অলংকরণ: জসীম অসীম
===============
রচনা: সেপ্টেম্বর ১৯৯৬,
পশ্চিমচান্দপুর, কুমিল্লা।
মঞ্চাভিনেতা এক যুবক: সে মিথুন-কর্কট-সিংহ-কন্যা-তুলা-বৃশ্চিক-ধনু-মকর-কুম্ভ-মীন-মেষ-বৃষ…ইত্যাদি রাশি বিষয়ে কোনো বিশ্বাসই রাখে না। একদিন সেই যুবক স্বপ্নে দেখে, হ্যাঁ স্বপ্নেই দেখে, স্বপ্নে দেখে এক দেশে আছে এক দেশ: সমাজতন্ত্রের দেশ। কিন্তু সেই দেশটা এখনও পৃথিবীতে নেই। তৈরি হয়নি।এখনও স্বপ্নেই আছে সেই দেশ। তবু সেখানে কেউ সমাজতন্ত্রবাদকে ‘ব্যাকডেটেড’ বলে মন্তব্য করে না। সে দেশে যে দু’হাতে মুদ্রা উপার্জন করে, তার পা সবাই চাটে না। অবশ্য দু’হাতে মুদ্রা সে দেশে কেউ উপার্জন করে না। করার দরকারও নেই। এমনকি করার উপায়ও নেই।
সেই দেশে সরকারি কারখানা লোকসানে পড়ে বিক্রি হয় না বেসরকারি খাতে। দরপত্র নিয়েও তাই কোনো প্রশ্ন নেই। নেই তাই ‘প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড’ কিংবা ‘কমিশন’। এমনকি সরকারি জায়গা কাউকে দরপত্রের মাধ্যমে দেওয়া হয় না ‘লীজ’। সেই দেশে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসদের মতো সাহিত্যিকগণ ন্যায্য সম্মান পান।
সেই দেশে আছে একজন মঞ্চ অভিনেতা, যে কেবল স্বপ্ন দেখে থাকে। বাস্তব জীবনে সে স্নাতক শ্রেণির বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ছাত্র হলেও থিয়েটার ছাড়া তেমন কোনো বিষয়েই ইদানিং আর লেখাপড়াও তেমন করে না। এ জগৎ-সংসারে সে মঞ্চ ছাড়া আর কিছুই বুঝতে চায় না।
তার মাথায় অনেক স্বপ্ন। অতল অতল উর্বর স্বপ্ন। স্বপ্ন কেবল মঞ্চের। চলচ্চিত্রের এই বিপুল প্রভাবের যুগেও চলচ্চিত্র তাকে টানে না। চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক কুমার ঘটক-সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে সে যথেষ্টই জানে, কিন্তু তার মাথায় একদিকে যেমন শিশির ভাদুরীর মতো ব্যক্তিরা উড়ে বেড়ান, তেমনি তার স্বপ্নে তার মঞ্চে চরিত্র হয়ে আসেন হিমাংশু কুমার দত্ত, মাস্টার দা’ সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, অমলেন্দু বিশ্বাসসহ আরও আরও সমাজসচেতন দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ।
আকাশ সংস্কৃতির বাণিজ্যিক প্রবল প্রতাপের কাছেও সে হার মানে না। ‘মিডিয়া’ বা ‘মাধ্যম’ তার কাছে বিষয় নয়, তার কাছে বিষয় হলো ‘সমাজতান্ত্রিক আদর্শ’ অথবা ‘সাম্যবাদ’। আদর্শ না থাকলে মিডিয়ার প্রচার ক্ষমতা দিয়ে কী লাভ হবে? তার কাছে প্রতিটি আদর্শহীন মিডিয়া’ই অর্থহীন। ‘আগে তো আদর্শ, তারপরেই তো মিডিয়া।’
সে দেখে বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রতিষ্ঠিতও নয়, প্রতিষ্ঠিত হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। সে আরও দেখে কেউ সৎ নেই এই দেশে, শুধুমাত্র শিশুগুলো ছাড়া। সবাই দুর্বৃত্ত: কী রাজা আর কী প্রজা।
মঞ্চ অভিনেতা ও বাংলা সাহিত্যের এ ছাত্রটি দেখে দেশে তার পছন্দের মতো কোনো মঞ্চও নেই। তাই সে মনে মনে একটি কল্পনার মঞ্চ গড়ে নেয়। সেই মঞ্চেও কখনো এসে গান গায় রবীন্দ্র-ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হয়, নিউক্লিয়ার বিদ্যুতের সংকট নিয়ে কেউ কথা বলে পাখি, বঙ্গোপসাগর কথা বলে মঞ্চেরই এক সক্রিয় চরিত্র হয়ে।1971 সালের রক্তাক্ত পদ্মা-মেঘনা-যমুনা নদী ইতিহাস বলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের, মঞ্চে উপস্থিত হয়েই। সে মঞ্চে সে কখনো কাক, কখনো বক, কখনো বা কুকুরকে তুলে দিয়ে দারুণ অভিনয় করায়। এমন করে করে সে এ দুর্বৃত্তের দেশে সকল নিরীহকে প্রতিবাদী করে তুলে তার স্বপ্নে।
তার এ রকম খেলাধুলা দেখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শিলালিপি চট্টাভট্টাচার্য এবং ‘হায় হায় বিশ্ববিদ্যালয়ে’র চোট্টা উপাচার্য প্রধানমন্ত্রীর কান ভারী করেন। এ বিষয়ে উপদেষ্টাদ্বয় একটি সংবাদ সম্মেলন করতে এসে সাংবাদিকদের নৃশংস প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়ে পেছনের দরজা দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যান।
আর মঞ্চের যুবক অভিনেতা সেই যুবকটি তিন তাসের ম্যাজিক দেখায় না কাউকে, তবে মানুষকে ‘বীর সখিনা’র গল্প শোনায়। আরও শোনায়: কিভাবে বীর প্রীতিলতা বিষ খেয়ে মরে গেলেন অথচ ইংরেজদের হাতে অসম্মানিত হলেন না। যুবক অভিনেতাটি সবাইকে বলে, যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজমের ছেলে আবদুল্লাহ হিল আমান আযামীকে কেন সেনাবাহিনীর চাকুরি থেকে বাদ দিয়ে দেয়া উচিত। যেহেতু বাংলাদেশে এখনও রয়েছে কিছু হিজল গাছ, স্বর্ণচাপা, অর্জুন, কদম, কৃষ্ণচূড়া, ছাতিম অথবা বটবৃক্ষ...তাই যুবকটি শ্বাস নিয়ে এখনও বেঁচে আছে।
