৬৫৬ সালের ১৭ জুন তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। উমাইয়া খলিফা হযরত উসমানের হত্যাকাণ্ডের পর অধিকাংশ বিদ্রোহী ও মদিনাবাসীর সমর্থন নিয়ে হাশেমী গোত্রীয় নেতা হযরত আলী খলিফা নির্বাচিত হন। কুফার বিদ্রোহী নেতা মালিক আশতার বিদ্রোহীদের মধ্যে হযরত আলীর পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে জোরাল ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ‘হুব্বে আলী’ বা ‘আলী প্রেমে’ বিশ্বাসী ছিলেন।
মালিক আশতারের মতো বিদ্রোহীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই মহানবীর পর হযরত আলীর আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব বা ইমামতিতে বিশ্বাস করত। তারা মনে করতো যে, হযরত আলীই ছিলেন মহানবীর ন্যায্য উত্তরাধিকারী; অথচ তাকে বাদ দিয়ে এ পর্যন্ত তিনজনকে খলিফা বানানো হয়েছে। তাই তারা হযরত উসমানকে উৎখাতের পর হযরত আলীকে খলিফা বানানোর ব্যাপারে বেশ উৎসাহী হয়ে ওঠে।
৬৫৬ সালের ২৩ জুন হযরত আলী এদের সবার কাছ থেকে খলিফা হিসেবে আনুগত্যের শপথ (বাইআত) গ্রহণ করেন। সর্বপ্রথম হযরত আলীর হাতে বাইআত করেন মালিক আশতার। এরপর একে একে অন্য সবার কাছ থেকে বাইআত গ্রহণ করেন। এভাবে বাইআত গ্রহণের প্রাথমিক পর্ব শেষ হলে হযরত আলী অন্য দুই বিশিষ্ট সাহাবী হযরত তালহা বিন উবাইদুল্লাহ ও হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়ামের বাইআত গ্রহণের গুরুত্ব অনুভব করলেন।
হযরত উসমানের পর এ দুজন সাহাবীও সম্ভাব্য খলিফা ছিলেন। কিন্তু হযরত আলীর তুলনায় তাদের সমর্থকের সংখ্যা ছিল কম। মহানবীর মৃত্যুর পর থেকেই হযরত আলী, তালহা ও যুবাইর একই রাজনৈতিক বলয়ে অবস্থান করছিলেন। মহানবীর মৃত্যুর পর খিলাফতের দাবী নিয়ে যে তিনটি পৃথক রাজনৈতিক পক্ষের উদ্ভব হয়েছিল তার একটি পক্ষে ছিলেন এ তিন সাহাবী। তখন তাদের পক্ষ থেকে হযরত আলীকেই খলিফা পদের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল।
পরবর্তীতে তিন খলিফার যুগে এ তিন বিখ্যাত সাহাবীকে খিলাফতের তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যায়নি। কেবল হযরত আবু বকরের সময়ে স্বঘোষিত নবী তোলায়হার বিরুদ্ধে একটি অভিযানে তাদেরকে পাঠানো হয়েছিল। এছাড়া আর কোন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অভিযানে তাদেরকে পাঠানো হয়নি। পারস্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য বিজয়ে তাদের কোন ভূমিকা ছিল না। তাই তারা কোন প্রদেশের শাসনকর্তাও হননি।
যদিও মহানবীর যুগে এ তিন সাহাবীকে খুবই বড় মাপের নেতা ও বীরযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হতো তবুও তিন খলিফার যুগে তারা অনেকটা নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলেন। হযরত উসমানের পতনের পটভূমিতে তারা আবার রাজনৈতিক ময়দানে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু তখন তারা আর পরস্পরের রাজনৈতিক মিত্র না থেকে পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। তাই হযরত আলী অন্য দুজন সাহাবীর সমর্থন ছাড়া খলিফা পদটিকে প্রতিদ্বন্দ্বীতামুক্ত মনে করলেন না।
তিনি বিদ্রোহী ও জনসাধারণের কাছ থেকে বাইআত গ্রহণ করেও খলিফা পদের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। সর্বসাধারণের বাইআতের পর মালিক আশতার পালাক্রমে হযরত তালহা ও যুবাইরের কাছে গেলেন এবং তাদেরকে জোরপূর্বক হযরত আলীর সামনে এনে হাজির করলেন। হযরত আলী তাদেরকে সৌজন্যতা দেখিয়ে বললেন যে, যদি তাদের কেউ খলিফা হতে চান তাহলে তিনি তাঁর জন্য খলিফা পদ ছেড়ে দিতে রাজী আছেন।
কিন্তু তালহা ও যুবাইর কোন সাঁড়া দিলেন না। এবার তাদেরকে বলা হল তারা যেন হযরত আলীর হাতে বাইআত করেন। কিন্তু তারা বাইআত না করে চুপচাপ বসে থাকলেন। এ সময় মালিক আশতার হঠাৎ করে খাপ থেকে তরবারি বের হযরত তালহার সামনে দাঁড়ালেন এবং বললেন, “যদি তুমি বাইআত না কর তাহলে এখনই তোমাকে শেষ করে ফেলব।”
হযরত তালহা পরিস্থিতি লক্ষ্য করে হযরত আলীকে বললেন যে, যদি হযরত আলী উসমান হত্যাকারিদের শাস্তি প্রদানের নিশ্চয়তা দেন তাহলে তিনি বাইআত করতে রাজী আছেন। হযরত আলী এ শর্ত মেনে নিলেন। হযরত তালহা তখন বাইআতের জন্য তাঁর দুর্বল হাতটি বাড়িয়ে দিলেন। উহুদ যুদ্ধে এ হাতটি ভীষনভাবে আহত হয়েছিল। হযরত তালহার আহত হাতে বাইআত করার দৃশ্য দেখে তখন উপস্থিত অনেকে এটিকে হযরত আলীর খিলাফতের জন্য একটি অশুভ সংকেত বলে বিবেচনা করেন। পরবর্তীতে এ আশংকা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল।
হযরত তালহার পর হযরত যুবাইরের সাথেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। তিনিও হযরত উসমান হত্যাকারিদের শাস্তির শর্তে আলীর হাতে বাইআত করলেন। এরপর হযরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসকে বাইআত করতে বলা হলে তিনি বললেন যে, তিনি সবার পরে বাইআত করবেন। তাঁর সাথে আর কোন জোরাজুরি হল না। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমারের বাইআত নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার পর মালিক আশতার তরবারি বের করে বলেলেন, “আমি তাকে হত্যা করব।”
হযরত আলী মালিক আশতারকে থামিয়ে দিয়ে বললেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উমারের পক্ষ থেকে কোন চক্রান্তের সম্ভাবনা নেই। এরপর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার উমরা হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় রওনা হন। তখন চারদিকে রটে গেল যে, তিনি হযরত আলীর বিরুদ্ধে মক্কার লোকজনকে সংঘটিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই মদিনা ছেড়েছেন। ফলে হযরত আলী তাকে অবিলম্বে বন্দী করার উদ্দেশ্যে লোক পাঠিয়ে দেন।
সে মুহুর্তে হযরত উমারের স্ত্রী হযরত আলীকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন যে, আব্দুল্লাহ আলীর বিরুদ্ধে কিছুই করবেন না। ফলে হযরত আলী আশ্বস্ত হন। তবে আব্দুল্লাহ ছাড়াও মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাহ, উসামা ইবনে শুবাহ, আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম প্রমুখ বিশিষ্ট সাহাবীরাও হযরত আলীর হাতে বাইআত করেননি। আরও অনেক সাধারণ মানুষও তাঁর হাতে বাইআত করেনি। বানি উমাইয়া অর্থাৎ উমাইয়া বংশের লোকজন হযরত আলীর হাতে বাইআত না করে মদিনা থেকে সিরিয়ায় পালিয়ে যেতে থাকে।
কেউ কেউ মক্কায়ও পালিয়ে যায়। যেসব সাহসী সাহাবী হযরত আলীর হাতে বাইআত না করে মদিনাতেই অবস্থান করছিলেন তারা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেন যে, হযরত আলীর খলিফা হওয়ার ঘটনায় মুসলমানদের মধ্যে যথেষ্ট রক্তারক্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। তাই তারা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকতে চান। হযরত আলীর হাতে বাইআতের পরদিন হযরত তালহা ও যুবাইর তাঁর সাথে দেখা করলেন।
তারা তাকে জানালেন যে, যদি তিনি উসমান হত্যাকারিদের শাস্তির ব্যবস্থা না করেন তাহলে তাদের বাইআত অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে। হযরত আলী এ কাজের জন্য আরও কিছুটা সময় চাইলেন। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে কানুঘাষা শুরু হয়ে গেল। হযরত আলীর খিলাফতের বিপদেরও সূচনা সেখান থেকেই। উমাইয়াদের সাথে সরাসরি শত্রুতা নেই এমন সব লোকজন হযরত আলীকে এ কারণেই বাইআত দিয়েছিল যে, তিনি হাশেমী হলেও অন্ততপক্ষে উসমান হত্যার বিচারটুকু করবেন।
কিন্তু হযরত আলীর সময়ক্ষেপণের ইচ্ছা দেখে তাদের এ বিশ্বাসে চিড় ধরে। উমাইয়া ও হাশেমীদের বাইরে অনেক নিরপেক্ষ গোত্রের এমন অনেক লোকজন ছিল যারা উমাইয়া-হাশেমী দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষ থাকলেও উমাইয়া খলিফা হযরত উসমানের হত্যাকাণ্ডকে মোটেও পছন্দ করেনি। আবার খলিফা উসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময়ে এদের অনেকেই বিদ্রোহীদেরকে মৌনসমর্থন দিয়েছিল এ কারণেই যে, তারা উমাইয়া বংশের লোকজনদের ক্ষমতা ও আধিপত্য পছন্দ করত না।
কিন্তু হযরত উসমানের পর বিদ্রোহীদের আধিপত্যও তাদেরকে বিরক্ত করে তোলে। উমাইয়া হোক অথবা হাশেমী হোক কিংবা অন্য যে কেউই হোক- কারও রাষ্ট্রবাদী আধিপত্য তাদের গোত্রীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী ছিল। তাই উমাইয়াদের বিপরীতে হাশেমী খলিফা হযরত আলীকে সমর্থন দিলেও তারা বিদ্রোহীদের আধিপত্য মেনে নিতে চায়নি। হযরত আলীর সাথে বিদ্রোহীদের এতো উঠাবসা তারা পছন্দ করেনি।
খিলাফতের তৃতীয় দিনে হযরত আলী বিদ্রোহীদেরকে নিজ নিজ এলাকায় চলে যেতে বলেন। কিন্তু কিছু বিদ্রোহী মদিনায় থেকে গেল। এসব বিদ্রোহীরা মদিনায় থেকে গিয়েছিল সম্ভবত এ কারণেই যে, তারা হযরত উসমান হত্যার বিচার যাতে কোন ভাবেই না হয় সে বিষয়টিকে নিশ্চিত করেই মদিনা ত্যাগ করতে চেয়েছিল। খিলাফতের তৃতীয় দিনে হযরত আলী আরেকটি কঠোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
তিনি হযরত তালহা ও যুবাইরে উপর মদিনার বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন। খিলাফতের চতুর্থ দিনে হযরত আলী হযরত উসমান কর্তৃক নিযুক্ত সকল গভর্নর, কর্মকর্তা ও প্রশাসককে পদচ্যুত করে একটি লিখিত আদেশ জারি করলেন। কিছু প্রদেশে এ আদেশটি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সিরিয়ার মতো এলাকায় এ আদেশ কীভাবে কার্যকর হবে সে প্রশ্নটিও উত্থাপিত হলো।
এ প্রশ্নের জবাবে হযরত আলী বললেন, “মুয়াবিয়াকে আমি তলোয়ারের আঘাতেই শায়েস্ত করব।” কিন্তু মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে হুট করে কোন কিছু করার সামর্থ তাঁর ছিল না। তাই অন্যান্য প্রদেশের মতো সিরিয়াতেও একজন গভর্নর পাঠিয়ে তিনি সিরিয়ার প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইলেন। সুহায়েল ইবনে হানিফকে তিনি সিরিয়ার গভর্নর নিযুক্ত করে পাঠালেন। কিন্তু সুহায়েল তাবুক অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে পুনরায় মদিনায় ফেরত চলে আসলেন।
তাবুক পৌঁছে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, হযরত উসমান ছাড়া অন্য কারও নিযুক্ত গভর্নর সিরিয়ায় পৌঁছালে তাঁর প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা অসম্ভব। তাই তিনি মদিনায় ফিরে আসেন। কুফায় প্রেরিত হযরত আলীর গভর্নর আম্মারা ইবনে শিহাবও মদিনায় ফিরে আসলেন। বসরায় প্রেরিত উসমান ইবনে হানিফ এবং মিশরে প্রেরিত কায়েস ইবনে সাদ স্ব স্ব প্রদেশের আংশিক লোকের আনুগত্য অর্জনে সক্ষম হন এবং সীমিত ক্ষমতা নিয়েই মসনদে বসেন।
মিশরের উমাইয়া বিরোধী লোকজন কায়েসের আনুগত্য স্বীকার করলেও বাকীরা মদিনা থেকে বিদ্রোহীরা না ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইয়েমেন ছিল হযরত আলীর সবচেয়ে অনুগত এলাকা। সেখানে প্রেরিত হযরত আলীর গভর্নর উবাইদুল্লাহ বিন আব্বাস নির্বিঘ্নে তাঁর নিজের হাতে শাসনভার তুলে নেন এবং আগের শাসনকর্তা মক্কায় চলে আসেন। পরবর্তীতে তিনি মক্কায় জড়ো হওয়া হযরত আলীর প্রতিপক্ষের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন।
সিরিয়া ও কুফায় নতুন গভর্নর পাঠাতে ব্যর্থ হয়ে হযরত আলী ও এ দু’প্রদেশের ক্ষমতাসীন গভর্নরদের কাছে আনুগত্যের শপথ চেয়ে পত্র পাঠালেন। কুফার গভর্নর আবু মুসা আশআরী খলিফার পত্রের একটি সদুত্তর পাঠালেন। তিনি খলিফাকে জানালেন যে, কুফার অধিকাংশ লোক তাঁর অত্যন্ত অনুগত। বিদ্রোহী স্বভাবের কুফাবাসীরা তাকে যেভাবে সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করেছে সেভাবে হযরত আলীর নতুন কোন গভর্নরকে গ্রহণ না-ও করতে পারে।
তাই খলিফার অনুগত শাসনকর্তা হিসেবে তিনিই সেখানকার গভর্নর থাকতে চান। হযরত আলী তাঁর আনুগত্যে খুশী হয়ে তাকেই কুফার গভর্নর হিসেবে রেখে দিলেন। কিন্তু সিরিয়া নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হল। দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও সিরিয়ায় পাঠানো পত্রের কোন উত্তর আসছিল না। সিরিয়ায় প্রেরিত দূতকে হযরত মুয়াবিয়া মাসের পর মাস অপেক্ষায় রেখে দিলেন।
তিন মাস পার হয়ে গেলে তিনি দূত মারফৎ এক অদ্ভুত উত্তর পাঠালেন। তাঁর সেই উত্তরপত্র ছিল একটি শূন্য চিঠি। এতে কোন লেখা ছিল না। এ চিঠি দ্বারা তিনি হয়ত বুঝিয়েছিলেন যে, সিরিয়ার দিকে হাত বাড়ালে হযরত আলীকে খালি হাতেই ফিরতে হবে এবং হযরত আলীকে দেওয়ার মতো কোন কিছু মুয়াবিয়ার কাছে নেই। পত্রবাহকের কাছ থেকে হযরত আলী আরও জানতে পারলেন যে, খলিফা উসমানের রক্তমাখা জামা এবং খলিফা পত্নী নায়লার কর্তিত আঙ্গুলী একজন মদিনাবাসীর মাধ্যমে গোপনে সিরিয়ায় পৌঁছেছে।
সেগুলো দামেস্কের মসজিদে প্রদর্শিত হচ্ছে। ষাট হাজার সৈন্য হযরত উসমানের জামার পাশে প্রতিদিন অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে এবং তারা হযরত আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দামেস্কের মসজিদের মিম্বরে রাখা হযরত উসমানের জামা দেখে সেখানকার জনগণ এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। হযরত আলী এ সংবাদ শুনার পর সবাইকে সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন।
হযরত তালহা ও যুবাইর হযরত আলীর এ সিদ্ধান্তের কথা শুনে তাঁর সাথে দেখা করলেন এবং উমরা পালনের জন্য মক্কায় চলে যেতে চাইলেন। হযরত আলী তাদেরকে নজরবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে মক্কায় যাওয়ার অনুমতি দিলেন। এরপর তিনি একটি সাধারণ ঘোষণার মাধ্যমে মদিনার সবাইকে অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র নিয়ে প্রস্তুত হতে বললেন। একই সাথে কুফা, বসরা ও মিশরের গভর্নরদের কাছে পত্র লিখে তাদেরকেও সৈন্য সংগ্রহের আদেশ দিলেন।
এভাবে হযরত আলী যখন সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি প্রায় গুছিয়ে এনেছেন তখনই খবর এল যে, মক্কায় তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি চলছে। ফলে হযরত আলী সিরিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান আপাতত মূলতবী রাখলেন। মদিনা থেকে বানি উমাইয়ার যেসব লোকজন মক্কায় পালিয়ে গিয়েছিল তারা হযরত উসমান হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। হযরত উসমান কর্তৃক নিযুক্ত মক্কার গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে হাযরামীর নেতৃত্বে তারা সেখানে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
হযরত আলী কর্তৃক পদচ্যুত বসরার গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে আমির এবং ইয়েমেনের গভর্নর ইয়ালা ইবনে মুনাব্বিহ মক্কায় এসে এদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হল, এদের সবার ওপরে নেতৃত্বের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন হযরত আবু বকরের কন্যা ও মহানবীর সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী হযরত আয়িশা সিদ্দীকা। হযরত আয়িশা সর্বপ্রথম উসমান হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
বিদ্রোহীদের হাতে মদিনার পতনের পর তিনি উমরা পালনের জন্য মক্কায় চলে যান। সেখান থেকে মদিনায় ফেরার পথে সারিফ নামক স্থানে পৌঁছার পর তিনি হযরত উসমান হত্যার সংবাদ পান। একই সাথে তিনি এটিও জানতে পারেন যে, হযরত উসমানের হত্যাকারিরা মদিনায় বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব সংবাদ শুনার পর তিনি উসমান হত্যার প্রতিশোধের সংকল্প নিয়ে সেখান থেকে পুনরায় মক্কায় চলে যান।
মক্কায় পৌঁছে তিনি সমবেত মানুষের সামনে হযরত উসমান হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে এক ভাষণ দেন। হযরত আয়িশার এ ভাষণের পরই উসমান হত্যার প্রতিশোধকামীরা মক্কার গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে হাযরামীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। বসরা ও ইয়েমেনের পদচ্যুত গভর্নরদের যোগদানের ফলে এ দলটি আরও ভারী হয়ে উঠেছিল। তবে দলটির মুখপাত্র ও প্রধান নেতা হিসেবে হযরত আয়িশাকেই সবাই মেনে নিয়েছিল। তিনিই মক্কার প্রতিশোধকামী দলটির নীতি নির্ধারকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন।
এরই মধ্যে মদিনা থেকে হযরত তালহা ও যুবাইর মক্কায় এসে পৌঁছেন। তারা হযরত আয়িশাকে জানালেন যে, বিদ্রোহীদের ভয়েই তারা মদিনা থেকে পালিয়ে এসেছেন। সেই সাথে তারা একথাও জানালেন যে, হযরত আয়িশার নেতৃত্বে তারা হযরত আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। মক্কার প্রতিশোধকামী দলটিতে হযরত তালহা ও যুবাইরের মতো সাহাবীদের যোগদানের ফলে এ দলটি আর তুচ্ছ রইল না। দলটির মূল নেতৃত্ব হযরত আয়িশার হাতেই থাকল।
হযরত আয়িশার অধীনে হযরত তালহা, হযরত যুবাইর, বসরার প্রাক্তন গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে আমীর এবং ইয়েমেনের প্রাক্তন গভর্নর ইয়ালা ইবনে মুনাব্বিহ এ দলটির সামরিক উপদেষ্টা ও অধিনায়ক নিযুক্ত হলেন। এ চারজন সেনাপতি শীঘ্রই একটি ছোটখাট সেনাবাহিনী গড়ে তোললেন। হযরত আলীর বাহিনী মক্কায় এসে হামলা চালালে তা প্রতিরোধের মতো শক্তি এ বাহিনীর ছিল না। তাই কেউ কেউ পরামর্শ দিল এ বাহিনী নিয়ে সিরিয়ায় চলে যাওয়া উচিত।
কিন্তু সিরিয়ার সাথে হযরত তালহা ও যুবাইরের তখনকার রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল অস্পষ্ট। এছাড়াও মদিনাকে পাশ কাটিয়ে মক্কা থেকে সিরিয়ায় চলে যাওয়া অসম্ভব ছিল। সর্বোপরি যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটি হল, সিরিয়ার রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে হযরত তালহা ও যুবাইরের রাজনৈতিক স্বার্থের দূরত্ব ছিল স্পষ্ট। হযরত তালহা ও যুবাইর কখনো মুয়াবিয়াকে খলিফা বানানোর কথা বলেননি। তারা নিজেদেরকে খলিফা পদের যোগ্য মনে করতেন।
সিরিয়ার জন্য মুয়াবিয়ার নিজের বাহিনীই ছিল যথেষ্ট এবং হযরত তালহা ও যুবাইরের মতো অস্পষ্ট মিত্রদের নিয়ে তাঁর তেমন কোন করণীয়ও ছিল না। তাই সিদ্ধান্ত হল যে, মক্কায় সমবেত হযরত আলীর প্রতিপক্ষ দলটি হযরত আলী ও মুয়াবিয়া উভয়ের কর্তৃত্বের বাইরে তৃতীয় কোন স্থানে সংগঠিত হয়ে নিজেদের নতুন হুকুমাত স্থাপন করবে এবং সেখান থেকে হযরত আলীকে পরাজিত করে নতুন খিলাফত ঘোষণা করবে। সুবিধা ও সম্ভাব্যতার বিচারে এ কাজের জন্য ইরাকই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট স্থান।
তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে, প্রথমে দক্ষিণ ইরাকের বসরা দখল করা হবে। বসরার প্রাক্তন গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে আমের বসরা সম্পর্কে ভালভাবে জানতেন এবং বসরাবাসীদের মধ্যে হযরত তালহার অনেক সমর্থক ছিল। বসরায় হযরত আলীর নিযুক্ত গভর্নর পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেননি। কেবল অর্ধেক লোকই তাঁর অনুগত হয়েছিল। বাকী অর্ধেক লোক ছিল হযরত আলীর খিলাফতের বিরোধী। তাই হযরত আয়িশার বাহিনী বসরার দিকে অগ্রসর হল।
বসরা এবং ইয়েমেনের প্রাক্তন দুই গভর্নরের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ এবং রসদ ছিল। ইয়েমেনের গভর্নর ছয়শ উট এবং ছয় লক্ষ দিনার নিয়ে মক্কায় এসেছিলেন। হযরত আয়িশার সেনাবাহিনী গঠনের তাদের এসব সম্পদ কাজে লেগেছিল। অর্থ ও রসদের লোভে মক্কার অনেকেই বসরামুখী বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। ফলে দেড় হাজার লোকের একটি বাহিনী তৈরি হয়। মক্কা থেকে বের হওয়ার পর আরও অনেক লোক এসে এ বাহিনীতে যোগ দেয়।
ফলে কিছুদূর যাওয়ার পর লোকসংখ্যা দাঁড়ায় তিন হাজার। মক্কায় অবস্থানকারি বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার এ বাহিনীতে যোগ দেননি। হযরত আলীকে দেওয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করেছিলেন। বাহিনীটি কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর প্রয়াত খলিফা হযরত উসমানের উপদেষ্টা মারওয়ান একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তিনি হযরত তালহা ও যুবাইরকে প্রশ্ন করেন যে, যদি হযরত আয়িশার বাহিনী বিজয়ী হয় তাহলে তাদের দুজনের মধ্যে কে পরবর্তী খলিফা নির্বাচিত হবেন?
