আজ আকাশটা অন্য দিনের চেয়ে একটু বেশী নীল। তার মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছে পরিস্কার সাদা মেঘ। অবাক হয়ে আকাশটাকে দেখছে আসিফ। পড়নে আকাশের মতই নীল পাঞ্জাবি। আসিফ আকাশ দেখছে আর অবাক হয়ে ভাবছে, বর্ষার আকাশ তো সাধারণত এমন হয় না। বর্ষা মানেই মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, সব সময় বৃষ্টি আসবে আসবে এমন একটা ভাব। কিন্তু কই?? তেমন কিছুই তো আজ চোখে পড়ছে না। ছোট সময় একবার গল্পের ছলে মা বলেছিল, “আকাশের মেঘেরা নাকি পরীদের হাসির অপেক্ষা করে, যখন সবচেয়ে সুন্দরী পরীটা নিস্পাপ হাসি হাসে তখনই নাকি খালি মেঘগুলো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে।” আজ কি তাহলে আকাশের সবচেয়ে সুন্দর পরীর মন খারাপ?? নাকি আকাশের পরী আকাশেই নেই, পৃথিবীতে চলে এসেছে।
হঠাৎ পাশ থেকে কে যেন খোঁচা দিল। অন্যমনস্ক অবস্থায় তাকিয়ে হঠাৎ রিন্তির হাস্যোজ্জল মুখটি দেখে মনটা ভাল হয়ে গেল। ধবধবে সাদা সালোয়ার কামিজ, সুন্দর করে খোপা করা চুল, কপালে ছোট্ট একটি টিপ আর মুখে লাস্যময়ী হাসি। বরাবরের মতই দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে। অবশ্য না হাসলেও ওকে দেখতে অনেক ভাল লাগে। রিন্তিকে দেখলেই কেন জানি মা’র কাছে শোনা সবচেয়ে সুন্দরী পরীটার কথা মনে পড়ে যায়। মনে হয়, এই বুঝি ঝুম করে বৃষ্টি নামল। নীল পাঞ্জাবিতে আসিফ আর সাদা কামিজে রিন্তিকে দূর থেকে দেখলে যে কেউ মনে করবে আকাশ আর মেঘ মর্ত্যে নেমে এসে পাশাপাশি বসে আছে।
আসিফঃ কি ব্যাপার, মেঘের মত এত সাদা কাপড়ের রহস্য কি?
রিন্তিঃ সাদা আমার প্রিয় রঙ, জানো না?
আসিফঃ ওহহ….তাই তো। শোনো, তোমার হাসির জন্য মেঘেরা ভীড় করে বসে আছে। একটু হাসো, মেঘেরা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ুক।
রিন্তিঃ তোমার কাছে আসলেই খালি দুনিয়ার সব আজগুবি কথাগুলো শোনা লাগে। এগুলো আমাকে বল ঠিক আছে, কিন্তু আর কাউকে বলো না। শেষে লোকে তোমাকে পাগল ভাববে।
আসিফঃ ভাবলে ভাবুক। তবু আমি বলব, তুমি হাসলেই বৃষ্টি পড়ে।
রিন্তিঃ আমি তো সবসময়ই হাসি। তোমার কথা যদি সত্যি হত তাহলে তো বৃষ্টি কখনোই থামত না, সারাদিন খালি বৃষ্টিই পড়ত।
আসিফঃ সব হাসিতো এক না। যে হাসি মনের ভেতর থেকে আসে, যে হাসিতে কোন কষ্ট থাকে না, যে হাসিতে ভালবাসা মেশানো থাকে তোমার সে হাসিই শুধু বৃষ্টি নামাতে পারে।
রিন্তিঃ থাক হইছে, এইসব ভালবাসা টালবাসা আমার মধ্যে কাজ করে না। জীবনে অনেকবার এসব শুনেছি, আর দরকার নেই। নতুন কিছু থাকলে বল।
আসিফঃ মন থেকে উঠে আসা নিস্কলুষ নিস্পাপ হাসিটাতো তোমার আছে, তাই না?? ভালবাসাটা নাহয় আমিই দিলাম।
রিন্তিঃ তোমার কাছ থেকে ভালবাসা নিব ক্যান? আমি ধার করা পছন্দ করি না। আমি এমনি হাসব, বৃষ্টি আসলে আসবে না আসলে নাই।
আসিফ(কিছুক্ষণ চুপ থেকে আস্তে আস্তে)ঃ রিন্তি আমার দিকে তাকাও। এবার হাসো, যে হাসিটা আসলেই তোমার, যেখানে কষ্ট নেই, যে হাসি নিস্পাপ নিস্কলুষ। সে হাসিতে আমি মিশিয়ে দিব ভালবাসা। এ ভালবাসা ধার করা ভালবাসা নয়। এ ভালবাসা তোমারই, আমি শুধু এতদিন তোমার জন্য যত্ন করে মনের কোণে রেখে দিয়েছিলাম। আজ সেই হাসির শব্দে মেঘগুলোকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দাও, নেমে আসুক ভালবাসার বৃষ্টি। যে বৃষ্টিতে হাত ধরে ভিজব তুমি, আমি; ভিজবে সারা পৃথিবী।
**********
যদিও বৃষ্টিটা অনেক ভাল লাগছে, তবু শ্রাবন্তী ভীষণ বিরক্ত। অফিস থেকে ফেরার পথে এরকম বৃষ্টিতে আটকে থাকা বিরক্তিকর। তবে আপাতত সেদিকে খেয়াল নেই শ্রাবন্তীর। অনেকক্ষণ ধরেই তার দৃষ্টি বাস স্টপের ওপারে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিজতে থাকা নীল পাঞ্জাবি পড়া লোকটার দিকে। লোকটা পাশে তাকিয়ে নিজে নিজেই বিড়বিড় করে কি জানি বলছে, মন খুলে হাসছে। মনে হচ্ছে যেন অদৃশ্য কেউ তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হাতটা এমনভাবে বাড়ানো দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন খুব যত্ন করে কারও হাত ধরে আছে? “লোকটা কি পাগল নাকি?”, মনে মনে ভাবল সে। ভাবতে ভাবতেই বাস চলে এল। তাড়াতাড়ি বাসে উঠে গেল শ্রাবন্তী। বাস্তবতার ব্যস্ততায় ভুলে গেল রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা পাগল মানুষটার কথা। বাস চলা শুরু করল। জানালা দিয়ে বাইরে হাত বাড়িয়ে দিল সে। হঠাৎ বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগল মুখে। একই সাথে অবাক ও বিস্মিত হল। কি ব্যাপার, আজ বৃষ্টির পানি নোনা কেন? বাসে বসে সারাকক্ষণ চিন্তা করেও এর প্রশ্নের উত্তর বের করতে পারল না। পারার কথাও না। কারণ, এ প্রশ্নের উত্তর শুধু একজন মানুষের কাছেই আছে, যে ওই বাস স্টপের উল্টা পাশের রাস্তাতে এখনো দাঁড়িয়ে আছে, তার না পাওয়া স্বপ্নটাকে সাথে নিয়ে।
পূর্ব প্রকাশিতঃ বৃষ্টি ও ভালবাসার গল্প
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১২ দুপুর ২:৪৬