ঈদ উপলক্ষে চ্যানেলে চ্যানেলে চলছে নাটকের পর নাটক। এতসব নাটক দেখতে গিয়ে যে কারো মনে নাট্যনির্মাতা হবার শখ জাগতে পারে। এদেশে যে কোন কিছু শেখার দুটি উপায় আছে। একটি হল দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, অন্যটি হল সংক্ষিপ্ত প্রক্রিয়া কিংবা শর্টকাট। যেমন আপনি কোন ভাষা শিখতে চান। ইচ্ছা করলে আপনি ওই ভাষার গ্রামার ধরে ধরে, কোন পন্ডিতের লিখা মোটা ডিকশনারী খুঁজে খুঁজে সেই ভাষাটি শিখতে পারেন। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া । অথবা নীলক্ষেতে গিয়ে কিনে আনতে পারেন "ত্রিশ দিনে অমুখ ভাষা শিখুন" টাইপের কোন পাতলা বই । পরের প্রক্রিয়াটি হল একটি শর্টকার্ট। এই ধরনের শর্টকার্ট কতটা কার্যকরী সেটা নিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ থাকলেও শর্টকার্টের জনপ্রিয়তা কিন্তু সন্দেহাতীত। এজন্যই বাসে উঠে হকারদের চিৎকার করতে দেখি "এই বইটি পড়লে আপনি জানতে পারবেন এটা
এই বইটি পড়লে আপনি জানতে পারবেন ওটা
এই বইটি পড়লে আপনি জানতে পারবেন সেটা
আরো জানতে পারবেন......।" এমন হাজারো জিনিস জানার বইটি হকার বিক্রি করে দশ টাকায়। আমরা চাই দশ টাকার বই দিয়ে সব জানতে, অত সময় কোথায়।সব জানার বই কিনে তাই কাস্টমারও খুশি, বিক্রি করে হকারও খুশি। ওয়েল মূল লিখায় যাবার আগেই প্রাসঙ্গিক-অপ্রাসঙ্গিক লেকচার শুনেই আপনারা বুঝে গেছেন আমি পন্ডিত শ্রেনীর নয় বরং হকার শ্রেণীর লোক। এই পোস্টটি পড়লে আপনি জানতে পারবেন কিভাবে সহীহ শুদ্ধভাবে একটি হিট ঈদনাটক বানানো যায়। দেরী নাকরে নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করুন।
নাম নির্বাচনঃ
যদিও কথায় আছে "নামে কিবা আসে যায়?" কিন্তু ঈদ নাটকের জন্য নাম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এক্ষেত্রে পান্তাভাত টাইপের নাম পরিহার করুন। যেমন- "করিম ভাত খায়" এই টাইপ নামের নাটক কিন্তু পাব্লিক খাবে না। নাম যতটা উদ্ভট হবে তত তা দর্শকের মনে গেথে যাবে, এবং তাঁরা হাজারো চ্যানেলের ভীড়ে আপনার নাটক দেখতে উৎসাহ অনুভব করবেন। যেমন নাম দিন- "ভটভটি হারুনের নষ্ট নাট", "মুসা মিয়ার আনন্দ ভ্রমন", কিংবা "টিংকু ডাক্তারের কোলবালিশ"। গবেষনায় দেখা গেছে একশব্দের নাটকের চেয়ে কয়েক শব্দের নাটকের নাম দর্শকদের মনে থাকে বেশি। তারা নামের একটি না একটি শব্দ মনে রাখেন। ফর ইউর কাইন্ড ইনফো 'সংশপ্তক' কিংবা 'শ্যামল-ছায়া" টাইপ নামের নাটকের এখন ভাত নাই। ঈয়েস "ইদ্রিস মিয়ার মিনিকেট চাউল" এটাও একটা ইনোভেটিভ নাম হতে পারে। