কুদরত আলী
সকালে ঘুম ভাংলে কুদরত আলী সাথে সাথে উঠে যান না। বিছানায় কিছুক্ষন গড়াগড়ি খান। তার স্ত্রী রহিমা মুখে গজগজ করলেও স্বামীকে খুব একটা বিরক্ত করেন না। কুদরত আলীর ঘুমের যেন সমস্যা না হয় এজন্য বরং তিনি শোবার নিঃশব্দে চলাফেরা করেন। ঘর ঝাট দেয়া হয়নি বলে কাজের মেয়েটাকে ফিসফিস করে ঝাড়ি দেন।
কিন্তু আজ তিনি কুদরত আলীর উপর মহা বিরক্ত। ঘর থেকে বের হবার সময় শব্দ করে দরজা বন্ধ করলেন। বাজখাই গলায় মেয়ে তুলির সাথে কথা বলতে লাগলেন "তোর বাপের বুড়া বয়সে ভীমরতি হইছে। ভোররাত পর্যন্ত খেলা দেখে। নামাজ-কালাম ভুলে এখন নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়।"
তুলি স্কুলের টিফিন ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাতে বলে "খেলা দেখবে না? কি বল মা? বিশ্বকাপ শুরু হইছে না?"
রহিমার গলা আরো চড়িয়ে বলেন "বিশ্বকাপ শুরু হইছে তো কি?
কাজকাম বাদ দিয়া খেলা দেখতে হবে? ওই টাক মাথার
খেলোয়াড়গুলা তোরে স্কুলে নিয়া যাবে? আমার বাজার করে দেবে?"
তুলি আগেও জানত তার মা একটু রসকষহীন প্রকৃতির নারী। সে তাও পরিস্থিতি হালকা করার জন্য মুখে হাসি ধরে রেখে বলে "সবাই তো খেলা দেখে মা। বাবা তো আর্জেন্টিনা সাপোর্ট করে। তোমাকে আমি খেলা বুঝিয়ে দিব। চল তুমি আর আমি মিলে একই টিম সাপোর্ট করি।"
রহিমা বেগমের মেজাজ আরো চড়ে গেল। ইচ্ছা করছে মেয়েটাকে কষে একটা চড় মারেন। গালে পাঁচআঙ্গুলের লালচে দাগ নিয়ে স্কুলে গেলে সবাই কি বলবে? এই কথা ভেবে এযাত্রায় চড় মারলেন না। কটমট করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে জবাব দেন " এই সংসারের অকর্মা গুলারে সাপোর্ট দিতে দিতে আমার জীবন পানি হয়ে গেল, বিশ্বকাপের দল আর কি সাপোর্ট করবো? তোরা বাপ বেটি ফুর্তিতে আছিস তোরা সাপোর্ট কর। মাথা কামানো ফুটবলার গুলার ছবি বুকে নিয়া ঘুমা। পারলে একটা রে বিয়া কর?"
তুলি অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়, "এসব কি বলছ মা?"
রহিমা মুখ ফিরিয়ে জবাব দেন "ঠিকই বলছি। যা স্কুলে, দেরী হয়ে যাচ্ছে।"
তুলি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে গজগজ করতে করতে বের হয়ে গেল। রহিমা বেগম সেই দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মেয়েটা দিনদিন বাপের মত হয়ে যাচ্ছে। বাপটা এমনিতেই অকর্মা। এই বিশ্বকাপ শুরু হবার পর আরও অকর্মা হয়ে গেছে। সারাদিন ঘুমায়, সারারাত খেলা দেখে। আর বলদের মত সংসারের সব বোঝা রহিমা বেগম একাই টেনে যাচ্ছেন। কিছুদিন পর আয়নায় চেহারা দেখলে রহিমা বেগম আর নিজেকে দেখবেন না। দেখবেন একটা বলদ দাড়ায়ে আছে। আপন মনে কথা বলতে বলতে রহিমা বেগম রান্নাঘরে চলে যান।
ইদরিস
