সালামত রিক্সার হুডে আকাশী রঙ করেছে। হ্যান্ডেলেও একটা ছোট আকাশী-সাদা পতাকা। এই রঙ আর পতাকা লাগাতে গিয়ে তাকে দুইদিন সিগারেট না খেয়ে থাকতে হয়েছে। আগে সে প্রায়ই মধ্যরাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলে যেত ।হাতে পয়সা থাকলে সিগারেটের পাশাপাশি অন্য নেশাও করতো। বিশ্বকাপ শুরু হবার পর থেকে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রাজিলের কোন সাপোর্টার সে রিক্সায় তুলবে না।
হলুদ রঙের বিশ্রি গেঞ্জিটা পড়ে যখন কেউ হাক দেয় "ঐ খালি, যাবি?"
তখন সালামত উদাস গলায় বলে "না মামা। বিরাজিলের লোক তুলি না রিস্কায়।" কেউ কেউ তার এই পাগলামী দেখে মজা পায়, অনেকে আবার 'হলুদ গেঞ্জির' চেয়ে বিশ্রীতর কোন গালি দিয়ে অন্য রিক্সা দেখে।
সালামত আর্জেন্টিনার সাপোর্টারদের কাছ থেকে সে ন্যায্য ভাড়ার চেয়ে পাঁচ টাকা কম রাখে। আকাশী সাদা গেঞ্জী পরে প্যাসেঞ্জার যখন তার আকাশী রিক্সায় উঠে তখন সালামতের মনটা শান্তি শান্তি লাগে। সীটে বসা লোকগুলারে আপন মনে হয়। এই করে সালামতে ইনকাম অর্ধেক হয়ে গেছে প্রায়। এ নিয়ে তার কোন আফসোস নাই। "জীবনে ট্যাকাই সব কিছু না, নীতি হইল সবচাইতে বড়।" নিজের ছেলে বল্টুকে সে প্রায়ই এই উপদেশ দেয়। বল্টুও বাপের মতই আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করে। একটা আকাশী সাদা জার্সির জন্য সালামতের কাছে প্রায়ই আবদার করে সে। "চুপ কর! এইগুলা বড়লোকের কাম। তুই লেহাপড়া কইরা মানুষ হইলে এইরকম মেলা গেঞ্জি কিনতে পারবি।" ধমক দিয়ে বল্টুকে চুপ করায় সালামত।
আজ সালামতের মন অনেক ভালো। আকাশী গেঞ্জি পড়া এক প্যাসেঞ্জার খুশি হয়ে তাকে দুইশ টাকা দিয়েছে। আর দিনের ইনকামও খারাপ না। অনেক দিন পরে সালামত আজ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাচ্ছে। তবে নেশা করার উদ্দেশ্যে না, সেখানে নাকি বড় টিভিতে খেলা দেখানো হয়।
রাত জেগে সে আর্জেন্টিনার খেলা দেখবে।
এক কাপ চা, দুটো সিগারেটও বোধহয় কিনবে।
তার পরেও হাতে কিছু টাকা থেকে যাওয়ার কথা। নিউমার্কেটের ফুটপাত থেকে বল্টুর সাইজের একটা জার্সি কেনা যায়। জার্সিটা পাওয়ার পর বল্টুর হাসিমুখ চিন্তা করতেই সালামতের মন ভালো হয়ে যায়। দশটা বেজে গেছে প্রায়। একটু পরেই খেলা। সালামত অনেক দূর থেকেই হৈ চৈ শুনতে পায়। ভেতরে ভেতরে একটা উত্তেজনা অনুভব করে সে, প্যাডেলে চাপ বাড়ায়। রিক্সার হ্যান্ডেলের আকাশী-সাদা পতাকাটি পতপত শব্দে উড়তে থাকে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কাছাকাছি এসে সালামত কিছুটা সতর্ক হয়। হৈচৈ এর শব্দ এখন আরো পরিস্কার। কিন্তু খেলা নিয়ে শব্দ হচ্ছে না, যেন কেউ মারামারি করছে। কয়েকটা অস্পস্ট গালিও শুনতে পেল সে। রিক্সাটা রাস্তার একপাশে তালা দিয়ে সে চিন্তিত মুখে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢুকে পড়ে। মারামারি খুনোখুনি সালামত জীবনে অনেক দেখেছে। খেলা দেখার অনিশ্চয়তাটাই তাকে মারামারির চেয়ে বেশি ভাবায়।