এ প্রশ্নের জবাবে হযরত তালহা ও যুবাইর জানান যে, যদি এ বাহিনী বিজয়ী হয় তাহলে তাদের দুজনের মধ্যে যাকে জনগণ পছন্দ করবে তিনিই খলিফা নির্বাচিত হবেন। একথা শুনার পর সাইদ ইবনুল আস নামে এক সাহাবী হযরত উসমানের পুত্রকেই খিলাফতের হকদার বলে দাবী করেন। কিন্তু তালহা ও যুবাইর এ দাবী অস্বীকার করেন। ফলে সাইদসহ কয়েকজন সাহাবী বাহিনী থেকে বেরিয়ে যান।
তাদের সাথে সাকীফ গোত্রের অনেক লোকও ফিরে চলে যায়। হযরত তালহা ও যুবাইর বাকী লোকদের নিয়েই ইরাকের দিকে অগ্রসর হলেন। তাদের বাহিনী বসরার কাছাকাছি পৌঁছালে তাদেরকে প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে বসরার গভর্নর উসমান ইবনে হুনায়ফ একটি বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। উসমান ইবনে হুনায়ফের বাহিনী বসরা থেকে বেরিয়ে আসার পর মারুর নামক স্থানে হযরত আয়িশার বাহিনীর মুখোমুখী হয়।
উসমানের বাহিনীর একাংশ হযরত তালহা ও যুবাইরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চায়নি। উসমান তাঁর অনুগত সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত পরাজিত ও বন্দী হন। হযরত আয়িশা উসমানকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলে তিনি মুক্তি লাভ করেন এবং খলিফার সাথে দেখা করার জন্য মদিনার দিকে চলে যান। বসরা হযরত তালহা, যুবাইর ও আয়িশার দখলে আসলেও সেখানকার লোকজন উভয়পক্ষেই বিভক্ত ছিল।
মক্কার বিরুদ্ধাচরণের খবর পেয়ে হযরত আলী আগেই সিরিয়া অভিযান মুলতবী করেছিলেন। বসরায় অভিযানের খবর পেয়ে তিনি হযরত তালহা, যুবাইর ও আয়িশার বিরুদ্ধে মদিনাবাসীর সাহায্য কামনা করলেন। মদিনাবাসীদের অনেকেই এ যুদ্ধে দ্বিধাবোধ করলেও শেষ পর্যন্ত হযরত আলীর পক্ষে যুদ্ধ করার মতো যথেষ্ঠ লোকজন জড়ো হল। হযরত আলী তাঁর বাহিনী নিয়ে বসরা অভিমুখে রওনা হলেন।
হযরত উসমানকে হত্যাকারি বিদ্রোহীরা ছিল এ বাহিনীর সবচেয়ে সক্রিয় অংশ। হযরত উসমানকে হত্যার পর কুফা ও মিশরের অনেক বিদ্রোহী মদিনায় থেকে গিয়েছিল। হযরত আলীর যুদ্ধাযাত্রায় তারাই সর্বাগ্রে যোগ দিয়েছিল। হযরত আলীর বাহিনী যীযায় পৌঁছার পর খবর এল যে, হযরত তালহা ও যুবাইর বসরা দখল করেছেন। হযরত আলী সেখানেই অবস্থান নিয়ে করে আরও সৈন্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেন।
তিনি সৈন্য সংগ্রহের জন্য কুফায় লোক পাঠিয়ে দিলেন এবং মদিনা থেকে আরও রসদ নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলেন। যীযাহ থেকে রওনা হওয়ার পূর্বে তাঈ গোত্রের কিছু লোক এসে হযরত আলীর বাহিনীতে যোগ দেয়। হযরত আলীর বাহিনী সাবিয়াহ নামক স্থানে পৌঁছার পর বসরার পরাজিত গভর্নর উসমান ইবনে হুনায়ফ সেখানে এসে পৌঁছালেন।
কুফা থেকে সৈন্য সংগ্রহের জন্য হযরত আলী যে দুজনকে পাঠিয়েছিলেন তারা ছিলেন মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর এবং মুহাম্মদ ইবনে জাফর। কুফার জনগণ তাদের অহবানে সাঁড়া না দেওয়ায় তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। কুফার গভর্নর আবু মুসা আশআরী এ যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করছিলেন। হযরত আলী দ্বিতীয দফায় কুফায় পাঠালেন মালিক আশতার এবং ইবনে আব্বাসকে।
তারাও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। এবার হযরত আলী পাঠালেন নিজ পুত্র হাসান এবং আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে। আম্মারের মাতা হযরত সুমাইয়া ছিলেন ইসলামের প্রথম শহীদ। তাঁর পিতা-মাতা দুজনই ইসলাম গ্রহণের অপরাধে শহীদ হয়েছিলেন। এ কারণে মুসলমানদের মধ্যে আম্মারের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। কিন্তু খলিফা উসমান একবার আম্মারকে প্রকাশ্যে শাস্তি দিয়েছিলেন। তাই আম্মার উসমান হত্যাকারি বিদ্রোহীদের সঙ্গে প্রকাশ্যেই জড়িত হয়েছিলেন।
হযরত হাসান ও হযরত আম্মার কুফার মসজিদে সমবেত জনগণকে হযরত আলীর পক্ষে আনতে চেষ্টা করেন। হযরত আম্মার উসমান হত্যাকারিদের সাথে জড়িত থাকায় কুফার গভর্নর আবু মুসা তাকে তিরষ্কার করেন এবং মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ হারাম বলে ফতোয়া দেন। এতে আম্মার প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে আবু মুসাকে গালি দিয়ে বসেন। ফলে উপস্থিত লোকজন আম্মারকে আক্রমণ করে বসে।
আবু মুসা নিজেই তখন আম্মারকে রক্ষা করেন। এরপর যায়েদ নামে জনৈক ব্যক্তি কুফাবাসীর প্রতি লিখা হযরত আয়িশার একটি পত্র পড়ে শুনান। এ পত্রে হযরত আয়িশা কুফাবাসীকে নিরপেক্ষ থাকার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু পত্র পাঠকারি যায়েদ নিজেই হযরত আলীর পক্ষে দাঁড়াবার যৌক্তিকতা তোলে ধরে উপস্থিত জনতার সামনে তাঁর মতামত তোলে ধরেন। উপস্থিত জনতার মধ্যে হযরত আলীর সমর্থকরা তাকে জোরালোভাবে সমর্থন জানায়।
গভর্নর আবু মুসার নিরপেক্ষতার আহ্বান উপেক্ষা করে এই প্রথম কুফায় হযরত আলীর পক্ষে কেউ আওয়াজ তুলল। এ সময় হযরত হাসানের বক্তব্য উপস্থিত জনতাকে খুবই প্রভাবিত করে এবং তারা হযরত আলীর প্রতি সমর্থন জানাতে থাকে। ঠিক সেই মুহুর্তে দ্বিতীয়বারের মতো কুফায় পৌঁছালেন মালিক আশতার। তাঁর উপস্থিতিতে হযরত আলীর প্রতি সমর্থন আরও বেড়ে যায়। মালিক আশতারের উপস্থিতিতে আবু মুসা আশআরীর কথা আর কেউ শুনল না।
মালিক আশতার কুফার বিভিন্ন গোত্রকে অত্যন্ত সফলভাবেই হযরত আলীর পক্ষে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হন। ফলে বসরার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য কুফায় শীঘ্রই নয় হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী প্রস্তুত হয়ে যায়। হযরত হাসান, আম্মার এবং মালিক আশতারের নেতৃত্বে এ বাহিনী হযরত আলীর বাহিনীর সাথে যীকার নামক স্থানে মিলিত হয়। এদেরকে নিয়ে হযরত আলীর বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা দাঁড়ায় বিশ হাজার।
হযরত আলী যুদ্ধ এড়াবার জন্য প্রথমে কুটনৈতিক প্রচেষ্টা চালান। আপোষ মীমাংসার একটি উপায় খুঁজে বের করার জন্য তিনি বসরায় দূত পাঠালেন। হযরত আলীর দূত কাকা ইবনে আমের বসরায় গিয়ে তিন নেতা-নেত্রীর সাথে দেখা করলেন। তারা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তাকে জানালেন যে, হযরত উসমান হত্যার বিচার ছাড়া আপোষের কোন সুযোগ নেই।
ইতোমধ্যে হযরত তালহা ও যুবাইর হযরত উসমান হত্যার বদলা হিসেবে বসরায় বেশ কিছু বিদ্রোহীকে হত্যা করেছিলেন। হারকুস নামে এক বিদ্রোহীকে হত্যা করতে গিয়ে তারা ছয় হাজার লোকের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ফলে তাদেরকে ব্যর্থ হতে হয়েছিল। হযরত আলীর দূত তাদেরকে এ ব্যর্থতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে হযরত আলীর সীমাবদ্ধতার দিকটিও বিবেচনার অনুরোধ জানান। এতে হযরত তালহা, যুবাইর ও আয়িশা যথেষ্ঠ নমনীয় হন।
হযরত আলীর দূত ফিরে আসার পর তিনি তাঁর পুরো বাহিনীকে একত্রিত করে আপোষের সম্ভাবনার কথা জানান। পরের দিন বসরার দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় তিনি হযরত উসমান হত্যাকারি বিদ্রোহীদেরকে মূল বাহিনী থেকে পৃথক থাকার নির্দেশ দেন। এ বিদ্রোহী সৈন্যদের সংখ্যা ছিল আড়াই হাজার। তারা হযরত আলী ও আয়িশার আপোষের মধ্যে নিজেদের মৃত্যুপরোয়ানা খুঁজে পায়। তাই তারা যে কোন মুল্যে আপোষ প্রতিহত করতে সংকল্পবদ্ধ হয়।
তারা হযরত আলীর মুল বাহিনী থেকে পৃথক থাকলেও মূল বাহিনীর সাথে সাথেই বসরার দিকে অগ্রসর হয়। বসরার সন্নিকটে পৌঁছার পর আসরে উবাইদুল্লাহর মাঠে হযরত আলীর বাহিনী তাবু ফেলে। অন্যদিকে হযরত তালহা, যুবাইর ও আয়িশার বাহিনী মাঠের অন্যদিকে অবস্থান নেয়। তাদের বাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা ছিল ত্রিশ হাজার। তিন দিন পর্যন্ত উভয় বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে চুপচাপ অবস্থান করতে থাকে। এ সময় জনৈক ব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে হযরত আলী একটি অদ্ভুত ফতোয়া দিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, যদি যুদ্ধ হয় তাহলে উভয় পক্ষের নিহত ব্যক্তিরা জান্নাতে যাবে। অপেক্ষার তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় উভয় পক্ষের সালিশরা আপোষের শর্তাবলী চুড়ান্ত করেন এবং সিদ্ধান্ত হয় যে, পরদিন ভোরবেলায় উভয় পক্ষ আপোষনামায় স্বাক্ষর করবেন। কিন্তু পরদিন ভোরবেলায় উভয়পক্ষের সৈন্যদের ঘুম ভাঙ্গল যুদ্ধের হাকডাকের মধ্যে এবং এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল উভয় পক্ষের পঞ্চাম হাজার সৈন্য।
চতুর্থদিন অতি প্রত্যুষে যখন উভয়পক্ষের সৈন্যরাই ঘুমিয়ে আছে তখন আড়াই হাজার বিদ্রোহী সৈন্য হযরত আলীর বাহিনীর পক্ষ থেকে হযরত তালহা ও যুবাইরের বাহিনীর ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। বসরার বাহিনীর যে অংশের উপর এ হামলা চালানো হয় তারা সাথে সাথেই অস্ত্র হাতে প্রতিরোধে নেমে যায়। ফলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। উভয়পক্ষের সকল সৈন্যই এক মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
হযরত আলী তাঁর বাহিনীকে শত্রুদের মোকাবিলায় উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর বাহিনীর অনেকেই যুদ্ধে বেশ বীরত্ব প্রদর্শন করে। ফলে প্রতিপক্ষের চেয়ে সংখ্যায় দশ হাজার কম হয়েও হযরত আলীর বাহিনী বেশি সফলতা অর্জন করতে থাকে। অন্যদিকে হযরত আয়িশা বর্মাবৃত হয়ে একটি উটের উপর সওয়ার হন এবং উটে চড়ে যুদ্ধের ময়দানে চলে আসেন।
হযরত আয়িশাকে যুদ্ধের ময়দানে দেখে বসরার সৈন্যরা উজ্জীবীত হয়ে ওঠে এবং বীরত্বের সঙ্গে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হযরত আলী প্রতিপক্ষের অবাঞ্চিত নিমর্মতা লক্ষ্য করে স্বয়ং নিজে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে মাঠে নামেন এবং প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমণ পরিচালনার ক্ষেত্রে হযরত আলী নিজ বাহিনীকে নিখুঁতভাবে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন। রণকুশলী হযরত আলীর পরিচালনায় মদিনার বাহিনী দ্রুতই সাফল্যের দিকে এগিয়ে যায়।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই হযরত তালহার পায়ে একটি বিষক্ত তীর বিদ্ধ হয় এবং এতে অধিক রক্তক্ষরণের ফলে তিনি মারা যান। হযরত যুবাইরকে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে জনৈক সৈন্য হত্যা করে। এ দুই নেতার মৃত্যুতে বসরার বাহিনী অনেকটা নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। বিভিন্ন গোত্রের নেতা ও ছোটখাটো অধিনায়করা নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে হযরত আয়িশার পক্ষে লড়ে যাচ্ছিলেন। হযরত আয়িশার উট যুদ্ধের ময়দানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
উটের পিঠে হযরত আয়িশাকে দেখে বসরার সৈন্যরা তাদের মনোবল ফিরে পাচ্ছিল। হযরত আয়িশার উটের চারপাশে ভয়ঙ্কর লড়াই চলছিল। এই উট ছিল হযরত আলীর সৈন্যদের লক্ষ্যবস্তু। কিন্তু হযরত আয়িশার সৈন্যরা অকাতরে জীবন দিয়ে হযরত আলীর সৈন্যদের ঠেকিয়ে রাখছিল। বসরার সৈন্যরা অনবরত নিহত হচ্ছিল কিন্তু তারা হযরত আলীর কোন সৈন্যকে আয়িশার ধারে কাছেও ঘেঁষতে দিচ্ছিল না।
চতুর্দিক থেকে হযরত আয়িশার বর্মের ওপর তীর বর্ষিত হচ্ছিল এবং তিনি চিৎকার করে উসমান হত্যাকারিদেরকে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হযরত আলীর মতো রণকুশলী সেনাপতির নেতৃত্বে পরিচালিত বাহিনীর সুসংগঠিত হামলা প্রতিরোধের শক্তি বসরার বাহিনীর ছিল না। তাই তারা সংখ্যায় বেশি হয়েও পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছিল। কিন্তু হযরত আয়িশার উটকে ঘিরে তারা অবার নব উদ্যমে এগিয়ে যায়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই হযরত আয়িশার উটের চারপাশে লাশের স্তুপ জমে যায়। হযরত আলী এই দৃশ্য দেখে বুঝে নিলেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত এই উট যুদ্ধের ময়দানে দৃশ্যমান থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধ হবে না। তাই হযরত আলী তার লোকদেরকে আদেশ দিলেন- যেভাবে পার এই উটকে আঘাত কর। এই উট ভূমিতে লুটিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধেরও সমাপ্তি ঘটবে।
হযরত আলীর পক্ষে বিদ্রোহী নেতা মালিক আশতার অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করছিলেন। উসমান হত্যাকারি বিদ্রোহীরাও প্রশংসনীয়ভাবে লড়ে যাচ্ছিল। তারা হযরত আলীর পরামর্শ অনুযায়ী আয়িশার উট লক্ষ করে একের পর এক জোরদার হামলা চালায়। কিন্তু উটকে ঘিরে থাকা আয়িশার বাহিনী অত্যন্ত বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে সবকয়টি হামলা প্রতিরোধ করে।
এ সময় হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়ামেরর পুত্র আব্দুল্লাহ হযরত আয়িশার উট রক্ষা করতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হযরত আলীর সৈন্যরা লাশের পাহাড়ের উপর দিয়ে এগিয়ে এসে এমন এক জোরালো হামলা চালায় যে, তারা হযরত আয়িশার উটের সামনের স্থানটি এক মুহুর্তের জন্য ফাঁকা করে ফেলতে সক্ষম হয়। সে মুহুর্তেই হযরত আলীর জনৈক যোদ্ধা হযরত আয়িশার উটের পায়ে চোখের পলকে এক আঘাত করে বসে।
সাথে সাথে হযরত আয়িশার উটটি চিৎকার করে বসে পড়ে। হযরত আয়িশার উট ভুলুণ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে তাঁর বাহিনী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং হযরত আলীর বাহিনী চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। হযরত আলীর বাহিনী হযরত আয়িশার উটটিকে ঘেরাও করে রাখে। হযরত আলী আয়িশার ভাই মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরকে তাঁর বোনের দেখাশুনার দায়িত্ব প্রদান করেন। এই যুদ্ধ ইতিহাসে ‘জাঙ্গে জামাল’ বা ‘উটের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
যেহেতু হযরত আয়িশা জামাল বা উটে চড়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন এবং সেটিই যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল তাই এ যুদ্ধের এরকম নামকরণ হয়। উটের যুদ্ধে হযরত আয়িশার পক্ষে ছিলেন ত্রিশ হাজার সৈন্য যাদের মধ্যে থেকে নয় হাজার সৈন্য নিহত হয়েছিলেন। অন্যদিকে হযরত আলীর বিশ হাজার সৈন্যের মধ্যে এক হাজার সত্তরজন সৈন্য নিহত হয়েছিলেন। অর্থাৎ জাঙ্গে জামালে নিহত সৈন্যদের মোট সংখ্যা ছিল দশ হাজার।
জঙ্গে জামালের বিজয়ের পরদিন হযরত আলী বসরায় প্রবেশ করেন এবং বসরাবাসীদের বাইআত গ্রহণ করেন। হযরত আলী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে বসরার গভর্নর নিযুক্ত করেন। কিছুদিন পর তিনি হযরত আয়িশাকে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের সঙ্গে মক্কায় পাঠিয়ে দেন। হযরত আয়িশা মক্কায় হজ্জ্ব আদায় করার পর মদিনায় চলে যান। এরপর তিনি আর কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেননি।
জঙ্গে জামালের পরাজয়ের পর এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারি উমাইয়ারা সিরিয়ায় চলে যায়। হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়ামের পুত্র আব্দুল্লাহ হযরত আয়িশার সাথে মক্কায় চলে যান। হযরত আলী বসরার কোষাগারের সকল অর্থ তার সৈন্যদেরকে বণ্টন করে দিয়ে দেন। প্রত্যেক সৈন্য পাঁচ দিরহাম করে পায়। এই অর্থ বণ্টন করার পর হযরত আলী তাঁর সৈন্যদেরকে বলেন: যদি তোমরা সিরিয়া আক্রমণ করে বিজয়ী হতে পার তাহলে নির্দিষ্ট ভাতা ছাড়াও এই পরিমাণ অর্থ তোমাদেরকে দেওয়া হবে।
তবে বিদ্রোহীদের একাংশ এ আশ্বাসে সন্তুষ্ট হল না। তারা হযরত আলী প্রদত্ত অর্থে সন্তুষ্ট না হয়ে বসরা ছেড়ে চলে গেল। এরা দ্রুত ইরাক ও আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং দুর্বৃত্ত ও দস্যু প্রকৃতির লোকদেরকে নিজেদের সাথে ভিড়িয়ে নেয়। এরা একটি বিরাট দল গড়ে তোলে। দুর্বৃত্তদের এই দলটি নিজেদের শক্তি সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে ইরানের সিজিস্তানের দিকে যাত্রা করে। হযরত আলী এদেরকে দমনের জন্য একটি বাহিনী পাঠিয়ে দেন।
এ বাহিনী পরাজিত হলে তিনি চার হাজার সৈন্যের আরেকটি বাহিনী পাঠিয়ে দেন। দ্বিতীয় বাহিনী এদেরকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। ইতোমধ্যে সিফফীন যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। তাই পরাজিত দুর্বৃত্তদের অনেকেই এ সুযোগে হযরত আলীর বাহিনীতে এসে যোগদান করে। জঙ্গে জামালের পর হযরত আলী তাঁর রাজধানী মদিনায় ফিরে যাওয়ার আর কোন সুযোগই পেলেন না। কারণ সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তাকে ইরাকেই অবস্থান করতে হচ্ছিল।
মদিনার লোকজন তখন অনেকটাই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল। মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অনেকেই তখন নিশ্চিতভাবে কাউকে সমর্থন করতে পারছিল না। অন্যদিকে ইরাকের কুফায় হযরত আলীর সমর্থকের সংখ্যা ছিল বেশি এবং কুফা ছিল ইরাকের অধিক নিকটবর্তী। তাই হযরত আলী তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে কুফায় চলে গেলেন এবং কুফা নগরীকেই তাঁর খিলাফতের রাজধানী ঘোষণা করলেন।
উল্লেখ্য যে, হযরত আলী তাঁর জীবনে আর কখনোই মদিনায় যেতে পারেননি। তিনি ইরাকেই নিহত হয়েছিলেন এবং ইরাকেরই কোন অজানা স্থানে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। হযরত আলী কুফায় রাজধানী স্থাপন করার পর হযরত মুয়াবিয়া সিরিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সিরিয়ায় হযরত মুয়াবিয়ার একটি বিশাল বাহিনী ছিল এবং এ বাহিনীর সৈন্যরা শপথ করেছিল যে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা উসমান হত্যার প্রতিশোধ না নেবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা বিছানায় ঘুমাবে না এবং ঠাণ্ডা পানিও পান করবে না।
কিন্তু ইরাক ও মিশর দুদিক থেকে সিরিয়ায় হামলা হলে তা প্রতিরোধের মতো সামর্থ্য সিরিয়ার ছিল না। তাই মিশরের গভর্নরের সাথে হযরত আলীর সম্পর্কের অবনতি ঘটানোর জন্য মুয়াবিয়া এক অদ্ভুত চাল চাললেন। মুয়াবিয়া জানতেন যে, হযরত আলী কর্তৃক নিযুক্ত মিশরের গভর্নর কায়েস ইবনে সাদ মিশরের সকল লোককে খলীফার অনুগত বানাতে পারেননি। মিশরের অনেক লোক ছিল উসমান হত্যার বিরোধী এবং তারা হযরত আলীকে খলিফা হিসেবে মেনে নেয়নি।
কায়েস এসব নিরপেক্ষ লোকজনকে ঘটাতে চাননি। কিন্তু হযরত আলীর পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে যে, কাউকে নিরপেক্ষ থাকতে দেওয়া উচিত হবে না এবং এসব লোকজনের কাছ থেকে জোর করে বাইআত আদায় করতে হবে। কায়েস খলিফাকে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, এসব লোকের ওপর জোর খাঁটাতে গেলে অনর্থক যুদ্ধের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। কিন্তু খলিফা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন এবং উল্টো মুয়াবিয়ার সাথে কায়েসের আতাঁতের সন্দেহ করে বসলেন।
এ পরিস্থিতিতে মুয়াবিয়া তাঁর দরবারে ঘন ঘন কায়েসের প্রশংসা শুরু করে দিলেন। এই কাজটি তিনি এমনভাবে করছিলেন যাতে হযরত আলীর গোয়েন্দারা সংবাদটি যেনো হযরত আলীর কানে পৌঁছে দেয়। খবর ঠিকই হযরত আলীর গোয়েন্দারা তাঁর কানে পৌঁছে দিল। ফলে হযরত আলী মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের মিশরের নতুন গভর্নর বানিয়ে পাঠালেন। কায়েস মর্মাহত হয়ে হযরত আলীর কাছে চলে আসেন।
অন্যদিকে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর মিশরের নিরপেক্ষ লোকজনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে গিয়ে তাদের সাথে এমন এক বিরোধে জড়িয়ে পড়েন যা থেকে তিনি আর কখনও বের হতে পারেননি। ফলে হযরত মুয়াবিয়া মিশরের বিপদ হতে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন এবং সিফফীন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। মুয়াবিয়ার যুদ্ধ প্রস্তুতির কথা শুনে বিখ্যাত সাহাবী আমর ইবনুল আস ফিলিস্তিন থেকে সিরিয়ার চলে যান এবং মুয়াবিয়ার সাথে যোগ দেন।
মুয়াবিয়ার মতো তিনিও মনে করতেন যে, হযরত আলী হচ্ছেন বিদ্রোহীদের নির্বাচিত খলিফা এবং এ নির্বাচনে অনেক শীর্ষস্থানীয় সাহাবীদের অংশগ্রহণ না থাকায় এ খিলাফতের ভিত্তি দুর্বল। এছাড়াও হযরত আলীর বাহিনীতে উসমান হত্যাকারিদের সর্দপ উপস্থিতির কারণে তিনি মুয়াবিয়ার দাবীকেই সঠিক মনে করতেন। বিচক্ষণ আমর ইবনুল আস মুয়াবিয়াকে পরামর্শ দেন যে, খলিফা উসমানের রক্তাক্ত জামা ও নায়লার কর্তিত আঙ্গুলী প্রতিদিন জনসমু্দ্রে প্রদর্শন না করে মাঝে মাঝে প্রদর্শন করা উচিত।
এদিকে হযরত আলী সিরিয়া আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কুফা থেকে তাঁর বাহিনী নিয়ে বের হয়ে এলেন। বসরার বাহিনীও এগিয়ে গিয়ে তাঁর সাথে মিলিত হল। ইরান থেকেও তাঁর কিছু বাহিনী এগিয়ে আসছিল। ফুরাত নদী অতিক্রমের পর হযরত আলী সিরিয়ার দিকে একটি অগ্রবর্তী বাহিনী পাঠিয়ে দেন। অন্যদিকে মুয়াবিয়া হযরত আলীর বিশাল বাহিনীর খবর পেয়ে তিনিও একটি অগ্রবর্তী বাহিনী পাঠিয়ে দেন।
হযরত আলী এ বাহিনীর খবর পেয়ে মালিক আশতারকে তাঁর অগ্রবর্তী বাহিনীর সেনাপতি বানিয়ে পাঠিয়ে দেন। দুই বাহিনী সিরিয়া সীমান্তের ভেতরে মুখোমুখি হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় দিন উভয় বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ চলে। তৃতীয় দিন হযরত আলী ও মুয়াবিয়া উভয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে এসে পৌঁছান। হযরত আলী মালিক আশতারকে ফুরাত উপকূল দখল করে তাড়াতাড়ি পানির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আদেশ দেন।
কিন্তু মুয়াবিয়ার সৈন্যরা পূর্বেই ফুরাত উপকূল দখল করে ফেলেছিল। ফলে হযরত আলীর শিবিরে পানির অভাব দেখা দেয়। হযরত আলী মুয়াবিয়ার কাছে একজন দূত পাঠিয়ে জানালেন যে, তিনি প্রতিপক্ষের অভিযোগ শুনতে রাজী আছেন এবং দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসার সম্ভাবনা যেন পানির কারণে বিনষ্ট না হয়ে যায়। মুয়াবিয়া এ ব্যাপারে তাঁর উপদেষ্টাদের পরামর্শ চাইলেন।
মিশরের সাবেক গভর্নর আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবি সারাহ এবং ওয়ালিদ ইবনে উকবা বললেন, যেহেতু হযরত উসমানকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় শহীদ করা হয়েছে সেহেতু হযরত আলীর সৈন্যদেরকেও তৃষ্ণার্ত রেখে মারতে হবে। হযরত আলীর দূত ফিরে এসে তাকে একথা জানালে তিনি পানির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বাহিনী পাঠিয়ে দেন। মুয়াবিয়ার মোতায়েন করা বাহিনীর সাথে এ বাহিনীর রক্তাক্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
