স্ক্যানডিনেভিয়ার লৌহযুগের অবসানের পরবর্তী সময়কে ভাইকিং যুগ বলে অভিহিত করা হয়। ‘ভাইকিং’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে নানা মত চালু রয়েছে। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন ‘ভাইকিং’ শব্দের অর্থ ‘জলদস্যু’। অন্যান্যরা মনে করেন ‘ভাইকিং’ বলতে ‘ভাইকেন’ অঞ্চল থেকে আগত লোকজনদেরকে বোঝায়। বর্তমান নরওয়ের অসলো অঞ্চলের তৎকালীন নাম ছিল ‘ভাইকেন’। ‘ভাইকেন’ শব্দটি প্রাচীন নর্স ভাষার অন্তর্গত।
বর্তমানে ‘ভাইকিং’ বলতে সাধারণত ৭৫০ সাল থেকে ১১০০ সালের মধ্যে স্ক্যানডিনেভিয়ার সুইডেন, নরওয়ে ও ডেনমার্ক অঞ্চলে বসবাসকারি জার্মান জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে বোঝায়। বর্তমান আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, হল্যান্ড এবং উত্তর জার্মানি অঞ্চলের তৎকালীন অধিবাসীদেরকে সাধারণভাবে নর্সম্যান বলা হতো। এছাড়াও এসব অঞ্চলের মানুষকে নর্থম্যান, ডেন, জার্মেনিয়ান বা নর্মান নামেও অভিহিত করা হতো।
রাশিয়া এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে ভাইকিংদেরকে ‘ভ্যারাঞ্জিয়ান’ নামে ডাকা হতো। বাইজেন্টাইন সম্রাটদের স্ক্যানডিনেভিয়ান দেহরক্ষীদেরকে ‘ভ্যারাঞ্জিয়ান রক্ষী’ বলা হতো। অনেক সময় ‘ভাইকিং’ বলতে জার্মান, কেল্টিক ও বাল্টো-শ্লাভদের থেকে পৃথক একটি স্বতন্ত্র নৃ-গোষ্ঠী বোঝানো হয়ে থাকে; আসলে তা ঠিক নয়। ভাইকিংরা মূলত জার্মানদেরই একটি শাখা।
ভাইকিংরা ছিল স্ক্যানডিনেভিয়ার উচ্চ জার্মান শাখাভুক্ত জাতিগোষ্ঠী। তারা ছিল মূলত সমুদ্রচারী। দুধর্ষ সমুদ্রযোদ্ধা হিসেবে তাদের বেশ খ্যাতি বা কুখ্যাতি ছিল। সমুদ্র অভিযানে তারা পৃথিবীর সকল জাতির চেয়ে এগিয়ে ছিল। তবে ভাইকিংদের সকলেই যে সমুদ্রচারী ছিল, তা নয়। তাদের অনেকেই ছিল কৃষিজীবী এবং এরা ডাঙ্গার স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্থ ছিল।
চিত্র: ভাইকিং যোদ্ধা
ভাইকিংরা সমুদ্রপথে সওদাগরী ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিল। তারা স্ক্যানডিনেভিয়া ও উত্তর ইউরোপের মধ্যে সমুদ্রব্যবসায় নিয়োজিত ছিল। সমুদ্রপথে ডাকাতি বা জলদস্যুতা ছিল তাদের অন্যতম পেশা। অন্যান্য জার্মান গোষ্ঠী- গথ, ভ্যান্ডাল এবং স্যাক্সনদের মতোই তাদের মধ্যে ভয়ংকর আক্রমণকারি বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন দেখা যায়। সমুদ্রপথে লুঠতরাজ ও ভিনদেশের উপকূলীয় এলাকায় আক্রমণের ক্ষেত্রে তারা স্যাক্সনদের চেয়েও এগিয়ে গিয়েছিল।