বড় পর্দার দিকে এগিয়ে যাবার সময় সেদিক থেকে আশা মানুষের কথাবার্তা সালামত মনোযোগ দিয়ে শুনে
"এদের জন্য শান্তিতে খেলাটাও দেখা যায় না "
"দুই দলের মারামারি, আর আমাগো দৌড়াদৌড়ি "
"তোরা সবাই মিলা খেলা দেখ! তা তো করবি না, সামনে বসা নিয়া মারামারি করবি। এখন দেহি কত সামনে বইয়া দেহস। বোক#@$গুলান"
পরিস্থিতি খুব একটা সুবিধার মনে না হলেও খেলা দেখার আশা নিয়ে সালামত বড় পর্দার দিকে এগুতে থাকে। পর্দার ঠিক সামনেই কয়েকজনকে হকিস্টিক নিয়ে ঘুরাঘুরি করতে দেখা যায়, ছুটে পালাতেও দেখা যায় দু-তিন জনকে। পর্দার পাশের অন্ধকার মতন জায়গা ধরে তবুও সালামত এগুতে থাকে। হঠাৎ তার কানে আসে একটা বাচ্চা ছেলের কান্না, "আব্বু ,আব্বু" একটা ঝোপের পাশেই ছিল ছেলেটা। "মারামারির ভিত্রে বাপরে হারায় ফেলসে মনে হয়।" সালামত নিচু হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বাচ্চাটার সামনে। "কি অইছে বাবু? আব্বারে পাইতেছো না? আয়া পড়বো..." কথাটা শেষ না হতেই মাথার পেছনে একটা ভারী আঘাত অনুভব করে সালামত। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। সামনে দাঁড়ানো ছোট ছেলেটাকে তার বল্টু ব মনে হয়। ছেলেটাকে দুই হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে সালামত জ্ঞান হারায়। নিজে মরে গেলেও সে বল্টুর কিছু হতে দেবে না।
যখন জ্ঞান ফিরে সালামতের তখন অনেক রাত হয়ে গেছে।সে সম্ভবত কোন হাসপাতালে আছে। ।বিছানার পাশেই বল্টুর সমবয়সী ছেলেটাকে দেখতে পায় সালামত। ছেলেটা একটা মাঝবয়সী লোকের হাত ধরে আছে। সালামতকে চোখ খুলতে দেখেই তারা এগিয়ে আসেন। বিছানার দিকে ঝুঁকে আসে মাঝবয়সী লোকটা "ভাই এটা আমার ছেলে, অভি। আপনি ওকে মারামারির মধ্যে বাঁচিয়েছেন।" সালামত একটু হাসার চেষ্টা করে। লোকটার কথা যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। প্রতিধ্বনির মত অস্পষ্ট কথা গুলো সালামতের কানে লাগে "আপনি মাথায় আঘাত পেয়েছেন। ডক্টর বলেছে তেমন সিরিয়াস কিছু না। টেনশন এর কিছু নেই।" সালামত মাথা ঘুরিয়ে ছোট ছেলেটাকে দেখার চেষ্টা করে। কোথায় অভি? সালামত দেখে একটা সাদা চেয়ারে তার ছেলে বল্টু বসে আছে। এতক্ষন লক্ষ্য করেনি সে, বল্টুর গায়ে আকাশী-সাদার বদলে একটা হলুদ জার্সি। হাসপাতালের মৃদু আলোতে বল্টুকে দেবশিশুর মত মনে হয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:৫১