জাতির কলঙ্ক মোচনের নাম করে আওয়ামী সরকার দেশে এবং বিদেশে যতই প্রোপাগান্ডা চালাক না কেন যুদ্ধাপরাধের বিচারের নাম করে যা কিছুই করা হচ্ছে সেটি যে ভারতের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতায় করা হচ্ছে সেকথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর চেপে রাখতে পারেননি। ক্ষমতার উচ্চ মার্গে বসে মন্ত্রী মিনিস্টাররা অনেক অপ্রিয় সত্যই জনগণের কাছে লুকিয়ে রাখেন। অথচ সেই জনগণই তাদেরকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় বসায়। কিন্তু জনগণের কাছে আড়াল করলে কি হবে, যখন এসব বিষয় আত্মঃরাষ্ট্রীয় পর্যায় চলে যায় তখন আসল সত্যটি আর লুকাবার উপায় থাকে না। এই বিষয়টি এখন উৎকটভাবে ধরা পড়েছে আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন থেকে ফাঁস হওয়া এক গোপন দলিলের মাধ্যমে। একটি রাষ্ট্রের অনেক গোপন দলিল থাকে, যেগুলো নির্দিষ্ট সময়সীমার আগে প্রকাশিত হয় না। সেগুলো প্রকাশের জন্য একটি সময়সীমা বেঁধে দেয়া থাকে। সেই সময়সীমা হতে পারে ১০ বছর, ২০ বছর, এমনকি ৩০ বছর। দেখা যায় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই গোপনীয়তার তথাকথিত অধিকারের অপব্যবহার করে থাকে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলো। বড় বড় রাষ্ট্রগুলো সেসব ক্ষেত্রেই গোপনীয়তার অধিকার রক্ষা করে যেসব ক্ষেত্রে তারা দুইটি বা ততোধিক রাষ্ট্রের মাঝে বিরাজমান সার্বভৌম সমতার নীতি গ্রহণ করে। আরো দেখা যায় যে, একটি বড় রাষ্ট্র অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্ররাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে যেটি অযাচিত এবং জাতিসংঘ সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে অনিয়ম, বেইনসাফী এবং জুলুম-পীড়নের এসব ঘটনা শেখ হাসিনার সরকার ঘটাচ্ছে সে কথা বাংলাদেশের ওয়াকেফহাল মহলের অনেকেই জানেন। কিন্তু সুস্পষ্ট দলিল এবং প্রমাণের অভাবে সেটি দৃঢ়তার সাথে বলতে পারেন না। বছরের পর বছর ধরে গোপনীয়তার অধিকারের নামে ক্ষমতামদমত্ত রাষ্ট্রগুলো যে অনাচার এবং জুলুম চালাচ্ছে সেটি আরো অনির্দিষ্টকাল অপ্রতিহত গতিতেই চলতো। কিন্তু এবারই প্রথম জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ নামক এক পশ্চিমা সাংবাদিক উইকিলিকস নামক একটি ইলেকট্রনিক সংবাদ মিডিয়া প্রকাশ করে গোপনীয়তার অচলায়তন ভেঙ্গে দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ এশিয়া, ইউরোপ এবং আমেরিকার অনেক রাষ্ট্রের লাখ লাখ গোপন দলিল ফাঁস করে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ বিশ্ববাসীকে হতবিহবল করেছেন। উইকিলিকস কর্তৃক এসব গোপন দলিল ফাঁস হওয়ার পর বিশ্ববাসী বিশেষ করে শিক্ষিত বিবেকবান বিশ্ববাসী স্তম্ভিত চেতনায় দেখতে পাচ্ছেন যে, ইরাক এবং আফগানিস্তান দখল এবং সেখানে অবস্থানের কারণ হিসেবে আমেরিকা এবং তার কোয়ালিশন ফোর্স তাদের দেশের জনগণের সাথে ডাঁহা মিথ্যাচার করেছেন।
বাংলাদেশেও আওয়ামী সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্যান্য মন্ত্রীসান্ত্রী যুদ্ধাপরাধ প্রশ্নে জ্বলজ্যান্ত মিথ্যা কথা বলেছেন। বাংলাদেশের মিডিয়ায় আওয়ামী লীগের প্রবল প্রভাবের ফলে সেই মিথ্যাটি হয়তো চিরদিন সত্য হয়ে থাকতো যদি না বর্তমান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন এই তো সেদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে টেলিফোনে কথা না বলতেন এবং সেই টেলিফোন সংলাপের পূর্ণ বিবরণী ফাঁস না হতো। এই টেলিফোন সংলাপটিও একটি গোপন দলিল হিসেবে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য সংরক্ষিত থাকার কথা। কিন্তু কোনো এক বেরসিক ব্যক্তি সেটি ইন্টারনেটে আপলোড করেছেন এবং সেই সুবাদে অনেকেই সেটা পড়েছেন এবং বিষয়বস্তু জেনে গেছেন। বাংলাদেশের প্রায় ৪ দশকের প্রবীণ ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘হলিডে' গত ২১ জানুয়ারি শুক্রবারে সেই টেলিফোন সংলাপটির অংশবিশেষ প্রকাশ করেছে। সম্মানিত পাঠক ভাই-বোনদের খেদমতে সেই টেলিফোন সংলাপের ট্রান্সক্রিপ্ট আমি নীচে তুলে দিচ্ছি এবং সেই সাথে সেই অংশের বাংলা অনুবাদও তার নিচে প্রকাশ করছি।
দুই.