কিন্তু একসময় থিয়েটার বিরোধী কিছু সংখ্যক মুসলিম উগ্র মৌলবাদী যুবকের হাতে বন্দী হয় মঞ্চের সেই অভিনেতা যুবকটি। বন্দী থাকলেও একদিন রাতের স্বপ্নে, ঘুমে, সে এমনই এক স্বপ্ন দেখতে শুরু করে যে, সে বড় আশ্চর্যময়। সে স্বপ্নে দেখে দেশের চীফ অফ আর্মি ষ্টাফ তার চাকুরি ছেড়ে রীতিমত বেকার জীবনযাপন শুরু করেছেন। এমনকি তিনি ব্যবসাও করছেন না, শুধু বনে বনে ঘুরে ঘুরে ভালোবাসার কবিতা লিখে যাচ্ছেন। আরও দেখেন, সেই আর্মি চীফ তুরস্কের ক্ষুরধার মোল্লা নাসিরুদ্দিনের সঙ্গে বেশ চুটিয়েই আড্ডা মারছেন। মঞ্চাভিনেতা এই যুবকটি যখন স্বপ্ন দেখে, তার সঙ্গে গাছের বড় শিকড়ের সঙ্গে যেন মিল রেখেই স্বপ্ন দেখে। গাছের বড় শিকড় অজস্র ছোট শিকড়ের জাল ছড়িয়েও তলায় অনেকখানি নেমে গিয়ে মাটির ওপর গাছকে খাড়া রাখে। এই যুবকের অজস্র স্বপ্নের জালও ছড়িয়ে ছড়িয়ে ও মাটির গভীরে নেমে গিয়ে কিংবা মহাশূন্যে উঠে গিয়ে তাকে যেন বাঁচার শক্তি সরবরাহ যোগায়। তার কল্পনাশক্তিও তীব্র। একাত্তরের শহীদদের স্মরণে কেউ যদি কখনো কোথাও কিংবা শহীদমিনারে মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের ব্যবস্থা করে, তখন সে মনে মনে ওখানে গিয়ে মোমবাতির আলো হয়ে যায়।
তার ঘুমের স্বপ্নে মঞ্চে এসে হাজির হয় কয়েকজন অভিনয়শিল্পী, যাদের পারফরমেন্সে সে দারুণ মুগ্ধ হয়। স্বপ্নবিলাসী এ যুবকটির স্বপ্ন প্রায়ই এসে জীবনেই মিশে যায় কিংবা জীবন গিয়ে স্বপ্নের সঙ্গেই মিশে যায়। জীবন ও স্বপ্ন কিংবা স্বপ্ন ও জীবন, বাস্তব কিংবা পরাবাস্তব কখনো কখনো তার কাছে ঠিক সরলরৈখিকই হয়ে যায়।
এই যুবকটির একটি ডাকনাম আছে ‘অমি’। এ নাম ধরেই এবার তার গল্পটি বলা যাক। বিশ শতকের নব্বই দশকের অনেক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তার জীবনে ও মননে, অভিনয়ে ও স্বপ্নে বারবার খুঁজে খুঁজে পাওয়া যায়।
‘অমি’-র ঘুমের স্বপ্নের মঞ্চে, স্বপ্নের থিয়েটারের মঞ্চে এসে হাজির হয় কিছু ছিন্নমূল মানুষ। ছিন্নমূলদের একজন শিক্ষিত প্রতিনিধি মঞ্চে এসে বলে, আমাদের একটি বাড়ি নেই। অথচ বাড়ি আছে অর্থের বিনিময়ে রাতারাতি লাইসেন্স যোগাড় করা একজন অসৎ ড্রাইভারেরও। আমাদের মতো মানুষ কোনো কোনো ঘরে থাকে ধারণ ক্ষমতার চেয়েও বেশি সংখ্যায়: জেলখানার মতোই। অথবা অনেকটা যাত্রী বোঝাই লোকাল বাস গাড়ির মতো। সে আরও বলে, আমাদের কাগজপত্র নেই, ব্যাংক আমাদের ঋণ দেয় না। জমির বর্তমান দর খুব বেশি। বাড়িওয়ালাদের তালিকা থেকে আমাদের নাম তাই বাদ পড়ে যায়। খুব সহজেই । চারদিকে জমির বেআইনী হস্তান্তর প্রক্রিয়া। বিড়ি কোম্পানীর প্রভাবশালী মালিকও ক্রমাগত একটির পর একটি বাড়ি করে চলে। কেউ কেউ তিনটা-চারটা-পাঁচটা...বাড়িও করে যাচ্ছে। অথচ আমাদের জমি পাওয়া কিংবা নিজস্ব বাড়ি হওয়ার ক্ষেত্রে শত শত বাধা। আমরা আজ ভূমিহীন মানুষ। কোনোভাবে মাথাগোঁজার আশায়, দিনরাত একটি জমির, একটি ঘরের রঙিন স্বপ্ন দেখি। তাই সন্ত্রাসীরা যখন কোথাও জ্বালিয়ে দেয় কারো ঘর কিংবা বাড়ি, তখন আমাদের খুবই কষ্ট হয়।
‘অমি’ ছিন্নমূলদের শিক্ষিত প্রতিনিধির ভাষণ শুনতে শুনতে কিছুটা ক্লান্তও হয়ে যায়। মার্কসবাদে তার দারুণ আসক্তি থাকলেও অস্তিত্ববাদ, পরাবাস্তববাদ কিংবা ফিউচারিজম, নিও-রিয়ালিজম ইত্যাদি ইজম এসে অমি-র মাথাটাকে তেতুঁলের চাটনির মতো গুলিয়ে দেয়। অবশ্য তেঁতুলের চাটনির কিছুটা অর্থমূল্য থাকলেও ‘অমি’-র মাথাটার কোনো মূল্যই নেই মানুষের কাছে। কিছু মানুষ অমি-কে পাগল বলে। কখনো কখনো মনে হয় কথাটা যেন একটুও মিথ্যে নয়। কারণ এ জগৎ সংসারে অমি-র মতো এমন ভাবনার মানুষ আমি আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাই না। সুতরাং ‘অমি’ পাগলই।
পাগল আসলে ঠিক ‘অমি’ একাই নয়, পাগল আমিও। এই ধরুন: লেখার পাগল।পাগল- লেখক। কারণ গল্পটি আসলে অমি-রও নয়, গল্পটি আমার নিজের। আর আমি নিজেও বাস্তবে হয়তো একটা পাগল। পাগল না হলে কেন এ গল্পের শুরুতে গল্পের মূল চরিত্রটির নাম দিতে পারলাম না? কিংবা বলতে পারলাম না গল্পটি আসলে আমারই। এমন লোককে লোকে কি মাথা খারাপ বলবে না অন্য কিছু বলবে? তবু অমি-র মাধ্যমেই আমি এ গল্পটি বলা শেষ করি।কারণ অনেকেই অমি-র সৃষ্টিকর্ম, নাটক কিংবা মঞ্চ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে। আর আমি আমার এ জীবনটাকে নিয়েই পরীক্ষানিরীক্ষা করছি। এটা কি এ সমাজে সুস্থ লোকের কাজ?