প্রথমবারের মতো ভিনদেশে উল্লেখযোগ্য ভাইকিং আক্রমণের ঘটনা ঘটে ৭৮৭ সালে। সেবছর নর্স দস্যুরা ইংল্যান্ডের দক্ষিণ উপকূলের ডরসেটে অবস্থিত পোর্টল্যান্ড মনাস্টেরিতে ভয়ানক লুণ্ঠন চালায়। এর পরবর্তী দু’শো বছরের ইউরোপীয় ইতিহাস ভাইকিং আক্রমণ ও লুণ্ঠনের ঘটনায় ভরপুর হয়ে আছে। ভাইকিংরা আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। এসব এলাকায় তারা বসতি স্থাপন করেছিল এবং ইংল্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাদের দখলে চলে গিয়েছিল।
ভাইকিংরা ফ্রান্স ও স্পেনের নদীপথে আধিপত্য বিস্তার করেছিল এবং রাশিয়ার বাল্টিক উপকূলীয় অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলেও ভাইকিং আক্রমণের অসংখ্য ঘটনা প্রচলিত রয়েছে। এমনকি সুদূর কাস্পিয়ান সাগরেও ভাইকিং আক্রমণের গল্প শোনা যায়। ভাইকিংরা একটি দুধর্ষ আক্রমণকারি জাতি হিসেবে খুবই দ্রুত পরিচিতি লাভ করেছিল। সমগ্র ইউরোপে তাদের হিংস্র ও তীব্র আক্রমণের নানা গল্প ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে এসব ঘটনা যে অতিরঞ্জিত হয়নি, তা নয়।
ফ্রান্স এবং ব্রিটেনের তৎকালীন খ্রিষ্টান যাজকরা তাদের উর্ধ্বতন বিশপদের কাছে লিখা পত্রে ভাইকিংদের সংহিস কর্মকাণ্ডের উপাখ্যান তোলে ধরেছিলেন। তাদের সেসব চিঠি থেকে জানা যায় ভাইকিংরা মূল্যবান বস্তু ও রত্ন সংগ্রহের আশায় ধনসম্পদে পরিপূর্ণ মনাস্টেরিগুলোতে নির্বিচারে আক্রমণ ও লুণ্ঠন চালাত এবং ধর্মযাজকদেরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করত। ব্রিটেনের অনেক ধর্মযাজক বিশ্বাস করতেন যে, ভাইকিং আক্রমণ হল ইশ্বরের পক্ষ থেকে এংলো-স্যাক্সনদের ওপর বর্ষিত অভিশাপ; এংলো-স্যাক্সনদের পাপের শাস্তি দেওয়ার জন্য ইশ্বর ভাইকিংদেরকে পাঠিয়েছেন।
যাজকদের লিখা পত্রে উল্লিখিত ভাইকিং আক্রমণের একটি ঘটনা এরূপ: আমরা এখন একটি বিধর্মী জাতির কাছ থেকে যেরকম সন্ত্রাসের শিকার হচ্ছি তা ব্রিটেনে “ইতোপূর্বে কখনো দেখা যায়নি….। চিন্তা করুন, সেইন্ট কাথবার্ট চার্চ তলিয়ে গিয়েছে ইশ্বরের যাজকদের রক্তের তলায়; লুন্ঠিত হয়েছে এর সকল ঐশ্বর্য্য। অথচ এটি হল ব্রিটেনের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় স্থান যা বিধর্মী লোকজনদের একটি সহজ শিকারে পরিণত হয়েছে।” (ইয়র্কের সেইন্ট এলকুইনের লিখা পত্র)
তবে খ্রিষ্টান যাজকরা অনেক ক্ষেত্রে ভাইকিং নিষ্ঠুরতার অতিরঞ্জিত বিবরণও তোলে ধরেছেন। যাজকরা তাদের রিপোর্টে সাধারণত ভাইকিং নৃশংসতার অতিরঞ্জিত বিবরণ পেশ করতে পছন্দ করতেন। সে সময়য়কার অনেক খ্রিষ্টান শাসকও কোন কোন ক্ষেত্রে ভাইকিংদের মতই নিষ্ঠুর ছিলেন। এমনকি ভাইকিংদের চেয়েও বেশি নৃশংসতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন অনেকে। কিন্তু তারা ধর্মীয় অঙ্গনে ভাইকিংদের মতো এতটা নিন্দিত ছিলেন না।