পার্টি অফিসে ইদরিস চিন্তিত মুখে বসে আছে। তেমন কাজ টাজ না থাকায় ইদরিস সারাদিন এখানেই থাকে। আমাদের দেশে কেউ কখনো নিজেকে বেকার পরিচয় দেয় না। বেকার মানুষ মাত্রই ব্যবসায়ী কিংবা পলিটিশিয়ান। কেউ যখন ইদরিসের সাথে হ্যান্ডশ্যাক করে জিজ্ঞেস করে "কি করছেন এখন?" সে তখন বাড়িয়ে ধরা হাতে আলতো চাপ দিয়ে বলে "এইতো পলিটিক্স এর সাথে আছি। সাথে টুকটাক ব্যাবসা।"
এমনিতে ইদরিস মনে মনে জার্মানী সাপোর্ট করে। কিন্তু মুখে সবাইকে বলে ব্রাজিল। এর কারণও আছে। কয়েকদিন আগে পেপারে এসেছে নেত্রী ব্রাজিল সাপোর্ট করে। পলিটিক্স এ উপরে উঠতে হলে সব ব্যাপারে নেত্রীর সাথে একই আদর্শ ধারণ করা লাগে। মন থেকে না হলেও বাইরে দেখাতে হয়। ইদরিস তাই এখন ব্রাজিলের ডাই হার্ট ফ্যান। পার্টি অফিসে নেতাদের সাথে রাতজেগে সে খেলা দেখে। গোল হলে চিৎকার দেয়। নেতারা তেহেরী খাওয়ান, মাঝে মাঝে বিজয় মিছিলও বের হয়, শ্লোগান দেয়ার দায়িত্ব পড়ে ইদরিসের উপর-
"জিতসে কারা? ব্রাজিল।"
আরো জোরে। ব্রাজিল।"
বিশ্বকাপ নিবে কে? ব্রাজিল ছাড়া আবার কে?
ইদরিস সিগারেটে লম্বা টান দেয়। পার্টি অফিসে একটু আগে খবর আসছে ব্রাজিলের পতাকা লাগাতে গিয়ে এক ছেলে নাকি ইলেক্ট্রিক শক খেয়ে মারা গেছে। ব্যাপারটা চিন্তার। এই ঘটনা এমনি এমনি শেষ হবে না। সাংবাদিক আসবে। রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি ব্রাজিলও এখন ইদরিসের দল। ব্রাজিলের পতাকা টাঙ্গাতে গিয়ে বিদ্যুতপৃষ্ট হয়ে মারা যাবার ঘটনা পেপারে আসলে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। নেতা-নেত্রীরা মন খারাপ করবে। খবর তো আসবেই। কিন্তু সেখানে ব্রাজিলের পতাকার ব্যাপারটা হাইড করতে হবে। টাকা খাওয়াতে হবে। ইদরিস মনে মনে ভাবে। সাথে ইন্ডিরেক্টলি হুমকি-ধমকিও দিতে হবে। এদেশে দুইটা জিনিসে সব কাজ হয়, টাকা আর হুমকি। ইদরিসের মনে আরেকটা প্ল্যান আসছে। খবরে ব্যাপারটা এভাবে আসলে কেমন হয় ?
বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হয়ে আর্জেন্টিনা সমর্থক বালকের মৃত্যু
বিশেষ প্রতিনিধিঃ আর্জেন্টিনার পতাকা টাঙ্গাতে গিয়ে বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হয়ে সিরাজগঞ্জ জেলার পাঠকাঠি গ্রামে আব্দুল জব্বার (১৪) নামে এক বালকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। আব্দুল জব্বার পাটকাঠি বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম মেধাবী ছাত্র। তার বাবার সাথে কথা বলে জানা যায় বিশ্বকাপ শুরু হবার পরপরই সে আর্জেন্টিনা সমর্থন করা শুরু করে, এরপরে তার পড়াশুনার অবনতি দেখা দেয়। জব্বার বড় হয়ে ডাক্তার হতে চেয়েছিল।
সাংবাদিক এর সাথে কথা বলে নিউজে আর্জেন্টিনার নাম ঢুকাতে হবে । সাপও মরল লাঠিও ভাংলো না। নেতারাও এতে অনেক খুশি হবে। নিজের বুদ্ধিতে নিজেই মুগ্ধ হয় ইদরিস। আধখাওয়া সিগারেটটা দিয়েই আরেকটা নতুন সিগারেট ধরায় সে। আজকাল সে ধোয়া রিং বানাতে শিখেছে। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৪ রাত ৮:২৭