এ বয়সের যুবকেরা যখন যুবতী নারী আর অর্থের পেছনেই ছোটে, তখন আমি পুঁজিবাদবিরোধী সংগ্রামে উত্তাল দিনের স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। আর ভালোবাসি কিংবা স্বপ্ন দেখি মার্কসবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেকে শহীদী আত্মাহুতি দেওয়ার। এ কথা এই রাষ্ট্রের কেউ জানলে আমার মাথা আর আস্ত রাখবে না? মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীগণও কখনো কখনো হেলমেট ব্যবহার করেন। অথচ আমি রাষ্ট্রের চালক হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও আমার কোনোই হেলমেট নেই। তাইতো অন্যেরা আমাকে মাথা-খারাপ বা উন্মাদ বলে অভিহিত করে।
কিন্তু আমি ভাবি যে নিজেকে শহীদী আত্মাহুতি দেওয়ার স্বপ্ন দেখে, সে কি তার নিজের মাথার কথা কখনো ভাবে? কেন সে হেলমেট যোগাড় করবে? ...ইত্যাদি। তবে আমি হেলমেট যোগাড় না করলেও পকেটে কিন্তু মরিচের গুড়া রাখি। সুযোগমত যদি কখনো যুদ্ধাপরাধীকে পাই, কমপক্ষে তার চোখে তো ছিটিয়ে দিতে পারবো। মরিচের এ গুড়াগুলোই যেন আমার কাছে পিস্তল-বন্দুক-কামান। যখন সংবাদপত্রে কোথাও কোনো শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করার খবর পড়ি, তখন আমার ঐ এলাকাকে রণক্ষেত্র বানিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। কারণ আমিও নিজেকে একজন শ্রমিকই মনে করি। তাই প্রায়ই আমার কাজের মালিকদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে তর্কাতর্কি হয়। আমি মালিকদের প্রভু মনে করি না, করি না অহেতুক শ্রদ্ধা। অথচ আমার প্রতিদিন ব্যবহৃত ভাষা কিন্তু শ্রমিকদের ভাষা নয়, কারণ আঞ্চলিক ভাষা আমার মুখে শোভা পায় না। এমনকি আঞ্চলিক ভাষাকে কাব্যিক রূপ দিয়ে বাংলা সাহিত্যে কবি আল মাহমুদ নতুনধারা সৃষ্টির অনবদ্য অবদান রাখলেও সেটা নিয়ে আমি অনেক মন্দ কথাও বলে ফেলি কখনো কোথাও। যাক, স্বপ্নের বিষয়ে আবারও আসি। ছিন্নমূল মানুষদের শিক্ষিত প্রতিনিধি মঞ্চে উঠে আরও বলতে থাকে, আমরা প্রতিদিন ঘর দেখি। আকাশ ছোঁয়া ঘর থেকে শুরু করে নৌকার ছইয়ের মতো ঘর। দেখি মাটির নিচের প্রাসাদ। অথচ আমাদের কোনো ঘরই নেই। নেই একটি গাড়ি। আমরা উচ্চবিত্ত পরিবারের মানুষের মতো এতোটা শৌখিন নই, তাই নকশাখচিত বাড়ির স্বপ্নে বিভোর নই আমরা। তাই কখনো খুব নেশাগ্রস্তও থাকি না। স্বপ্ন দেখি না কবিগুরুর কুঠিবাড়ির মতো বাড়িতে বসে রাশি রাশি কবিতা লেখার।
আমরা চাই ছায়াদার কোনো বৃক্ষের তলে সাধারণ একটি ঘর। সাধারণ একটি আশ্রয়। তারপর মঞ্চের সমস্ত ছিন্নমূল মানুষ সম্মিলিত কিংবা কোরাস কণ্ঠে বলে, আমরা খুব সংকটে আছি। আমরা এখনও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের শরণার্থী বাঙ্গালী। আমরা বেঁচে থাকতে চাই, অথচ আমাদের জীবন আজ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ঠিক তখনই
মঞ্চের ছিন্নমূল মানুষের মধ্য থেকে একটি নারীকণ্ঠ বলে, এ শহরে এ পৃথিবীতে আমাদের নিজস্ব কোনো জায়গা নেই, বাঁচার একটি চাকরি নেই, নেই নিজস্ব ছোটপুজিঁর কোনো ব্যবসাও। অথচ আমরা বাঁচার জন্য কতো শত রকমের কাজকর্ম করি। আমাদের নেই তাই নির্ধারিত পেশাও। আছে অনাহারে রাত কাটানোর যন্ত্রণা।
আমরা এ অগ্নিদগ্ধ পৃথিবীর মানুষ। তাই যখন চাঁদে পানির সন্ধানে এতো আয়োজন, তখন আমাদের বাড়িঘরের কোনো খবরই নেই। আমরা প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেঁচে থাকি। হয়তো নিঃসন্দেহে জীবনবিলাসী আমরা। তা না হলে এতো দুঃখেও কেউ বাঁচতে চায় না। কিন্তু আমরা বাঁচতে চাই। যদি আমরা লটারীতে ১০-৫০ লাখ টাকা পেয়ে যেতাম, তাহলে অনেক ছিন্নমূল মানুষের বাড়িঘরের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সকাল-সন্ধ্যা ব্যস্ত হয়ে যেতাম। যেহেতু আমরা নিঃসন্দেহে জীবনবিলাসী মানুষ, তাই এতো অভাব-অনটনেও বাঁচতে ভালোবাসি। তারপর মঞ্চে এক দৃঢ় মৌনতা এবং অন্ধকার নেমে আসে।
আমি তখন প্রায় প্রতিদিনই রোজা রাখা এসব মানুষদের নিয়ে ভাবতে থাকি। রোদে পোড়া ফ্যাকাসে এসব মানুষ কারোর করুণা পায় না। যদিও সব শ্রেণির মানুষই একদিন দাহ হবে কিংবা মাটির বিছানায় মিশে যাবে। কিন্তু সে-তো মৃত্যুর পর। কিন্তু বেঁচে থাকা অবস্থায়তো পার্থক্য কোনোদিনও দূর হবে না।
যারা প্রতিদিন মৃত্যুর প্রহর গুণে বেঁচে থাকে, আমি এখনও মনে করি সমাজতন্ত্রের আদর্শ প্রচারে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তাদের মুক্তি মিলতে পারে। এ নিয়ে কথা বলতে গেলেই বিভিন্ন মানুষের তোপের মুখে পড়ি আমি। কেউ বলে, যে শিশুর জন্ম হলো বিভিন্ন ক্রটি নিয়ে, তাকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিভাবে ভালো করবে? কেউ বলে সমাজতন্ত্রের গ্রাহক যে বাড়াচ্ছো, কমিশন কতো পাবে? কী পাবে?... এসব শুনলে মাথা গরম হয়ে যায় আমার। কিছু লোক সব কিছুতেই স্বার্থ খুঁজে বেড়ায়।স্বার্থহীন কিছু জগতে রয়েছে বলেও তারা বিশ্বাস করে না।