বর্তমানের অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভাইকিংদের দখল অভিযান ও লুটতরাজ ছিল মূলত তাদের পূর্বপুরুষদের ভূমিতে খ্রিষ্টান শাসকদের অবৈধ পদার্পণের বিরুদ্ধে এক ধরণের আদিম ও হিংস্র প্রতিরোধ স্পৃহার বহিঃপ্রকাশ। ভাইকিংরা হিংস্রতার মধ্য দিয়ে আত্মরক্ষার পথ বেছে নিয়েছিল। প্রায় তিনশ’ বছর ধরে চলা খ্রিষ্টধর্মীয় যুদ্ধ এবং নিষ্ঠুর খ্রিষ্টান রাজাদের হাতে সংঘটিত গণহত্যার বিরুদ্ধে ভাইকিংরা আদিম পন্থায় প্রতিশোধ নিয়েছিল।
চিত্র: ভাইকিং যোদ্ধা
ক্যাথলিক ফ্রান্সের উৎপীড়ণের বিরুদ্ধে বিধর্মী মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধ ছিল মূলত ৬৯০ থেকে ৮০৪ সাল পর্যন্ত চলা ফ্রিজিয়ান ও স্যাক্সন যুদ্ধের সমুদ্রভিত্তিক সম্প্রসারণ। ক্যাথলিকরা অনেক সময় ইচ্ছা করেই বিধর্মীদের পুরাতন পবিত্র স্থানের ওপর খ্রিষ্টান মনাস্টেরি নির্মাণ করত। অনেক মনাস্টেরি নির্মিত হয়েছিল বিধর্মীদের দেবতাদের জন্য সংরক্ষিত পবিত্র স্থানের ওপর। তাই ভাইকিংরা যেসব মনাস্টেরি পুড়িয়ে দিয়েছিল এবং সমূলে ধ্বংস করেছিল তা অনেক ক্ষেত্রে ছিল প্রতিশোধমূক; কেবল ধ্বংসের জন্যই ধ্বংস ছিল না।
ফ্রান্সের ক্যাথলিক মনাস্টেরিগুলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রাম্য লোকজনদেরকে শোষণ করত। গ্রাম্য লোকজনদেরকে তাদের নিকটস্থ মনাস্টেরিতে ট্যাক্স এবং টাইদ প্রদান করতে হতো। টাইদ হল চার্চের খাজনারূপে প্রদেয় বাৎসরিক ফসল ও নবজাত পশুর এক-দশমাংশ যা সরকারি আদেশবলে সকল গ্রাম্য লোকজনকে নিকটস্থ মনাস্টেরি বা চার্চে জমা দিতে হতো। এভাবে গ্রামাঞ্চলে মনাস্টেরিগুলোর ধর্মীয় শোষণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফ্রাংক সম্রাট শার্লামেনের ধর্মযোদ্ধাদের পেছনে যে খরচ হতো তা আসত এই টাইদ এবং ট্যাক্স থেকেই।
চিত্র: ভাইকিং রণতরী
তাই ভাইকিংদের মনাস্টেরি লুণ্ঠনের বিষয়টি ছিল অনেকটা ‘চোরাই মাল চুরি’ করার মতো। কারণ মনাস্টেরির সম্পত্তিগুলো তাদের মতো সাধারণ লোকজনের কাছ থেকেই আদায় করা হতো। আবার নিজেদের নিরাপত্তার জন্যও ভাইকিংদেরকে মনাস্টেরির সোনাদানাসমূহ লুট করতে হতো কারণ এসব সোনাদানা যে কোন মূহুর্তে রাজকীয় বাহিনীর পেছনে খরচ হওয়ার সম্ভাবনা থাকত যে রাজকীয় ধর্মযোদ্ধারা ভাইকিংদের মাতৃভূমিতেই হানা দিত এবং নির্বিচারে ধর্ষণ ও লুটতরাজ চালাত!
যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়াও আরেকটি কারণে ভাইকিংদের বেশ খ্যাতি ছিল। সেটি হল সমুদ্র অভিযান। ইউরোপের উপকূলরেখা ধরে তারা ভূমধ্যসাগরে ঘুরে বেড়াত এবং উত্তর আফ্রিকার উপকূলেও ভ্রমণ করত। রাশিয়ার নদীপথ ধরে তারা কনস্টানটিনোপলে পৌঁছে যেত এবং এমনকি এশিয়ার বাগদাদও তাদের কাছে অচেনা ছিল না। ভাইকিংরা জরভিক (ইয়র্ক), কিয়েভ এবং আয়ারল্যান্ডের প্রধান প্রধান শহর যেমন ডাবলিন, কর্ক, ওয়েক্সফোর্ড, লিমেরিক ইত্যাদি শহর গড়ে তোলেছিল।
ডেনরা দক্ষিণদিকে ফ্রিজল্যান্ড, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে অভিযান চালাত। ১০১৩ থেকে ১০১৬ সালের মধ্যে ডেন নেতা কানুট দ্য গ্রেট ইংল্যান্ডের সিংহাসনের উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন। সুইডিশরা পূর্বদিকে এগিয়ে রাশিয়ায় পৌঁছেছিল। সেখানে রুরিক সর্বপ্রথম রাশিয়ান স্টেইট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সুইডিশরা সেখান থেকে নদীপথ ধরে আরও দক্ষিণে এগিয়ে কৃষ্ণ সাগরে পৌঁছেছিল এবং বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ও কনস্টানটিনোপলে প্রবেশ করেছিল।
চিত্র: ভাইকিং রণতরী
নরওয়েজিয়ানরা অগ্রসর হয় পশ্চিম দিকে। তারা ফারোজ, শেটল্যান্ড, অর্কনি, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের অধিকাংশ অঞ্চলে পৌঁছেছিল। ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ড ছাড়া তারা প্রধানত লোকালয়বিহীন বিভিন্ন ভূখণ্ড খুঁজে পেয়েছিল এবং সেসব ভূখণ্ডে বসতি গড়ে তোলেছিল।
৯৮৫ সালে উত্তর আমেরিকা আবিষ্কার করেন বিজার্নি হেরজল্ফসন। এরপর গ্রিনল্যান্ড থেকে সেখানে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করেন লেইফ এরিকসন এবং থরফিন্নুর কার্লসেফনি। থরফিন্নুর কার্লসেফনি উত্তর আমেরিকার সে অঞ্চলটির নাম দিয়েছিলেন ভিনল্যান্ড। ভিনল্যান্ড বর্তমান কানাডার নিউফাউন্ডল্যান্ডে অবস্থিত।
১০০৫ সালের দিকে লেইফ এরিকসন এবং থরফিন্নুর কার্লসেফনির প্রচেষ্টায় নিউফাউন্ডল্যান্ডের উত্তর পেনিনসুলায়- লানস অক্স চারণভূমির কাছে একটি ক্ষুদ্র বসতি স্থাপন করা হয়। কিন্তু সেখানকার পুরাতন অধিবাসীদের আক্রমণ এবং ঠাণ্ডা আবহাওয়ার ফলে বসতিটি কয়েক বছরের মধ্যেই বিলুপ্তি লাভ করেছিল। সেখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো বর্তমানে জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্গত।
বর্তমান বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, ভাইকিংরা যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে হঠাৎ করে একটি শীতল যুগ শুরু হয়ে যায় যা পরবর্তী কয়েকশ’ বছর ধরে অব্যাহত ছিল। এই ক্ষুদ্র বরফযুগটি গ্রিনল্যান্ডের ভাইকিং উপনিবেশগুলোকে বিলুপ্তির মুখে ঠেলে দিয়েছিল এবং পশ্চিমদিকে ভাইকিংদের এগিয়ে যাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, ভাইকিংদের মূল ভূখণ্ডগুলোতেও শীতের মারাত্মক প্রভাব পড়েছিল।