এমতাবস্থায় সুচতুর আমর ইবনুল আস হযরত মুয়াবিয়াকে বললেন যে, হযরত আলীর সৈন্যদেরকে তৃষ্ণার্ত রেখে মেরে ফেলার ব্যাপারটি মুয়াবিয়ার বাহিনীরও অনেকই পছন্দ করছে না এবং মুয়াবিয়ার বাহিনীতে যদি এভাবে হযরত আলীর প্রতি সহানুভূতি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। তাই মুয়াবিয়া তাঁর বিপক্ষ দলকে পানি পানের সুযোগ দেন এবং ফুরাত উপকূলে যুদ্ধ বন্ধ করে দেওয়ার আদেশ দেন।
এরপর দুদিন ধরে উভয় বাহিনী নীরবে অবস্থান করে। ইয়েমেন, হিজায এবং ইরান থেকে প্রচুর সৈন্য এসে হযরত আলীর বাহিনীতে যোগ দেয়। হযরত আলীর বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা দাঁড়ায় নব্বই হাজারে। অন্যদিকে মুয়াবিয়ার বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল আশি হাজার। হযরত আলী ও হযরত মুয়াবিয়া ছিলেন যার যার বাহিনীর প্রধান। উভয় বাহিনীতেই এদের অধীনে বেশ কয়েকজন সেনাপতি ছিলেন।
হযরত আলীর সেনাপতিদের মধ্যে মালিক আশতার, সুহায়েল ইবনে হানাফী, আম্মার ইবনে ইয়াসির, কায়েস ইবনে সাদ প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে মুয়াবিয়ার বাহিনীতে আমর ইবনুল আস, মুসলিম ইবনে ওকবা, হাবিব ইবনে মাসলামা, আবুল আওয়ার সালামী, যুলকালা হামীরী প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযোগ্য। উভয় বাহিনীর অপেক্ষার তৃতীয় দিন হযরত আলী মুয়াবিয়ার কাছে তিনজন প্রতিনিধি পাঠান।
এরা মুয়াবিয়াকে হযরত আলীর আনুগত্য স্বীকারের জন্য অনুরোধ করেন। মুয়াবিয়া সাফ জানিয়ে দিলেন যে, উসমান হত্যার বিচার ছাড়া তিনি আর কিছুই ভাবেন না। তখন একজন প্রতিনিধি মুয়াবিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন: তোমার উসমান হত্যার প্রতিশোধের দাবীর আড়ালে কি লুকিয়ে রয়েছে তা আমরা ভাল করেই জানি। তুমি উসমানের সাহায্যে এগিয়ে যেতে এজন্য বিলম্ব করেছ যাতে তিনি শহীদ হয়ে যান এবং খুনের প্রতিশোধকে উপলক্ষ্য করে তুমি খিলাফতের দাবী উত্থাপন করতে পার।
মুয়াবিয়া অত্যন্ত কঠোর ভাষায় এ অভিযোগের জবাব দেন। ফলে প্রতিনিধিদল ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। আপোষ মীমাংসার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সিফফীন যুদ্ধের প্রথম পর্ব শুরু হল। প্রায় এক মাস ধরে এ পর্ব চলতে থাকে। এ সময় প্রকৃত যুদ্ধ নয়, বরং এক ধরণের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলতে থাকে। প্রথম কয়েকদিন দুই বাহিনী থেকে কেবল দুজন যুদ্ধ করত। পরবর্তীতে দুই বাহিনীর দুটি ক্ষুদ্র দলের মধ্যে যুদ্ধ হতো।
বাকীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখত। এভাবে একমাস চলে যায়। প্রকৃত যুদ্ধ বেধে গেলে তা কী ভয়াবহ রক্তপাত সৃষ্টি করবে তা উভয়পক্ষেরই জানা ছিল। উভয়পক্ষেই পরস্পরের আত্মীয় থাকায় একটি আপোষ মীমাংসার জন্য সবাই অপেক্ষা করতে রাজী ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, আপোষের সকল পথই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
হযরত আলীর পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব ছিল না যে, তিনি মুয়াবিয়ার দাবী মেনে নিয়ে মালিক আশতারের মতো প্রভাবশালী সেনাপতি, মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের মতো গুরুত্বপূর্ণ গভর্নর এবং আম্মার ইবনে ইয়াসিরের মতো সাহাবীকে উসমান হত্যার অভিযোগে শাস্তি প্রদান করবেন। প্রথম এক মাস যুদ্ধের মহড়ার পর যুদ্ধের জন্য নিষিদ্ধ মুহাররাম মাস এসে যায়। ফলে এ মাসে যুদ্ধ পুরোপুরি বন্ধ থাকে।
যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পর হযরত আলীর আরেকটি প্রতিনিধি দল মুয়াবিয়ার কাছ থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। হযরত মুয়াবিয়া এদের কাছে হযরত আলীকে উসমান হত্যাকারি বলে দাবী করেন এবং হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির সম্পর্কে তিনি তাদেরকে বলেন, “আমি হযরত উসমানের গোলামের বিনিময়েও আম্মারকে হত্যা করতে পারব।” এসব কথাবর্তার পর প্রতিনিধিরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে।
এরপর হযরত মুয়াবিয়ার একটি প্রতিনিধি দল হযরত আলীর সাথে দেখা করে এবং বলে: হযরত উসমান হকপন্থী খলিফা ছিলেন। ...তাঁর জীবন তোমার কাছে অসহ্য হওয়ায় তুমি তাকে হত্যা করেছ। হযরত আলী একথা শুনে প্রচণ্ড রাগান্বিত হয়ে বলেন: ...একমাত্র তরবারিই এই বিরোধের মীমাংসা করবে। ...আমরা আবু বকর ও উমারকে তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে দেখেছি।
তাই আমি রক্তসম্বন্ধ ও আত্মীয়তার দিক দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকটতর হওয়া সত্ত্বেও তাদের খিলাফতের ব্যাপারে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করিনি। এরপর জনসাধারণ উসমানকে খলিফা নির্বাচন করল। তাঁর কর্মধারায় অসন্তুষ্ট হয়ে লোকেরা তাকে হত্যা করে। তারপর লোকেরা আমার হাতে বাইআত করার আবেদন জানায়। আমি তাদের আবেদনে সাঁড়া দেই।
একথার পর মুয়াবিয়ার জনৈক প্রতিনিধি হযরত আলীকে প্রশ্ন করেন: আপনি কি একথার সাক্ষ্য দেন না যে, হযরত উসমানকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে? হযরত আলী উত্তরে বলেন: আমি উসমানকে মজলুমও বলি না আবার জালিমও বলি না। একথা শুনে মুয়াবিয়ার প্রতিনিধিরা বলেন যে, যে ব্যক্তি উসমানকে মজলুম মনে করে না তাকে উপদেশ দেওয়া আর না দেওয়া সমান। এরপর তারা চলে যান। এটিই ছিল হযরত আলী ও মুয়াবিয়ার মধ্যে আপোষ মীমাংসার শেষ প্রচেষ্টা।
মুহাররম মাসের শেষ দিনে হযরত আলী তাঁর বাহিনীকে জানিয়ে দেন যে, পরবর্তী দিনে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হবে। মুয়াবিয়াও তাঁর বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। পরের দিন ভোরে ঐতিহাসিক সিফফীন যুদ্ধের মূল পর্বের সূচনা হয়। এদিন হযরত আলীর সেনাপতি হিসেবে ময়দানে ছিলেন মালিক আশতার। অন্যদিকে মুয়াবিয়ার সেনাপতি ছিলেন হাবীব ইবনে মাসলামা। সারাদিন ধরে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলে।
সন্ধ্যায় দুই বাহিনী নিজ নিজ শিবিরে ফিরে যায়। যুদ্ধে উভয় পক্ষের হাজার হাজার সৈন্য নিহত হন। দ্বিতীয় দিনেও একইভাবে যুদ্ধ চলে। তৃতীয় দিনের যুদ্ধ ছিল খুবই ভয়ঙ্কর। রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে হযরত আলীর সেনাপতি ছিলেন আম্মার ইবনে ইয়াসির। অন্যদিকে মুয়াবিয়ার সেনাপতি ছিলেন একসময়কার মিশর ও ফিলিস্তিন বিজয়ী আমর ইবনুল আস। প্রচুর প্রাণহানী হলেও এদিনের যুদ্ধেও কেউ চুড়ান্তভাবে পরাজিত হল না।
চতুর্থ ও পঞ্চ দিনেও যুদ্ধের ফলাফল অপরিবর্তিত থাকে। ষষ্ঠ দিনে আবারও মালিক আশতার এবং হাবীব ইবনে মাসলামার নেতৃত্বে যুদ্ধ চলে। সপ্তম দিনে স্বয়ং হযরত আলী এবং মুয়াবিয়া যুদ্ধের ময়দানে চলে আসেন। এদিনের যুদ্ধ ছিল পূর্বের চেয়ে অনেক রক্তক্ষয়ী ও ভয়ঙ্কর। কিন্তু যুদ্ধে কোন জয়-পরাজয় নির্ধারিত হল না। উভয় পক্ষের সৈন্যসংখ্যা ছিল কাছাকাছি এবং উভয় পক্ষেই ইসলামের ইতিহাসের অনেক বড় বড় বীর যোদ্ধা ছিলেন।
কৌশল ও যোগ্যতায় কেউ কারও চেয়ে কম ছিল না। তাই এত প্রাণহানীর পরও যুদ্ধের ফলাফল পেতে দেরী হচ্ছিল। সাতদিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দুই বাহিনী সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। প্রথম সাত দিন উভয় বাহিনীর একেকটি অংশ যুদ্ধে লিপ্ত হত। অষ্টম দিন ভোরে হযরত আলী তাঁর সমগ্র বাহিনী নিয়ে মুয়াবিয়ার বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। হযরত মুয়াবিয়ার বাহিনীও মৃত্যুর শপথ নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর হযরত আলীর ডান পাশের বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে এবং ডান পাশের সেনাপতি আব্দুল্লাহ ইবনে বুদায়েল নিহত হন। হযরত আলী মালিক আশতারকে ডান পাশের বাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে নিজে বাম পাশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উভয় পক্ষের মধ্যবর্তী বাহিনী তখনও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। মালিক আশতার হযরত আলীর ডানপাশের পলায়নরত সৈন্যদেরকে ফিরিয়ে এনে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
হযরত আলী বামপাশের সৈন্যদের মনোবল ফিরিয়ে এনে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মুয়াবিয়ার সৈন্যরা হযরত আলীর কাছে পৌঁছার জন্য প্রাণপনে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। সারাদিন ধরে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলে। যুদ্ধের ময়দানে হাজার হাজার সৈন্যদের মৃতদেহ পড়ে থাকে। দিনের শেষের দিকে হযরত আলী বাম পাশ ছেড়ে ডান পাশে চলে আসেন। এর ফলে ডান পাশের সৈন্যদের মনোবল বেড়ে যায়।
কিন্তু বাম পাশের সৈন্যরা ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হয়। সেখানে লাশের পাহাড় জমে ওঠে। আব্দুল কায়েস নামে একজন সেনাপতি এ সময় বাম পাশের নেতৃত্ব নিয়ে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনেন। বামপাশের যুদ্ধে যুলকালা ও আব্দুল্লাহ ইবনে উমার নামে মুয়াবিয়ার দুই সেনাপতি নিহত হন। দিনের শেষে যখন রাত ঘনিয়ে আসছে তখন আম্মার ইবনে ইয়াসিরের নেতৃত্বে একদল জানবাজ যোদ্ধা মুয়াবিয়ার মধ্যবর্তী বাহিনীর উপর হামলা চালায়।
আমর ইবনুল আস অত্যন্ত কষ্টে এ হামলা প্রতিরোধ করেন। ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হলে আম্মার ইবনে ইয়াসির নিহত হন। আম্মারের নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে হযরত আলী খুবই মর্মাহত হন। সে সময়ে মুয়াবিয়ার বাহিনীর তিনটি অংশই যুদ্ধে নেমে পড়েছে। তরবারির ঝনঝনানি, উড়ন্ত বর্শার তীব্র আঘাত আর যোদ্ধাদের তাকবীর ধ্বনিতে রাতের নীরবতা ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাচ্ছিল। রাতটি ছিল জুমুআর পবিত্র রাত।
এ রাত লাইলাতুল হারীর নামে খ্যাত। হযরত ওয়ায়েস কারনী এ রাতে নিহত হয়েছিলেন। সারা রাত যুদ্ধে কেটে যায়। হযরত আলী সারা রাত ধরে ডান, বাম ও মধ্যবর্তী বাহিনীতে ঘুরে ঘুরে তরবারি চালাচ্ছিলেন। অন্যদিকে মুয়াবিয়া এবং আমর ইবনুল আসও সারা রাত যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। রাত শেষে ভোর হলে পবিত্র জুমুআর দিন শুরু হল। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধের কোন লক্ষণই দেখা গেল না।
এদিনও সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলতে থাকে। আগের দিনের যুদ্ধে সিরীয় বাহিনীর অবস্থান ছিল শক্ত। সিরীয়দের চাপে হযরত আলীর বাহিনী বার বার পযুর্দস্ত হয়েছিল। কিন্তু রাতের বেলায় যুদ্ধের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। রাতের যুদ্ধে হযরত আলীর সৈন্যরা নিহত হয়েছিল কম। অন্যদিকে সিরীয় সৈন্যরা নিহত হয়েছিল বেশি। জুমুআর দিন দুপুর পর্যন্ত যুদ্ধে সিরিয়ার বাহিনীর অর্ধেকের চেয়েও বেশি সৈন্য নিহত হয়েছিল।
ফলে তাদের সংখ্যা আশি হাজার থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিল পয়ত্রিশ হাজারে। অন্যদিকে হযরত আলীর সৈন্য নিহত হয়েছিল বিশ থেকে পঁচিশ হাজার এবং তাঁর বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা দাঁড়িয়েছিল পয়ষট্টি থেকে সত্তর হাজারে। এর ফলে হযরত আলীর সৈন্যসংখ্যা হযরত মুয়াবিয়ার সৈন্যসংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল।
ত্রিশ ঘন্টার যুদ্ধে উভয় পক্ষের যে পরিমাণ মুসলিম সৈন্য নিহত হয়েছিলেন তা দিয়ে অনায়াসেই কয়েকটি পারস্য সাম্রাজ্য জয় করা সম্ভব হতো। ইতোপূর্বে বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যের পুরো অংশ এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অর্ধেক অঞ্চল জয় করতে গিয়েও এতো বেশি মুসলমান সৈন্য নিহত হননি। তাই সিফফীনের যুদ্ধ হল ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক অধ্যায়।
ত্রিশ ঘন্টা ধরে যুদ্ধের পর যখন সূর্য কিছুটা ঢলে পড়ল তখন মালিক আশতার তাঁর বাহিনীর দায়িত্ব অন্যজনকে দিয়ে নিজে একটি বিশাল অশ্বারোহী বাহিনীর দায়িত্ব নিলেন। হযরত আলীর অশ্বারোহী সৈন্যদের বড় অংশটিকে নিয়ে তিনি যুদ্ধের ময়দান থেকে পৃথক হয়ে গেলেন। যেহেতু হযরত আলীর বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল মুয়াবিয়ার বাহিনীর প্রায় দ্বিগুণ সেহেতু মালিক আশতারের অশ্বারোহীদের ছাড়াই তাদের জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কঠিন কিছু ছিল না।
মালিক আশতার তাঁর অশ্বারোহীদেরকে নিয়ে ঘুরপথে এগিয়ে গিয়ে মুয়াবিয়ার বাহিনীর পেছন থেকে একটি সাঁড়াশী আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন। এ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য মুয়াবিয়ার বাড়তি কোন সৈন্য ছিল না। তাঁর বাহিনীর সকলেই সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। মালিক আশতারকে তাঁর অশ্বারোহী সৈন্যরা কথা দিল যে, তারা বিজয় অথবা মৃত্যু- এ দুটোর যে কোন একটি বেছে নিবে।
এই আত্মোৎসর্গকারি অশ্বারোহী সৈন্যদেরকে নিয়ে মালিক আশতার একটি সুবিধাজনক অবস্থান থেকে শত্রুর ওপর ভয়াবহ আক্রমণ চালালেন। শত্রুর ওপর সাঁড়াশী আক্রমণ চালিয়ে তিনি তাদের মধ্যবর্তী বাহিনীর কাছে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। এ সময় সিরীয় বাহিনীর পতাকাবাহী মালিক আশতারের হাতে নিহত হয় এবং মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আসের অবস্থানের সামনেই রক্তাক্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
পুরো সিরীয় বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। যুদ্ধের কোন কেন্দ্র থাকল না। উভয় বাহিনীর ডানপাশ এবং বামপাশ সংকুচিত হয়ে মধ্যবর্তী বাহিনীর সাথে মিশে যায়। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, সিরীয় বাহিনীর সামনে পরাজয় বরণ ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না। কিন্তু তখনও সিরীয়রা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেনি। শেষ পর্যন্ত আমর ইবনুল আস এমন একটি কৌশল আঁটঁলেন যে, তা দিয়ে তিনি কেবল সিফফীন যুদ্ধই নয়, পুরো ইসলামের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন।
সামনে নিশ্চিত পরাজয় দেখে আমর ইবনুল আস মুয়াবিয়কে বললন: কী দেখছ? সকলকে নির্দেশ দাও যেন তারা অবিলম্বে নিজ নিজ বর্শায় কুরআন মাজিদ গেঁথে তা উচু করে ধরে এবং উচ্চঃস্বরে বলতে থাকে, “আমাদের ও তোমাদের মধ্যে ফয়সালা এ কুরআনই করবে।” আমর ইবনুল আসের পরামর্শ অনুযায়ী মুয়াবিয়া সাথে সাথেই সবাইকে এই নির্দেশ প্রদান করলেন।
এর ফলে সিরিয়ার প্রতিটি সৈন্য নিজ নিজ বর্শায় কুরআন গেঁথে তা উঁচু করে ধরল এবং উচ্চস্বরে বলতে থাকল: হে মুসলিম ভাইয়েরা! আমাদের যুদ্ধ তো ধর্মের জন্য! অতএব এসো, আমরা কুরআনের ফয়সালা মেনে নেই এবং এখানেই যুদ্ধের ইতি টানি। যদি এই যুদ্ধে সিরীয়রা ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে রোমানদের আক্রমণ কে প্রতিরোধ করবে? আর যদি ইরাকীরা ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে প্রাচ্যের আক্রমণকারিদের মোকাবিলা কে করবে?
হযরত আলীর সৈন্যরা কুরআনকে বর্শার মাথায় দেখে যুদ্ধ থেকে হাত গুটিয়ে নিল। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস এই দৃশ্য দেখে বললেন: এতক্ষণ যুদ্ধ হচ্ছিল; এখন প্রতারণা শুরু হল। হযরত আলী তাঁর সৈন্যদেরকে বুঝিয়ে বললেন যে, তারা যেন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে এই প্রতারণার ফাঁদে পা না দেয়। কিন্তু সৈন্যরা আর যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক ছিল না। কারণ টানা দুদিন ধরে যুদ্ধ করতে করতে তারা সহ্যশক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল।
টানা দুদিনের যুদ্ধে হঠাৎ বিরতি দেখা দেওয়ায় সৈন্যদের মাঝে আবসাদ ভেঙ্গে পড়ার প্রবণতা সৃষ্টি হল। এছাড়াও হযরত আলীর অভিজ্ঞ সমরনায়করা যেভাবে বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন সেভাবে সাধারণ সৈন্যরা বুঝতে পারেনি যে, বিজয় কতটা সন্নিকটে! তাই তারা ভেবেছিলো এই অনন্ত যুদ্ধ আর চালিয়ে লাভ নেই। এই অবস্থায় সাধারণ সৈন্যরা হযরত আলীর উপর চাপ প্রয়োগ করে যাতে তিনি মালিক আশতারকে যুদ্ধ থেকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হন।
এমনকি অনেক সাধারণ সৈন্য হযরত আলীকে হুমকি দিতেও শুরু করে। ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মালিক আশতার যুদ্ধ বন্ধ করে চলে আসতে বাধ্য হন। সাথে সাথে সমগ্র যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে আসে নীরবতা। মালিক আশতার হযরত আলীর কাছ থেকে প্রকৃত ঘটনা শুনার পর আক্ষেপ করে বলেন: হে ইরাকবাসী! যখন সিরিয়াবাসীদের উপর তোমাদের বিজয় লাভ ছিল সুনিশ্চিত ঠিক তখনই তোমরা তাদের প্রতারণার ফাঁদে পা দিলে।
একথা শুনে যুদ্ধবিরোধী সৈনিকেরা মালিক আশতারের উপর হামলা করতে উদ্যত হয়। কিন্তু হযরত আলীর হস্তক্ষেপে তারা বিরত থাকল। এরপর হযরত আলী মুয়াবিয়ার কাছে একজন দূত পাঠালেন। মুয়াবিয়া হযরত আলীর দূতকে বলেন যে, কুরআনের ভিত্তিতে এই বিরোধ মীমাংসার জন্য দুই পক্ষ থেকে দুজন সালিশকারি নিযুক্ত করা প্রয়োজন। হযরত আলী এই প্রস্তাব সম্পর্কে কোন মতামত দেওয়ার পূর্বেই তাঁর চারপাশে জড়ো হওয়া যুদ্ধবিরোধী লোকজন এ প্রস্তাবকে জোরাল সমর্থন জানাল।
হযরত আলী তখনই বুঝতে পারলেন যে, হযরত উসমানের মতো তাঁরও পায়ের নীচের মাটি সরে যেতে শুরু করেছে; অর্থাৎ তাঁর লোকজনদের মধ্যে বিদ্রোহের প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে! ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল যখন এসব লোকজন হযরত মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে সালিশকারি হিসেবে আমর ইবনুল আসকে মেনে নিল অথচ হযরত আলীর পক্ষ থেকে সালিশকারি হিসেবে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস কিংবা মালিক আশতারকে মেনে নিল না।
তারা হযরত আলীকে তাদের পছন্দমত সালিশকারি নিযুক্ত করতে বাধ্য করল। এদের চাপে হযরত আলী তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বসরার গভর্নর আবু মুসা আশআরীকে তাঁর পক্ষ থেকে সালিশকারি নিযুক্ত করলেন। এরপর আমর ইবনুল আস হযরত আলীর দরবারে এসে একটি দ্বিপক্ষীয় অঙ্গীকারনামা প্রস্তুত করলেন। উভয় পক্ষের সালিশকারিরাও এই মর্মে অঙ্গীকার করলেন যে, তারা পরবর্তী ছয় মাস সময়ের মধ্যে যে কোন সময় দামেশক ও কুফার ঠিক মধ্যবর্তী স্থানে উভয় পক্ষকে তাদের চুড়ান্ত রায় শুনিয়ে দেবেন।
তখন উভয় পক্ষ থেকে মাত্র চারশ করে লোক উপস্থিত থাকবে। সালিশকারিদের রায় শুনার জন্য সমগ্র মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে মোট আটশ লোক সেখানে উপস্থিত থাকবেন। দ্বিপক্ষীয় অঙ্গীকারনামায় সাক্ষী হিসেবে হযরত আলী ও মুয়াবিয়ার পক্ষে অনেকেই স্বাক্ষর করেন। মালিক আশতারকে এতে স্বাক্ষরের কথা বলা হলে তিনি স্পষ্ট ভাষায় তা অস্বীকার করেন। অঙ্গীকারনামা সংক্রান্ত কাজে চারদিন লেগে যায়।
এরপর উভয় বাহিনী কুফা ও দামেশকের দিকে ফিরে যায়। সিফফীনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ৬৫৭ সালের জুলাই মাসে। তখন হযরত আলীর খিলাফতের দ্বিতীয় বছর চলছিল। হযরত আলী খলিফা হয়েছিলেন ৬৫৬ সালের ২৩ জুন। আর সিফফীনের মূল যদ্ধ সংঘটিত হয় ৬৫৭ সালের ১৯ জুলাই থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত। ৯ দিনের এ যুদ্ধে উভয় পক্ষে ৭০০০০ এর চেয়েও বেশি সৈন্য নিহত হয়েছিলেন। অনেক বিখ্যাত সাহাবী এ যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন।
এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কলঙ্কিত অধ্যায়। সাহাবাদের নিজেদের মধ্যে সংঘটিত জঙ্গে জামালের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই সংঘটিত হয়েছিল ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধ। এই দুই যুদ্ধে আশি হাজারের চেয়েও বেশি মুসলমান নিহত হয়েছিলেন। এই সংখ্যাটি ছিল পূর্ববর্তীতে সকল যুদ্ধে নিহত মোট মুসলমানদের সংখ্যার চেয়েও বেশি।
৬২৪ সালে সংঘটিত বদর যুদ্ধ থেকে শুরু করে ৬৫৭ সালের জঙ্গে জামালের পূর্ব পর্যন্ত মুসলমানরা যেসব যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তার সবগুলোই ছিল বিধর্মীদের সাথে। সেসব যুদ্ধে মুসলমানদের এতো প্রাণহানী ঘটেনি যা ঘটেছিল নিজেদের মধ্যে সংঘটিত দুটি যুদ্ধে। এর ফলে সিফফীনের অসমাপ্ত যুদ্ধ মুসলমানদের মধ্যে নানা ধরণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বেশি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় হযরত আলীর বাহিনীর মধ্যে।
সিরীয়রা সবসময়ই তাদের শাসকের অনুগত ছিল। তারা মুয়াবিয়ার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু হযরত আলীর অনুসারীরা কখনোই পুরোপুরি ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। ইরাকীদের ঐতিহ্যই ছিল রাজনৈতিক প্রশ্নে মতবিরোধে লিপ্ত হওয়া। হযরত আলীর বাহিনীতে যেমন যুদ্ধবিরোধী লোকজন ছিল তেমনি অতি উৎসাহী যুদ্ধবাজ লোকজনও ছিল। এরা সিফফীনের সন্ধিচুক্তি মেনে নেয়নি। সিরিয়াবাসীদের উপর পুনরায় আক্রমণের জন্য এরা হযরত আলীকে অনুরোধ করে।
কিন্তু হযরত আলী তাদেরকে বলেন যে, চুক্তির নির্ধারিত সময় পার না হলে এটি কোনভাবেই সম্ভব হবে না। একথা শুনে তারা চুপ হয়ে যায়। কিন্তু হযরত আলীর বাহিনীতে এমনভাবে মতবিরোধ ছড়িয়ে পড়ে যা থেকে তারা আর কখনোই বেরিয়ে আসতে পারেনি। হযরত আলী যখন তাঁর বাহিনী নিয়ে কুফার পথে রওনা হন তখন তাঁর সৈন্যদের মাঝে সিফফীন যুদ্ধ নিয়ে এমন মতবিরোধ সৃষ্টি হয় যে, ব্যাপারটি গালাগালি ও হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়।
হযরত আলী অসহায়ভাবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। সিফফীনের যুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ নিয়ে সমগ্র পথ জুড়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি ও কথা কাটাকাটি চলতে থাকে। নানা যুক্তিতর্ক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়ে তাদের মধ্যে অসংখ্য দল-উপলের সৃষ্টি হয়। এসব দল-উপদল প্রকাশ্যে একে অন্যের বিরোধীতা করতে থাকে এবং প্রয়োজনে তরবারি ধারণের জন্যও প্রস্তুত হয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত সকল দল-উপদলকে ছাপিয়ে দুটি দল প্রাধান্য বিস্তার করে। সংখ্যা এবং মতবাদের দিক থেকে এ দুটি দলই ছিল সবচেয়ে স্বকীয় ও শক্তিশালী। একটি দল হযরত আলীর আনুগত্য অস্বীকার করে এবং হযরত আলী ও মুয়াবিয়া- উভয়কেই রক্তপাতের জন্য দায়ী করে। এরা ‘খাওয়ারিজ দল’ নামে পরিচিতি পায়। আরেকটি দল ছিল সম্পূর্ণ এদের বিপরীত। এরা হযরত আলীকে নির্দোষ দাবী করে এবং তাকেই খিলাফতের প্রকৃত হকদার হিসেবে সাব্যস্ত করে।