আরেকটি বিষয়: অনেক ভেবেই দেখেছি আমিও: এই ২৬ বছর বয়সটিই কিন্তু রক্ত গরমেরই বয়স। এই যে আমারও এখন বিয়ে করারই বয়স। কিন্তু আমাদের এই অভাবের জনবহুল সংসারে কি এখন আমার বিয়ে করা সম্ভব? পরিবারের সব্বার স্বার্থ মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে? অথচ সমাজতান্ত্রিক দেশ হলে সম্ভবত রাষ্ট্র আমাকে বিয়ে খাতে নিশ্চয়ই ঋণ দিতো অথবা সহায়তা করতো কোনো না কোনোভাবেই। আমার কাছে এখন কোনো মেয়ের বাবাই তার আদরের মেয়েকে দেবে না। প্রয়োজনে কোনো অর্থে সক্ষম কিন্তু শরীরে অক্ষম বুড়োর সঙ্গেই দেবে: যে বুড়োর ইট-রড-সিমেন্ট কেনার ভালো সামর্থ্য রয়েছে। অথচ কন্যার বাবারা দেখবে না বুড়ো বরটির ঐ (...) ক্ষমতা নেই। আমাকে নিয়ে আমার বাবা-মায়ের অনেক আশা ছিল। কিন্তু দেশ-রাষ্ট্র-সমাজ-সংসার-ধর্ম-দর্শন-সাহিত্য-সংসংস্কৃতি...ইত্যাদি নিয়ে ভেবে ভেবে আমার মাথা খারাপ বলে, বাবা এখন আমার প্রতি খুবই হতাশ। মা বলেন, বাবারে, কী হবে এতোসব ভেবে? আমি মাকে বলি, মানুষের জীবনটা কোনো ডিপফ্রিজ নয় মা, যা এ কালের প্রায় সব যুবতীই ভাবে। এই দেশের সোনার ছেলে ক্ষুদিরাম বসু, সূর্য সেন, শহীদ রফিক, কর্ণেল তাহের, নূর হোসেনরা এই ডিপফ্রিজের জন্য তাদের সোনার জীবন বলি দিয়ে যায়নি মা। জীবনটা ভারতের অমিতাভ বচ্চন অভিনীত বাণিজ্যিক সিনেমা নয়। অথচ এই দেশে লুটপাটের নাম হয়ে গেছে জীবন। না খেয়ে মরে গেলেও এই লুটপাটে অংশ নিতে পারবো না আমি। কোনোদিনও না। মা বলেন, এইভাবে চিন্তা করলে তুই বাঁচবি কোনদেশে? শুধু একজন মানুষ তো এই দুনিয়া ঠিক করতে পারবে না। আমি বলি, আমি একা নই। পৃথিবীতে আমার মতো এমন ভাবনার মানুষ আরো আছেন। হয়তো তাদের সঙ্গে আমার এখন কোনো যোগাযোগই নেই। যোগাযোগ তৈরি করতে হবে। না হলেও দুঃখ নেই। কারণ তারা আমার মৃত্যুর পরে হলেও আমাকে চেনে নেবে। মা এসব শুনলে অবশ্য আর আলাপ চালায় না।
কিন্তু আমি ঘুমের স্বপ্নের মঞ্চে যেসব ছিন্নমূল মানুষের কথা শুনি, তা আমার রক্তে প্রবেশ করে। আমি যেন একাই দর্শক সেই মঞ্চ নাটকের। আমি তাদেরকে কিভাবে ক্ষতিপূরণ দেবো? এই জীবনে আমি কোনোদিন নির্বাচনেও ভোট দেইনি, দেবোও না কোনোদিন। কোনো চোরকে আমি ভোট দিতে পারবো না। প্রার্থীদের কাতারে কাতারে চোরের মুখ দেখে দেখে নির্বাচনের প্রতি ঘৃণাও তৈরি হয়েছে আমার। বমি আসে। তাই ব্যালটে নয়, বুলেটে বিশ্বাসী আমি। লুটেরা কেন নির্বাচনে অংশ নিতে পারে? ছিন্নমূল মানুষের জন্য ওরা কী করবে? বরং ক্ষমতায় গিয়ে লুট করবে আরও বেশি।
তবে আমি স্বপ্নের মঞ্চে দারুণভাবে উপভোগ করি ছিন্নমূলদের অভিনয়। আমার ইচ্ছে করছিল তখন, আমি নিজেই মঞ্চে প্রবেশ করে অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হই। কিন্তু তার আগেই আলো জ্বলে উঠে মঞ্চে। দেখি মঞ্চে প্রবেশ করেছে চরিত্র হয়ে স্বয়ং ‘বাংলাদেশ’। বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা আবৃত ‘বাংলাদেশ’ চরিত্রটি দেখে আমি ভেবেই পাই না এ আবার কেমন চরিত্র? একটি দেশ কিভাবে একটি চরিত্রের দায়িত্ব পালন করে এবং কথাও বলছে মানুষেরই মতো? এ কী করে সম্ভব? কিন্তু সম্ভব। মঞ্চে সত্যি সত্যিই এসেছে ‘বাংলাদেশ’। তবে তার মানচিত্রের সবুজ জমিনে বেয়নেটে চার্জ করার দাগ রয়েছে। চোখ রয়েছে কালো কাপড়ে বাঁধা। তারপরও ‘বাংলাদেশ’ কথা বলতে থাকে! ‘সমাজতন্ত্র ফেরৎ চাই আমার সংবিধানে। বিচার চাই সংবিধান ধর্ষণকারীর আজ। যারা এখনও এই আমাকে ধর্ষণের হুমকি দেয়, কিংবা চিতায় ধু-ধু করে জ্বালিয়ে দিতে চায়, যারা চাষীর রক্ত করে পান, আমি তাদের মৃত্যুবরণে বাধ্য করতে চাই।'
কতোদিন যেন কোনঠাসা ছিলাম আমি। ‘বাংলাদেশে’র মুখে এমন শব্দগুচ্ছ পেয়ে ‘সাঁওতাল বিদ্রোহে’র কথা মনে পড়ে আমার। বাংলাদেশের মুখে এমন ইস্পাতদৃঢ় রক্তব্য শুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) আড্ডার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে আমার। তখনও আমার স্বপ্ন ছিল ঐ একটাই। থিয়েটারের মাধ্যমে দেশের জন্য কিছু একটা করা। পরে আমি সমাজতান্ত্রিক থিয়েটারের স্বপ্ন দেখতে থাকি। তখন থেকেই বিভিন্ন লোক বলতে থাকে, আমাকে নাকি কার্লমার্কস-লেনিন-স্ট্যালিনের ভূতে ধরেছে। আমি বলি, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে কার ভূতে ধরেছে? আমি বলি, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেছে ঠিকই। কিন্তু সমাজতন্ত্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এখনও শেষ হয়নি। ঠিক একই রকম বক্তব্য শুনলাম মঞ্চের ‘বাংলাদেশ’ চরিত্রের মুখ থেকেও: ‘সমাজতন্ত্র ফেরৎ চাই আমার সংবিধানে।’ তাহলে আমার আর বাংলাদেশের চাওয়ার মধ্যে তো কোনো ফারাকই নেই। আমি তো কবরের স্বপ্ন দেখি না, জীবনের স্বপ্ন দেখি। আমি যখন ঢাকায় পড়ছিলাম, বাংলা বিভাগের অনার্স কোর্সের ছাত্র, তখন আমার দিনগুলো যেন স্বপ্নেই কেটেছিল। তখন দুঃখময়ী এ দেশের মানুষের মুখে হাসি দেখার স্বপ্নে আচ্ছন্ন ছিল আমার সব দিন। আমার সেই সব কৃতিত্বপূর্ণ দিনগুলোতে আমি মুদ্রার স্বপ্নে বিভোর থাকতে পারতাম। কিন্তু আমি শত দারিদ্রে বসবাস করেও মুদ্রার নেশায় নিজেকে হারিয়ে দেইনি। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতার ১৭ বছর বয়সী মেয়ে ‘রূপালি’ তখন আমাকে নিয়ে পালাতেও প্রস্তুত ছিলো। কিন্তু আমি ছিলাম মানব-মানবীর প্রেমের নামে জুয়াখেলার বিপক্ষের একজন যুবক। সেই সময়ের থিয়েটারের প্রতি প্রেম আমার, সমাজতন্ত্রের প্রতি প্রেম আমার বারবার প্রত্যাবর্তন করেছে। তাই ঘুমের স্বপ্নে কখনো চড়েছি মধ্যরাতের ট্রেনে। কখনো দেখেছি মঞ্চে এসে কথা বলে ‘বাংলাদেশ’।