ভাইকিং যুগের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ জার্মানদের ইতিহাসে বেশ ব্যতিক্রমধর্মী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। প্রযুক্তিগতভাবে ভাইকিংরা অনেক এগিয়ে গিয়েছিল। ভাইকিংরা তাদের সময়ের সবচেয়ে উন্নত পালতোলা জাহাজ নির্মাণ করেছিল। সমুদ্র অভিযানের জন্য তারা যে ডিসট্যান্স টেবিল বানিয়েছিল তার সাথে বর্তমানের উপগ্রহের পরিমাপের মাত্র ২ থেকে ৪ শতাংশ অমিল রয়েছে। আটলান্টিক মহাসাগরের মতো বিশাল দূরত্বের জলরাশিতেও তাদের ডিসট্যান্স টেবিল অনেক নিখুঁত হয়েছিল।
ভাইকিংদের জাহাজগুলো তাদেরকে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া ছাড়াও যুদ্ধের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা প্রদান করত। তারা খুবই কার্যকরভাবে ‘হিট এন্ড রান’ আক্রমণের কৌশল প্রয়োগ করতে পারত। এ কৌশল অনুযায়ী তারা খুবই দ্রততার সাথে অপ্রত্যাশিত আঘাত হানতে পারত এবং পাল্টা আক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই পালিয়ে যেতে পারত। ভাইকিংদের জাহাজগুলো অগভীর পানিতেও চলাচলের উপযোগী ছিল যে কারণে তারা নদীপথ ধরে ভূখণ্ডের অনেক গভীরে চলে যেতে পারত।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ভাইকিংদের আক্রমণের ঘটনাগুলো ছিল তাদের টিকে থাকার লড়াইয়ের অংশ; পরদেশ বিজয়ের উদ্দেশ্য ছিল এক্ষেত্রে গৌণ। স্ক্যানডিনেভিয়ার দক্ষিণে ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে তাদের স্বগোত্রীয় বিধর্মীদের ওপর খ্রিষ্টানরা যেসব গণহত্যার ঘটনা ঘটায় তা তাদেরকে খ্রিষ্টান দেশসমূহে আক্রমণের জন্য প্ররোচিত করে।
বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যেত, ভাইকিং সর্দাররা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু অনুসারী সংগ্রহ করে অভিযানে বেরিয়ে পড়তেন। ভাইকিংরা যেখাতে যেত সেখানকার অধিবাসীদেরকে সরিয়ে দিত এবং সেখানে বসবাস শুরু করে দিত। বিজিত এলাকার সকল মূল্যবান বস্তুও তারা হাতিয়ে নিত। তাদের মধ্যে নতুন নতুন সমুদ্র পথ খুঁজে বেড়ানোর প্রচণ্ড নেশা কাজ করত।
তাদের সবচেয়ে আগ্রহের জায়গা ছিল উত্তর আটলান্টিক। উত্তর আটলান্টিকের সমুদ্রপথ ধরে তারা আইসল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড এবং শেষ পর্যন্ত উত্তর আমেরিকায় পৌঁছে যায়। ১০০০ সালের কাছাকাছি সময়ে, কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের প্রায় ৫০০ বছর পূর্বে ভাইকিংরা উত্তর আমেরিকার কানাডায় পৌঁছেছিল। তারা নবআবিস্কৃত এ জায়গাটির নাম দিয়েছিল ভিনল্যান্ড।
চিত্র: ভাইকিংদের ব্যবহৃত ঢাল
ভাইকিংরা মানবজাতির মধ্যে নতুন মাত্রায় যোগাযোগ গড়ে তোলেছিল এবং সহজে বিশাল দূরত্ব ভ্রমণের মাধ্যমে পৃথিবীকে ছোট করে নিয়ে এসেছিল। তারা জাহাজ নির্মাণের প্রযুক্তিতে নতুনত্ব এনেছিল, নতুন নতুন জাতির মানুষের দেখা পেয়েছিল এবং নতুন চিন্তাধারাও শিখেছিল। মানুষের নতুন নতুন উদ্ভাবনী চিন্তার সাথে ভাইকিংদের গতিশীলতার একটি মিল রয়েছে।
একসময় একটি বর্বর ও খুনী জাতি হিসেবে ভাইকিংদের ব্যাপক জনপরিচিতি থাকলেও বর্তমানের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। মধ্যযুগের বিভিন্ন খ্রিষ্টান দলিলে ভাইকিংদেরকে যেভাবে লুটেরা বর্বর গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তার বাইরে তাদের অনেক অর্জনের ইতিহাসও পাওয়া যাচ্ছে।
