somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক সংগ্রামী মায়ের কথা

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ৯:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মা! হৃদতন্ত্রী নেচে ওঠা একটি শব্দ। মানুষ ছাড়াও অন্যান্য হিংস্র প্রাণীদের মধ্যেও ‘মায়ের’ স্বভাব অনেকটাই মাতৃসুলভ। যে হিংস্র বাঘটি এইমাত্র একটি হরিণকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে খেয়ে এলো তাকেও তার ছোট্ট শাবক কীভাবে কান-লেজ কামড়াচ্ছে ও তার হিংস্র মা ছোট্ট শাবককে চেটে বা শব্দ করে তার প্রতিউত্তর দিচ্ছে তা এখন স্যাটেলাইট টিভির কল্যাণে প্রত্যহ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। মায়েদের নিয়ে এ অঞ্চলে কম গল্প-উপন্যাস-সিনেমা তৈরি হয়নি। এমনকি বিশ্বসাহিত্যে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ উপন্যাস অন্যতম পাঠকপ্রিয় ও পঠিত উপন্যাস হিসেবেও খ্যাত। ভারতের বিহারে মাত্র কিছুদিন আগে তৃতীয় শ্রেণীর ট্রেনযাত্রী জনৈক মহিলার হঠাত্ করে টয়লেটে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়ে আকস্মিকভাবে তা টয়লেটের ফোকর দিয়ে নিচে লাইনে পড়ে গেলে সন্তানের টানে ওই ‘মা’ কোনো কিছু চিন্তা না করেই চলন্ত ট্রেন থেকে লাইনে ঝাঁপ দিয়ে নিজে আহত হলেও, সদ্য জন্ম নেয়া সন্তানটি ট্রেনের ট্র্যাকে থাকে অক্ষত! মায়ের আন্তরিক অলৌকিক টানই সম্ভবত চলন্ত ট্রেন থেকে নিচে পড়ে যাওয়া সন্তানকে অক্ষত রেখেছিল! পরকীয়ার কারণে সন্তান ফেলে ঘর-ছাড়া কিংবা প্রেমিকের সহযোগিতায় নিজ সন্তান হত্যার দু-একটি ঘটনা ঘটলেও যা নিতান্তই আমাদের বর্তমান ক্ষয়িষ্ণু ভোগবাদী সমাজের সাময়িক সংক্রমণ। পৃথিবীতে অনেক উচ্চশিক্ষিত মহান মায়ের ইতিহাস রচিত হয়েছে। কিন্তু এমন গ্রামীণ অশিক্ষিত মাকে নিয়ে কেউ হয়তো লিখবে না সেই মায়ের কথাই বলছি। যে তার সন্তানকে মানুষ করার জন্য জীবনবাজি রেখে রাস্তায় নেমেছিলেন এবং সমাজের নানা ভ্রূকুটি সহ্য করে ৭ সন্তানকে সুশিক্ষিত করেছিলেন এক প্রতিকূল বৈরী সমাজে। আজকের মায়েদের অনুপ্রেরণাদায়ক এমন মায়ের বলিষ্ঠ উদাহরণ এটি।
এই মায়ের বসতি ছিল বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার নিতান্তই চরাঞ্চল কাজিরচর গ্রামে। যেখানে গ্যাস, বিদ্যুত্, টেলিফোন তখন তো নয়ই, এখনও আলোর মুখ দেখেনি। প্রায় ৯৮ শতাংশ সাক্ষরতাহীন এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ জেলে ও চরাঞ্চলের কৃষক সম্প্রদায়ের, অন্ধকার আর কুসংস্কার যাদের জীবনচিত্র। মেয়েরা তো নয়ই, ছেলেরাও তখন সেখানে স্কুলে যেত না। স্কুলও ছিল দুর্গম পথে এবং বহুদূরে। যে মায়ের কথা বলছি তার বিয়ে হয় বাল্যকালে, মানে ৬ বছর বয়সে। কালক্রমে সাত সন্তানের জননী হন তিনি। স্বামী ছিলেন অনেক ধানী জমির সহজ-সরল মালিক-কৃষক। কিন্তু গ্রামীণ নগ্ন ষড়যন্ত্রে স্বামীর প্রায় সব জমি হারাতে হয় মামলা-মোকদ্দমায়। ভিটে থেকে উত্খাতের জন্য স্বামীর শেষ সম্বল গরুগুলোকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা হয় একদিন, বাড়ি থেকে করা হয় যড়যন্ত্রমূলকভাবে উত্খাত। জমি-গরু হারিয়ে স্বামী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অনেকটা দেশান্তরী হন।