‘বাংলাদেশ’ আবারও বলতে থাকে: আর নয় স্বল্পতম মূল্যে মানুষ বেচা। আবার চাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসমুদ্র এই দেশে। এই উদ্যানে যেমন করে পাকিস্তানীদের মাথা নত করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, ঠিক সেভাবে শান্তি কমিটির হোতাদেরও আজকে ফাঁসি চাই। ফেরৎ চাই সমাজতন্ত্র আবার, আমার সংবিধানে। যে সংসদ মানে না সমাজতন্ত্র, মশাল ছুঁড়ে আগুন লাগাবো সেখানে। আগুন ধরিয়ে দেবো আমি শোষণের আদিম আইনে। লাল রক্তে রঞ্জিত হবে সংসদভবনের পথ। রক্ত যমুনা বয়ে যাবে শহর থেকে শহরে, যদি না আমার সংবিধানে সমাজতন্ত্র থাকে।
আমার বুকে আর চাই না বিকলাঙ্গ জাতি। আমি আজ হাড্ডিসার এক দেশ। এ দেশটাতে নিজের মাংস বেচার পেশার অবসান হবে কবে? মানুষ শিকারের অবৈধ অধিকার বন্ধ হবে কবে? অনেকবার আন্দোলনে আমার সন্তানের রক্ত ঝরেছে কেবল। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত হয়েছি আমি অনেক। মেঘাচ্ছন্ন সংবিধানকে মেনে নেবো না আর। বন্ধ হোক মানুষ শিকারের অবৈধ অধিকার। সমাজতন্ত্র ফেরৎ চাই আমার সংবিধানে। আমি স্নিগ্ধ হয়ে উঠবো নির্মাণে নির্মাণে।
এভাবে বক্তব্য শেষ করে ‘বাংলাদেশ' যেই মঞ্চ ছেড়ে যাবে, ঠিক তখনই আমি মঞ্চে উঠে ‘বাংলাদেশ'কে জড়িয়ে ধরি। দেখি জাতীয় পতাকায় আবৃত ‘বাংলাদেশে’র শরীরে জড়ানো ভারতীয় অবৈধ শাড়ি। একি! তাহলে কি ‘বাংলাদেশ’ও এতক্ষণ মিথ্যেই বলে গেল? তবে কি এ ‘বাংলাদেশ' সমাজতন্ত্র চায়? নাকি আসলে চাওয়ার অভিনয় করে? মঞ্চকে একদা মন্দির-মসজিদ-গীর্জার মতো পবিত্র বলেছিলেন নাট্যকর্মী জন মার্টিন আমাকে। থিয়েটারের ওয়ার্কশপে। সে কথা এখনও আমার স্পষ্ট মনে আছে। জন মার্টিনকে আমি প্রথম বিটিভি-তে দেখি ১৯৮৯ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলামের উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’ অবলম্বনে ধারাবাহিক নাটকে ‘প্যাকালে’ চরিত্রে। কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী ছিলেন সেই নাটকের প্রযোজক। আজ এই জন মার্টিনের গীর্জাসম পবিত্র মঞ্চে দাঁড়িয়ে ‘বাংলাদেশ'ও মিথ্যে কথা বলবে? এ কথা সহ্য করবো না আমি।
কিন্তু না, একটু পরেই ‘বাংলাদেশ'কেও খুঁজে পাইনি আমি। যেতে যেতে ‘বাংলাদেশ' বলে, ‘বাংলাদেশ’ যেন এখন একটি চর। এই চরে চলছে লুটপাট। শান্তি অপহৃত। সমাজতন্ত্র কতো শত বছর পরে আসে, তার কোনো নিশ্চয়তাই নেই। এমনও হতে পারে, কোনোদিনও আসবে না কিংবা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্নই হবে সমাজতান্ত্রিক আদর্শ। তখন তা আর সংবিধানে কী করে স্থান নেবে? তাহলে তুমি কিভাবে বুঝে নেবে তোমার সংবিধান থেকে সেই কাঙ্খিত সমাজের আদর্শিক নীতিমালা? মনে হয় সংবিধানে স্থান পাওয়া নয়, সমাজতন্ত্র সমাহিতই হবে।'
এসব শুনে আবার আমার মাথায় রক্ত উঠে। ছোটবেলায় একবার এক দুর্ঘটনায় আমার মাথা ছিদ্র হয়ে অনেক রক্ত ঝরেছিল। পরে তা জোড়া লাগলে আমার সাহস আবারও বেড়ে যায়। আমি তখন আমার সঙ্গীসাথীদের সঙ্গে ঝগড়া লাগলে মাথা দিয়েই আঘাত করতাম বেশি। বলতাম, এ মাথা আমার পরীক্ষিত মাথা। সেই থেকে এই মাথার ওপর চাপ বাড়ছে আমার। এখনও বিভিন্ন চাপ। সামলানোটাই আমার মাথার জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে যায়। আমাকে সেই চ্যালেঞ্জের মুখে আবার ফেলে দিয়েছে এই মঞ্চের চরিত্র ‘বাংলাদেশ'। তার শেষের ভন্ডামি দেখে আমার মাথার শৈশবের সেই ছিদ্রপথে আবারও রক্ত ঝরে। অথচ ‘বাংলাদেশ’ এর মঞ্চে এসে সমাজতন্ত্রের জয়গান শুনে দারুণ রোমাঞ্চ অনুভব করেছিলাম। মঞ্চে এলেই কি ‘রাজনীতিবিদ'দের মতো সবাই মিথ্যেবাদী হয়ে যায় কিংবা হয়ে যায় সৎ চরিত্রাভিনেতা? আমি যদি মরিচচাষী হতাম, তাহলে ভাতের বদলে এমন মিথ্যেবাদীদের কমপক্ষে একমাসকাল শুধু মরিচ খাইয়ে বাঁচাতাম।
তারপর মঞ্চে আসে কৃষক। ততক্ষনে আমি আবার দর্শক সারিতে নেমে আসি। কিন্তু আমি কৃষককে ডেকে বলি, তোমরা কি প্রকৃতই কৃষক নাকি কৃষকের অভিনয় করছো? তোমাদের অভিনয় ভালো হচ্ছে না। থিয়েটার কিন্তু ছেলেখেলা নয়। থিয়েটার ধর্মচর্চার মতো। তাই ঐ মঞ্চে দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বললে আমি এর প্রতিশোধ নেবো। এ মঞ্চের প্রেমে পড়ে পৃথিবীর অনেক মঞ্চপাগল তাদের জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া ছেড়েছিলেন। আমিও আজ সেই পথেরই পথিক। তাই মঞ্চকে মিথ্যুকের মিথ্যার কলঙ্কে কলঙ্কিত হতে দেবো না।
আমার কথা শুনে এবার মঞ্চের কৃষক বলে, কৃষকের এ দেশে সবচেয়ে বেশি কোনঠাসা কৃষকই। এমন হলে কেমন করে এগিয়ে যাবে স্বপ্নের বাংলাদেশ। আপনারা সবাই যখন ঢাকায় বাড়ি করার স্বপ্নে বিভোর, তখন আমাদের জমি-বাড়ি গিলে খায় নদী। ফারাক্কার বাঁধের জন্য কার ক্ষতি হয়েছে বেশি? কৃষকের। জমিখেকো-ভূমিখেকোদের বড় শিকার কারা? কৃষক। আমাদের কেউ স্বেচ্ছায় রক্ত দেয় না। অথচ আমরা পুরো জাতিকে স্বেচ্ছায় খাদ্য-রক্ত দেই। অথচ আজ আমাদের কিছুই করার নেই। হাত-পা বাঁধা আমাদের। বিদ্যুৎ সংকটে আমাদের সেচ বন্ধ থাকলে উৎপাদনে যেমন ধস নামে, তেমনি আমাদের ফসলের দামও যায় কমে। এসব কথা সত্য। আমরা মিথ্যা বলা বুঝি না। নদীমাতৃক বাংলাদেশের কৃষক আমরা-পদ্মা-মেঘনার ভাঙ্গনের সঙ্গে লড়াই করে বাঁচি। নদীতে যখন তলিয়ে যায় জমি, তখনও স্বপ্ন দেখি। এই স্বপ্ন ছাড়া পুঁজি বলতে আজ আর আমাদের কিছুই নেই। পিঁড়িতে বসে ভাত খাই, মিথ্যা বুঝি না ভাই। আমরা যদি মিথ্যা করে বলি, বাংলাদেশে আর সত্য বলবে কারা?