অন্যান্য জার্মানদের মতই ভাইকিংদের একমাত্র পুরাতাত্ত্বিক দলিল হল রুনীয় অক্ষরে লিখা কিছু শিলালিপি। প্রাচীন টিউটনিক বর্ণমালার অক্ষরকে ‘রুন’ অক্ষর বলা হয়। প্রাচীন জার্মানদের নিজেদের হাতে রচিত একমাত্র পুরাতাত্ত্বিক দলিল হল এ অক্ষরে রচিত শিলালিপিগুলো। জার্মান অধ্যুষিত বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার রুনীয় শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে।
সুইডেনে প্রায় ৩৫০০টি রুনীয় শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে। এসব শিলালিপি থেকে ভাইকিংদের সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। তবে শিলালিপিগুলোর ভাষ্য অতি সংক্ষিপ্ত হওয়ায় অনেক কিছু বোঝা যায়নি। এর চেয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে ভাইকিং জগত সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গিয়েছে। ভাইকিংরা অন্যান্য অখ্রিষ্টান বিধর্মীদের মতই মৃতদেহ পোড়াত।
চিত্র: ভাইকিংদের যুদ্ধ
ভাইকিংদের কিছু বড় আকারের জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা তাদের জীবন যাত্রা সম্পর্কে অমূল্য ধারণা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। খননের মাধ্যমে উদ্ধারকৃত ভাইকিং গ্রামগুলো এখন পর্যটকদের কাছে বেশ আগ্রহের বিষয়। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের কাছে বিরকা নামক স্থানটি ভাইকিং ঐতিহ্যের স্মৃতি বহন করছে। বিরকা ছিল সুইডেনের প্রথম বাণিজ্য-শহর। এখানে ভাইকিং আমলের প্রায় ৩০০০ হাজার কবর রয়েছে।
বাণিজ্যের প্রতি ভাইকিংদের কতটা ঝোঁক ছিল তা হেডেবির মতো বাণিজ্য বন্দর থেকে সহজেই বোঝা যায়। এ বন্দরটি ছিল ফ্রাংকদের সীমান্তের খুবই কাছে। ফলে ফ্রাংক ও ভাইকিং সংস্কৃতির একটি কার্যকর মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল এটি। ১০৫০ সালে এক বিরোধের জের ধরে নরওয়েজিয়ানরা এ বিখ্যাত বন্দরটি ধ্বংস করে দিয়েছিল। স্টকহোমের হিস্ট্রি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত ভাইকিং নিদর্শনগুলো এক নজর দেখলেই ভাইকিংদের সমুদ্র বাণিজ্যের গুরুত্ব বোঝা যায়।
ভাইকিং যুগের শিল্পচেতনা আজও বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়। আসবাবপত্র, তলোয়ার, বেল্ট, ঘোড়ার জীন- প্রভৃতির মধ্যে এ শিল্প আজও প্রতিফলিত হয়। সেযুগের সকল জার্মান শিল্পীরাই তাদের প্রাচীন ধর্ম এবং স্বজাতীয় চেতনাকে তাদের শিল্পের মধ্যে ফুটিয়ে তুলতেন। জার্মান শিল্পচেতনার এ ধারা একসময় কেল্টিকদের মধ্যে প্রবেশ করে এবং দীর্ঘদিনের চর্চার মধ্য দিয়ে তা কেল্টিকদের হাতেই প্রতিষ্ঠ লাভ করে। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় কেল্টিকরা এ শিল্পকে বেশ এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাই এ শিল্প বর্তমানে ‘কেল্টিক আর্ট’ নামে পরিচিত। তবে প্রকৃত অর্থে তা হবে ‘হিবার্নো-স্যাক্সন আর্ট’।
চিত্র: ভাইকিংদের যুদ্ধ-সরঞ্জাম
স্ক্যানডিনেভিয়ান জার্মানরা একটি উন্নত আইন ব্যবস্থাও গড়ে তোলেছিল যা ছিল পুরনো পৃথিবীর অন্যতম সেরা গণতান্ত্রিক আইন ব্যবস্থা। তাদের সমাজে গুরুত্বপূর্ণ আইনী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রকাশ্য সভার আয়োজন করা হতো এবং সে সভায় সকল স্বাধীন মানুষেরা তাদের নিজ নিজ মতামত ব্যক্ত করতে পারত। এভাবে প্রকাশ্য ভোটের মাধ্যমে বড় বড় সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো।