কিন্তু সাক্ষরতাহীন গ্রামীণ মা সাত সন্তানকে মানুষ করার দৃঢ় প্রত্যয়ে রাস্তায় নামেন। বড় মেয়েকে (যার বয়স এখন ৮৫ বছর) অনেক দূরের দুর্গম পথে স্কুলে পাঠান, যে কিনা ওই স্কুলের প্রথম ছাত্রী। দুই ছেলেকেও অন্যের বাড়ি লজিং রেখে পড়াতে থাকেন নিজের অসচ্ছলতার কারণে। সন্তানদের মানুষ, সংসার চালানো ও লেখাপড়া করানোর জন্য সদ্য চালু হওয়া সরকারি প্রকল্প পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে নিম্নপদে চাকরি নেন তিনি। কিন্তু অসচেতন সাক্ষরতাহীন কুসংস্কারে ভরা গ্রামের মানুষ মহিলার পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে চাকরি করে ছেলে ও মেয়েকে লেখাপড়া করানোকে ন্যক্কারজনক দৃষ্টিতে দেখতে থাকেন। নিজ আত্মীয়রাও এ বিভাগে চাকরি করার অপরাধে তাকে ধিক্কার ও অনেকটা একঘরে করেন। গ্রামীণ কয়েকজন সক্ষম গৃহবধূকে ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ’ কার্যক্রম গ্রহণে থানা সদরে নিয়ে যাওয়ার পথে হঠাত্ ঝড়ে নৌকাডুবিতে একজন মহিলা ও তার শিশু মারা গেলে পাপ কাজের জন্য গজবী মৃত্যুর জন্য কয়েক গ্রামের মানুষ এই মায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং তার নামে নানা অপপ্রচার, কুত্সা ও পেশাগত কাজে বাধার সৃষ্টি করে। কিন্তু ওই মা দমে না গিয়ে সরকারিভাবে এর মোকাবিলা করেন এবং নিজ উদ্যোগে স্থানীয় বাজারে সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এনে জনমত গঠনের জন্য সভা করেন।
এভাবে নানা বন্ধুর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ওই সংগ্রামী মা তার সব সন্তানকে মানুষ করেন, তিন মেয়েকে বিয়ে দেন এবং নাতি-পুতিদের নিয়ে যৌথ পরিবার ধরে রাখতে সক্ষম হন। চার সন্তানকে তিনি বিদেশে পাঠান। তার এলাকায় তার প্রথম সন্তান স্কুলে যাওয়া মেয়েকেও তিনি গ্র্যাজুয়েট করেন। বিদেশে থাকা সন্তানরা তার নামে টাকা পাঠালে তিনি ঢাকা শহরে ওই সময় রাস্তাঘাটহীন পশ্চিম কাফরুল তালতলা এলাকায় নিজে জমি কেনেন এবং নিজে অক্ষরজ্ঞানহীন গ্রামীণ অজপাড়াগাঁয়ের মহিলা হয়েও একটি ৬-তলা বাড়ি এককভাবে নির্মাণ করেন। মালপত্র কেনা ও বাড়ির হিসাব রাখার জন্য তিনি অন্য মানুষের সাহায্য নিতেন। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্বাক্ষর করতে না পারা ও নিজে হিসাব লিখে রাখতে না পারার দুঃখবোধে সাক্ষরতার ইচ্ছা তার মনে প্রবলভাবে জাগ্রত হয় এবং প্রায় ৮০ বছর বয়সে নাতিদের কাছে পড়ালেখা শুরু করেন। তিন-চার মাসের চেষ্টায় সে হিসাব রাখা ও দৈনিক পত্রিকা পড়া শেখেন। শেষ জীবনে তিনি একজন ‘সফল নারী’ হিসেবে ঢাকা শহরে পরিবারের সঙ্গে কাফরুল তালতলায় নিজ হাতে নির্মিত বাড়িতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বাস করতেন। নিজ খরচে তিনি হজব্রত পালনসহ কয়েকবার বিদেশ ভ্রমণ করেন। নিজ গ্রাম কাজিরচরে গেলে তিনি গ্রামীণ অসহায় মহিলাদের নিজের সংগ্রামী জীবনের গল্প শোনাতেন এবং উদ্বুদ্ধ করতেন। ১৯৯৮ সালে তিনি মারা করেন। এই মায়ের সাত সন্তানই এখন দেশ-বিদেশে সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রতিষ্ঠিত। চলুন আমরা এ মায়েদের পথকে অনুসরণ করি এবং নিজ সন্তানদের সুশিক্ষা দেয়ার সব বন্ধুর পথকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাই।
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পাশ্চাত্যের তথাকথিত নারীবাদ বনাম ইসলাম: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৩ রা মে, ২০২৫ বিকাল ৪:২৪