এরা যে কোন মূল্যে হযরত আলীর পক্ষে থাকার কথা বলে। এই দল ‘শীআনে আলী’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ‘শীআনে আলী’ মানে হল ‘আলীর পক্ষ’। কুফার নিকটবর্তী হওয়ার পর খাওয়ারিজ দলটি হযরত আলীর বাহিনী থেকে পৃথক হয়ে হারুরার দিকে চলে যায়। এদের সংখ্যা ছিল বারো হাজার। আব্দুল্লাহ ইবনুল কাব ছিলেন এদের প্রধান নেতা এবং শীস ইবনে রিবাঈ ছিলেন এদের সেনাপ্রধান।
এই শীস ইবনে রিবাঈ সিফফীনের যুদ্ধের সময়ে দুবার হযরত আলীর প্রতিনিধি হিসেবে মুয়াবিয়ার কাছে গিয়েছিলেন। হারুরায় অবস্থান করার পর খাওয়ারিজরা তাদের মূলনীতি ঘোষণা করে এভাবে: মানুষের মধ্যে কোন খলিফা বা আমীর নেই। বাইআত কেবল আল্লাহর জন্য। হুকুম বা আদেশ কেবল আল্লাহই দিতে পারেন; খলিফা বা আমীর নয়। মুসলমান সমাজের সকল কাজ সম্পাদিত হবে পরামর্শের ভিত্তিতে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতানুসারে। আমীরে মুয়াবিয়া এবং খলিফা হযরত আলী উভয়েই সমান দোষী।
হযরত আলী খাওয়ারিজদেরকে বুঝিয়ে সুজিয়ে তাঁর অনুগত করার চেষ্টা করেন। খাওয়ারিজরা সিফফীনের যুদ্ধ বন্ধ করা এবং মুয়াবিয়ার সাথে আপোষের প্রচেষ্টাকে সঠিক মনে করেনি। তারা মনে করত যে, মুয়াবিয়া মুসলমানদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টির ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাই মুয়াবিয়া ছিলেন হত্যাযোগ্য অপরাধী। এ ধরনের অপরাধীর সাথে মধ্যস্ততার প্রচেষ্টাকে তারা মেনে নেয়নি।
তারা মনে করত যে, মুয়াবিয়ার সাথে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিয়ে হযরত আলী নিজেও অপরাধ করেছেন। হযরত আলী তাদেরকে বুঝালেন যে, তিনি মোটেও যুদ্ধ বন্ধ করতে চাননি; পরিস্থিতিই তাকে মধ্যস্থতা মেনে নিতে বাধ্য করেছিল। এতে তারা কিছুটা শান্ত হয়। হযরত আলী খাওয়ারিজ নেতা ইয়াযিদ ইবনে কায়েসকে ইস্পাহান ও রাঈ শহরের গভর্নর নিয়োগ করেন। এরপর খাওয়ারিজরা হযরত আলীর অনুরোধে কুফায় আসতে সম্মত হয়।
সিফফীনের অঙ্গীকারনামা অনুযায়ী যখন ছয় মাসের মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে তখন উভয়পক্ষের সালিশকারিরা যথাস্থানে মিলিত হলেন। দামেশক ও কুফার ঠিক মধ্যবর্তী আযরাজ নামক স্থানে তারা মিলিত হন। স্থানটি ছিল জুমাতুল জান্দালের নিকটে অবস্থিত। হযরত আলী এবং মুয়াবিয়া তাদের রাজধানীতেই অপেক্ষা করতে থাকেন। খাওয়ারিজ নেতা হারুকুস ইবনে যুহায়ের কুফায় অবস্থানত হযরত আলীকে শেষবারের মতো মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যানের অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
আযরাজের সালিশী বৈঠকে মক্কা ও মদিনার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিও যোগ দেন। উভয় পক্ষের চারশ করে লোক বৈঠকস্থলের বাইরে অবস্থান করতে থাকে। গণ্যমান্য সাহাবীদেরকে নিয়ে উভয় সালিশকারি বৈঠকে বসেন। প্রথমে আমর ইবনুল আস কৌশলে আবু মুসা আশআরীকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নেন যে, উসমান হত্যার প্রতিশোধের দাবী সঠিক এবং মুয়াবিয়া খলিফা হওয়ার যোগ্য। কিন্তু হযরত আলীও খলিফা হওয়ার যোগ্য হওয়ায় কাউকেই বাদ দেওয়া গেল না।
শেষ পর্যন্ত আবু মুসা আশাআরী বলেন যে, উভয়কেই বাদ দিয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে উমারকে খলিফা বানানো উচিত। কিন্তু সেখানে উপস্থিত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার খলিফা হতে অস্বীকৃতি জানান। এতে আরও আলোচনা চলতে থাকে। দীর্ঘ আলোচনার পর কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পেরে উভয় সালিশকারি এই অভিমত প্রকাশ করলেন যে, হযরত আলী ও মুয়াবিয়া উভয়কেই ক্ষমতা থেকে পদচ্যুত করা হবে এবং এরপর মুসলমানরা মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে নতুন খলিফা নির্বাচন করবে।
বৈঠকের বাইরে উভয়পক্ষের লোকজন অধীর আগ্রহে সালিশকারিদের সিদ্ধান্ত জানার জন্য অপেক্ষা করছিল। যখন ঘোষণা করা হল যে, সবার সামনে সালিশকারিরা তাদের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করবেন তখন তারা সাথে সাথে একটি জায়গায় সমবেত হয়ে গেল। সেখানে একটি মঞ্চও রাখা হল। আমর ইবনুল আস আবু মুসা আশআরীকে অনুরোধ করলেন যে, প্রথমে তিনি যেন উপস্থিত সবাইকে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন।
আবু মুসা আশআরী মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন যে, এই মুহুর্তে হযরত আলী ও মুয়াবিয়া উভয়কেই পদচ্যুত করা হলো এবং উপস্থিত মুসলমানদেরকে খলিফা নির্বাচনের অধিকার প্রদান করা হল। এরপর আমর ইবনুল আস মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন যে, আবু মুসা আশআরী যেহেতু হযরত আলীর সালিশকারি সেহেতু আবু মুসার ঘোষণা অনুযায়ী হযরত আলী পদচ্যুত হয়েছেন, মুয়াবিয়া হননি এবং মুয়াবিয়ার সালিশকারি হিসেবে আমর ইবনুল আস হযরত আলীর শূণ্যস্থানে মুয়াবিয়াকেই খলিফা নিযুক্ত করলেন।
আমর ইবনুল আসের এই কূটকৌশল আবু মুসাকে হতবাক করে দেয়। তিনি আমরকে বললেন: তুমি আমাকে ধোঁকা দিয়েছ। উপস্থিত ইরাকী লোকজন ক্ষোভে ফেটে পড়ে। একজন আমরকে তরবারি দিয়ে আঘাত করে বসলে আমরও পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন। তবে কয়েকজনের হস্তক্ষেপে উভয়ে লড়াই থেকে বিরত হন। বিশৃঙ্খলা ও হট্টগোলের মধ্য দিয়েই সালিশী অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হল। অতি দ্রুত দুই সালিশকারি কুফা ও দামেশকের পথে রওনা হয়ে যান।
বাকী লোকজনও রওনা হয়ে গেল। হযরত আলী সালিশী সিদ্ধান্তের কথা জানার পর তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং মুয়াবিয়া ও তাঁর লোকজনকে অভিসম্পাত করেন। মুয়াবিয়াও হযরত আলীকে অভিসম্পাত করেন। তখন থেকে দুপক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিসম্পাত প্রদানের রীতি শুরু হয়। হযরত আলী পুনরায় সিরিয়া আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। ঠিক তখনই কুফার খাওয়ারিজরা বিদ্রোহ করে বসল।
বিদ্রোহের পূর্বে হারকুস এবং আরেকজন খাওয়ারিজ নেতা হযরত আলীর কাছে এসে বললেন যে, মুয়াবিয়ার সাথে মধ্যস্থতা না করার জন্য তারা হযরত আলীকে বার বার অনুরোধ করার পরও তিনি সে অনুরোধ রাখেননি। আবার এখন তিনি নিজেই মধ্যস্থতা বর্জন করেছেন। অথচ তিনি এখনও তাঁর আগের ভুল স্বীকার করেননি। হযরত আলী তাঁর ভুল স্বীকার না করলে তারা তাকে সমর্থন করবে না।
তারা হযরত আলীকে প্রথমে ভুলের জন্য অনুশোচনা করে তারপর সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হতে বলে। হযরত আলী চরম বিরক্ত হয়ে বললেন যে, মুয়াবিয়ার সাথে মধ্যস্থতার সিদ্ধান্ত নিতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন এবং এতে তিনি কোন ভুলও করেননি। এতে দুই নেতা অসুন্তষ্ট হয়ে চলে যান। এরপর হযরত আলী কুফার মসজিদে বক্তব্য দিতে গেলে খাওয়ারিজরা স্লোগান দিতে থাকে “লা হুকমা ইল্লা লিল্লাহ” অর্থাৎ “আল্লাহ ছাড়া কারও হুকুম মানিনা”।
এরপর হযরত আলী মসজিদ থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে চলে যান। অন্যদিকে খাওয়ারিজরা তাদের এক নেতার বাড়িতে সমবেত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা কুফা ছেড়ে চলে যাবে এবং হযরত আলীর শাসনের বাইরে গিয়ে নিজেদের নতুন মতবাদের ভিত্তিতে নতুন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলবে। পরের দিন খাওয়ারিজরা আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহাবকে তাদের প্রধান নেতা বা আমির নির্বাচিত করে এবং মাদায়েনের দিকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
বসরার খাওয়ারিজদেরকেও এ খবর পাঠানো হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, মাদয়েনের পূর্বে নাহরাওয়ানের প্রান্তরে সকল খাওয়ারিজরা মিলিত হবে। প্রথমে কুফার খাওয়ারিজরা নাহরাওয়ানে পৌঁছাল। এরপর বসরার খাওয়ারিজরাও সেখানে এসে মিলিত হল। নাহরাওয়ানে নিজেদেরকে সুসংগঠিত করার পর খাওয়ারিজদের মোট সংখ্যা দাঁড়াল পঁচিশ হাজার। খাওয়ারিজরা চলে যাওয়ার পর হযরত আলী তাদেরকে গুরুত্ব না দিয়ে সিরিয়া আক্রমণের দিকেই মনোনিবেশ করলেন।
তিনি প্রথমে বসরায় চিঠি পাঠালেন। কিন্তু বসরার মোট ষাট হাজার সৈন্যের মধ্যে মাত্র তিন হাজার সৈন্য তাঁর আহ্বানে সাঁড়া দিয়ে কুফায় এসে পৌঁছাল। কুফাবাসীরাও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত হযরত আলীর ভাষণে কাজ হল। চল্লিশ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী তাঁর পতাকাতলে সমবেত হল। এবার হযরত আলী নাহরাওয়ানের খাওয়ারিজ নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহাবকে চিঠি লিখলেন।
চিঠিতে তিনি তাদেরকে অনুরোধ জানালেন যে, তিনি এবার তাদের কথামতো সিরিয়া আক্রমণে যাচ্ছেন। অতএব নিজেদের মধ্যে বিরোধ না রেখে সবাই মিলে সিরিয়া আক্রমণে যাওয়া উচিত। খাওয়ারিজদের উত্তর আসল: তুমি আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে মধ্যস্থতাকারি নিয়োগ করেছিলে এবং এখন আবার সিরিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাচ্ছ। এসব তুমি তোমার প্রবৃত্তির তাড়নায় করছ। যদি তুমি নিজের কাফির হওয়ার কথা স্বীকার কর এবং তাওবা কর তাহলে আমরা তোমার সাহায্যের জন্য প্রস্তুত আছি।
এই উত্তর পেয়ে হযরত আলী এদের সম্পর্কে নিরাশ হয়ে গেলেন। খাওয়ারিজরা সবসময়ই বলতো যে, হযরত মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করে তারা নিজেরাও কাফির হয়ে গিয়েছিলো এবং পরে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তারা তাওবা করে মুসলমান হয়েছে। এখন হযরত আলীরও উচিত তাওবা করে পুনরায় মুসলমান হওয়া। হযরত আলী যখন খাওয়ারিজদেরকে উপেক্ষা করেই সিরিয়া আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিলেন ঠিক তখনই খবর এল যে, হযরত আলীর পক্ষে কথা বলায় আব্দুল্লাহ ইবনে খাব্বাব নামে জনৈক সাহাবী খাওয়ারিজদের হাতে নিহত হয়েছেন।
এর ফলে আশঙ্কা দেখা দিল যে, হযরত আলীর বাহিনী সিরিয়ায় চলে গেলে খাওয়ারিজরা কুফা ও বসরা দখল করে নিতে পারে। তাই হযরত আলী সিরিয়া যুদ্ধ মুলতবী রেখে খাওয়ারিজদেরকে দমনের উদ্দেশ্যে নাহরাওয়ানের দিকে রওনা হলেন। হযরত আলীর বিরাট বাহিনী দেখে খাওয়ারিজদের দুই তৃতীয়াংশ লোকই যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে যায়। বাকী এক তৃতীয়াংশ লোক হযরত আলীর বাহিনীর হাতে প্রাণ দিতে প্রস্তুত হল।
যুদ্ধ শেষে দেখা গেল মাত্র নয়জন খাওয়ারিজ জীবিত রয়েছে। হযরত আলী খাওয়ারিজদের লাশ দাফন না করেই সে অবস্থায় ফেলে রেখে চলে আসেন। এ যুদ্ধে প্রায় নয় হাজার খাওয়ারিজ নিহত হয়েছিলেন। মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধের তৃতীয় ঘটনা ছিল এটি। তিনটি যুদ্ধে নিহত মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়াল নব্বই হাজার। নাহরাওয়ানের যুদ্ধ শেষ করে হযরত আলী কুফায় না ফিরে সরাসরি সিরিয়া অভিযানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
কিন্তু তাঁর সৈন্যরা সিরিয়া অভিযানে আর যেতে চাচ্ছিল না। নিজের বাহিনী নিয়ে তিনি যখন নাখীলায় এসে অবস্থান নিলেন তখন তিনি অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন যে, তাঁর সৈন্যরা ছাউনি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কেউ তাঁর কথা আর শুনল না। যখন ছাউনি একেবারে শূন্য হয়ে গেল তখন তিনি নিজেও কুফায় চলে আসলেন। হযরত আলী সকল নেতৃবৃন্দকে একত্রিত করে তাদের যুদ্ধ বর্জনের কারণ জানতে চাইলেন।
কেউই কোন সদুত্তর দিল না। তিনি সবাইকে পুনরায় সিরিয়া আক্রমণের জন্য অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হাতে গোনা কিছু লোক ছাড়া সবাই নীরব থাকল। এরপর হযরত আলী আবারও সবাইকে একত্রিত করে সিরিয়া আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এবারও সবাই তাঁর কথা শুনল বটে কিন্তু নীরব থাকল। শেষ পর্যন্ত হযরত আলী নিজেও নীরব হয়ে গেলেন। তখন হযরত আলীর সবচেয়ে বড় বন্ধু মালিক আশতার আর পৃথিবীতে ছিলেন না।
সিফফীনের যুদ্ধের কিছুদিন পরে তিনি মিশর যাওয়ার পথে মারা গিয়েছিলেন। একজন বেদুইন সর্দার তাঁর খাবারে বিষ প্রয়োগ করায় তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ধারণা করা হয় যে, এ ঘটনায় মুয়াবিয়ার হাত ছিল। মালিক আশতারের মৃত্যুতে হযরত আলী তাঁর সবচেয়ে বড় বন্ধুকে হারিয়েছিলেন। সিফফীনের যুদ্ধের পর হযরত আলী মালিক আশতারকে মক্কা-মদিনা অঞ্চল অর্থাৎ জাযিরার শাসনকর্তা বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন।
এর কিছুদিন পর তিনি তাকে মিশরের গভর্নর বানিয়ে পাঠান। মিশরের তখনকার গভর্নর মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর উসমান ভক্তদেরকে দমন করতে পারছিলেন না। ইবনে খাদীজের নেতৃত্বে মিশরের উসমান ভক্তরা মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল এবং কয়েকটি যুদ্ধে বিজয়ও লাভ করেছিল। তাই মিশরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্য মালিক আশতারকে নতুন গভর্নর বানিয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু মালিক আশতার মিশরে পৌঁছার পূর্বে পথিমধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
তখন হযরত আলী ও মুয়াবিয়ার মধ্যে মধ্যস্থতার সময় চলছিল। তাই মুয়াবিয়া মিশরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছিলেন না। সালিশী বৈঠকের পর মুয়াবিয়া আমর ইবনুল আসের নেতৃত্বে মিশরের উদ্দেশ্যে ছয় হাজার সৈন্য পাঠিয়ে দেন। এ খবর কুফায় পৌঁছালে হযরত আলী কুফাবাসীদেরকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করতে চেষ্টা করেন। এটি ছিল খাওয়ারিজদের সাথে যুদ্ধের পরবর্তী সময়। মাত্র দুই হাজার লোক হযরত আলীর আহবানে সাঁড়া দিয়ে মিশর রক্ষার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
কিন্তু এরা কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর মিশরের পতন এবং মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে কুফায় ফিরে আসে। মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর আমরের বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথমে দুই হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী পাঠিয়েছিলেন। এরা আমরের হাতে সম্পূর্ণ পরাজিত হয়। এরপর মুহাম্মদ নিজেই আমরের সাথে যুদ্ধের জন্য এগিয়ে যান। কিন্তু তাঁর সাথের সৈন্যরা তাকে ফেলে পালিয়ে চলে যায়। একাকী মুহাম্মদ তখন জাবালা ইবনে মাসরুর নামক এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নেন।
সিরীয় বাহিনী এবং ইবনে খাদীজের সৈন্যরা চারদিক থেকে জাবালার বাড়ি ঘিরে ফেলে। মুহাম্মদ ধরা পড়েন! ইবনে খাদীজ তাকে নিজ হাতে হত্যা করেন। এরপর মুহাম্মদের লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়। ৬৫৮ সালে এ ঘটনা সংঘটিত হয়। এর পরবর্তী দুবছর মুয়াবিয়া একের পর এক সফলতা লাভ করতে থাকেন। মিশর দখলের পর হযরত মুয়াবিয়ার মনোবল আরও বেড়ে গিয়েছিল। তিনি হযরত আলীর অধীনস্ত বসরায় বিদ্রোহ সৃষ্টির জন্য আব্দুল্লাহ ইবনে হাযরামীকে পাঠান।
জঙ্গে জামালে নিহত অনেক লোকের পরিবার বসরায় বসবাস করত। তাই সেখানে হযরত আলীর প্রতি অসন্তুষ্ট লোকের অভাব ছিল না। আব্দুল্লাহ ইবনে হাযরামী বসরার গভর্নরের অনুপস্থিতিতে সেখানে প্রবেশ করেন। তিনি প্রথমে সফল হলেও পরে ব্যর্থ ও নিহত হন। হযরত আলীর খিলাফতে বসরার পরবর্তী বিদ্রোহ ছিল ইরানের ফারিসবাসীদের বিদ্রোহ। এটি একটি খাওয়ারিজ বিদ্রোহ ছিল। যিয়াদ নামে হযরত আলীর এক সেনাপতি এ বিদ্রোহ দমন করেন।
৬৫৮ থেকে ৬৬০ সাল পর্যন্ত মুয়াবিয়া তাঁর রাজ্য সম্প্রসারিত করতে থাকেন। অন্যদিকে হযরত আলীর খিলাফত সংকুচিত হতে থাকে। উদারতা, ক্ষমা, অর্থকড়ি সবকিছু দিয়ে মুয়াবিয়া আরবের লোকজনদেরকে তাঁর পক্ষে টানতে থাকেন। মদিনা, তায়েফ, ইয়েমেন প্রভৃতি স্থান থেকে দলে দলে লোকজন দামেশকে এসে মুয়াবিয়ার দরবারে ভীড় জমাতে থাকে। মদিনা, মক্কা ও ইয়েমেনবাসীরা হযরত আলীর খিলাফত বর্জন করে হযরত মুয়াবিয়াকে বাইআত প্রদান করায় আরব উপদ্বীপে হযরত আলীর শাসন আর থাকল না।
৬৬০ সালের মধ্যে সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিশর ছাড়াও পুরো হিজায ও ইয়েমেনে মুয়াবিয়ার শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইরাক ও ইরান ছিল হযরত আলীর অধীনস্ত; কিন্তু সেখানেও তাঁর শত্রুর অভাব ছিল না। হযরত আলীর ঘনিষ্ট লোকজনদের সাথেও তাঁর কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বসরার গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস তাঁর উপর অসন্তুষ্ট হয়ে মক্কায় চলে যান। হযরত আলীর ভাই আকীলও তাঁর উপর অসন্তুষ্ট হয়ে মুয়াবিয়ার কাছে চলে যান।
মুয়াবিয়া আকীলকে সদরে গ্রহণ করেন এবং তাঁর জন্য সরকারি ভাতা নির্ধারণ করে দেন। এ ঘটনা ছিল হযরত আলীর জন্য খুবই হতাশাজনক। মুয়াবিয়া হযরত আলীকে সকল দিক থেকে কোনঠাসা করার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। হযরত আলীর এলাকায় তাঁর সৈন্যরা কয়েকটি হানাও দিয়েছিল। মুয়াবিয়ার সেনাপতি নুমান ইবনে বশীর আইনুত তামুর দখল করে নিয়েছিলেন। মাদায়েন ও আনবারেও লুন্ঠন চালানো হয়। হযরত আলীর খিলাফত ইরাক ও ইরানে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লেও মুয়াবিয়া তাকে যথেষ্ট ভয় পেতেন।
তাই ৬৬০ সালে তিনি হযরত আলীর এলাকায় আর আক্রমণ না করার সিদ্ধান্ত নেন। ৬৬১ সাল ছিল হযরত আলীর খিলাফতের শেষ বছর। একই সাথে তা ছিল তাঁর জীবনেরও শেষ বছর। হযরত আলীর ভাই আকীল সিরিয়ায় চলে যাওয়ার পর তিনি তাঁর জীবনে শেষবারের মতো কুফাবাসীকে সিরিয়া আক্রমণের জন্য রাজী করিয়েছিলেন। ষাট হাজার কুফাবাসী তাকে কথা দিয়েছিল যে, তারা এবার আর তাকে ত্যাগ করবে না এবং দেহে প্রাণ থাকা পর্যন্ত তাঁর পক্ষে লড়বে।
এর ফলে হযরত আলী আরও সৈন্য এবং সরঞ্জাম সংগ্রহ করার কাজে লেগে গেলেন। কিন্তু ভাগ্যের কী নিমর্ম পরিহাস! ঘাতকের ধারাল খঞ্জরের এক নিমর্ম আঘাত ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিল। অতীতের বীর জুলিয়াস সিজারের মতো হযরত আলীও একদিন ভোরে আততায়ীর আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। এ আততায়ীর নাম আব্দুর রহমান ইবনে মুলজিম মুরাদী। আব্দুর রহমান ছিলেন একজন খাওয়ারিজ নেতা।
নাহরাওয়ানের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারি প্রায় নয় হাজার খাওয়ারিজদের সকলকেই হযরত আলী হত্যা করেছিলেন। যে নয়জন খাওয়ারিজ প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলো তারা ছিলেন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। এরা প্রথমে ইরানে বিদ্রোহ সৃষ্টির চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে সফলতা লাভ করতে না পেরে তারা ইরাক ও হিজাযে ছড়িয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তিন খাওয়ারিজ নেতা মক্কায় মিলিত হয়ে এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
তারা কাবাগৃহে একত্রিত হয়ে শপথ করেন যে, যে তিন নেতা ইসলামি বিশ্বকে যুদ্ধে লিপ্ত রেখেছেন তাদেরকে তারা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে হলেও হত্যা করবেন। যে তিন নেতা মুসলমানদেরকে যুদ্ধে নিয়োজিত রেখেছেন তারা হলেন হযরত মুয়াবিয়া, হযরত আলী এবং হযরত আমর ইবনুল আস। তিন খাওয়ারিজ নেতা এ তিনজনকে হত্যার জন্য রওনা হয়ে গেলেন। কথা ছিল যে, কুফা, দামেশক ও ফুসতাতের মসজিদে একই দিনে একই সময়ে এ তিন নেতাকে বিষমাখা তরবারি দ্বারা হত্যা করা হবে।
হত্যাকান্ডের সময় নির্ধারিত হয় ১৬ রমজান রোজ শুক্রবার ভোরের নামাজের সময়। পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই তিন খাওয়রিজ যার যার গন্তব্যে হাজির হয়ে গেল। বারক ইবনে আব্দুল্লাহ দামেশকের মসজিদে মুয়াবিয়াকে আঘাত করলে মুয়াবিয়া সে আঘাতে আহত হন কিন্তু প্রাণে বেঁচে যান। মিশরের আমর ইবনুল আস সেদিন অসুস্থ থাকায় মসজিদে যাননি। ফলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
ফুসতাতের মসজিদে যিনি তাঁর স্থলে ইমামতি করছিলেন সে ব্যক্তি বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছিলেন। কুফার মসজিদে হযরত আলীকে আঘাত করেন আব্দুর রহমান ইবনে মুলজিম মুরাদী। ইবনে মুজলিমের সাথে আরও দুজন খাওয়ারিজ এ হামলায় সহায়ক হয়েছিল। হযরত আলীর কপালের ওপর তরবারির আঘাত লাগায় তিনি মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। আহত হওয়ার পরদিন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
হযরত আলী তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর তিন পুত্র- হাসান, হুসাইন ও মুহাম্মদ ইবনুল হানাফিয়াকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে যান। ৬৬১ সালের ২৭ জানুয়ারী হযরত আলী মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে এবং নতুন ইতিহাসের সূচনা হয়। হযরত আলীর সাড়ে চার বছরের খিলাফতের পুরোটাই ছিল তাঁর জন্য অত্যন্ত তিক্ত সময়।
শেষ পর্যন্ত আততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়ে ইসলামের এ মহান বীর তাঁর তিক্ত জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। হযরত আলীর মৃত্যুর পর তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী তাঁর আততায়ীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। দামেশক ও ফুসতাতের আততায়ীদেরকেও হত্যা করা হয়েছিল। হযরত আলীর খিলাফতের সময় তাকে যেভাবে তিক্ততা ঘিরে রেখেছিল তাঁর মৃত্যুর পরেও তা তাকে ঘিরে রাখে।
তাঁর মৃতদেহকে খাওয়ারিজরা যাতে কবর থেকে উঠিয়ে অবমাননা করতে না পারে সেজন্য তাকে অজ্ঞাত স্থানে সমাহিত করা হয়। এজন্য হযরত আলীর কবর আজও অজ্ঞাত। তাকে কোথায় সমাহিত করা হয়েছিল তা নিয়ে নানা রহস্য ও মতামত ছড়িয়ে আছে। এর মধ্যে একটি বর্ণনা হল, তাকে মদিনায় সমাহিত করার উদ্দেশ্যে উটের পিঠে করে মদিনায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। পথিমধ্যে হঠাৎ সেই উটটি দৌড়ে পালায়। এরপর তার আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।
এর ফলে হযরত আলী চিরতরে হারিয়ে যান। বিজয়ের ইতিহাসকে অসমাপ্ত রেখেই ইসলামের ইতিহাসের এই মহান বীর ইতিহাসের অন্তরালে হারিয়ে যান। অনেকে মনে করেন, হযরত আলী আসলে কখনো সত্যিকারভাবে পরাজিত হননি। তিনি পরাজিত হয়েছিলেন মূলত ধূর্ততা ও কূটনীতির কাছে। তাকে তলোয়ার দিয়ে কেউ কখনো পরাজিত করতে পারেনি। যদি তিনি ধূর্ততা ও কূটনীতির কাছে পরাজিত না হতেন তাহলে হয়তো মেসিডোনীয় বীর আলেকজান্ডারের পরে তিনিই হতেন সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা!
লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880
বি.দ্র: রকমারিসহ বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটে লেখকের সবগুলো বই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে লেখকের নামে সার্চ দিলেই যথেষ্ট।
৬৫৬ সালের ১৭ জুন তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন। উমাইয়া খলিফা হযরত উসমানের হত্যাকাণ্ডের পর অধিকাংশ বিদ্রোহী ও মদিনাবাসীর সমর্থন নিয়ে হাশেমী গোত্রীয় নেতা হযরত আলী খলিফা নির্বাচিত হন। কুফার বিদ্রোহী নেতা মালিক আশতার বিদ্রোহীদের মধ্যে হযরত আলীর পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে জোরাল ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ‘হুব্বে আলী’ বা ‘আলী প্রেমে’ বিশ্বাসী ছিলেন।
মালিক আশতারের মতো বিদ্রোহীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই মহানবীর পর হযরত আলীর আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব বা ইমামতিতে বিশ্বাস করত। তারা মনে করতো যে, হযরত আলীই ছিলেন মহানবীর ন্যায্য উত্তরাধিকারী; অথচ তাকে বাদ দিয়ে এ পর্যন্ত তিনজনকে খলিফা বানানো হয়েছে। তাই তারা হযরত উসমানকে উৎখাতের পর হযরত আলীকে খলিফা বানানোর ব্যাপারে বেশ উৎসাহী হয়ে ওঠে।
৬৫৬ সালের ২৩ জুন হযরত আলী এদের সবার কাছ থেকে খলিফা হিসেবে আনুগত্যের শপথ (বাইআত) গ্রহণ করেন। সর্বপ্রথম হযরত আলীর হাতে বাইআত করেন মালিক আশতার। এরপর একে একে অন্য সবার কাছ থেকে বাইআত গ্রহণ করেন। এভাবে বাইআত গ্রহণের প্রাথমিক পর্ব শেষ হলে হযরত আলী অন্য দুই বিশিষ্ট সাহাবী হযরত তালহা বিন উবাইদুল্লাহ ও হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়ামের বাইআত গ্রহণের গুরুত্ব অনুভব করলেন।
হযরত উসমানের পর এ দুজন সাহাবীও সম্ভাব্য খলিফা ছিলেন। কিন্তু হযরত আলীর তুলনায় তাদের সমর্থকের সংখ্যা ছিল কম। মহানবীর মৃত্যুর পর থেকেই হযরত আলী, তালহা ও যুবাইর একই রাজনৈতিক বলয়ে অবস্থান করছিলেন। মহানবীর মৃত্যুর পর খিলাফতের দাবী নিয়ে যে তিনটি পৃথক রাজনৈতিক পক্ষের উদ্ভব হয়েছিল তার একটি পক্ষে ছিলেন এ তিন সাহাবী। তখন তাদের পক্ষ থেকে হযরত আলীকেই খলিফা পদের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল।
পরবর্তীতে তিন খলিফার যুগে এ তিন বিখ্যাত সাহাবীকে খিলাফতের তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যায়নি। কেবল হযরত আবু বকরের সময়ে স্বঘোষিত নবী তোলায়হার বিরুদ্ধে একটি অভিযানে তাদেরকে পাঠানো হয়েছিল। এছাড়া আর কোন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অভিযানে তাদেরকে পাঠানো হয়নি। পারস্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য বিজয়ে তাদের কোন ভূমিকা ছিল না। তাই তারা কোন প্রদেশের শাসনকর্তাও হননি।
যদিও মহানবীর যুগে এ তিন সাহাবীকে খুবই বড় মাপের নেতা ও বীরযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হতো তবুও তিন খলিফার যুগে তারা অনেকটা নিস্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলেন। হযরত উসমানের পতনের পটভূমিতে তারা আবার রাজনৈতিক ময়দানে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। কিন্তু তখন তারা আর পরস্পরের রাজনৈতিক মিত্র না থেকে পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। তাই হযরত আলী অন্য দুজন সাহাবীর সমর্থন ছাড়া খলিফা পদটিকে প্রতিদ্বন্দ্বীতামুক্ত মনে করলেন না।
তিনি বিদ্রোহী ও জনসাধারণের কাছ থেকে বাইআত গ্রহণ করেও খলিফা পদের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। সর্বসাধারণের বাইআতের পর মালিক আশতার পালাক্রমে হযরত তালহা ও যুবাইরের কাছে গেলেন এবং তাদেরকে জোরপূর্বক হযরত আলীর সামনে এনে হাজির করলেন। হযরত আলী তাদেরকে সৌজন্যতা দেখিয়ে বললেন যে, যদি তাদের কেউ খলিফা হতে চান তাহলে তিনি তাঁর জন্য খলিফা পদ ছেড়ে দিতে রাজী আছেন।
কিন্তু তালহা ও যুবাইর কোন সাঁড়া দিলেন না। এবার তাদেরকে বলা হল তারা যেন হযরত আলীর হাতে বাইআত করেন। কিন্তু তারা বাইআত না করে চুপচাপ বসে থাকলেন। এ সময় মালিক আশতার হঠাৎ করে খাপ থেকে তরবারি বের হযরত তালহার সামনে দাঁড়ালেন এবং বললেন, “যদি তুমি বাইআত না কর তাহলে এখনই তোমাকে শেষ করে ফেলব।”
হযরত তালহা পরিস্থিতি লক্ষ্য করে হযরত আলীকে বললেন যে, যদি হযরত আলী উসমান হত্যাকারিদের শাস্তি প্রদানের নিশ্চয়তা দেন তাহলে তিনি বাইআত করতে রাজী আছেন। হযরত আলী এ শর্ত মেনে নিলেন। হযরত তালহা তখন বাইআতের জন্য তাঁর দুর্বল হাতটি বাড়িয়ে দিলেন। উহুদ যুদ্ধে এ হাতটি ভীষনভাবে আহত হয়েছিল। হযরত তালহার আহত হাতে বাইআত করার দৃশ্য দেখে তখন উপস্থিত অনেকে এটিকে হযরত আলীর খিলাফতের জন্য একটি অশুভ সংকেত বলে বিবেচনা করেন। পরবর্তীতে এ আশংকা সত্য প্রমাণিত হয়েছিল।
হযরত তালহার পর হযরত যুবাইরের সাথেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। তিনিও হযরত উসমান হত্যাকারিদের শাস্তির শর্তে আলীর হাতে বাইআত করলেন। এরপর হযরত সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসকে বাইআত করতে বলা হলে তিনি বললেন যে, তিনি সবার পরে বাইআত করবেন। তাঁর সাথে আর কোন জোরাজুরি হল না। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমারের বাইআত নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ার পর মালিক আশতার তরবারি বের করে বলেলেন, “আমি তাকে হত্যা করব।”
হযরত আলী মালিক আশতারকে থামিয়ে দিয়ে বললেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে উমারের পক্ষ থেকে কোন চক্রান্তের সম্ভাবনা নেই। এরপর হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার উমরা হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় রওনা হন। তখন চারদিকে রটে গেল যে, তিনি হযরত আলীর বিরুদ্ধে মক্কার লোকজনকে সংঘটিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই মদিনা ছেড়েছেন। ফলে হযরত আলী তাকে অবিলম্বে বন্দী করার উদ্দেশ্যে লোক পাঠিয়ে দেন।
সে মুহুর্তে হযরত উমারের স্ত্রী হযরত আলীকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলেন যে, আব্দুল্লাহ আলীর বিরুদ্ধে কিছুই করবেন না। ফলে হযরত আলী আশ্বস্ত হন। তবে আব্দুল্লাহ ছাড়াও মুহাম্মদ ইবনে মাসলামাহ, উসামা ইবনে শুবাহ, আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম প্রমুখ বিশিষ্ট সাহাবীরাও হযরত আলীর হাতে বাইআত করেননি। আরও অনেক সাধারণ মানুষও তাঁর হাতে বাইআত করেনি। বানি উমাইয়া অর্থাৎ উমাইয়া বংশের লোকজন হযরত আলীর হাতে বাইআত না করে মদিনা থেকে সিরিয়ায় পালিয়ে যেতে থাকে।
কেউ কেউ মক্কায়ও পালিয়ে যায়। যেসব সাহসী সাহাবী হযরত আলীর হাতে বাইআত না করে মদিনাতেই অবস্থান করছিলেন তারা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেন যে, হযরত আলীর খলিফা হওয়ার ঘটনায় মুসলমানদের মধ্যে যথেষ্ট রক্তারক্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। তাই তারা এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকতে চান। হযরত আলীর হাতে বাইআতের পরদিন হযরত তালহা ও যুবাইর তাঁর সাথে দেখা করলেন।
তারা তাকে জানালেন যে, যদি তিনি উসমান হত্যাকারিদের শাস্তির ব্যবস্থা না করেন তাহলে তাদের বাইআত অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে। হযরত আলী এ কাজের জন্য আরও কিছুটা সময় চাইলেন। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে কানুঘাষা শুরু হয়ে গেল। হযরত আলীর খিলাফতের বিপদেরও সূচনা সেখান থেকেই। উমাইয়াদের সাথে সরাসরি শত্রুতা নেই এমন সব লোকজন হযরত আলীকে এ কারণেই বাইআত দিয়েছিল যে, তিনি হাশেমী হলেও অন্ততপক্ষে উসমান হত্যার বিচারটুকু করবেন।
কিন্তু হযরত আলীর সময়ক্ষেপণের ইচ্ছা দেখে তাদের এ বিশ্বাসে চিড় ধরে। উমাইয়া ও হাশেমীদের বাইরে অনেক নিরপেক্ষ গোত্রের এমন অনেক লোকজন ছিল যারা উমাইয়া-হাশেমী দ্বন্দ্বে নিরপেক্ষ থাকলেও উমাইয়া খলিফা হযরত উসমানের হত্যাকাণ্ডকে মোটেও পছন্দ করেনি। আবার খলিফা উসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময়ে এদের অনেকেই বিদ্রোহীদেরকে মৌনসমর্থন দিয়েছিল এ কারণেই যে, তারা উমাইয়া বংশের লোকজনদের ক্ষমতা ও আধিপত্য পছন্দ করত না।
কিন্তু হযরত উসমানের পর বিদ্রোহীদের আধিপত্যও তাদেরকে বিরক্ত করে তোলে। উমাইয়া হোক অথবা হাশেমী হোক কিংবা অন্য যে কেউই হোক- কারও রাষ্ট্রবাদী আধিপত্য তাদের গোত্রীয় স্বাধীনতার পরিপন্থী ছিল। তাই উমাইয়াদের বিপরীতে হাশেমী খলিফা হযরত আলীকে সমর্থন দিলেও তারা বিদ্রোহীদের আধিপত্য মেনে নিতে চায়নি। হযরত আলীর সাথে বিদ্রোহীদের এতো উঠাবসা তারা পছন্দ করেনি।
খিলাফতের তৃতীয় দিনে হযরত আলী বিদ্রোহীদেরকে নিজ নিজ এলাকায় চলে যেতে বলেন। কিন্তু কিছু বিদ্রোহী মদিনায় থেকে গেল। এসব বিদ্রোহীরা মদিনায় থেকে গিয়েছিল সম্ভবত এ কারণেই যে, তারা হযরত উসমান হত্যার বিচার যাতে কোন ভাবেই না হয় সে বিষয়টিকে নিশ্চিত করেই মদিনা ত্যাগ করতে চেয়েছিল। খিলাফতের তৃতীয় দিনে হযরত আলী আরেকটি কঠোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
তিনি হযরত তালহা ও যুবাইরে উপর মদিনার বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন। খিলাফতের চতুর্থ দিনে হযরত আলী হযরত উসমান কর্তৃক নিযুক্ত সকল গভর্নর, কর্মকর্তা ও প্রশাসককে পদচ্যুত করে একটি লিখিত আদেশ জারি করলেন। কিছু প্রদেশে এ আদেশটি কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও সিরিয়ার মতো এলাকায় এ আদেশ কীভাবে কার্যকর হবে সে প্রশ্নটিও উত্থাপিত হলো।
এ প্রশ্নের জবাবে হযরত আলী বললেন, “মুয়াবিয়াকে আমি তলোয়ারের আঘাতেই শায়েস্ত করব।” কিন্তু মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে হুট করে কোন কিছু করার সামর্থ তাঁর ছিল না। তাই অন্যান্য প্রদেশের মতো সিরিয়াতেও একজন গভর্নর পাঠিয়ে তিনি সিরিয়ার প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইলেন। সুহায়েল ইবনে হানিফকে তিনি সিরিয়ার গভর্নর নিযুক্ত করে পাঠালেন। কিন্তু সুহায়েল তাবুক অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে পুনরায় মদিনায় ফেরত চলে আসলেন।
তাবুক পৌঁছে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, হযরত উসমান ছাড়া অন্য কারও নিযুক্ত গভর্নর সিরিয়ায় পৌঁছালে তাঁর প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা অসম্ভব। তাই তিনি মদিনায় ফিরে আসেন। কুফায় প্রেরিত হযরত আলীর গভর্নর আম্মারা ইবনে শিহাবও মদিনায় ফিরে আসলেন। বসরায় প্রেরিত উসমান ইবনে হানিফ এবং মিশরে প্রেরিত কায়েস ইবনে সাদ স্ব স্ব প্রদেশের আংশিক লোকের আনুগত্য অর্জনে সক্ষম হন এবং সীমিত ক্ষমতা নিয়েই মসনদে বসেন।
মিশরের উমাইয়া বিরোধী লোকজন কায়েসের আনুগত্য স্বীকার করলেও বাকীরা মদিনা থেকে বিদ্রোহীরা না ফিরে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইয়েমেন ছিল হযরত আলীর সবচেয়ে অনুগত এলাকা। সেখানে প্রেরিত হযরত আলীর গভর্নর উবাইদুল্লাহ বিন আব্বাস নির্বিঘ্নে তাঁর নিজের হাতে শাসনভার তুলে নেন এবং আগের শাসনকর্তা মক্কায় চলে আসেন। পরবর্তীতে তিনি মক্কায় জড়ো হওয়া হযরত আলীর প্রতিপক্ষের সাথে হাত মিলিয়েছিলেন।
সিরিয়া ও কুফায় নতুন গভর্নর পাঠাতে ব্যর্থ হয়ে হযরত আলী ও এ দু’প্রদেশের ক্ষমতাসীন গভর্নরদের কাছে আনুগত্যের শপথ চেয়ে পত্র পাঠালেন। কুফার গভর্নর আবু মুসা আশআরী খলিফার পত্রের একটি সদুত্তর পাঠালেন। তিনি খলিফাকে জানালেন যে, কুফার অধিকাংশ লোক তাঁর অত্যন্ত অনুগত। বিদ্রোহী স্বভাবের কুফাবাসীরা তাকে যেভাবে সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করেছে সেভাবে হযরত আলীর নতুন কোন গভর্নরকে গ্রহণ না-ও করতে পারে।
তাই খলিফার অনুগত শাসনকর্তা হিসেবে তিনিই সেখানকার গভর্নর থাকতে চান। হযরত আলী তাঁর আনুগত্যে খুশী হয়ে তাকেই কুফার গভর্নর হিসেবে রেখে দিলেন। কিন্তু সিরিয়া নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হল। দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও সিরিয়ায় পাঠানো পত্রের কোন উত্তর আসছিল না। সিরিয়ায় প্রেরিত দূতকে হযরত মুয়াবিয়া মাসের পর মাস অপেক্ষায় রেখে দিলেন।
তিন মাস পার হয়ে গেলে তিনি দূত মারফৎ এক অদ্ভুত উত্তর পাঠালেন। তাঁর সেই উত্তরপত্র ছিল একটি শূন্য চিঠি। এতে কোন লেখা ছিল না। এ চিঠি দ্বারা তিনি হয়ত বুঝিয়েছিলেন যে, সিরিয়ার দিকে হাত বাড়ালে হযরত আলীকে খালি হাতেই ফিরতে হবে এবং হযরত আলীকে দেওয়ার মতো কোন কিছু মুয়াবিয়ার কাছে নেই। পত্রবাহকের কাছ থেকে হযরত আলী আরও জানতে পারলেন যে, খলিফা উসমানের রক্তমাখা জামা এবং খলিফা পত্নী নায়লার কর্তিত আঙ্গুলী একজন মদিনাবাসীর মাধ্যমে গোপনে সিরিয়ায় পৌঁছেছে।
সেগুলো দামেস্কের মসজিদে প্রদর্শিত হচ্ছে। ষাট হাজার সৈন্য হযরত উসমানের জামার পাশে প্রতিদিন অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে এবং তারা হযরত আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দামেস্কের মসজিদের মিম্বরে রাখা হযরত উসমানের জামা দেখে সেখানকার জনগণ এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। হযরত আলী এ সংবাদ শুনার পর সবাইকে সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন।
হযরত তালহা ও যুবাইর হযরত আলীর এ সিদ্ধান্তের কথা শুনে তাঁর সাথে দেখা করলেন এবং উমরা পালনের জন্য মক্কায় চলে যেতে চাইলেন। হযরত আলী তাদেরকে নজরবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়ে মক্কায় যাওয়ার অনুমতি দিলেন। এরপর তিনি একটি সাধারণ ঘোষণার মাধ্যমে মদিনার সবাইকে অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র নিয়ে প্রস্তুত হতে বললেন। একই সাথে কুফা, বসরা ও মিশরের গভর্নরদের কাছে পত্র লিখে তাদেরকেও সৈন্য সংগ্রহের আদেশ দিলেন।
এভাবে হযরত আলী যখন সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি প্রায় গুছিয়ে এনেছেন তখনই খবর এল যে, মক্কায় তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি চলছে। ফলে হযরত আলী সিরিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান আপাতত মূলতবী রাখলেন। মদিনা থেকে বানি উমাইয়ার যেসব লোকজন মক্কায় পালিয়ে গিয়েছিল তারা হযরত উসমান হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। হযরত উসমান কর্তৃক নিযুক্ত মক্কার গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে হাযরামীর নেতৃত্বে তারা সেখানে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
হযরত আলী কর্তৃক পদচ্যুত বসরার গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে আমির এবং ইয়েমেনের গভর্নর ইয়ালা ইবনে মুনাব্বিহ মক্কায় এসে এদের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। তবে অদ্ভুত ব্যাপার হল, এদের সবার ওপরে নেতৃত্বের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন হযরত আবু বকরের কন্যা ও মহানবীর সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী হযরত আয়িশা সিদ্দীকা। হযরত আয়িশা সর্বপ্রথম উসমান হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
বিদ্রোহীদের হাতে মদিনার পতনের পর তিনি উমরা পালনের জন্য মক্কায় চলে যান। সেখান থেকে মদিনায় ফেরার পথে সারিফ নামক স্থানে পৌঁছার পর তিনি হযরত উসমান হত্যার সংবাদ পান। একই সাথে তিনি এটিও জানতে পারেন যে, হযরত উসমানের হত্যাকারিরা মদিনায় বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব সংবাদ শুনার পর তিনি উসমান হত্যার প্রতিশোধের সংকল্প নিয়ে সেখান থেকে পুনরায় মক্কায় চলে যান।
মক্কায় পৌঁছে তিনি সমবেত মানুষের সামনে হযরত উসমান হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের আহ্বান জানিয়ে এক ভাষণ দেন। হযরত আয়িশার এ ভাষণের পরই উসমান হত্যার প্রতিশোধকামীরা মক্কার গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে হাযরামীর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। বসরা ও ইয়েমেনের পদচ্যুত গভর্নরদের যোগদানের ফলে এ দলটি আরও ভারী হয়ে উঠেছিল। তবে দলটির মুখপাত্র ও প্রধান নেতা হিসেবে হযরত আয়িশাকেই সবাই মেনে নিয়েছিল। তিনিই মক্কার প্রতিশোধকামী দলটির নীতি নির্ধারকের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন।
এরই মধ্যে মদিনা থেকে হযরত তালহা ও যুবাইর মক্কায় এসে পৌঁছেন। তারা হযরত আয়িশাকে জানালেন যে, বিদ্রোহীদের ভয়েই তারা মদিনা থেকে পালিয়ে এসেছেন। সেই সাথে তারা একথাও জানালেন যে, হযরত আয়িশার নেতৃত্বে তারা হযরত আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। মক্কার প্রতিশোধকামী দলটিতে হযরত তালহা ও যুবাইরের মতো সাহাবীদের যোগদানের ফলে এ দলটি আর তুচ্ছ রইল না। দলটির মূল নেতৃত্ব হযরত আয়িশার হাতেই থাকল।
হযরত আয়িশার অধীনে হযরত তালহা, হযরত যুবাইর, বসরার প্রাক্তন গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে আমীর এবং ইয়েমেনের প্রাক্তন গভর্নর ইয়ালা ইবনে মুনাব্বিহ এ দলটির সামরিক উপদেষ্টা ও অধিনায়ক নিযুক্ত হলেন। এ চারজন সেনাপতি শীঘ্রই একটি ছোটখাট সেনাবাহিনী গড়ে তোললেন। হযরত আলীর বাহিনী মক্কায় এসে হামলা চালালে তা প্রতিরোধের মতো শক্তি এ বাহিনীর ছিল না। তাই কেউ কেউ পরামর্শ দিল এ বাহিনী নিয়ে সিরিয়ায় চলে যাওয়া উচিত।
কিন্তু সিরিয়ার সাথে হযরত তালহা ও যুবাইরের তখনকার রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল অস্পষ্ট। এছাড়াও মদিনাকে পাশ কাটিয়ে মক্কা থেকে সিরিয়ায় চলে যাওয়া অসম্ভব ছিল। সর্বোপরি যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটি হল, সিরিয়ার রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে হযরত তালহা ও যুবাইরের রাজনৈতিক স্বার্থের দূরত্ব ছিল স্পষ্ট। হযরত তালহা ও যুবাইর কখনো মুয়াবিয়াকে খলিফা বানানোর কথা বলেননি। তারা নিজেদেরকে খলিফা পদের যোগ্য মনে করতেন।
সিরিয়ার জন্য মুয়াবিয়ার নিজের বাহিনীই ছিল যথেষ্ট এবং হযরত তালহা ও যুবাইরের মতো অস্পষ্ট মিত্রদের নিয়ে তাঁর তেমন কোন করণীয়ও ছিল না। তাই সিদ্ধান্ত হল যে, মক্কায় সমবেত হযরত আলীর প্রতিপক্ষ দলটি হযরত আলী ও মুয়াবিয়া উভয়ের কর্তৃত্বের বাইরে তৃতীয় কোন স্থানে সংগঠিত হয়ে নিজেদের নতুন হুকুমাত স্থাপন করবে এবং সেখান থেকে হযরত আলীকে পরাজিত করে নতুন খিলাফত ঘোষণা করবে। সুবিধা ও সম্ভাব্যতার বিচারে এ কাজের জন্য ইরাকই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট স্থান।
তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে, প্রথমে দক্ষিণ ইরাকের বসরা দখল করা হবে। বসরার প্রাক্তন গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে আমের বসরা সম্পর্কে ভালভাবে জানতেন এবং বসরাবাসীদের মধ্যে হযরত তালহার অনেক সমর্থক ছিল। বসরায় হযরত আলীর নিযুক্ত গভর্নর পূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেননি। কেবল অর্ধেক লোকই তাঁর অনুগত হয়েছিল। বাকী অর্ধেক লোক ছিল হযরত আলীর খিলাফতের বিরোধী। তাই হযরত আয়িশার বাহিনী বসরার দিকে অগ্রসর হল।
বসরা এবং ইয়েমেনের প্রাক্তন দুই গভর্নরের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ এবং রসদ ছিল। ইয়েমেনের গভর্নর ছয়শ উট এবং ছয় লক্ষ দিনার নিয়ে মক্কায় এসেছিলেন। হযরত আয়িশার সেনাবাহিনী গঠনের তাদের এসব সম্পদ কাজে লেগেছিল। অর্থ ও রসদের লোভে মক্কার অনেকেই বসরামুখী বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। ফলে দেড় হাজার লোকের একটি বাহিনী তৈরি হয়। মক্কা থেকে বের হওয়ার পর আরও অনেক লোক এসে এ বাহিনীতে যোগ দেয়।
ফলে কিছুদূর যাওয়ার পর লোকসংখ্যা দাঁড়ায় তিন হাজার। মক্কায় অবস্থানকারি বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার এ বাহিনীতে যোগ দেননি। হযরত আলীকে দেওয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করেছিলেন। বাহিনীটি কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর প্রয়াত খলিফা হযরত উসমানের উপদেষ্টা মারওয়ান একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তিনি হযরত তালহা ও যুবাইরকে প্রশ্ন করেন যে, যদি হযরত আয়িশার বাহিনী বিজয়ী হয় তাহলে তাদের দুজনের মধ্যে কে পরবর্তী খলিফা নির্বাচিত হবেন?
