবেন এই দায়বদ্ধতা। সবচেয়ে বড় কথা আসলেই কি তাই? একটা কথা মনে রাখবেন। ধর্ষণ কিংবা ইভ টিজিং অপরাধীর কোন লিংগভেদ নেই। এদের একটাই পরিচয়, এরা সমাজের কিট। এদের তাড়াতে হবে এবং নারী পুরুষ সবাই এক হয়েই তাড়াতে হবে। আরো একটা ঘটনা বলে রাখি প্রথম আলোর [লিঙ্কঃ http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-01-03/news/318371] যে খবর নিয়ে এত তোলপাড়, সেটা যদি ভাল করে পড়েন তাহলে দেখবেন গুন্ডারা তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে কিংবা বাগে পেয়ে ধর্ষণ করেনি। বরং মেয়েটির’ই এক বান্ধবী তাকে ছলচাতুরি করে গুন্ডাদের হাতে তুলে দিয়েছিল। তাই এই পৃথিবীর সকল পুরুষদের দোষারোপ করার আগে এটাও চিন্তা করবেন মেয়েরা ও মেয়ে হয়ে অন্য মেয়েকে পশুদের হাতে তুলে দিচ্ছে। তাই মেয়েদের কাছে হিরো হওয়ার জন্য লজিকের উপরে থাকার চেষ্টা করবেন। মনে রাখবেন লজিক ছাড়া চাটুকারদের সীমা ঐ পা চাটা পর্যন্তই। এর উপরে উঠতে যোগ্যতা লাগে।
লেখকের অভিমত
আমি যখন এই লেখাটি লিখছি তখন মেয়েটি হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছে। আমরা কি কেউ মেয়েটির নাম জানি? সত্যি বলতে আমি নিজে ও জানি না। আসলে জানার সময় কোথায়? আমরা তো নিজেদের তর্কেই বাঁচি না। মেয়েটির হয়ত রক্তের দরকার হতে পারত, কিছু টাকার দরকার ছিল এগুলো নিয়ে ভাবার সময় ও তো নেই। পেপারে দেখলাম রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের কাছ থেকে কিছু সাহায্য গেছে। যাহোক এটা একটা ভাল খবর। কিন্তু এটা তো আপাতত। এরপরে যখন মেয়েটি সুস্থ্য হয়ে যখন ঘরে ফিরবে আমরা কি তাকে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার কথা একবার ও ভেবেছি। আসলে সে সময় ও আমাদের নেই। আমাদের সময় আছে শুধু বৃথা তর্ক করার। তাও যুক্তি তর্ক না। আমার কাছে যা মনে হয় আসলে আমাদের যান্ত্রির জীবনে এগুলো বিনা পয়সার বিনোদনের খোরাক।
ধর্ষণ সমস্যা রোধে আমার মনে হয় তিনটি বিষয় নিশ্চিত করা দরকার। এছাড়া ও আরো অনেক কিছু খেয়াল করতে হবে। তবে আপাতত তিনটির কথাই লিখছি।
প্রথমত, অবশ্যই নারী পুরুষের মধ্যে শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। উপরের ক্যাটেগরির সমাধানগুলোর প্রায় সব গুলোই নারী পুরুষের মধ্যে শ্রদ্ধাহীন সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করে। এসব ব্যাপারে সামাজিক সংগঠন এবং আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।
দ্বিতীয়ত, স্বজনপ্রীতি আর লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির যে ব্যাপারটা থাকে যেকোনো কিছুতে সেটা অবশ্যই সমাজ থেকে দূর করতে হবে।
তৃতীয়ত, অবশ্যই দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা লাগবে। আমাদের দেশের ঢিলা আইন ব্যবস্থার কারণে বেশীরভাগ কেসের’ই রায় হয় না। ধর্ষণের ক্ষেত্রে যাতে অন্তত তেমন কিছু না হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে।
সর্বোপরি যেটা বলব, উপরের তিন ক্যাটাগরির সংখ্যা কম। কিন্তু এরপরে ও আমরা যারা আছি নিজেদের কথা চিন্তা করে এসবে আসতে চাই না। আমরা ভয় পাই, ভাবি একটু পাশ কাটিয়ে গেলে হয়ত নির্ঝন্ধাটে থাকা যাবে। কিন্তু আমরা এটা ভাবি না হয়ত একদিন আমাদের পালা ও আসবে। তাই নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে চাইলেও এক সময় হয়ত আমরাই এর শিকার হব। তাই সময় হয়েছে রুখে দাঁড়ানোর আর জোর গলায় বলার, “আর নয় ধর্ষণ, ধর্ষকদের বিচার চাই”।
***এখানে ধার্মিক কিংবা মুক্তমনাদের ছোট করে কিছু বলা হয় নি। কিছু জ্ঞানহীন মূর্খের ধার্মিক এবং মুক্তমনা পরিচয়ে অর্থহীন প্রচারণাকে হেয় করা হয়েছে মাত্র।***
পূর্বপ্রকাশিতঃ একজন ধর্ষিতা ও একদল বাষ্টার্ডের গল্প
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ৯:০৯