Partial text of the leaked transcript reveals Secretary Clinton having said to Hasina, "Madame Prime Minister, I have been updated by Ambassador-at-Large Stephen Rapp about his visit to Dhaka. Honestly, at the request of New Delhi, we sent him there and tried our best to help you better organize the (war crime) trial. After listening from Ambassador Rapp and our Ambassador Moriarty, I felt obligated to inform you that both I and President Obama take the iss1ent. Bangladesh has to reform the whole process in a way so that it doesn't become a conduit of punishing opposition."
In response PM Hasina said, "Madame Secretary, I understand your concern and I already asked my Law Minister to take note of what Ambassador Rapp suggested. This is a trial we undertook with active support and assistance of New Delhi. I am sure Indian Ambassador in Washington DC will brief you further on that."
Hasina-Clinton conversations contained a number of other sensitive matters which we decided not to publish for discretionary reasons. But one particular concern of the US Secretary of State deserves public attention.
বঙ্গানুবাদ : ট্রান্সক্রিপ্টের অংশ বিশেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বলছেন, ‘‘ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টার, আমাদের ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত স্টিফেন র্যা প তার ঢাকা সফরের সর্বশেষ ফলাফল আমাকে জানিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কি, দিল্লীর অনুরোধে আমরা তাকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলাম এবং আপনি যাতে আরো সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে পারেন সে ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। রাষ্ট্রদূত র্যা প এবং ঢাকাস্থ আমেকিার রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির কাছ থেকে সবকিছু শোনার পর আমি এটি আপনাকে জানানো কর্তব্য বলে মনে করি যে, আমি এবং প্রেসিডেন্ট ওবামা আমাদের মতামত আপনাকে জানাই। আসলে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের সমগ্র প্রক্রিয়াকেই এমনভাবে সংস্কার করতে হবে যাতে করে সেটি বিরোধী দলকে শায়েস্তা করার হাতিয়ার না হয়।’’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটনের এই বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘ম্যাডাম সেক্রেটারি, আমি আপনার উদ্বেগ অনুধাবন করছি এবং আমাদের আইনমন্ত্রীকে ঐসব বিষয় বিবেচনা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছি। এটি এমন একটি বিচার যেটি আমরা নয়াদিল্লীর সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতাক্রমে করতে যাচ্ছি। আমি নিশ্চিত যে, এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনস্থ ভারতীয় রাষ্টদূত আপনাকে প্রয়োজনীয় ব্রিফিং দেবে।’’
উপরের এই আলোচনা থেকে দুটি বিষয় স্পষ্টভাবে বেরিয়ে আসে। প্রথমটি হলো, আওয়ামী সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচারের নামে এ পর্যন্ত যা করেছে সেটিকে পশ্চিমা দুনিয়া বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘বিরোধী দলকে দমনের হাতিয়ার' বলে মনে করে। দ্বিতীয়টি হলো, যুদ্ধাপরাধ প্রক্রিয়ার সংশোধন। এ কথার অর্থ হলো এই যে, তিনি নিজে এবং প্রেসিডেন্ট ওবামা বিষয়টাকে খুব গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে জবাব দিয়েছেন সেখান থেকে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে পড়ে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে প্রণীত ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল আইনের সংশোধন চায়, যাতে করে এটি আন্তর্জাতিক মানের সমকক্ষ হয়। অন্য কথায় বাংলাদেশের এই আইনটি এখন পর্যন্ত আত্মর্জাতিক মান অর্জন করতে পারেনি।
এরপর হলিডে পত্রিকার ঐ রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, হাসিনা ও হিলারীর ঐ সংলাপে আরো অনেকগুলো স্পর্শকাতর বিষয় রয়েছে। তবে তারা এই মুহূর্তে সেগুলো প্রকাশ করতে চান না। তবে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে উদ্বিগ্ন।
তিন.