এ প্রশ্নের জবাবে হযরত তালহা ও যুবাইর জানান যে, যদি এ বাহিনী বিজয়ী হয় তাহলে তাদের দুজনের মধ্যে যাকে জনগণ পছন্দ করবে তিনিই খলিফা নির্বাচিত হবেন। একথা শুনার পর সাইদ ইবনুল আস নামে এক সাহাবী হযরত উসমানের পুত্রকেই খিলাফতের হকদার বলে দাবী করেন। কিন্তু তালহা ও যুবাইর এ দাবী অস্বীকার করেন। ফলে সাইদসহ কয়েকজন সাহাবী বাহিনী থেকে বেরিয়ে যান।
তাদের সাথে সাকীফ গোত্রের অনেক লোকও ফিরে চলে যায়। হযরত তালহা ও যুবাইর বাকী লোকদের নিয়েই ইরাকের দিকে অগ্রসর হলেন। তাদের বাহিনী বসরার কাছাকাছি পৌঁছালে তাদেরকে প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে বসরার গভর্নর উসমান ইবনে হুনায়ফ একটি বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। উসমান ইবনে হুনায়ফের বাহিনী বসরা থেকে বেরিয়ে আসার পর মারুর নামক স্থানে হযরত আয়িশার বাহিনীর মুখোমুখী হয়।
উসমানের বাহিনীর একাংশ হযরত তালহা ও যুবাইরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চায়নি। উসমান তাঁর অনুগত সৈন্যদের নিয়ে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত পরাজিত ও বন্দী হন। হযরত আয়িশা উসমানকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলে তিনি মুক্তি লাভ করেন এবং খলিফার সাথে দেখা করার জন্য মদিনার দিকে চলে যান। বসরা হযরত তালহা, যুবাইর ও আয়িশার দখলে আসলেও সেখানকার লোকজন উভয়পক্ষেই বিভক্ত ছিল।
মক্কার বিরুদ্ধাচরণের খবর পেয়ে হযরত আলী আগেই সিরিয়া অভিযান মুলতবী করেছিলেন। বসরায় অভিযানের খবর পেয়ে তিনি হযরত তালহা, যুবাইর ও আয়িশার বিরুদ্ধে মদিনাবাসীর সাহায্য কামনা করলেন। মদিনাবাসীদের অনেকেই এ যুদ্ধে দ্বিধাবোধ করলেও শেষ পর্যন্ত হযরত আলীর পক্ষে যুদ্ধ করার মতো যথেষ্ঠ লোকজন জড়ো হল। হযরত আলী তাঁর বাহিনী নিয়ে বসরা অভিমুখে রওনা হলেন।
হযরত উসমানকে হত্যাকারি বিদ্রোহীরা ছিল এ বাহিনীর সবচেয়ে সক্রিয় অংশ। হযরত উসমানকে হত্যার পর কুফা ও মিশরের অনেক বিদ্রোহী মদিনায় থেকে গিয়েছিল। হযরত আলীর যুদ্ধাযাত্রায় তারাই সর্বাগ্রে যোগ দিয়েছিল। হযরত আলীর বাহিনী যীযায় পৌঁছার পর খবর এল যে, হযরত তালহা ও যুবাইর বসরা দখল করেছেন। হযরত আলী সেখানেই অবস্থান নিয়ে করে আরও সৈন্য সংগ্রহের উদ্যোগ নেন।
তিনি সৈন্য সংগ্রহের জন্য কুফায় লোক পাঠিয়ে দিলেন এবং মদিনা থেকে আরও রসদ নিয়ে আসার ব্যবস্থা করলেন। যীযাহ থেকে রওনা হওয়ার পূর্বে তাঈ গোত্রের কিছু লোক এসে হযরত আলীর বাহিনীতে যোগ দেয়। হযরত আলীর বাহিনী সাবিয়াহ নামক স্থানে পৌঁছার পর বসরার পরাজিত গভর্নর উসমান ইবনে হুনায়ফ সেখানে এসে পৌঁছালেন।
কুফা থেকে সৈন্য সংগ্রহের জন্য হযরত আলী যে দুজনকে পাঠিয়েছিলেন তারা ছিলেন মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর এবং মুহাম্মদ ইবনে জাফর। কুফার জনগণ তাদের অহবানে সাঁড়া না দেওয়ায় তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। কুফার গভর্নর আবু মুসা আশআরী এ যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করছিলেন। হযরত আলী দ্বিতীয দফায় কুফায় পাঠালেন মালিক আশতার এবং ইবনে আব্বাসকে।
তারাও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। এবার হযরত আলী পাঠালেন নিজ পুত্র হাসান এবং আম্মার ইবনে ইয়াসিরকে। আম্মারের মাতা হযরত সুমাইয়া ছিলেন ইসলামের প্রথম শহীদ। তাঁর পিতা-মাতা দুজনই ইসলাম গ্রহণের অপরাধে শহীদ হয়েছিলেন। এ কারণে মুসলমানদের মধ্যে আম্মারের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। কিন্তু খলিফা উসমান একবার আম্মারকে প্রকাশ্যে শাস্তি দিয়েছিলেন। তাই আম্মার উসমান হত্যাকারি বিদ্রোহীদের সঙ্গে প্রকাশ্যেই জড়িত হয়েছিলেন।
হযরত হাসান ও হযরত আম্মার কুফার মসজিদে সমবেত জনগণকে হযরত আলীর পক্ষে আনতে চেষ্টা করেন। হযরত আম্মার উসমান হত্যাকারিদের সাথে জড়িত থাকায় কুফার গভর্নর আবু মুসা তাকে তিরষ্কার করেন এবং মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ হারাম বলে ফতোয়া দেন। এতে আম্মার প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে আবু মুসাকে গালি দিয়ে বসেন। ফলে উপস্থিত লোকজন আম্মারকে আক্রমণ করে বসে।
আবু মুসা নিজেই তখন আম্মারকে রক্ষা করেন। এরপর যায়েদ নামে জনৈক ব্যক্তি কুফাবাসীর প্রতি লিখা হযরত আয়িশার একটি পত্র পড়ে শুনান। এ পত্রে হযরত আয়িশা কুফাবাসীকে নিরপেক্ষ থাকার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু পত্র পাঠকারি যায়েদ নিজেই হযরত আলীর পক্ষে দাঁড়াবার যৌক্তিকতা তোলে ধরে উপস্থিত জনতার সামনে তাঁর মতামত তোলে ধরেন। উপস্থিত জনতার মধ্যে হযরত আলীর সমর্থকরা তাকে জোরালোভাবে সমর্থন জানায়।
গভর্নর আবু মুসার নিরপেক্ষতার আহ্বান উপেক্ষা করে এই প্রথম কুফায় হযরত আলীর পক্ষে কেউ আওয়াজ তুলল। এ সময় হযরত হাসানের বক্তব্য উপস্থিত জনতাকে খুবই প্রভাবিত করে এবং তারা হযরত আলীর প্রতি সমর্থন জানাতে থাকে। ঠিক সেই মুহুর্তে দ্বিতীয়বারের মতো কুফায় পৌঁছালেন মালিক আশতার। তাঁর উপস্থিতিতে হযরত আলীর প্রতি সমর্থন আরও বেড়ে যায়। মালিক আশতারের উপস্থিতিতে আবু মুসা আশআরীর কথা আর কেউ শুনল না।
মালিক আশতার কুফার বিভিন্ন গোত্রকে অত্যন্ত সফলভাবেই হযরত আলীর পক্ষে উদ্বুদ্ধ করতে সক্ষম হন। ফলে বসরার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য কুফায় শীঘ্রই নয় হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী প্রস্তুত হয়ে যায়। হযরত হাসান, আম্মার এবং মালিক আশতারের নেতৃত্বে এ বাহিনী হযরত আলীর বাহিনীর সাথে যীকার নামক স্থানে মিলিত হয়। এদেরকে নিয়ে হযরত আলীর বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা দাঁড়ায় বিশ হাজার।
হযরত আলী যুদ্ধ এড়াবার জন্য প্রথমে কুটনৈতিক প্রচেষ্টা চালান। আপোষ মীমাংসার একটি উপায় খুঁজে বের করার জন্য তিনি বসরায় দূত পাঠালেন। হযরত আলীর দূত কাকা ইবনে আমের বসরায় গিয়ে তিন নেতা-নেত্রীর সাথে দেখা করলেন। তারা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তাকে জানালেন যে, হযরত উসমান হত্যার বিচার ছাড়া আপোষের কোন সুযোগ নেই।
ইতোমধ্যে হযরত তালহা ও যুবাইর হযরত উসমান হত্যার বদলা হিসেবে বসরায় বেশ কিছু বিদ্রোহীকে হত্যা করেছিলেন। হারকুস নামে এক বিদ্রোহীকে হত্যা করতে গিয়ে তারা ছয় হাজার লোকের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ফলে তাদেরকে ব্যর্থ হতে হয়েছিল। হযরত আলীর দূত তাদেরকে এ ব্যর্থতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে হযরত আলীর সীমাবদ্ধতার দিকটিও বিবেচনার অনুরোধ জানান। এতে হযরত তালহা, যুবাইর ও আয়িশা যথেষ্ঠ নমনীয় হন।
হযরত আলীর দূত ফিরে আসার পর তিনি তাঁর পুরো বাহিনীকে একত্রিত করে আপোষের সম্ভাবনার কথা জানান। পরের দিন বসরার দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় তিনি হযরত উসমান হত্যাকারি বিদ্রোহীদেরকে মূল বাহিনী থেকে পৃথক থাকার নির্দেশ দেন। এ বিদ্রোহী সৈন্যদের সংখ্যা ছিল আড়াই হাজার। তারা হযরত আলী ও আয়িশার আপোষের মধ্যে নিজেদের মৃত্যুপরোয়ানা খুঁজে পায়। তাই তারা যে কোন মুল্যে আপোষ প্রতিহত করতে সংকল্পবদ্ধ হয়।
তারা হযরত আলীর মুল বাহিনী থেকে পৃথক থাকলেও মূল বাহিনীর সাথে সাথেই বসরার দিকে অগ্রসর হয়। বসরার সন্নিকটে পৌঁছার পর আসরে উবাইদুল্লাহর মাঠে হযরত আলীর বাহিনী তাবু ফেলে। অন্যদিকে হযরত তালহা, যুবাইর ও আয়িশার বাহিনী মাঠের অন্যদিকে অবস্থান নেয়। তাদের বাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা ছিল ত্রিশ হাজার। তিন দিন পর্যন্ত উভয় বাহিনী পরস্পরের মুখোমুখি হয়ে চুপচাপ অবস্থান করতে থাকে। এ সময় জনৈক ব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে হযরত আলী একটি অদ্ভুত ফতোয়া দিয়েছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, যদি যুদ্ধ হয় তাহলে উভয় পক্ষের নিহত ব্যক্তিরা জান্নাতে যাবে। অপেক্ষার তৃতীয় দিন সন্ধ্যায় উভয় পক্ষের সালিশরা আপোষের শর্তাবলী চুড়ান্ত করেন এবং সিদ্ধান্ত হয় যে, পরদিন ভোরবেলায় উভয় পক্ষ আপোষনামায় স্বাক্ষর করবেন। কিন্তু পরদিন ভোরবেলায় উভয়পক্ষের সৈন্যদের ঘুম ভাঙ্গল যুদ্ধের হাকডাকের মধ্যে এবং এক ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল উভয় পক্ষের পঞ্চাম হাজার সৈন্য।
চতুর্থদিন অতি প্রত্যুষে যখন উভয়পক্ষের সৈন্যরাই ঘুমিয়ে আছে তখন আড়াই হাজার বিদ্রোহী সৈন্য হযরত আলীর বাহিনীর পক্ষ থেকে হযরত তালহা ও যুবাইরের বাহিনীর ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। বসরার বাহিনীর যে অংশের উপর এ হামলা চালানো হয় তারা সাথে সাথেই অস্ত্র হাতে প্রতিরোধে নেমে যায়। ফলে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। উভয়পক্ষের সকল সৈন্যই এক মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
হযরত আলী তাঁর বাহিনীকে শত্রুদের মোকাবিলায় উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর বাহিনীর অনেকেই যুদ্ধে বেশ বীরত্ব প্রদর্শন করে। ফলে প্রতিপক্ষের চেয়ে সংখ্যায় দশ হাজার কম হয়েও হযরত আলীর বাহিনী বেশি সফলতা অর্জন করতে থাকে। অন্যদিকে হযরত আয়িশা বর্মাবৃত হয়ে একটি উটের উপর সওয়ার হন এবং উটে চড়ে যুদ্ধের ময়দানে চলে আসেন।
হযরত আয়িশাকে যুদ্ধের ময়দানে দেখে বসরার সৈন্যরা উজ্জীবীত হয়ে ওঠে এবং বীরত্বের সঙ্গে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হযরত আলী প্রতিপক্ষের অবাঞ্চিত নিমর্মতা লক্ষ্য করে স্বয়ং নিজে অস্ত্রসজ্জিত হয়ে মাঠে নামেন এবং প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমণ পরিচালনার ক্ষেত্রে হযরত আলী নিজ বাহিনীকে নিখুঁতভাবে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন। রণকুশলী হযরত আলীর পরিচালনায় মদিনার বাহিনী দ্রুতই সাফল্যের দিকে এগিয়ে যায়।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই হযরত তালহার পায়ে একটি বিষক্ত তীর বিদ্ধ হয় এবং এতে অধিক রক্তক্ষরণের ফলে তিনি মারা যান। হযরত যুবাইরকে যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে জনৈক সৈন্য হত্যা করে। এ দুই নেতার মৃত্যুতে বসরার বাহিনী অনেকটা নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। বিভিন্ন গোত্রের নেতা ও ছোটখাটো অধিনায়করা নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে হযরত আয়িশার পক্ষে লড়ে যাচ্ছিলেন। হযরত আয়িশার উট যুদ্ধের ময়দানে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
উটের পিঠে হযরত আয়িশাকে দেখে বসরার সৈন্যরা তাদের মনোবল ফিরে পাচ্ছিল। হযরত আয়িশার উটের চারপাশে ভয়ঙ্কর লড়াই চলছিল। এই উট ছিল হযরত আলীর সৈন্যদের লক্ষ্যবস্তু। কিন্তু হযরত আয়িশার সৈন্যরা অকাতরে জীবন দিয়ে হযরত আলীর সৈন্যদের ঠেকিয়ে রাখছিল। বসরার সৈন্যরা অনবরত নিহত হচ্ছিল কিন্তু তারা হযরত আলীর কোন সৈন্যকে আয়িশার ধারে কাছেও ঘেঁষতে দিচ্ছিল না।
চতুর্দিক থেকে হযরত আয়িশার বর্মের ওপর তীর বর্ষিত হচ্ছিল এবং তিনি চিৎকার করে উসমান হত্যাকারিদেরকে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হযরত আলীর মতো রণকুশলী সেনাপতির নেতৃত্বে পরিচালিত বাহিনীর সুসংগঠিত হামলা প্রতিরোধের শক্তি বসরার বাহিনীর ছিল না। তাই তারা সংখ্যায় বেশি হয়েও পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছিল। কিন্তু হযরত আয়িশার উটকে ঘিরে তারা অবার নব উদ্যমে এগিয়ে যায়।
কিছুক্ষণের মধ্যেই হযরত আয়িশার উটের চারপাশে লাশের স্তুপ জমে যায়। হযরত আলী এই দৃশ্য দেখে বুঝে নিলেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত এই উট যুদ্ধের ময়দানে দৃশ্যমান থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধ হবে না। তাই হযরত আলী তার লোকদেরকে আদেশ দিলেন- যেভাবে পার এই উটকে আঘাত কর। এই উট ভূমিতে লুটিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধেরও সমাপ্তি ঘটবে।
হযরত আলীর পক্ষে বিদ্রোহী নেতা মালিক আশতার অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করছিলেন। উসমান হত্যাকারি বিদ্রোহীরাও প্রশংসনীয়ভাবে লড়ে যাচ্ছিল। তারা হযরত আলীর পরামর্শ অনুযায়ী আয়িশার উট লক্ষ করে একের পর এক জোরদার হামলা চালায়। কিন্তু উটকে ঘিরে থাকা আয়িশার বাহিনী অত্যন্ত বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে সবকয়টি হামলা প্রতিরোধ করে।
এ সময় হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়ামেরর পুত্র আব্দুল্লাহ হযরত আয়িশার উট রক্ষা করতে গিয়ে আহত হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হযরত আলীর সৈন্যরা লাশের পাহাড়ের উপর দিয়ে এগিয়ে এসে এমন এক জোরালো হামলা চালায় যে, তারা হযরত আয়িশার উটের সামনের স্থানটি এক মুহুর্তের জন্য ফাঁকা করে ফেলতে সক্ষম হয়। সে মুহুর্তেই হযরত আলীর জনৈক যোদ্ধা হযরত আয়িশার উটের পায়ে চোখের পলকে এক আঘাত করে বসে।
সাথে সাথে হযরত আয়িশার উটটি চিৎকার করে বসে পড়ে। হযরত আয়িশার উট ভুলুণ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে তাঁর বাহিনী বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং হযরত আলীর বাহিনী চূড়ান্ত বিজয় লাভ করে। হযরত আলীর বাহিনী হযরত আয়িশার উটটিকে ঘেরাও করে রাখে। হযরত আলী আয়িশার ভাই মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরকে তাঁর বোনের দেখাশুনার দায়িত্ব প্রদান করেন। এই যুদ্ধ ইতিহাসে ‘জাঙ্গে জামাল’ বা ‘উটের যুদ্ধ’ নামে পরিচিত।
যেহেতু হযরত আয়িশা জামাল বা উটে চড়ে যুদ্ধে গিয়েছিলেন এবং সেটিই যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল তাই এ যুদ্ধের এরকম নামকরণ হয়। উটের যুদ্ধে হযরত আয়িশার পক্ষে ছিলেন ত্রিশ হাজার সৈন্য যাদের মধ্যে থেকে নয় হাজার সৈন্য নিহত হয়েছিলেন। অন্যদিকে হযরত আলীর বিশ হাজার সৈন্যের মধ্যে এক হাজার সত্তরজন সৈন্য নিহত হয়েছিলেন। অর্থাৎ জাঙ্গে জামালে নিহত সৈন্যদের মোট সংখ্যা ছিল দশ হাজার।
জঙ্গে জামালের বিজয়ের পরদিন হযরত আলী বসরায় প্রবেশ করেন এবং বসরাবাসীদের বাইআত গ্রহণ করেন। হযরত আলী আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে বসরার গভর্নর নিযুক্ত করেন। কিছুদিন পর তিনি হযরত আয়িশাকে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের সঙ্গে মক্কায় পাঠিয়ে দেন। হযরত আয়িশা মক্কায় হজ্জ্ব আদায় করার পর মদিনায় চলে যান। এরপর তিনি আর কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেননি।
জঙ্গে জামালের পরাজয়ের পর এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারি উমাইয়ারা সিরিয়ায় চলে যায়। হযরত যুবাইর ইবনুল আওয়ামের পুত্র আব্দুল্লাহ হযরত আয়িশার সাথে মক্কায় চলে যান। হযরত আলী বসরার কোষাগারের সকল অর্থ তার সৈন্যদেরকে বণ্টন করে দিয়ে দেন। প্রত্যেক সৈন্য পাঁচ দিরহাম করে পায়। এই অর্থ বণ্টন করার পর হযরত আলী তাঁর সৈন্যদেরকে বলেন: যদি তোমরা সিরিয়া আক্রমণ করে বিজয়ী হতে পার তাহলে নির্দিষ্ট ভাতা ছাড়াও এই পরিমাণ অর্থ তোমাদেরকে দেওয়া হবে।
তবে বিদ্রোহীদের একাংশ এ আশ্বাসে সন্তুষ্ট হল না। তারা হযরত আলী প্রদত্ত অর্থে সন্তুষ্ট না হয়ে বসরা ছেড়ে চলে গেল। এরা দ্রুত ইরাক ও আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং দুর্বৃত্ত ও দস্যু প্রকৃতির লোকদেরকে নিজেদের সাথে ভিড়িয়ে নেয়। এরা একটি বিরাট দল গড়ে তোলে। দুর্বৃত্তদের এই দলটি নিজেদের শক্তি সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে ইরানের সিজিস্তানের দিকে যাত্রা করে। হযরত আলী এদেরকে দমনের জন্য একটি বাহিনী পাঠিয়ে দেন।
এ বাহিনী পরাজিত হলে তিনি চার হাজার সৈন্যের আরেকটি বাহিনী পাঠিয়ে দেন। দ্বিতীয় বাহিনী এদেরকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। ইতোমধ্যে সিফফীন যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। তাই পরাজিত দুর্বৃত্তদের অনেকেই এ সুযোগে হযরত আলীর বাহিনীতে এসে যোগদান করে। জঙ্গে জামালের পর হযরত আলী তাঁর রাজধানী মদিনায় ফিরে যাওয়ার আর কোন সুযোগই পেলেন না। কারণ সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তাকে ইরাকেই অবস্থান করতে হচ্ছিল।
মদিনার লোকজন তখন অনেকটাই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল। মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে অনেকেই তখন নিশ্চিতভাবে কাউকে সমর্থন করতে পারছিল না। অন্যদিকে ইরাকের কুফায় হযরত আলীর সমর্থকের সংখ্যা ছিল বেশি এবং কুফা ছিল ইরাকের অধিক নিকটবর্তী। তাই হযরত আলী তাঁর সেনাবাহিনী নিয়ে কুফায় চলে গেলেন এবং কুফা নগরীকেই তাঁর খিলাফতের রাজধানী ঘোষণা করলেন।
উল্লেখ্য যে, হযরত আলী তাঁর জীবনে আর কখনোই মদিনায় যেতে পারেননি। তিনি ইরাকেই নিহত হয়েছিলেন এবং ইরাকেরই কোন অজানা স্থানে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। হযরত আলী কুফায় রাজধানী স্থাপন করার পর হযরত মুয়াবিয়া সিরিয়ার নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। সিরিয়ায় হযরত মুয়াবিয়ার একটি বিশাল বাহিনী ছিল এবং এ বাহিনীর সৈন্যরা শপথ করেছিল যে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা উসমান হত্যার প্রতিশোধ না নেবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা বিছানায় ঘুমাবে না এবং ঠাণ্ডা পানিও পান করবে না।
কিন্তু ইরাক ও মিশর দুদিক থেকে সিরিয়ায় হামলা হলে তা প্রতিরোধের মতো সামর্থ্য সিরিয়ার ছিল না। তাই মিশরের গভর্নরের সাথে হযরত আলীর সম্পর্কের অবনতি ঘটানোর জন্য মুয়াবিয়া এক অদ্ভুত চাল চাললেন। মুয়াবিয়া জানতেন যে, হযরত আলী কর্তৃক নিযুক্ত মিশরের গভর্নর কায়েস ইবনে সাদ মিশরের সকল লোককে খলীফার অনুগত বানাতে পারেননি। মিশরের অনেক লোক ছিল উসমান হত্যার বিরোধী এবং তারা হযরত আলীকে খলিফা হিসেবে মেনে নেয়নি।
কায়েস এসব নিরপেক্ষ লোকজনকে ঘটাতে চাননি। কিন্তু হযরত আলীর পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে যে, কাউকে নিরপেক্ষ থাকতে দেওয়া উচিত হবে না এবং এসব লোকজনের কাছ থেকে জোর করে বাইআত আদায় করতে হবে। কায়েস খলিফাকে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, এসব লোকের ওপর জোর খাঁটাতে গেলে অনর্থক যুদ্ধের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। কিন্তু খলিফা তাঁর সিদ্ধান্তে অনড় রইলেন এবং উল্টো মুয়াবিয়ার সাথে কায়েসের আতাঁতের সন্দেহ করে বসলেন।
এ পরিস্থিতিতে মুয়াবিয়া তাঁর দরবারে ঘন ঘন কায়েসের প্রশংসা শুরু করে দিলেন। এই কাজটি তিনি এমনভাবে করছিলেন যাতে হযরত আলীর গোয়েন্দারা সংবাদটি যেনো হযরত আলীর কানে পৌঁছে দেয়। খবর ঠিকই হযরত আলীর গোয়েন্দারা তাঁর কানে পৌঁছে দিল। ফলে হযরত আলী মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের মিশরের নতুন গভর্নর বানিয়ে পাঠালেন। কায়েস মর্মাহত হয়ে হযরত আলীর কাছে চলে আসেন।
অন্যদিকে মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর মিশরের নিরপেক্ষ লোকজনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে গিয়ে তাদের সাথে এমন এক বিরোধে জড়িয়ে পড়েন যা থেকে তিনি আর কখনও বের হতে পারেননি। ফলে হযরত মুয়াবিয়া মিশরের বিপদ হতে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন এবং সিফফীন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। মুয়াবিয়ার যুদ্ধ প্রস্তুতির কথা শুনে বিখ্যাত সাহাবী আমর ইবনুল আস ফিলিস্তিন থেকে সিরিয়ার চলে যান এবং মুয়াবিয়ার সাথে যোগ দেন।
মুয়াবিয়ার মতো তিনিও মনে করতেন যে, হযরত আলী হচ্ছেন বিদ্রোহীদের নির্বাচিত খলিফা এবং এ নির্বাচনে অনেক শীর্ষস্থানীয় সাহাবীদের অংশগ্রহণ না থাকায় এ খিলাফতের ভিত্তি দুর্বল। এছাড়াও হযরত আলীর বাহিনীতে উসমান হত্যাকারিদের সর্দপ উপস্থিতির কারণে তিনি মুয়াবিয়ার দাবীকেই সঠিক মনে করতেন। বিচক্ষণ আমর ইবনুল আস মুয়াবিয়াকে পরামর্শ দেন যে, খলিফা উসমানের রক্তাক্ত জামা ও নায়লার কর্তিত আঙ্গুলী প্রতিদিন জনসমু্দ্রে প্রদর্শন না করে মাঝে মাঝে প্রদর্শন করা উচিত।
এদিকে হযরত আলী সিরিয়া আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে কুফা থেকে তাঁর বাহিনী নিয়ে বের হয়ে এলেন। বসরার বাহিনীও এগিয়ে গিয়ে তাঁর সাথে মিলিত হল। ইরান থেকেও তাঁর কিছু বাহিনী এগিয়ে আসছিল। ফুরাত নদী অতিক্রমের পর হযরত আলী সিরিয়ার দিকে একটি অগ্রবর্তী বাহিনী পাঠিয়ে দেন। অন্যদিকে মুয়াবিয়া হযরত আলীর বিশাল বাহিনীর খবর পেয়ে তিনিও একটি অগ্রবর্তী বাহিনী পাঠিয়ে দেন।
হযরত আলী এ বাহিনীর খবর পেয়ে মালিক আশতারকে তাঁর অগ্রবর্তী বাহিনীর সেনাপতি বানিয়ে পাঠিয়ে দেন। দুই বাহিনী সিরিয়া সীমান্তের ভেতরে মুখোমুখি হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় দিন উভয় বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ চলে। তৃতীয় দিন হযরত আলী ও মুয়াবিয়া উভয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে এসে পৌঁছান। হযরত আলী মালিক আশতারকে ফুরাত উপকূল দখল করে তাড়াতাড়ি পানির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আদেশ দেন।
কিন্তু মুয়াবিয়ার সৈন্যরা পূর্বেই ফুরাত উপকূল দখল করে ফেলেছিল। ফলে হযরত আলীর শিবিরে পানির অভাব দেখা দেয়। হযরত আলী মুয়াবিয়ার কাছে একজন দূত পাঠিয়ে জানালেন যে, তিনি প্রতিপক্ষের অভিযোগ শুনতে রাজী আছেন এবং দুই পক্ষের মধ্যে মীমাংসার সম্ভাবনা যেন পানির কারণে বিনষ্ট না হয়ে যায়। মুয়াবিয়া এ ব্যাপারে তাঁর উপদেষ্টাদের পরামর্শ চাইলেন।
মিশরের সাবেক গভর্নর আব্দুল্লাহ বিন সাদ বিন আবি সারাহ এবং ওয়ালিদ ইবনে উকবা বললেন, যেহেতু হযরত উসমানকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় শহীদ করা হয়েছে সেহেতু হযরত আলীর সৈন্যদেরকেও তৃষ্ণার্ত রেখে মারতে হবে। হযরত আলীর দূত ফিরে এসে তাকে একথা জানালে তিনি পানির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বাহিনী পাঠিয়ে দেন। মুয়াবিয়ার মোতায়েন করা বাহিনীর সাথে এ বাহিনীর রক্তাক্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
এমতাবস্থায় সুচতুর আমর ইবনুল আস হযরত মুয়াবিয়াকে বললেন যে, হযরত আলীর সৈন্যদেরকে তৃষ্ণার্ত রেখে মেরে ফেলার ব্যাপারটি মুয়াবিয়ার বাহিনীরও অনেকই পছন্দ করছে না এবং মুয়াবিয়ার বাহিনীতে যদি এভাবে হযরত আলীর প্রতি সহানুভূতি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। তাই মুয়াবিয়া তাঁর বিপক্ষ দলকে পানি পানের সুযোগ দেন এবং ফুরাত উপকূলে যুদ্ধ বন্ধ করে দেওয়ার আদেশ দেন।