পাশ্চাত্যের তথাকথিত নারীবাদ বনাম ইসলাম: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ

ছবি কৃতজ্ঞতা এআই।

ভূমিকা

নারীর অধিকার নিয়ে আলোচনা ইতিহাসের এক দীর্ঘ অধ্যায়। পাশ্চাত্যে নারী আন্দোলন শুরু হয় ১৮শ শতকের শেষভাগে, যার ফলশ্রুতিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি স্মার্ট জাতির অন্তঃসারশূন্য আত্মজৈবনিক !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা মে, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৩৪


একটা সময় ছিল, যখন জাতির ভবিষ্যৎ বলতে বোঝানো হতো এমন এক শ্রেণিকে, যারা বই পড়ে, প্রশ্ন তোলে, বিতর্কে অংশ নেয়, আর চিন্তা করে। এখন জাতির ভবিষ্যৎ মানে—ইনফ্লুয়েন্সার। তারা সকাল ১০টায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতায় যাবার আগেই নারী বিদ্বেষ শুরু

লিখেছেন অপলক , ০৩ রা মে, ২০২৫ রাত ১০:১১

সংবাদ সম্মেলন থেকে বের করে দেওয়া হলো নারী সাংবাদিককে, যা বললেন মুফতি ফয়জুল করিম

বরিশালে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিমের এক নারী সাংবাদিক মনিকা চৌধুরীকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামী দলগুলো নারী বিদ্বেষী - এটা একটি মিথ্যা প্রোপাগান্ডা

লিখেছেন সত্যপথিক শাইয়্যান, ০৩ রা মে, ২০২৫ রাত ১১:২৯

আরবের দেশগুলোকে আমাদের দেশের নারী আন্দোলনের নেত্রীরা দেখতে পারেন না হিজাব ইস্যুর কারণে। অথচ, আরব দেশ কাতার বি,এন,পি'র চেয়ারপারসনকে চার্টারড প্ল্যানে করে দেশে পাঠাচ্ছে। আরো কিছু উদাহরণ দেই। আওয়ামী লীগ... ...বাকিটুকু পড়ুন

নারীনীতি ইস্যুতে তথাকথিত চুশীলদের নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৪ ঠা মে, ২০২৫ সকাল ৮:৫৩

নারীনীতি ইস্যুতে তথাকথিত চুশীলদের নিয়ে কিছু কথা



ইদানিং নারীনীতি নিয়ে দেশে নানা তর্ক-বিতর্ক চলছে। আলেম-ওলামা এবং ইসলামপন্থীরা যখন পাশ্চাত্যঘেঁষা নারীনীতির সুপারিশকে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন, তখনই মূলত এই আলোচনার বিস্তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×