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন এখানে উল্লেখ করা সবগুলো নাটকেই কোন একটি চরিত্রকে হাইলাইট করা হয়েছে। এর পেছনেও আছে উদ্দেশ্য। কোনমতে নাটক এক ঈদে হিট করলেই হল। এরপর থেকে প্রতি রোজার ঈদ, কুরবানীর ঈদে এই নাটকের সিকুয়াল বানাবেন। যেমন "ভটভটি হারুনের বাঁকা বল্টু", "মুসা মিয়ার বৈদেশ যাত্রা" "টিংকু ডাক্তারের আন্ডারওয়্যার" কিংবা "ইদ্রিস মিয়ার ফালুদা।" বমি করার আগ পর্যন্ত দর্শকদের একের পর এক খাওয়াতেই থাকবেন মিনিকেট চাউল থেকে ফালুদা
চরিত্র নির্ধারনঃ
নিন্দুকেরা বলে নাটিকের সব চরিত্রই গুরুত্বপূর্ণ। যে কোন একটি ভজঘট পাকালেই নাটক শেষ। নিন্দুকের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। একটি ঈদ নাটক হিট করতে একটি চরিত্রই যথেষ্ট।চরিত্রটি কেন্দ্রীয় হতে হবে এমন কোন কথা নাই। এই চরিত্রটির কাজই হল দর্শক যখন অন্য চরিত্রগুলার ক্রমাগত ব্যর্থতায় ঘুমিয়ে পড়তে যাবেন তখন তাদেরকে আকস্মিক কাতুকুতু দিয়ে জাগিয়ে রাখা। এই চরিত্রটি হবে অদ্ভুত। ভাত দুই নিয়মে খাওয়া যায়। একটা হল সরাসরি সামনে থেকে মুখে হাত দিয়ে আরেকটি হল মাথার পেছন দিয়ে হাত ঘুড়িয়ে তারপর মুখে। আমাদের আলোচিত চরিত্রটি সব কাজ দ্বিতীয় পন্থায় করবেন। তার বেশভুষা হবে তার চেয়েও অদ্ভুত। যেমন কোন পুরুষ চরিত্রকে দেখা যেতে পারে "সবসময় মেকাপ(সাদা পাউডার) মেখে ঘুরে বেরাচ্ছেন" কিংবা " হাজী গামছা গলায় দিয়ে, পাঞ্জাবী পড়ে মাস্তানী করছেন।" পাঞ্জাবী পড়া মাস্তানের চোখে একটু সুরমাও দেয়া যেতে পারে। কাতুকুতু দেয়া চরিত্রটির মুখের ভাষাও হবে অদ্ভুত। রাস্তার পাশে পপকর্ণ বানাতে দেখেছেন? পপকর্ণের খই এর মতই আমাদের চরিত্রটির মুখে কথার খই ফুটবে।বাস্তব জীবনে কেউ উনার ধারেকাছের ভাষাতেও কথা বলেন না। সেটা কোন সমস্যা না, সবাই জানে এটা নাটক।
কাহিনীঃ
জ্ঞানী গুনী ব্যাক্তিরা নাটকের নানারূপ শ্রেণীবিন্যাস করলেও ডিজিটাল বাংলাদেশে ঈদ নাটক দুই প্রকার,
>গ্রামের নাটক
> শহরের নাটক