এরপর দুদিন ধরে উভয় বাহিনী নীরবে অবস্থান করে। ইয়েমেন, হিজায এবং ইরান থেকে প্রচুর সৈন্য এসে হযরত আলীর বাহিনীতে যোগ দেয়। হযরত আলীর বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা দাঁড়ায় নব্বই হাজারে। অন্যদিকে মুয়াবিয়ার বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল আশি হাজার। হযরত আলী ও হযরত মুয়াবিয়া ছিলেন যার যার বাহিনীর প্রধান। উভয় বাহিনীতেই এদের অধীনে বেশ কয়েকজন সেনাপতি ছিলেন।
হযরত আলীর সেনাপতিদের মধ্যে মালিক আশতার, সুহায়েল ইবনে হানাফী, আম্মার ইবনে ইয়াসির, কায়েস ইবনে সাদ প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযোগ্য। অন্যদিকে মুয়াবিয়ার বাহিনীতে আমর ইবনুল আস, মুসলিম ইবনে ওকবা, হাবিব ইবনে মাসলামা, আবুল আওয়ার সালামী, যুলকালা হামীরী প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযোগ্য। উভয় বাহিনীর অপেক্ষার তৃতীয় দিন হযরত আলী মুয়াবিয়ার কাছে তিনজন প্রতিনিধি পাঠান।
এরা মুয়াবিয়াকে হযরত আলীর আনুগত্য স্বীকারের জন্য অনুরোধ করেন। মুয়াবিয়া সাফ জানিয়ে দিলেন যে, উসমান হত্যার বিচার ছাড়া তিনি আর কিছুই ভাবেন না। তখন একজন প্রতিনিধি মুয়াবিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন: তোমার উসমান হত্যার প্রতিশোধের দাবীর আড়ালে কি লুকিয়ে রয়েছে তা আমরা ভাল করেই জানি। তুমি উসমানের সাহায্যে এগিয়ে যেতে এজন্য বিলম্ব করেছ যাতে তিনি শহীদ হয়ে যান এবং খুনের প্রতিশোধকে উপলক্ষ্য করে তুমি খিলাফতের দাবী উত্থাপন করতে পার।
মুয়াবিয়া অত্যন্ত কঠোর ভাষায় এ অভিযোগের জবাব দেন। ফলে প্রতিনিধিদল ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। আপোষ মীমাংসার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর সিফফীন যুদ্ধের প্রথম পর্ব শুরু হল। প্রায় এক মাস ধরে এ পর্ব চলতে থাকে। এ সময় প্রকৃত যুদ্ধ নয়, বরং এক ধরণের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা চলতে থাকে। প্রথম কয়েকদিন দুই বাহিনী থেকে কেবল দুজন যুদ্ধ করত। পরবর্তীতে দুই বাহিনীর দুটি ক্ষুদ্র দলের মধ্যে যুদ্ধ হতো।
বাকীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখত। এভাবে একমাস চলে যায়। প্রকৃত যুদ্ধ বেধে গেলে তা কী ভয়াবহ রক্তপাত সৃষ্টি করবে তা উভয়পক্ষেরই জানা ছিল। উভয়পক্ষেই পরস্পরের আত্মীয় থাকায় একটি আপোষ মীমাংসার জন্য সবাই অপেক্ষা করতে রাজী ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, আপোষের সকল পথই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
হযরত আলীর পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব ছিল না যে, তিনি মুয়াবিয়ার দাবী মেনে নিয়ে মালিক আশতারের মতো প্রভাবশালী সেনাপতি, মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের মতো গুরুত্বপূর্ণ গভর্নর এবং আম্মার ইবনে ইয়াসিরের মতো সাহাবীকে উসমান হত্যার অভিযোগে শাস্তি প্রদান করবেন। প্রথম এক মাস যুদ্ধের মহড়ার পর যুদ্ধের জন্য নিষিদ্ধ মুহাররাম মাস এসে যায়। ফলে এ মাসে যুদ্ধ পুরোপুরি বন্ধ থাকে।
যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার পর হযরত আলীর আরেকটি প্রতিনিধি দল মুয়াবিয়ার কাছ থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। হযরত মুয়াবিয়া এদের কাছে হযরত আলীকে উসমান হত্যাকারি বলে দাবী করেন এবং হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির সম্পর্কে তিনি তাদেরকে বলেন, “আমি হযরত উসমানের গোলামের বিনিময়েও আম্মারকে হত্যা করতে পারব।” এসব কথাবর্তার পর প্রতিনিধিরা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে।
এরপর হযরত মুয়াবিয়ার একটি প্রতিনিধি দল হযরত আলীর সাথে দেখা করে এবং বলে: হযরত উসমান হকপন্থী খলিফা ছিলেন। ...তাঁর জীবন তোমার কাছে অসহ্য হওয়ায় তুমি তাকে হত্যা করেছ। হযরত আলী একথা শুনে প্রচণ্ড রাগান্বিত হয়ে বলেন: ...একমাত্র তরবারিই এই বিরোধের মীমাংসা করবে। ...আমরা আবু বকর ও উমারকে তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে দেখেছি।
তাই আমি রক্তসম্বন্ধ ও আত্মীয়তার দিক দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর নিকটতর হওয়া সত্ত্বেও তাদের খিলাফতের ব্যাপারে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করিনি। এরপর জনসাধারণ উসমানকে খলিফা নির্বাচন করল। তাঁর কর্মধারায় অসন্তুষ্ট হয়ে লোকেরা তাকে হত্যা করে। তারপর লোকেরা আমার হাতে বাইআত করার আবেদন জানায়। আমি তাদের আবেদনে সাঁড়া দেই।
একথার পর মুয়াবিয়ার জনৈক প্রতিনিধি হযরত আলীকে প্রশ্ন করেন: আপনি কি একথার সাক্ষ্য দেন না যে, হযরত উসমানকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়েছে? হযরত আলী উত্তরে বলেন: আমি উসমানকে মজলুমও বলি না আবার জালিমও বলি না। একথা শুনে মুয়াবিয়ার প্রতিনিধিরা বলেন যে, যে ব্যক্তি উসমানকে মজলুম মনে করে না তাকে উপদেশ দেওয়া আর না দেওয়া সমান। এরপর তারা চলে যান। এটিই ছিল হযরত আলী ও মুয়াবিয়ার মধ্যে আপোষ মীমাংসার শেষ প্রচেষ্টা।
মুহাররম মাসের শেষ দিনে হযরত আলী তাঁর বাহিনীকে জানিয়ে দেন যে, পরবর্তী দিনে চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হবে। মুয়াবিয়াও তাঁর বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। পরের দিন ভোরে ঐতিহাসিক সিফফীন যুদ্ধের মূল পর্বের সূচনা হয়। এদিন হযরত আলীর সেনাপতি হিসেবে ময়দানে ছিলেন মালিক আশতার। অন্যদিকে মুয়াবিয়ার সেনাপতি ছিলেন হাবীব ইবনে মাসলামা। সারাদিন ধরে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলে।
সন্ধ্যায় দুই বাহিনী নিজ নিজ শিবিরে ফিরে যায়। যুদ্ধে উভয় পক্ষের হাজার হাজার সৈন্য নিহত হন। দ্বিতীয় দিনেও একইভাবে যুদ্ধ চলে। তৃতীয় দিনের যুদ্ধ ছিল খুবই ভয়ঙ্কর। রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে হযরত আলীর সেনাপতি ছিলেন আম্মার ইবনে ইয়াসির। অন্যদিকে মুয়াবিয়ার সেনাপতি ছিলেন একসময়কার মিশর ও ফিলিস্তিন বিজয়ী আমর ইবনুল আস। প্রচুর প্রাণহানী হলেও এদিনের যুদ্ধেও কেউ চুড়ান্তভাবে পরাজিত হল না।
চতুর্থ ও পঞ্চ দিনেও যুদ্ধের ফলাফল অপরিবর্তিত থাকে। ষষ্ঠ দিনে আবারও মালিক আশতার এবং হাবীব ইবনে মাসলামার নেতৃত্বে যুদ্ধ চলে। সপ্তম দিনে স্বয়ং হযরত আলী এবং মুয়াবিয়া যুদ্ধের ময়দানে চলে আসেন। এদিনের যুদ্ধ ছিল পূর্বের চেয়ে অনেক রক্তক্ষয়ী ও ভয়ঙ্কর। কিন্তু যুদ্ধে কোন জয়-পরাজয় নির্ধারিত হল না। উভয় পক্ষের সৈন্যসংখ্যা ছিল কাছাকাছি এবং উভয় পক্ষেই ইসলামের ইতিহাসের অনেক বড় বড় বীর যোদ্ধা ছিলেন।
কৌশল ও যোগ্যতায় কেউ কারও চেয়ে কম ছিল না। তাই এত প্রাণহানীর পরও যুদ্ধের ফলাফল পেতে দেরী হচ্ছিল। সাতদিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দুই বাহিনী সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। প্রথম সাত দিন উভয় বাহিনীর একেকটি অংশ যুদ্ধে লিপ্ত হত। অষ্টম দিন ভোরে হযরত আলী তাঁর সমগ্র বাহিনী নিয়ে মুয়াবিয়ার বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। হযরত মুয়াবিয়ার বাহিনীও মৃত্যুর শপথ নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর হযরত আলীর ডান পাশের বাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে এবং ডান পাশের সেনাপতি আব্দুল্লাহ ইবনে বুদায়েল নিহত হন। হযরত আলী মালিক আশতারকে ডান পাশের বাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে নিজে বাম পাশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। উভয় পক্ষের মধ্যবর্তী বাহিনী তখনও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। মালিক আশতার হযরত আলীর ডানপাশের পলায়নরত সৈন্যদেরকে ফিরিয়ে এনে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
হযরত আলী বামপাশের সৈন্যদের মনোবল ফিরিয়ে এনে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মুয়াবিয়ার সৈন্যরা হযরত আলীর কাছে পৌঁছার জন্য প্রাণপনে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। সারাদিন ধরে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলে। যুদ্ধের ময়দানে হাজার হাজার সৈন্যদের মৃতদেহ পড়ে থাকে। দিনের শেষের দিকে হযরত আলী বাম পাশ ছেড়ে ডান পাশে চলে আসেন। এর ফলে ডান পাশের সৈন্যদের মনোবল বেড়ে যায়।
কিন্তু বাম পাশের সৈন্যরা ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হয়। সেখানে লাশের পাহাড় জমে ওঠে। আব্দুল কায়েস নামে একজন সেনাপতি এ সময় বাম পাশের নেতৃত্ব নিয়ে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনেন। বামপাশের যুদ্ধে যুলকালা ও আব্দুল্লাহ ইবনে উমার নামে মুয়াবিয়ার দুই সেনাপতি নিহত হন। দিনের শেষে যখন রাত ঘনিয়ে আসছে তখন আম্মার ইবনে ইয়াসিরের নেতৃত্বে একদল জানবাজ যোদ্ধা মুয়াবিয়ার মধ্যবর্তী বাহিনীর উপর হামলা চালায়।
আমর ইবনুল আস অত্যন্ত কষ্টে এ হামলা প্রতিরোধ করেন। ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হলে আম্মার ইবনে ইয়াসির নিহত হন। আম্মারের নিহত হওয়ার সংবাদ শুনে হযরত আলী খুবই মর্মাহত হন। সে সময়ে মুয়াবিয়ার বাহিনীর তিনটি অংশই যুদ্ধে নেমে পড়েছে। তরবারির ঝনঝনানি, উড়ন্ত বর্শার তীব্র আঘাত আর যোদ্ধাদের তাকবীর ধ্বনিতে রাতের নীরবতা ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাচ্ছিল। রাতটি ছিল জুমুআর পবিত্র রাত।
এ রাত লাইলাতুল হারীর নামে খ্যাত। হযরত ওয়ায়েস কারনী এ রাতে নিহত হয়েছিলেন। সারা রাত যুদ্ধে কেটে যায়। হযরত আলী সারা রাত ধরে ডান, বাম ও মধ্যবর্তী বাহিনীতে ঘুরে ঘুরে তরবারি চালাচ্ছিলেন। অন্যদিকে মুয়াবিয়া এবং আমর ইবনুল আসও সারা রাত যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। রাত শেষে ভোর হলে পবিত্র জুমুআর দিন শুরু হল। কিন্তু যুদ্ধ বন্ধের কোন লক্ষণই দেখা গেল না।
এদিনও সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলতে থাকে। আগের দিনের যুদ্ধে সিরীয় বাহিনীর অবস্থান ছিল শক্ত। সিরীয়দের চাপে হযরত আলীর বাহিনী বার বার পযুর্দস্ত হয়েছিল। কিন্তু রাতের বেলায় যুদ্ধের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। রাতের যুদ্ধে হযরত আলীর সৈন্যরা নিহত হয়েছিল কম। অন্যদিকে সিরীয় সৈন্যরা নিহত হয়েছিল বেশি। জুমুআর দিন দুপুর পর্যন্ত যুদ্ধে সিরিয়ার বাহিনীর অর্ধেকের চেয়েও বেশি সৈন্য নিহত হয়েছিল।
ফলে তাদের সংখ্যা আশি হাজার থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিল পয়ত্রিশ হাজারে। অন্যদিকে হযরত আলীর সৈন্য নিহত হয়েছিল বিশ থেকে পঁচিশ হাজার এবং তাঁর বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা দাঁড়িয়েছিল পয়ষট্টি থেকে সত্তর হাজারে। এর ফলে হযরত আলীর সৈন্যসংখ্যা হযরত মুয়াবিয়ার সৈন্যসংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল।
ত্রিশ ঘন্টার যুদ্ধে উভয় পক্ষের যে পরিমাণ মুসলিম সৈন্য নিহত হয়েছিলেন তা দিয়ে অনায়াসেই কয়েকটি পারস্য সাম্রাজ্য জয় করা সম্ভব হতো। ইতোপূর্বে বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যের পুরো অংশ এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অর্ধেক অঞ্চল জয় করতে গিয়েও এতো বেশি মুসলমান সৈন্য নিহত হননি। তাই সিফফীনের যুদ্ধ হল ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক অধ্যায়।
ত্রিশ ঘন্টা ধরে যুদ্ধের পর যখন সূর্য কিছুটা ঢলে পড়ল তখন মালিক আশতার তাঁর বাহিনীর দায়িত্ব অন্যজনকে দিয়ে নিজে একটি বিশাল অশ্বারোহী বাহিনীর দায়িত্ব নিলেন। হযরত আলীর অশ্বারোহী সৈন্যদের বড় অংশটিকে নিয়ে তিনি যুদ্ধের ময়দান থেকে পৃথক হয়ে গেলেন। যেহেতু হযরত আলীর বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল মুয়াবিয়ার বাহিনীর প্রায় দ্বিগুণ সেহেতু মালিক আশতারের অশ্বারোহীদের ছাড়াই তাদের জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া কঠিন কিছু ছিল না।
মালিক আশতার তাঁর অশ্বারোহীদেরকে নিয়ে ঘুরপথে এগিয়ে গিয়ে মুয়াবিয়ার বাহিনীর পেছন থেকে একটি সাঁড়াশী আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন। এ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য মুয়াবিয়ার বাড়তি কোন সৈন্য ছিল না। তাঁর বাহিনীর সকলেই সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। মালিক আশতারকে তাঁর অশ্বারোহী সৈন্যরা কথা দিল যে, তারা বিজয় অথবা মৃত্যু- এ দুটোর যে কোন একটি বেছে নিবে।
এই আত্মোৎসর্গকারি অশ্বারোহী সৈন্যদেরকে নিয়ে মালিক আশতার একটি সুবিধাজনক অবস্থান থেকে শত্রুর ওপর ভয়াবহ আক্রমণ চালালেন। শত্রুর ওপর সাঁড়াশী আক্রমণ চালিয়ে তিনি তাদের মধ্যবর্তী বাহিনীর কাছে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। এ সময় সিরীয় বাহিনীর পতাকাবাহী মালিক আশতারের হাতে নিহত হয় এবং মুয়াবিয়া ও আমর ইবনুল আসের অবস্থানের সামনেই রক্তাক্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
পুরো সিরীয় বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। যুদ্ধের কোন কেন্দ্র থাকল না। উভয় বাহিনীর ডানপাশ এবং বামপাশ সংকুচিত হয়ে মধ্যবর্তী বাহিনীর সাথে মিশে যায়। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, সিরীয় বাহিনীর সামনে পরাজয় বরণ ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না। কিন্তু তখনও সিরীয়রা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেনি। শেষ পর্যন্ত আমর ইবনুল আস এমন একটি কৌশল আঁটঁলেন যে, তা দিয়ে তিনি কেবল সিফফীন যুদ্ধই নয়, পুরো ইসলামের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন।
সামনে নিশ্চিত পরাজয় দেখে আমর ইবনুল আস মুয়াবিয়কে বললন: কী দেখছ? সকলকে নির্দেশ দাও যেন তারা অবিলম্বে নিজ নিজ বর্শায় কুরআন মাজিদ গেঁথে তা উচু করে ধরে এবং উচ্চঃস্বরে বলতে থাকে, “আমাদের ও তোমাদের মধ্যে ফয়সালা এ কুরআনই করবে।” আমর ইবনুল আসের পরামর্শ অনুযায়ী মুয়াবিয়া সাথে সাথেই সবাইকে এই নির্দেশ প্রদান করলেন।
এর ফলে সিরিয়ার প্রতিটি সৈন্য নিজ নিজ বর্শায় কুরআন গেঁথে তা উঁচু করে ধরল এবং উচ্চস্বরে বলতে থাকল: হে মুসলিম ভাইয়েরা! আমাদের যুদ্ধ তো ধর্মের জন্য! অতএব এসো, আমরা কুরআনের ফয়সালা মেনে নেই এবং এখানেই যুদ্ধের ইতি টানি। যদি এই যুদ্ধে সিরীয়রা ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে রোমানদের আক্রমণ কে প্রতিরোধ করবে? আর যদি ইরাকীরা ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে প্রাচ্যের আক্রমণকারিদের মোকাবিলা কে করবে?
হযরত আলীর সৈন্যরা কুরআনকে বর্শার মাথায় দেখে যুদ্ধ থেকে হাত গুটিয়ে নিল। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস এই দৃশ্য দেখে বললেন: এতক্ষণ যুদ্ধ হচ্ছিল; এখন প্রতারণা শুরু হল। হযরত আলী তাঁর সৈন্যদেরকে বুঝিয়ে বললেন যে, তারা যেন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসে এই প্রতারণার ফাঁদে পা না দেয়। কিন্তু সৈন্যরা আর যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক ছিল না। কারণ টানা দুদিন ধরে যুদ্ধ করতে করতে তারা সহ্যশক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল।
টানা দুদিনের যুদ্ধে হঠাৎ বিরতি দেখা দেওয়ায় সৈন্যদের মাঝে আবসাদ ভেঙ্গে পড়ার প্রবণতা সৃষ্টি হল। এছাড়াও হযরত আলীর অভিজ্ঞ সমরনায়করা যেভাবে বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন সেভাবে সাধারণ সৈন্যরা বুঝতে পারেনি যে, বিজয় কতটা সন্নিকটে! তাই তারা ভেবেছিলো এই অনন্ত যুদ্ধ আর চালিয়ে লাভ নেই। এই অবস্থায় সাধারণ সৈন্যরা হযরত আলীর উপর চাপ প্রয়োগ করে যাতে তিনি মালিক আশতারকে যুদ্ধ থেকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হন।
এমনকি অনেক সাধারণ সৈন্য হযরত আলীকে হুমকি দিতেও শুরু করে। ফলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মালিক আশতার যুদ্ধ বন্ধ করে চলে আসতে বাধ্য হন। সাথে সাথে সমগ্র যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে আসে নীরবতা। মালিক আশতার হযরত আলীর কাছ থেকে প্রকৃত ঘটনা শুনার পর আক্ষেপ করে বলেন: হে ইরাকবাসী! যখন সিরিয়াবাসীদের উপর তোমাদের বিজয় লাভ ছিল সুনিশ্চিত ঠিক তখনই তোমরা তাদের প্রতারণার ফাঁদে পা দিলে।
একথা শুনে যুদ্ধবিরোধী সৈনিকেরা মালিক আশতারের উপর হামলা করতে উদ্যত হয়। কিন্তু হযরত আলীর হস্তক্ষেপে তারা বিরত থাকল। এরপর হযরত আলী মুয়াবিয়ার কাছে একজন দূত পাঠালেন। মুয়াবিয়া হযরত আলীর দূতকে বলেন যে, কুরআনের ভিত্তিতে এই বিরোধ মীমাংসার জন্য দুই পক্ষ থেকে দুজন সালিশকারি নিযুক্ত করা প্রয়োজন। হযরত আলী এই প্রস্তাব সম্পর্কে কোন মতামত দেওয়ার পূর্বেই তাঁর চারপাশে জড়ো হওয়া যুদ্ধবিরোধী লোকজন এ প্রস্তাবকে জোরাল সমর্থন জানাল।
হযরত আলী তখনই বুঝতে পারলেন যে, হযরত উসমানের মতো তাঁরও পায়ের নীচের মাটি সরে যেতে শুরু করেছে; অর্থাৎ তাঁর লোকজনদের মধ্যে বিদ্রোহের প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছে! ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল যখন এসব লোকজন হযরত মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে সালিশকারি হিসেবে আমর ইবনুল আসকে মেনে নিল অথচ হযরত আলীর পক্ষ থেকে সালিশকারি হিসেবে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস কিংবা মালিক আশতারকে মেনে নিল না।
তারা হযরত আলীকে তাদের পছন্দমত সালিশকারি নিযুক্ত করতে বাধ্য করল। এদের চাপে হযরত আলী তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বসরার গভর্নর আবু মুসা আশআরীকে তাঁর পক্ষ থেকে সালিশকারি নিযুক্ত করলেন। এরপর আমর ইবনুল আস হযরত আলীর দরবারে এসে একটি দ্বিপক্ষীয় অঙ্গীকারনামা প্রস্তুত করলেন। উভয় পক্ষের সালিশকারিরাও এই মর্মে অঙ্গীকার করলেন যে, তারা পরবর্তী ছয় মাস সময়ের মধ্যে যে কোন সময় দামেশক ও কুফার ঠিক মধ্যবর্তী স্থানে উভয় পক্ষকে তাদের চুড়ান্ত রায় শুনিয়ে দেবেন।
তখন উভয় পক্ষ থেকে মাত্র চারশ করে লোক উপস্থিত থাকবে। সালিশকারিদের রায় শুনার জন্য সমগ্র মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে মোট আটশ লোক সেখানে উপস্থিত থাকবেন। দ্বিপক্ষীয় অঙ্গীকারনামায় সাক্ষী হিসেবে হযরত আলী ও মুয়াবিয়ার পক্ষে অনেকেই স্বাক্ষর করেন। মালিক আশতারকে এতে স্বাক্ষরের কথা বলা হলে তিনি স্পষ্ট ভাষায় তা অস্বীকার করেন। অঙ্গীকারনামা সংক্রান্ত কাজে চারদিন লেগে যায়।
এরপর উভয় বাহিনী কুফা ও দামেশকের দিকে ফিরে যায়। সিফফীনের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ৬৫৭ সালের জুলাই মাসে। তখন হযরত আলীর খিলাফতের দ্বিতীয় বছর চলছিল। হযরত আলী খলিফা হয়েছিলেন ৬৫৬ সালের ২৩ জুন। আর সিফফীনের মূল যদ্ধ সংঘটিত হয় ৬৫৭ সালের ১৯ জুলাই থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত। ৯ দিনের এ যুদ্ধে উভয় পক্ষে ৭০০০০ এর চেয়েও বেশি সৈন্য নিহত হয়েছিলেন। অনেক বিখ্যাত সাহাবী এ যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন।
এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কলঙ্কিত অধ্যায়। সাহাবাদের নিজেদের মধ্যে সংঘটিত জঙ্গে জামালের ক্ষত শুকাতে না শুকাতেই সংঘটিত হয়েছিল ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধ। এই দুই যুদ্ধে আশি হাজারের চেয়েও বেশি মুসলমান নিহত হয়েছিলেন। এই সংখ্যাটি ছিল পূর্ববর্তীতে সকল যুদ্ধে নিহত মোট মুসলমানদের সংখ্যার চেয়েও বেশি।
৬২৪ সালে সংঘটিত বদর যুদ্ধ থেকে শুরু করে ৬৫৭ সালের জঙ্গে জামালের পূর্ব পর্যন্ত মুসলমানরা যেসব যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তার সবগুলোই ছিল বিধর্মীদের সাথে। সেসব যুদ্ধে মুসলমানদের এতো প্রাণহানী ঘটেনি যা ঘটেছিল নিজেদের মধ্যে সংঘটিত দুটি যুদ্ধে। এর ফলে সিফফীনের অসমাপ্ত যুদ্ধ মুসলমানদের মধ্যে নানা ধরণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বেশি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় হযরত আলীর বাহিনীর মধ্যে।
সিরীয়রা সবসময়ই তাদের শাসকের অনুগত ছিল। তারা মুয়াবিয়ার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ছিল। কিন্তু হযরত আলীর অনুসারীরা কখনোই পুরোপুরি ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। ইরাকীদের ঐতিহ্যই ছিল রাজনৈতিক প্রশ্নে মতবিরোধে লিপ্ত হওয়া। হযরত আলীর বাহিনীতে যেমন যুদ্ধবিরোধী লোকজন ছিল তেমনি অতি উৎসাহী যুদ্ধবাজ লোকজনও ছিল। এরা সিফফীনের সন্ধিচুক্তি মেনে নেয়নি। সিরিয়াবাসীদের উপর পুনরায় আক্রমণের জন্য এরা হযরত আলীকে অনুরোধ করে।
কিন্তু হযরত আলী তাদেরকে বলেন যে, চুক্তির নির্ধারিত সময় পার না হলে এটি কোনভাবেই সম্ভব হবে না। একথা শুনে তারা চুপ হয়ে যায়। কিন্তু হযরত আলীর বাহিনীতে এমনভাবে মতবিরোধ ছড়িয়ে পড়ে যা থেকে তারা আর কখনোই বেরিয়ে আসতে পারেনি। হযরত আলী যখন তাঁর বাহিনী নিয়ে কুফার পথে রওনা হন তখন তাঁর সৈন্যদের মাঝে সিফফীন যুদ্ধ নিয়ে এমন মতবিরোধ সৃষ্টি হয় যে, ব্যাপারটি গালাগালি ও হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়।
হযরত আলী অসহায়ভাবে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর সকল চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। সিফফীনের যুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ নিয়ে সমগ্র পথ জুড়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি ও কথা কাটাকাটি চলতে থাকে। নানা যুক্তিতর্ক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ নিয়ে তাদের মধ্যে অসংখ্য দল-উপলের সৃষ্টি হয়। এসব দল-উপদল প্রকাশ্যে একে অন্যের বিরোধীতা করতে থাকে এবং প্রয়োজনে তরবারি ধারণের জন্যও প্রস্তুত হয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত সকল দল-উপদলকে ছাপিয়ে দুটি দল প্রাধান্য বিস্তার করে। সংখ্যা এবং মতবাদের দিক থেকে এ দুটি দলই ছিল সবচেয়ে স্বকীয় ও শক্তিশালী। একটি দল হযরত আলীর আনুগত্য অস্বীকার করে এবং হযরত আলী ও মুয়াবিয়া- উভয়কেই রক্তপাতের জন্য দায়ী করে। এরা ‘খাওয়ারিজ দল’ নামে পরিচিতি পায়। আরেকটি দল ছিল সম্পূর্ণ এদের বিপরীত। এরা হযরত আলীকে নির্দোষ দাবী করে এবং তাকেই খিলাফতের প্রকৃত হকদার হিসেবে সাব্যস্ত করে।
এরা যে কোন মূল্যে হযরত আলীর পক্ষে থাকার কথা বলে। এই দল ‘শীআনে আলী’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ‘শীআনে আলী’ মানে হল ‘আলীর পক্ষ’। কুফার নিকটবর্তী হওয়ার পর খাওয়ারিজ দলটি হযরত আলীর বাহিনী থেকে পৃথক হয়ে হারুরার দিকে চলে যায়। এদের সংখ্যা ছিল বারো হাজার। আব্দুল্লাহ ইবনুল কাব ছিলেন এদের প্রধান নেতা এবং শীস ইবনে রিবাঈ ছিলেন এদের সেনাপ্রধান।