আমি বলি, মিথ্যে কথা বললে মরে যাবে তুমি। পুড়ে যাবে এ মঞ্চ। এইতো সেদিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার ‘স্টার থিয়েটার’ কেমন করে পুড়ে দগ্ধ হলো। অথচ শত তারকার মধুর স্মৃতিতে এ মঞ্চ ধন্য ছিল। সুতরাং সাবধান। এটা মঞ্চ। বাণিজ্য কমপ্লেক্স নয়। এখানে দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বললে এ মঞ্চের সব নকশা খসে পড়ে যাবে। আমার কথা শুনে কৃষক বলে, আগুনে পোড়ালেও আমি সত্য বলে যাবো। মিথ্যা বলা বুঝি না ভাই। আগুনে পোড়ালেও আমি সত্য বলে যাবো। মুক্তির চূড়াবিহারী মানুষ আমি: আমরা। দেবতার নাম করে রাক্ষসে ভরেছে সমাজ। স্বৈরাচারী পদ্মা গিলে কৃষক-চত্বর আমার। প্রহৃত হৃদয় নিয়ে তারপরও মুক্তির কথা বলি। আগুনে পোড়ালেও এই মুক্তির কথা বলে যাবো ফ্রান্সের সেই মুক্তির দূত জোয়ান অব আর্কের মতো।
এবার বাংলার কৃষকের এ কথাগুলো শুনে আমার সত্যি ভালো লাগে। সরাসরি সমাজতন্ত্রের কথা সে না বললেও সব সময় অজ্ঞাতকুলশীল হয়ে থাকা এ শ্রেণির কোনো প্রতিনিধির মুখে এমন স্পষ্ট বক্তব্য আমাকে সত্যি আনন্দ দেয়। কারণ আমি প্রেমিক। থিয়েটারের এবং সমাজতন্ত্রের। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে আমি অভিসন্দর্ভ রচনা করবো। নাট্যপরিচালক স্তানিস্লাভস্কি তাই এখনো আমার নিয়মিত পাঠের বিষয়। ‘দুর্বার নাট্যচক্রে’র কর্মশালায় এসে অভিনেতা আবুল হায়াৎ বলেছিলেন, ‘দেওয়ান গাজীর কিচ্ছা' একবার নয়, বারবার দেখবে মঞ্চে। তাহলে বুঝবে অনেকদিন পর পর নাটকের প্রোডাকশন। আমি আবুল হায়াতের থিয়েটার প্রেম অনুভব করি। এই পৃথিবীতে কারো ইশক নবীর প্রতি, কারো ইশক নারীর প্রতি। আর আমার ইশক বর্তমানে থিয়েটার ও সমাজতন্ত্রের প্রতি। তাই আমি যাকে পাই, তার কাছেই সমাজতান্ত্রির থিয়েটারের গল্প বলি। আমার বাবা বলেন, এটা সমাজতন্ত্রের দেশ নয়। তাই শেষ পর্যন্ত তুই আপোষ করতে বাধ্য হবি। আমি বলি, না। মরলেও না। বাবা কিছুটা ব্যঙ্গের রসে হাসেন। আমার তখন মনে হয়, তাহলে কি আমার বাবাও এই সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা পছন্দ করেন না? আমি আমার বাসার চে গুয়েভারার পোস্টারটিকে দরজায় এনে লাগাই। ‘অলওয়েজ ফর ভিক্টোরী। হোমল্যান্ড অর ডেথ।' “ইসলামী ব্যাংকে”র একজন কর্মকর্তা সেদিন আমাদের বাসায় এসেছিলেন অন্য কাজে। চে-কে দেখে বলেন, এটা তো কমিউনিস্টের পোস্টার। আমি বলি, এই বাসাটাও কিউবার আরেকটি দূতাবাস। সঙ্গে সঙ্গে আমি ভারতের কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুর জীবনের কিছুটা উদাহরণ নিয়ে আসি। তাকে বলি, যদি পারেন, পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক কিংবা মৃণাল সেনের কিছু ছবি দেখবেন। তাহলে বুঝবেন কমিউনিস্টরা কেন এতোটা শ্রদ্ধেয়। আপনারাই তাদের না বুঝে বদনাম করেছেন। সমাজ এখন যেভাবে অর্থবিত্তের দিকে ধাবমান, এটি একটি রাষ্ট্রের সঠিক পন্থা নয়।
কিন্তু এভাবে বলতে বলতে একসময় আমিও ক্লান্ত হই। এভাবে বলাটাতে কি কোনো মুক্তি আছে? একসময় আমার ঘুমও ভাঙ্গে। স্বপ্নও টুটে যায়। স্বপ্নে দেখা মঞ্চ নাটকের চরিত্রেরাও হারিয়ে যায়। যদিও মন থেকে মুছে যায় না তাদের বক্তব্য।
এ কেমন সময়: সবাই কেবল অর্থের পেছনেই দৌড়াবে? আদর্শের কি কোনোই মূল্যই নেই? আদর্শের অনুভূতিতে আঘাতকারী ব্যক্তিরা লুটেপুটে খাচ্ছে সব। এর সমাধানটা কী? শান্তি কমিটির লোকেরা এখন অনেকেই ‘জামায়াত ইসলামী’ করে। কিন্তু আমি দেখেছি।‘জামাতি হামলা’ও কম নৃশংস নয়। ওদের মধ্যেই প্রথম জীবনে সহিংসতা দেখি আমি। কিন্তু আমার প্রায়ই মনে হয় বিশ্ব ইজতেমা অভিমুখে লাখো মুসল্লির স্রোত যেভাবে নামে, সেভাবে যদি সারাদেশের সর্বস্তরের লোক সমাজতান্ত্রিক কোনো সম্মেলনে উপস্থিত হতো, কতো সম্ভাবনা ছিল। আমার এমন মতামত সেদিন আমার বর্তমান বসবাস স্থান কুমিল্লা শহরের পশ্চিমচানপুরের কিছু সংখ্যক লোকের সঙ্গে বিনিময় করার পর এলাকা থেকে আমাকে বহিস্কারের নিরব বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি বাবা কিছুটা সামাল না দিলে বিক্ষোভ সরবও হতে পারতো। কেউ কেউ মনে করেছেন, আমার মারাত্মক পতন হয়েছে। বলা চলে এ এলাকায় আমি অনেকটা নি:সঙ্গ হয়ে পড়েছি। ক্ষোভ থেকে কেউ কেউ আমার প্রতি বদলাও নিতে পারে। একজন সেদিন আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছে, আমি মারা গেলে আমার লাশে নাকি সে প্রশ্রাবও করবে। ঠিক এই লোকটিকে এখনই আমি খুন করতে পারি। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আইন-আদালত হলে আমার অসুস্থ মা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে দ্রুতই মারা যাবেন। মাঝে মাঝে মনে হয় বৈষম্যহীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র পাওয়ার যোগ্য নয় এ জাতি। লাথি মারতে ইচ্ছে করে জঙ্গিবাদী তৎপরতার মদদদাতাদের বুকে। আমি ভালোবাসি সমাজতন্ত্র। মার্কসীয় নন্দনত্ত্বের আলোকে আমি কবিতা লিখি। টাকা পেলে ঠিক সেই ধারার ফিল্ম বানানোরও স্বপ্ন আছে। আমার এসব ভাবনার জন্য অসংখ্য লোক আমাকে সামনে পিছনে পাগল বলেও মন্তব্য করে। কিন্তু পাগল কি স্নিগ্ধ বকুলতলা ভালোবাসে? ঢাকার যাত্রাবাড়ি মোড় থেকে হাঁটতে হাঁটতে ২৫০ দক্ষিণ যাত্রাবাড়ির আব্বাস উদ্দিন রোডের তার বন্ধু আবিদ হোসেনের বাসার দোতলায় গিয়ে আড্ডা মারে, ভাত খায়? অথবা সেখান থেকে আবারও হেঁটে মতিঝিল জনতা ব্যাংক মোড়ে যায় কোনো প্রয়োজনীয় কাজে? অথবা ঢাকা নিউমার্কেটে যায় মঞ্চ নাটকের পাণ্ডুলিপি ফটোকপি করতে? কিন্তু আমি করি। তাহলে আমি কী রকম পাগল? আমার ইচ্ছে করে বন্ধুদের সঙ্গে বনভোজনে যেতে। কবিতার সবুজ আশ্রয়ে অনেক বড় হতে। কিন্তু আমার মেধার অনেক ফসল অবশ্য পোক্ত হওয়ার অনেক আগেই বিক্রি করে দিতে হয় বিভিন্ন মহাজনের কাছে। এর চেয়ে বড় ট্রাজেডি মানবজীবনে আর কী আছে?
প্রতিদিন হৃদয় আবদ্ধ হয় আরও বেশি সংকটের জালে। তারপরও সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখি আমি। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ-দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ অধ্যয়নে যে পরিমাণ সময় খরচ হয় আমার, নিজের শরীরের প্রতি যদি তার অর্ধেকও ব্যয় হতো, আমার চেহারা-সুরত আরও ভালো থাকতো। সাহসের অভাবে বাগানে বাগানে ফুল ফোটা বন্ধ হয়ে গেলেও আমি সমাজতন্ত্রের সৈনিক হিসেবে
হলেও বেঁচে থাকতে চাই। আমার এমন নেশা বাস্তবসম্মত? নাকি আমি মিথ্যে কথা বলছি? নাকি দেখছি অলীক স্বপ্ন? অলীক কেন হবে? ভ্লাদিমীর ইলিচ লেনিন তো তা বাস্তবে দেখিয়ে গেছেন। রাশিয়ায় । ১৯১৭ সালে।
আমাদের সমাজ জীবনের কৃষকেরা আজ এতটা সাহসী নয়। দুর্গন্ধযুক্ত সমাজ তাদেরকে যেন কোনো পীড়া দেয় না। তাদের সাহস আজকাল ক্রমাগত শুকিয়ে শুকিয়ে মরু হতে দেখেছি আমি। দেখেছি আরও সব আদর্শের বড় আদর্শ হয়ে গেছে টাকা। কুত্তার বাচ্চা টাকা। টাকা পেতে আর জীবন ধরে রাখতে ঢাকা শহরের দিকে প্রতিদিন মানুষের যেভাবে স্রোত নামে, তা অবাক করার মতো। তাহলে শক্তি বেশি কার? টাকার নাকি আদর্শের? টাকা হলে কি আদর্শও কিনতে পাওয়া যায়? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনও পাচ্ছি না আমি।
কারণ চোখের সামনেই টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে মন্দিরের প্রতিমা, বৌদ্ধমূর্তি। কোথাও কোথাও জন্মভূমির মাটির গন্ধ। টাকার জন্য এ দেশ এখন বাজার, বিভিন্ন গোষ্ঠীর। অথচ এ দেশ লক্ষ শহীদের রক্তে সিক্ত দেশ। আজ হয়েছে টাকার উপনিবেশ। টাকার কাছে বিপন্ন আজ লেখক, লোকগায়কের সুর। বৈপ্লবিক যাবতীয় পদক্ষেপ।
মায়াবী জালের এমন টাকার সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে পারবো? টাকার অভাবে কতো পরিবারের জমজমাট আড্ডা মরে গেছে। ফুল ফোটানোর আগেই মরেছে শত গোলাপ গাছ। টাকার কাছে বিক্রি হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহী আত্মা স্বাধীন বাংলাদেশে আবার হানা দেয়। পুঁজিপতি এ টাকা দিয়ে প্রতিদিন মানুষে মানুষে বৈষম্যের প্রাচীর গড়ে যায়। তার বিপক্ষে গেলে বুলেটে-বেয়নেটে স্তব্ধ করে দেয় প্রতিবাদী মানুষের কণ্ঠ। টাকার অত্যাচারে গণজীবন আজ ফাঁকা। জীবনে-মরণে-স্বপনে-গগনে কেবলই টাকার খেলা। এই টাকার নেশায় অনেক মানুষ বর্জন করে সত্য-অর্জন করে মিথ্যা। টাকার সৌরভেই পুঁজিপতির এত গৌরব আজ।