স্ক্যানডিনেভিয়ার জার্মান নারীরা যথেষ্ট স্বাধীন ছিল। পুরুষের মতো তারাও প্রকৃত ক্ষমতা ও অধিকার ভোগ করত। তারা জমির মালিক হতে পারত, সম্পদের উত্তরাধিকার লাভ করত এবং স্বামীকে তালাক দেওয়ার অধিকার রাখত। স্ক্যানডিনেভিয়ান নারীদের কবরে প্রায়ই ঘরের চাবি পাওয়া যায়। এই রীতি থেকে সহজেই বুঝা যায় যে, সেসব নারীদের হাতে গৃহস্থালী, খামার এবং সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ছিল।
কিছু স্ক্যানডিনেভিয়ান রূপকথা থেকে নারী যোদ্ধাদের কথাও জানা যায়। এসব নারী যোদ্ধারা খুবই সম্মানের অধিকারী ছিলেন। স্ক্যানডিনেভিয়ান সমাজে নারী এবং বয়স্কদেরকে খুবই সম্মানের চোখে দেখা হতো। অনেক নারীরা সমাজের খুবই উচ্চ পদে আসীন ছিলেন এবং যথেষ্ট প্রভাব-প্রতিপত্তির অধিকারী ছিলেন। তারা ভালো শিক্ষারও অধিকারী হতেন।
জার্মানদের মূল ধর্ম এবং সংস্কৃতি পৌরাণিক উপাদানে পরিপূর্ণ। মানবীয় গুণাবলীর অধিকারী দেবদেবীরা তাদের প্রাত্যহিক জীবনে খুবই গভীর ভূমিকা রাখতেন। তাদের সর্বোচ্চ দেবতার নাম ছিল ওডিন। তবে আরও অনেক দেবদেবী খুবই গুরুত্বের সাথে পূঁজিত হতেন। নর্স-জার্মান পুরাণ এবং প্রাচীন নর্স সাহিত্য থেকে তাদের ধর্মীয় দেবতা এবং পৌরাণিক বীর যোদ্ধাদের কথা জানা যায়।
তবে এসব কাহিনী তাদের নিজেদের হাতে রচিত হয়নি। যেহেতু জার্মানদের লিখিত ভাষা জানা ছিল না তাই পৌরাণিক কাহিনীগুলো তাদের মুখে মুখেই প্রচলিত ছিল। পরবর্তীতে খ্রিষ্টান পন্ডিতরা এগুলো লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তাই জার্মানদের পৌরাণিক কাহিনীগুলো জানার জন্য আমাদেরকে খ্রিষ্টান পন্ডিতদের ওপরেই নির্ভর করতে হয়।
স্ক্যানডিনেভিয়ায় খ্রিষ্টধর্মের আবির্ভাবের পর সেখানকার ভাইকিং যুগের সমাপ্তি ঘটে। তবে গবেষকদের মতে, ভাইকিং যুগের অবসানের পেছনে খ্রিষ্টধর্মই একমাত্র কারণ ছিল না। সে সময়য়ে অনেক ভাইকিং মূল ইউরোপের নাগরিক হয়ে মূল স্রোতের সাথে মিশে গিয়েছিল। এছাড়াও যুগ যুগ ধরে চলে আসা ভাইকিং লুণ্ঠনকার্য তখন ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে কার্যকর প্রতিরোধের মুখে পড়েছিল।
স্ক্যানডিনেভিয়ায় খ্রিষ্টধর্মের বিস্তার লাভের পর সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে কোমলতা বিকশিত হতে থাকে। এক পর্যায়ে সেখানে নরওয়ে, ডেনমার্ক এবং সুইডেন রাজ্যের জন্ম হয়। এসব রাজ্যের রাজারা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ কামনা করতেন। তাই একসময় স্ক্যানডিনেভিয়ানরা তাদের নিজেদের রাজ্যগুলোতে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে শুরু করে।
লেখক: আসিফ আযহার
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
ই-মেইল: [email protected]
ওয়েবসাইট: http://www.asifajhar.wordpress.com
ফেসবুক: Asif Ajhar, যোগাযোগ: 01785 066 880
বি.দ্র: রকমারিসহ বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটে লেখকের সবগুলো বই পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে লেখকের নামে সার্চ দিলেই যথেষ্ট।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জানুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৬:৩১