কাহিনীর 'ক' ও না বুঝলেও প্রথমেই ঠিক করে নিন আপনার নাটক শহরের হবে নাকি গ্রামের হবে। শহর কিংবা গ্রাম যেমন নাটকই তৈরি করুন না কেন ভুলেও সেখাননার প্রকৃত ঘটনা দেখাতে যাবেন না যেন। গ্রামের মানুষ গ্রামের কাজ করছে শহরের মানুষ শহরের কাজ করছে এইটাইপ ঘটনার খাওয়া নাই। যেমন গ্রামের নাটক যদি "পদ্মা নদীর মাঝি" কিংবা "পোকামাকড়ের ঘরবসতি" টাইপ বানাই ফেলেন তাইলে ফ্লপ খাইবেন শিউর। কাহিনী গ্রামের হলেও দেখান যে একগাদা শহুরে মানুষ জোর করে গ্রামের টানে কথা বলছেন।শহরের নাটকে দেখান একগাদা বিদেশী মানুষ জোর করে বাংলা বলার চেষ্টা করছেন। দেখান যে গ্রামের মানুষ ফেসবুকে চ্যাট করছে, টেকনোলজি সম্পর্কে তাদের জ্ঞান অসাধারন। শহরের ক্ষেত্রে দেখান তাঁরা ভিডিও কল করছে, স্কাইপিতে কথা বলছেন, ভিডিও কোয়ালিটি ১০৮০পি কিন্তু একবারো বাফারিং হচ্ছে না। ভুলেও নাটকে লোডশেডিং দেখাতে যাবেন না। ডিজিটাল বাংলাদেশে সেন্সর বোর্ডেই তাহলে নাটক আটকে যাবে
শকঃ
সত্যি কথা হল ঈদের নাটক মানুষ দেখে হাসার জন্য। আর আমরা সবচেয়ে খুশি হই কিসে? কারো দুর্ভোগ কিংবা পাগলামী দেখে। রাস্তায় কেউ আছাড় খেয়ে পড়ে গেলে আমরা পেট ফাটিয়ে হাসি। আছাড় খাওয়াটা এক ধরণের শক। পুরো নাটক জুড়েই আমাদের কাতুকুতু দেয়া চরিত্রটি অদ্ভুত কথাবার্তার পাশাপাশি নানা ঊদ্ভট কর্মকান্ডও করবেন। যেগুলা দর্শকদের জন্য শকের কাজ করবে কাউকে হঠাৎ চড় মারা, মুখের উপর থুথু ছিটিয়ে দেয়া, বাথরুমে বসে পেটব্যাথার অভিনয় করা, ইচ্ছামত ন্যাকামী করা, হঠাৎ করে পুকুরে লাফ দেয়া, ধুম করে গাছে উঠে যাওয়া, হাসতে হাসতে হঠাৎ কেঁদে দেয়া- মোট কথা নাটক হিট করতে যা যা প্রয়োজন এই চরিত্রটি তা চাহিবা মাত্র করতে বাধ্য থাকবে।
সমাপ্তিঃ
আমাদের বাস্তব জীবনে তেমন কোন সুখের সমাপ্তি না থাকলেও আমরা নাটক সিনেমায় শুভ সমাপ্তি দেখতে পছন্দ করি।কাজেই নাটকে সুখের সমাপ্তি দিন। নায়ক নায়িকার মিল দেখান, দুষ্ট লোকদের জেলে ঢুকান, কুটনী মহিলার ঠ্যাং ভেঙ্গে দিন। তিন আঙ্গুলের মাথা দিয়া এক চিমটি ন্যাকামো, দুই মুঠি শক আধা গ্লাস ভাঁড়ামোর মধ্যে দিয়ে দিন ঘুটা, ঘুটা, ঘুটা। কংগ্রাচুলেশনস!!!! আপনিও এখন একজন ঈদের হিট নাটক নির্মাতা।
পরিশিষ্ট ১:
ব্যবহৃত ছবির সাথে লেখার মূল-বিষয়বস্তুর মিল না থাকার সম্ভাবনাই বেশী।
পরিশিষ্ট ২:
লেখাটার উদ্দেশ্য শুধুই মজা করা। আমাদের প্যাকেজ নাটক এখনো বিভিন্ন দেশের শত পর্বের ধারাবাহিকের চেয়ে গুনগত মানে অনেক এগিয়ে। শত প্রতিকূলতার মাঝেও যেসব গুনী নাট্য-নির্মাতারা প্রতিনিয়ত আমাদের নাট্যাসম্ভারকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন তাঁদের জন্য অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শ্রদ্ধা।