এই দেশে সমাজতন্ত্রের সৈনিক কিভাবে হবো, এ নিয়ে দুশ্চিন্তাও রয়েছে। কারণ টাকার কাছে যেভাবে বিক্রি হয়ে যায় শোষিত মানুষের মুক্তির সনদ, নবজন্ম নেয়া স্বৈরাচার, নারী নির্যাতন, বাড়ে নারী পাচার, পিস্তল আর পাইপগান সঙ্গী হয় গরীব বেকার যুবকের, সাংবাদিকের জীবনঝুঁকি বাড়ে, তাতে কিন্তু আমার আশঙ্কা এবং হতাশাও বাড়ে। বন্য মানুষও ধন্য হয় টাকার গন্ধ পেলে। হিসেব করে না সে টাকাতে আদর্শ আছে কী না। আদর্শ থাকা আর না থাকার মাঝে, সাদা আর কালো টাকার ভীড়ে স্থির থাকাটাই তো কঠিন। পুঁজিপতিরা যেভাবে কোটি শোষিত মানুষকে উলঙ্গ নৃত্য দিয়ে আপ্যায়ন করে, তার বিপক্ষে আদর্শ নিয়ে টিকে থাকা বড় কঠিন। টাকায় বাঘের দুধ পাওয়া গেলেও সব মায়ের দুধ বিক্রি হয় না। বিক্রি হয় না দুর্জয় শক্তিতে শক্তিমান বায়ান্নের রক্তে রাঙ্গা ঢাকার রাজপথ, সুহৃদ প্রকাশক, সজ্জন সম্পাদক ও একজন সাহসী কবি। আমি এমনইভাবে বিশ্বাস করি। সত্যি সত্যি কি আমি এভাবে বিশ্বাস করি? তাহলে সত্য কথাটাই বলি। আমি ঠিক জানি না। এতো যে সমাজতন্ত্রের বুলি শোনা গেল আমার মুখে, সেই আমিও কি সমাজতন্ত্রের সৈনিক হওয়ার যোগ্যতা রাখি? না রাখি না কিংবা জানি না। কারণ উদয় হওয়ার আগেই যদি অন্য অনেকের মতো নিজেকেও দেখি অস্তগামী সূর্যের সমান্তরালে, তাহলে এর কী বিশ্লেষণ করবো? কিছু উগ্রবাদী লোক, অবশ্য আমিও উগ্রবাদী তবে ওদের মতাবলম্বী নই। আমাকে যখন সেদিন রাতে পথ আটকে বললো, শুধু তোর জিহবা এবং ডান হাতটিই আমাদের শত্রু। তাই আজ এই রাতে তোর ওই দুইটি অঙ্গ আমরা কেটে নিয়ে যাবো। আমি তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করি। আমার স্বপ্ন থেকে ক্যামেরার শাটার স্পীডের এক সেকেন্ডের এক হাজার ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যেই হাওয়া হয়ে যায় নীল অপরাজিতা ফুলের রঙ। আমি বলি, আমি আর কক্ষনোই যুবক ছাত্রদের কমিউনিজম বুঝাবো না।
উগ্রবাদীদের একজন বলে, আমরা বলি কী, আর আমাদের সারিন্দা বলে কী।
আমি বলি, আমি আর কক্ষনোই আপনাদের বিরুদ্ধে কথা বলবো না। কোনোদিনই না।
তাদের একজন চোখজোড়া তার লালপদ্মের মতো রং করে বলে, তুই নাকি লেনিনের ভূতের সাহাবী?
এ কথা শুনে তাদেরই কয়েকজন হেসে ফেলে। একজন তার ছুরিটা আমাকে বারবার দেখায়। আমার তখন যীশুর ক্রুশের কথা মনে পড়ে। যদিও যীশুর সাহসের লক্ষভাগের একভাগও পাইনি আমি। হঠাৎই আমার মাথার উপর দিয়ে ‘চৈতার মাগো' টাইপের কী একটা পাখি ডেকে উড়ে গেল। কিন্তু এ পাখি তো চৈত্রমাসে ডাকে। তবে কি আমি ভুল শুনলাম? হয়তো ভয়ে মাথা ঠিক নেই আমার। অবশেষে ওরা আমাকে কিছু শর্ত দিয়ে ছেড়ে দিলো। আমার ভয় পাওয়া নিয়ে ততক্ষনে ওরা তামাশাও জুড়ে দিয়েছে। আমি একবার ফিরেও তাকালাম না ওদের দিকে। ভদ্রছেলের মতো ধীরে ধীরে বাসার দিকে আসতে থাকলাম।
বর্তমানে আমার কোনো স্ত্রী-সন্তানও নেই। অর্থবিত্তও নেই। এই দেশে মন্ত্রী কিংবা রাজা হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। তাই হারাবারও কিছু নেই আমার। অথচ সেই আমিই সেদিন মধ্যরাতে বাসায় ফেরার পথে কোনো এক নির্জন স্থানে অঝোর বৃষ্টির লগ্নে একাধিক জঙ্গির কবলে পড়ে জীবনভিক্ষাও চেয়েছি। একবারও ভাবলাম না আমার দেশগড়ার মিশনে ওরাই অন্যতম বাধা। অথচ আমি তো এতদিন ধরে বীরত্ব লালন করেছি। লজ্জাবতী বানরের মতো কেন ফিরে এলাম। কেন আমি প্রতিবাদ করতে গিয়ে মরতেও সাহস দেখালাম না। শুধু কি সেটা নিরস্ত্র ছিলাম বলেই। তবে কি এই দেশ বীরশূন্যই হয়ে যাবে? মনে হয় এখনই বুঝি এই দেশে, এই গ্রহে যুবকদের দালাল হওয়ার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময়?
আমার এতদিনের তুঙ্গ দাপট একাধিক জঙ্গির প্রাণনাশী হুমকিতে পিছিয়ে পড়েছে। বুঝলাম, বাঁশের চেয়ে যেমন কঞ্চি বড়, তেমনি আমার আদর্শের চেয়েও গলাবাজি বড়। শেষ পর্যন্ত আমিও প্রমাণ করলাম আমার জীবনের, সংগ্রামের, স্বপ্নের ফলাফল জিরো। সমাজতন্ত্রের প্রতি কিংবা থিয়েটারের প্রতি আমার যে ভালোবাসা, তার নিরীক্ষা করে আমি বুঝেছি, আমার চেয়ে একটি শিম্পাঞ্জিও আদর্শ প্রেমিক। একটি লেখার খাতা কিংবা বিরল প্রজাতির কোনো কচ্ছপের মূল্যও আমার চেয়ে বেশি। কারণ জীবনের প্রথম প্রান্তেই যদি জীবনের শেষপ্রান্তের চেয়ে বেশি মৃত্যুভয় কাজ করে, তাহলে এ কলঙ্কের বোঝা কোথায় রাখা যায়? সুতরাং এ কথা নিশ্চিত আমি আর সফল হবো না। ফলাফল জিরো। জিরো প্লাস জিরো প্লাস জিরো, ইকুয়েল টু জিরো। বিপ্লবের ফাঁকা বুলি স্রেফ ভন্ডামি মাত্র।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৩:১০