এই শীস ইবনে রিবাঈ সিফফীনের যুদ্ধের সময়ে দুবার হযরত আলীর প্রতিনিধি হিসেবে মুয়াবিয়ার কাছে গিয়েছিলেন। হারুরায় অবস্থান করার পর খাওয়ারিজরা তাদের মূলনীতি ঘোষণা করে এভাবে: মানুষের মধ্যে কোন খলিফা বা আমীর নেই। বাইআত কেবল আল্লাহর জন্য। হুকুম বা আদেশ কেবল আল্লাহই দিতে পারেন; খলিফা বা আমীর নয়। মুসলমান সমাজের সকল কাজ সম্পাদিত হবে পরামর্শের ভিত্তিতে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতানুসারে। আমীরে মুয়াবিয়া এবং খলিফা হযরত আলী উভয়েই সমান দোষী।
হযরত আলী খাওয়ারিজদেরকে বুঝিয়ে সুজিয়ে তাঁর অনুগত করার চেষ্টা করেন। খাওয়ারিজরা সিফফীনের যুদ্ধ বন্ধ করা এবং মুয়াবিয়ার সাথে আপোষের প্রচেষ্টাকে সঠিক মনে করেনি। তারা মনে করত যে, মুয়াবিয়া মুসলমানদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টির ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তাই মুয়াবিয়া ছিলেন হত্যাযোগ্য অপরাধী। এ ধরনের অপরাধীর সাথে মধ্যস্ততার প্রচেষ্টাকে তারা মেনে নেয়নি।
তারা মনে করত যে, মুয়াবিয়ার সাথে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিয়ে হযরত আলী নিজেও অপরাধ করেছেন। হযরত আলী তাদেরকে বুঝালেন যে, তিনি মোটেও যুদ্ধ বন্ধ করতে চাননি; পরিস্থিতিই তাকে মধ্যস্থতা মেনে নিতে বাধ্য করেছিল। এতে তারা কিছুটা শান্ত হয়। হযরত আলী খাওয়ারিজ নেতা ইয়াযিদ ইবনে কায়েসকে ইস্পাহান ও রাঈ শহরের গভর্নর নিয়োগ করেন। এরপর খাওয়ারিজরা হযরত আলীর অনুরোধে কুফায় আসতে সম্মত হয়।
সিফফীনের অঙ্গীকারনামা অনুযায়ী যখন ছয় মাসের মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে তখন উভয়পক্ষের সালিশকারিরা যথাস্থানে মিলিত হলেন। দামেশক ও কুফার ঠিক মধ্যবর্তী আযরাজ নামক স্থানে তারা মিলিত হন। স্থানটি ছিল জুমাতুল জান্দালের নিকটে অবস্থিত। হযরত আলী এবং মুয়াবিয়া তাদের রাজধানীতেই অপেক্ষা করতে থাকেন। খাওয়ারিজ নেতা হারুকুস ইবনে যুহায়ের কুফায় অবস্থানত হযরত আলীকে শেষবারের মতো মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যানের অনুরোধ করে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
আযরাজের সালিশী বৈঠকে মক্কা ও মদিনার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিও যোগ দেন। উভয় পক্ষের চারশ করে লোক বৈঠকস্থলের বাইরে অবস্থান করতে থাকে। গণ্যমান্য সাহাবীদেরকে নিয়ে উভয় সালিশকারি বৈঠকে বসেন। প্রথমে আমর ইবনুল আস কৌশলে আবু মুসা আশআরীকে দিয়ে স্বীকার করিয়ে নেন যে, উসমান হত্যার প্রতিশোধের দাবী সঠিক এবং মুয়াবিয়া খলিফা হওয়ার যোগ্য। কিন্তু হযরত আলীও খলিফা হওয়ার যোগ্য হওয়ায় কাউকেই বাদ দেওয়া গেল না।
শেষ পর্যন্ত আবু মুসা আশাআরী বলেন যে, উভয়কেই বাদ দিয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে উমারকে খলিফা বানানো উচিত। কিন্তু সেখানে উপস্থিত আব্দুল্লাহ ইবনে উমার খলিফা হতে অস্বীকৃতি জানান। এতে আরও আলোচনা চলতে থাকে। দীর্ঘ আলোচনার পর কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পেরে উভয় সালিশকারি এই অভিমত প্রকাশ করলেন যে, হযরত আলী ও মুয়াবিয়া উভয়কেই ক্ষমতা থেকে পদচ্যুত করা হবে এবং এরপর মুসলমানরা মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে নতুন খলিফা নির্বাচন করবে।
বৈঠকের বাইরে উভয়পক্ষের লোকজন অধীর আগ্রহে সালিশকারিদের সিদ্ধান্ত জানার জন্য অপেক্ষা করছিল। যখন ঘোষণা করা হল যে, সবার সামনে সালিশকারিরা তাদের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করবেন তখন তারা সাথে সাথে একটি জায়গায় সমবেত হয়ে গেল। সেখানে একটি মঞ্চও রাখা হল। আমর ইবনুল আস আবু মুসা আশআরীকে অনুরোধ করলেন যে, প্রথমে তিনি যেন উপস্থিত সবাইকে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন।
আবু মুসা আশআরী মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন যে, এই মুহুর্তে হযরত আলী ও মুয়াবিয়া উভয়কেই পদচ্যুত করা হলো এবং উপস্থিত মুসলমানদেরকে খলিফা নির্বাচনের অধিকার প্রদান করা হল। এরপর আমর ইবনুল আস মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিলেন যে, আবু মুসা আশআরী যেহেতু হযরত আলীর সালিশকারি সেহেতু আবু মুসার ঘোষণা অনুযায়ী হযরত আলী পদচ্যুত হয়েছেন, মুয়াবিয়া হননি এবং মুয়াবিয়ার সালিশকারি হিসেবে আমর ইবনুল আস হযরত আলীর শূণ্যস্থানে মুয়াবিয়াকেই খলিফা নিযুক্ত করলেন।
আমর ইবনুল আসের এই কূটকৌশল আবু মুসাকে হতবাক করে দেয়। তিনি আমরকে বললেন: তুমি আমাকে ধোঁকা দিয়েছ। উপস্থিত ইরাকী লোকজন ক্ষোভে ফেটে পড়ে। একজন আমরকে তরবারি দিয়ে আঘাত করে বসলে আমরও পাল্টা আক্রমণ শুরু করেন। তবে কয়েকজনের হস্তক্ষেপে উভয়ে লড়াই থেকে বিরত হন। বিশৃঙ্খলা ও হট্টগোলের মধ্য দিয়েই সালিশী অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হল। অতি দ্রুত দুই সালিশকারি কুফা ও দামেশকের পথে রওনা হয়ে যান।
বাকী লোকজনও রওনা হয়ে গেল। হযরত আলী সালিশী সিদ্ধান্তের কথা জানার পর তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং মুয়াবিয়া ও তাঁর লোকজনকে অভিসম্পাত করেন। মুয়াবিয়াও হযরত আলীকে অভিসম্পাত করেন। তখন থেকে দুপক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিসম্পাত প্রদানের রীতি শুরু হয়। হযরত আলী পুনরায় সিরিয়া আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। ঠিক তখনই কুফার খাওয়ারিজরা বিদ্রোহ করে বসল।
বিদ্রোহের পূর্বে হারকুস এবং আরেকজন খাওয়ারিজ নেতা হযরত আলীর কাছে এসে বললেন যে, মুয়াবিয়ার সাথে মধ্যস্থতা না করার জন্য তারা হযরত আলীকে বার বার অনুরোধ করার পরও তিনি সে অনুরোধ রাখেননি। আবার এখন তিনি নিজেই মধ্যস্থতা বর্জন করেছেন। অথচ তিনি এখনও তাঁর আগের ভুল স্বীকার করেননি। হযরত আলী তাঁর ভুল স্বীকার না করলে তারা তাকে সমর্থন করবে না।
তারা হযরত আলীকে প্রথমে ভুলের জন্য অনুশোচনা করে তারপর সিরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হতে বলে। হযরত আলী চরম বিরক্ত হয়ে বললেন যে, মুয়াবিয়ার সাথে মধ্যস্থতার সিদ্ধান্ত নিতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন এবং এতে তিনি কোন ভুলও করেননি। এতে দুই নেতা অসুন্তষ্ট হয়ে চলে যান। এরপর হযরত আলী কুফার মসজিদে বক্তব্য দিতে গেলে খাওয়ারিজরা স্লোগান দিতে থাকে “লা হুকমা ইল্লা লিল্লাহ” অর্থাৎ “আল্লাহ ছাড়া কারও হুকুম মানিনা”।
এরপর হযরত আলী মসজিদ থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে চলে যান। অন্যদিকে খাওয়ারিজরা তাদের এক নেতার বাড়িতে সমবেত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা কুফা ছেড়ে চলে যাবে এবং হযরত আলীর শাসনের বাইরে গিয়ে নিজেদের নতুন মতবাদের ভিত্তিতে নতুন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলবে। পরের দিন খাওয়ারিজরা আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহাবকে তাদের প্রধান নেতা বা আমির নির্বাচিত করে এবং মাদায়েনের দিকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
বসরার খাওয়ারিজদেরকেও এ খবর পাঠানো হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে, মাদয়েনের পূর্বে নাহরাওয়ানের প্রান্তরে সকল খাওয়ারিজরা মিলিত হবে। প্রথমে কুফার খাওয়ারিজরা নাহরাওয়ানে পৌঁছাল। এরপর বসরার খাওয়ারিজরাও সেখানে এসে মিলিত হল। নাহরাওয়ানে নিজেদেরকে সুসংগঠিত করার পর খাওয়ারিজদের মোট সংখ্যা দাঁড়াল পঁচিশ হাজার। খাওয়ারিজরা চলে যাওয়ার পর হযরত আলী তাদেরকে গুরুত্ব না দিয়ে সিরিয়া আক্রমণের দিকেই মনোনিবেশ করলেন।
তিনি প্রথমে বসরায় চিঠি পাঠালেন। কিন্তু বসরার মোট ষাট হাজার সৈন্যের মধ্যে মাত্র তিন হাজার সৈন্য তাঁর আহ্বানে সাঁড়া দিয়ে কুফায় এসে পৌঁছাল। কুফাবাসীরাও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত হযরত আলীর ভাষণে কাজ হল। চল্লিশ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী তাঁর পতাকাতলে সমবেত হল। এবার হযরত আলী নাহরাওয়ানের খাওয়ারিজ নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে ওয়াহাবকে চিঠি লিখলেন।
চিঠিতে তিনি তাদেরকে অনুরোধ জানালেন যে, তিনি এবার তাদের কথামতো সিরিয়া আক্রমণে যাচ্ছেন। অতএব নিজেদের মধ্যে বিরোধ না রেখে সবাই মিলে সিরিয়া আক্রমণে যাওয়া উচিত। খাওয়ারিজদের উত্তর আসল: তুমি আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে মধ্যস্থতাকারি নিয়োগ করেছিলে এবং এখন আবার সিরিয়াদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাচ্ছ। এসব তুমি তোমার প্রবৃত্তির তাড়নায় করছ। যদি তুমি নিজের কাফির হওয়ার কথা স্বীকার কর এবং তাওবা কর তাহলে আমরা তোমার সাহায্যের জন্য প্রস্তুত আছি।
এই উত্তর পেয়ে হযরত আলী এদের সম্পর্কে নিরাশ হয়ে গেলেন। খাওয়ারিজরা সবসময়ই বলতো যে, হযরত মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বন্ধ করে তারা নিজেরাও কাফির হয়ে গিয়েছিলো এবং পরে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে তারা তাওবা করে মুসলমান হয়েছে। এখন হযরত আলীরও উচিত তাওবা করে পুনরায় মুসলমান হওয়া। হযরত আলী যখন খাওয়ারিজদেরকে উপেক্ষা করেই সিরিয়া আক্রমণের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিলেন ঠিক তখনই খবর এল যে, হযরত আলীর পক্ষে কথা বলায় আব্দুল্লাহ ইবনে খাব্বাব নামে জনৈক সাহাবী খাওয়ারিজদের হাতে নিহত হয়েছেন।
এর ফলে আশঙ্কা দেখা দিল যে, হযরত আলীর বাহিনী সিরিয়ায় চলে গেলে খাওয়ারিজরা কুফা ও বসরা দখল করে নিতে পারে। তাই হযরত আলী সিরিয়া যুদ্ধ মুলতবী রেখে খাওয়ারিজদেরকে দমনের উদ্দেশ্যে নাহরাওয়ানের দিকে রওনা হলেন। হযরত আলীর বিরাট বাহিনী দেখে খাওয়ারিজদের দুই তৃতীয়াংশ লোকই যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে চলে যায়। বাকী এক তৃতীয়াংশ লোক হযরত আলীর বাহিনীর হাতে প্রাণ দিতে প্রস্তুত হল।
যুদ্ধ শেষে দেখা গেল মাত্র নয়জন খাওয়ারিজ জীবিত রয়েছে। হযরত আলী খাওয়ারিজদের লাশ দাফন না করেই সে অবস্থায় ফেলে রেখে চলে আসেন। এ যুদ্ধে প্রায় নয় হাজার খাওয়ারিজ নিহত হয়েছিলেন। মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধের তৃতীয় ঘটনা ছিল এটি। তিনটি যুদ্ধে নিহত মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়াল নব্বই হাজার। নাহরাওয়ানের যুদ্ধ শেষ করে হযরত আলী কুফায় না ফিরে সরাসরি সিরিয়া অভিযানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
কিন্তু তাঁর সৈন্যরা সিরিয়া অভিযানে আর যেতে চাচ্ছিল না। নিজের বাহিনী নিয়ে তিনি যখন নাখীলায় এসে অবস্থান নিলেন তখন তিনি অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন যে, তাঁর সৈন্যরা ছাউনি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কেউ তাঁর কথা আর শুনল না। যখন ছাউনি একেবারে শূন্য হয়ে গেল তখন তিনি নিজেও কুফায় চলে আসলেন। হযরত আলী সকল নেতৃবৃন্দকে একত্রিত করে তাদের যুদ্ধ বর্জনের কারণ জানতে চাইলেন।
কেউই কোন সদুত্তর দিল না। তিনি সবাইকে পুনরায় সিরিয়া আক্রমণের জন্য অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু হাতে গোনা কিছু লোক ছাড়া সবাই নীরব থাকল। এরপর হযরত আলী আবারও সবাইকে একত্রিত করে সিরিয়া আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এবারও সবাই তাঁর কথা শুনল বটে কিন্তু নীরব থাকল। শেষ পর্যন্ত হযরত আলী নিজেও নীরব হয়ে গেলেন। তখন হযরত আলীর সবচেয়ে বড় বন্ধু মালিক আশতার আর পৃথিবীতে ছিলেন না।
সিফফীনের যুদ্ধের কিছুদিন পরে তিনি মিশর যাওয়ার পথে মারা গিয়েছিলেন। একজন বেদুইন সর্দার তাঁর খাবারে বিষ প্রয়োগ করায় তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ধারণা করা হয় যে, এ ঘটনায় মুয়াবিয়ার হাত ছিল। মালিক আশতারের মৃত্যুতে হযরত আলী তাঁর সবচেয়ে বড় বন্ধুকে হারিয়েছিলেন। সিফফীনের যুদ্ধের পর হযরত আলী মালিক আশতারকে মক্কা-মদিনা অঞ্চল অর্থাৎ জাযিরার শাসনকর্তা বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন।
এর কিছুদিন পর তিনি তাকে মিশরের গভর্নর বানিয়ে পাঠান। মিশরের তখনকার গভর্নর মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর উসমান ভক্তদেরকে দমন করতে পারছিলেন না। ইবনে খাদীজের নেতৃত্বে মিশরের উসমান ভক্তরা মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল এবং কয়েকটি যুদ্ধে বিজয়ও লাভ করেছিল। তাই মিশরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্য মালিক আশতারকে নতুন গভর্নর বানিয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু মালিক আশতার মিশরে পৌঁছার পূর্বে পথিমধ্যেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
তখন হযরত আলী ও মুয়াবিয়ার মধ্যে মধ্যস্থতার সময় চলছিল। তাই মুয়াবিয়া মিশরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছিলেন না। সালিশী বৈঠকের পর মুয়াবিয়া আমর ইবনুল আসের নেতৃত্বে মিশরের উদ্দেশ্যে ছয় হাজার সৈন্য পাঠিয়ে দেন। এ খবর কুফায় পৌঁছালে হযরত আলী কুফাবাসীদেরকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করতে চেষ্টা করেন। এটি ছিল খাওয়ারিজদের সাথে যুদ্ধের পরবর্তী সময়। মাত্র দুই হাজার লোক হযরত আলীর আহবানে সাঁড়া দিয়ে মিশর রক্ষার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
কিন্তু এরা কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর মিশরের পতন এবং মুহাম্মদ ইবনে আবু বকরের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে কুফায় ফিরে আসে। মুহাম্মদ ইবনে আবু বকর আমরের বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথমে দুই হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী পাঠিয়েছিলেন। এরা আমরের হাতে সম্পূর্ণ পরাজিত হয়। এরপর মুহাম্মদ নিজেই আমরের সাথে যুদ্ধের জন্য এগিয়ে যান। কিন্তু তাঁর সাথের সৈন্যরা তাকে ফেলে পালিয়ে চলে যায়। একাকী মুহাম্মদ তখন জাবালা ইবনে মাসরুর নামক এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নেন।
সিরীয় বাহিনী এবং ইবনে খাদীজের সৈন্যরা চারদিক থেকে জাবালার বাড়ি ঘিরে ফেলে। মুহাম্মদ ধরা পড়েন! ইবনে খাদীজ তাকে নিজ হাতে হত্যা করেন। এরপর মুহাম্মদের লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়। ৬৫৮ সালে এ ঘটনা সংঘটিত হয়। এর পরবর্তী দুবছর মুয়াবিয়া একের পর এক সফলতা লাভ করতে থাকেন। মিশর দখলের পর হযরত মুয়াবিয়ার মনোবল আরও বেড়ে গিয়েছিল। তিনি হযরত আলীর অধীনস্ত বসরায় বিদ্রোহ সৃষ্টির জন্য আব্দুল্লাহ ইবনে হাযরামীকে পাঠান।
জঙ্গে জামালে নিহত অনেক লোকের পরিবার বসরায় বসবাস করত। তাই সেখানে হযরত আলীর প্রতি অসন্তুষ্ট লোকের অভাব ছিল না। আব্দুল্লাহ ইবনে হাযরামী বসরার গভর্নরের অনুপস্থিতিতে সেখানে প্রবেশ করেন। তিনি প্রথমে সফল হলেও পরে ব্যর্থ ও নিহত হন। হযরত আলীর খিলাফতে বসরার পরবর্তী বিদ্রোহ ছিল ইরানের ফারিসবাসীদের বিদ্রোহ। এটি একটি খাওয়ারিজ বিদ্রোহ ছিল। যিয়াদ নামে হযরত আলীর এক সেনাপতি এ বিদ্রোহ দমন করেন।
৬৫৮ থেকে ৬৬০ সাল পর্যন্ত মুয়াবিয়া তাঁর রাজ্য সম্প্রসারিত করতে থাকেন। অন্যদিকে হযরত আলীর খিলাফত সংকুচিত হতে থাকে। উদারতা, ক্ষমা, অর্থকড়ি সবকিছু দিয়ে মুয়াবিয়া আরবের লোকজনদেরকে তাঁর পক্ষে টানতে থাকেন। মদিনা, তায়েফ, ইয়েমেন প্রভৃতি স্থান থেকে দলে দলে লোকজন দামেশকে এসে মুয়াবিয়ার দরবারে ভীড় জমাতে থাকে। মদিনা, মক্কা ও ইয়েমেনবাসীরা হযরত আলীর খিলাফত বর্জন করে হযরত মুয়াবিয়াকে বাইআত প্রদান করায় আরব উপদ্বীপে হযরত আলীর শাসন আর থাকল না।
৬৬০ সালের মধ্যে সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও মিশর ছাড়াও পুরো হিজায ও ইয়েমেনে মুয়াবিয়ার শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ইরাক ও ইরান ছিল হযরত আলীর অধীনস্ত; কিন্তু সেখানেও তাঁর শত্রুর অভাব ছিল না। হযরত আলীর ঘনিষ্ট লোকজনদের সাথেও তাঁর কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বসরার গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস তাঁর উপর অসন্তুষ্ট হয়ে মক্কায় চলে যান। হযরত আলীর ভাই আকীলও তাঁর উপর অসন্তুষ্ট হয়ে মুয়াবিয়ার কাছে চলে যান।
মুয়াবিয়া আকীলকে সদরে গ্রহণ করেন এবং তাঁর জন্য সরকারি ভাতা নির্ধারণ করে দেন। এ ঘটনা ছিল হযরত আলীর জন্য খুবই হতাশাজনক। মুয়াবিয়া হযরত আলীকে সকল দিক থেকে কোনঠাসা করার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। হযরত আলীর এলাকায় তাঁর সৈন্যরা কয়েকটি হানাও দিয়েছিল। মুয়াবিয়ার সেনাপতি নুমান ইবনে বশীর আইনুত তামুর দখল করে নিয়েছিলেন। মাদায়েন ও আনবারেও লুন্ঠন চালানো হয়। হযরত আলীর খিলাফত ইরাক ও ইরানে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়লেও মুয়াবিয়া তাকে যথেষ্ট ভয় পেতেন।
তাই ৬৬০ সালে তিনি হযরত আলীর এলাকায় আর আক্রমণ না করার সিদ্ধান্ত নেন। ৬৬১ সাল ছিল হযরত আলীর খিলাফতের শেষ বছর। একই সাথে তা ছিল তাঁর জীবনেরও শেষ বছর। হযরত আলীর ভাই আকীল সিরিয়ায় চলে যাওয়ার পর তিনি তাঁর জীবনে শেষবারের মতো কুফাবাসীকে সিরিয়া আক্রমণের জন্য রাজী করিয়েছিলেন। ষাট হাজার কুফাবাসী তাকে কথা দিয়েছিল যে, তারা এবার আর তাকে ত্যাগ করবে না এবং দেহে প্রাণ থাকা পর্যন্ত তাঁর পক্ষে লড়বে।
এর ফলে হযরত আলী আরও সৈন্য এবং সরঞ্জাম সংগ্রহ করার কাজে লেগে গেলেন। কিন্তু ভাগ্যের কী নিমর্ম পরিহাস! ঘাতকের ধারাল খঞ্জরের এক নিমর্ম আঘাত ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিল। অতীতের বীর জুলিয়াস সিজারের মতো হযরত আলীও একদিন ভোরে আততায়ীর আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। এ আততায়ীর নাম আব্দুর রহমান ইবনে মুলজিম মুরাদী। আব্দুর রহমান ছিলেন একজন খাওয়ারিজ নেতা।
নাহরাওয়ানের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারি প্রায় নয় হাজার খাওয়ারিজদের সকলকেই হযরত আলী হত্যা করেছিলেন। যে নয়জন খাওয়ারিজ প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলো তারা ছিলেন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। এরা প্রথমে ইরানে বিদ্রোহ সৃষ্টির চেষ্টা করেন। কিন্তু এতে সফলতা লাভ করতে না পেরে তারা ইরাক ও হিজাযে ছড়িয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তিন খাওয়ারিজ নেতা মক্কায় মিলিত হয়ে এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
তারা কাবাগৃহে একত্রিত হয়ে শপথ করেন যে, যে তিন নেতা ইসলামি বিশ্বকে যুদ্ধে লিপ্ত রেখেছেন তাদেরকে তারা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে হলেও হত্যা করবেন। যে তিন নেতা মুসলমানদেরকে যুদ্ধে নিয়োজিত রেখেছেন তারা হলেন হযরত মুয়াবিয়া, হযরত আলী এবং হযরত আমর ইবনুল আস। তিন খাওয়ারিজ নেতা এ তিনজনকে হত্যার জন্য রওনা হয়ে গেলেন। কথা ছিল যে, কুফা, দামেশক ও ফুসতাতের মসজিদে একই দিনে একই সময়ে এ তিন নেতাকে বিষমাখা তরবারি দ্বারা হত্যা করা হবে।
হত্যাকান্ডের সময় নির্ধারিত হয় ১৬ রমজান রোজ শুক্রবার ভোরের নামাজের সময়। পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই তিন খাওয়রিজ যার যার গন্তব্যে হাজির হয়ে গেল। বারক ইবনে আব্দুল্লাহ দামেশকের মসজিদে মুয়াবিয়াকে আঘাত করলে মুয়াবিয়া সে আঘাতে আহত হন কিন্তু প্রাণে বেঁচে যান। মিশরের আমর ইবনুল আস সেদিন অসুস্থ থাকায় মসজিদে যাননি। ফলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।
ফুসতাতের মসজিদে যিনি তাঁর স্থলে ইমামতি করছিলেন সে ব্যক্তি বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছিলেন। কুফার মসজিদে হযরত আলীকে আঘাত করেন আব্দুর রহমান ইবনে মুলজিম মুরাদী। ইবনে মুজলিমের সাথে আরও দুজন খাওয়ারিজ এ হামলায় সহায়ক হয়েছিল। হযরত আলীর কপালের ওপর তরবারির আঘাত লাগায় তিনি মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। আহত হওয়ার পরদিন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
হযরত আলী তাঁর মৃত্যুর পূর্বে তাঁর তিন পুত্র- হাসান, হুসাইন ও মুহাম্মদ ইবনুল হানাফিয়াকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে প্রয়োজনীয় উপদেশ দিয়ে যান। ৬৬১ সালের ২৭ জানুয়ারী হযরত আলী মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে ইসলামের ইতিহাসের প্রাথমিক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে এবং নতুন ইতিহাসের সূচনা হয়। হযরত আলীর সাড়ে চার বছরের খিলাফতের পুরোটাই ছিল তাঁর জন্য অত্যন্ত তিক্ত সময়।
শেষ পর্যন্ত আততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়ে ইসলামের এ মহান বীর তাঁর তিক্ত জীবন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। হযরত আলীর মৃত্যুর পর তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী তাঁর আততায়ীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। দামেশক ও ফুসতাতের আততায়ীদেরকেও হত্যা করা হয়েছিল। হযরত আলীর খিলাফতের সময় তাকে যেভাবে তিক্ততা ঘিরে রেখেছিল তাঁর মৃত্যুর পরেও তা তাকে ঘিরে রাখে।
তাঁর মৃতদেহকে খাওয়ারিজরা যাতে কবর থেকে উঠিয়ে অবমাননা করতে না পারে সেজন্য তাকে অজ্ঞাত স্থানে সমাহিত করা হয়। এজন্য হযরত আলীর কবর আজও অজ্ঞাত। তাকে কোথায় সমাহিত করা হয়েছিল তা নিয়ে নানা রহস্য ও মতামত ছড়িয়ে আছে। এর মধ্যে একটি বর্ণনা হল, তাকে মদিনায় সমাহিত করার উদ্দেশ্যে উটের পিঠে করে মদিনায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। পথিমধ্যে হঠাৎ সেই উটটি দৌড়ে পালায়। এরপর তার আর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।
এর ফলে হযরত আলী চিরতরে হারিয়ে যান। বিজয়ের ইতিহাসকে অসমাপ্ত রেখেই ইসলামের ইতিহাসের এই মহান বীর ইতিহাসের অন্তরালে হারিয়ে যান। অনেকে মনে করেন, হযরত আলী আসলে কখনো সত্যিকারভাবে পরাজিত হননি। তিনি পরাজিত হয়েছিলেন মূলত ধূর্ততা ও কূটনীতির কাছে। তাকে তলোয়ার দিয়ে কেউ কখনো পরাজিত করতে পারেনি। যদি তিনি ধূর্ততা ও কূটনীতির কাছে পরাজিত না হতেন তাহলে হয়তো মেসিডোনীয় বীর আলেকজান্ডারের পরে তিনিই হতেন সবচেয়ে বড় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা!
লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880
বি.দ্র: রকমারিসহ বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটে লেখকের সবগুলো বই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে লেখকের নামে সার্চ দিলেই যথেষ্ট।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১০:৪৩