সেই উদ্বেগের বিষয়টি হলো বাংলাদেশের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ইউনুস। এ ব্যাপারে হিলারী ক্লিনটন টেলিফোনে শেখ হাসিনাকে বলেছেন, ‘‘Madame Prime Minister, let me come to the core point for which I called you. As you have seen even Washington Post picked up your treatment to Dr. Yunus and the Grameen Bank. I thought it is about time to tell you how upset we are. I am personally upset because Dr. Yunus has been a family friend to the Clintons long before his wining of the Nobel Prize. President Clinton is equally upset. Hope you are aware how hard he worked to see Dr. Yunus get this award. I know people may have personal issues, but when it comes to national icon like Dr. Yunus, I thought Bangladesh shouldn't demonize country's only Nobel Laureate.’’
বঙ্গানুবাদ : ‘‘ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টার, এবার আমি আসছি মূল বিষয়ে, যে বিষয়ে আমি আপনাকে টেলিফোন করেছি। আপনি দেখেছেন যে, আপনারা ড. ইউনুস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে যে আচরণ করছেন সেটি ‘ওয়াশিংটন পোস্টের'ও নজর এড়ায়নি। এখন আপনাকে একথা বলার সময় এসেছে যে আপনার এই আচরণে আমরা গভীরভাবে ব্যথিত। আমি ব্যক্তিগতভাবে মর্মাহত। কারণ, নোবেল প্রাইজ পাওয়ার অনেক আগে থেকেই ড. ইউনুস ক্লিনটন পরিবারের একজন পারিবারিক বন্ধু। আমার স্বামী সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও আমার মতই মর্মাহত। আপনারা জানেন যে ড. ইউনুসের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পেছনে বিল ক্লিনটন কি কঠোর পরিশ্রম করেছেন। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অন্য কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ থাকতেই পারে। কিন্তু যখন সেটি ড. ইউনুসের মতো জাতীয় কিংবদন্তীর পর্যায়ে আসে তখন আমি মনে করি যে, বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ীর ভাবমূর্তি এমন দানবীয়ভাবে অংকন করা উচিত নয়।’’
হাসিনা-হিলারী সংলাপের পর আর কোনো ব্যাখ্যা দেয়ার অবকাশ থাকে না।
‘‘রাষ্ট্রদূত র্যা প এবং ঢাকাস্থ আমেরিকার রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির কাছ থেকে সবকিছু শোনার পর আমি এটি আপনাকে জানানো কর্তব্য বলে মনে করি যে, আমি এবং প্রেসিডেন্ট ওবামা আমাদের মতামত আপনাকে জানাই। আসলে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের সমগ্র প্রক্রিয়াকেই এমনভাবে সংস্কার করতে হবে যাতে করে সেটি বিরোধী দলকে শায়েস্তা করার হাতিয়ার না হয়।’’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটনের এই বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘‘ম্যাডাম সেক্রেটারি, আমি আপনার উদ্বেগ অনুধাবন করছি এবং আমাদের আইনমন্ত্রীকে ঐসব বিষয় বিবেচনা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছি। এটি এমন একটি বিচার যেটি আমরা নয়াদিল্লীর সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতাক্রমে করতে যাচ্ছি। আমি নিশ্চিত যে এ ব্যাপারে ওয়াশিংটনস্থ ভারতীয় রাষ্টদূত আপনাকে প্রয়োজনীয় ব্রিফিং দেবে।’’
সূত্র : দৈনিক সংগ্রাম