আজ জানার বাসায় দাওয়াত। কী নিয়ে যাই চিন্তা করতে করতে বিফ ভুনা করে বাটি ভর্তি করে নিয়ে নিলাম। একটা ওয়াইনের বোতল নিয়ে গেলে হয়তো ও বেশী খুশী হতো। তবে আমার হাতের বিফ ভুনা ওর কাছে নাকি স্বর্গীয় মনে হয়। তাই বিফ ভুনাটা নিয়ে যাওয়াটাই উত্তম।সেই অনেক আগের কথা, জানা প্রায়ই জোড় করে আমার বাসায় আসতো এবং দীর্ঘ সময় থেকে, খেয়ে দেয়ে বাড়ি যেত । প্রায় শুক্রবার রাতে কোথাও মেয়েকে রাখার ব্যবস্থা করতে না পারলে আমার বাসায় ওর মেয়েটিকে রেখে পানশালা অথবা রঙ্গমঞ্চে রঙিন হয়ে আসতো । শুক্রবারের একটি রাত ওর একা জীবনটিকে মদের পেয়ালায় ভাসিয়ে দিতো । খুব নেশাগ্রস্ত থাকতো বলে ওর মেয়ে জেসিকাকে আমি আমার কাছেই রেখে দিতাম সেই রাতগুলোতে । পরের দিন দুপুরে এসে ও জেসিকাকে নিয়ে যেত। প্রথম দিকে ভীষণ বিরক্ত হতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে ওর দুঃখী জীবনটির জন্য ওর প্রতি মায়া জন্মে গিয়েছিলো । ওর মেয়ে জেসিকাকে আমার নিজের মেয়ে বলেই মনে হতো । তাছাড়া আমার মেয়ে ঈশার এক মাত্র প্রাণের বন্ধু ছিলো জেসিকা। ওরা সেই নার্সারি থেকে ইয়ার সিক্স পর্যন্ত একই ক্লাসে একই সেকশনে পড়েছে। তারপর সেকেন্ডারিতে উঠে আলাদা আলাদা স্কুলে ভর্তি হয়ে ওদের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যায়। স্বাভাবিক ভাবেই জানা আর আমার মধ্যেও দূরত্ব বেড়ে যায়। আজ অনেক দিন পরে ফোন করে খুব করে যেতে বলল। আমার অন্য কোন প্ল্যান ছিল না বলে রাজিও হয়ে গেলাম।
জানা রাশিয়ান মেয়ে। ইংল্যন্ডে এসেছে আঠারো বছর বয়সে। বিশ বছরেরও বেশীকাল ধরে ইংল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। ওর মেয়ে জেসিকা দারুন মেধাবী। জানা এতোটুকু যত্ন নেয় না ওর মেয়ের পড়াশুনার ব্যপারে অথচ মেয়েটি ক্লাসে সবকিছুতে সর্বোচ্চ নাম্বার পায়। জানা চায় ওর মেয়ে স্পোর্টি হোক, খেলাধূলা , নাচ এগুলো করে যেন সবসময় ফিট থাকে , ওড় মত মুটিয়ে যেন না যায়। এজন্য পড়াশুনার চেয়েও অন্যান্য এক্টিভিটিতে বেশী ব্যস্ত রাখে মেয়েকে। ও চায় জেসিকাকে বলিউডের নায়িকা বানাতে। এতো এতো ফেমাস বানাতে চায় যাতে করে জেসিকার বাবা অনুশোচনা করতে পারে জেসিকাকে বাবার পরিচয় দেয়নি বলে। অথচ জেসিকার মন লেগে থাকে পড়াশুনায় ।কিন্তু জানার ধারণা পড়াশুনা করে সেই ছাপোষা আস্তাকুরের বস্তা পচা জীবন ছাড়া আর কিছুই হয় না। জানা স্বপ্ন দেখে চাকচিক্যে ভরপুর ঝিলমিলে জীবন জেসিকাকে নিয়ে । জেসিকার এই পড়াশুনায় মন হবার কারণও সম্ভবত আমাদের বাসায় বেশী সময় কাটায় বলে। আমি যেহেতু ঈশার পড়াশুনার ব্যপারে বেশী সিরিয়াস তাই জেসিকাও ঈশাকে অনুসরণ করতো।নিজের গভীর আগ্রহ থেকেই পড়াশুনা করতো বলেই ঈশার থেকেও বেশী ভালো রেজাল্ট করতো বরাবরই। তাছাড়া, জেসিকা এশিয়ান মানুষের প্রতি আলাদা একটি আকর্ষণ অনুভব করতো। এশিয়ানদের সাথেই বেশী মিশতে চাইতো।
জেসিকার বাবা ছিল ইন্ডিয়ান। জেসিকার মা জানা উনিশ বিশ বছর বয়সে ইন্ডিয়া ভ্রমণে যায়, সেখান থেকেই জেসিকার বাবার সাথে প্রেম, তারপর বিয়ে করে জানা জেসিকার বাবাকে নিয়ে আসে ইংলেন্ডে । জেসিকা হবার পরে ওর বাবার যখন ব্রিটিশ সিটিজেনশিপ হয়ে যায়, তখন থেকেই জেসিকাদের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় ওর বাবা।কারণ লোকটার টার্গেটই ছিল ব্রিটিশ সিটিজেনশিপ অর্জন করা। জানাকে সে কখনোই ভালোবাসেনি। জানাকে বলে দিয়েছে ও যেন কখনোই জেসিকার বাবা হবার দাবী না নিয়ে আসে কখনোই। শুধু মাত্র স্পার্ম ডোনার হিসেবেই যেন ভাবে ওকে ।জানার মন ভেঙে যায় কিন্তু এই কথাগুলো জেসিকাকে কোন দিন বলেনি ওর মনও যাতে ভেঙে না যায় মায়ের মত।
এদিকে জেসিকা খুব করে এশিয়ান হতে চায়, ঠিক ওর বাবার মত। ও জানে এশিয়ানরা পড়াশুনা বেশী পছন্দ করে তাই সে পড়াশুনাতেই মনযোগ দেয় বেশী। হয়তো ভাবে অনেক বেশী বিদ্যান হলে বাবাকে ফেরত পাবে। জেসিকা হয়েছেও এশিয়ানদের মত। ওর চুলের রঙ কালো, মায়ের মত ব্লন্ড হয়নি। মায়ের নীল চোখ পায়নি, পেয়েছে নীলে আর কালোতে মিশিয়ে কী যেন এক গভীর রঙ। দারুন মিষ্টি হয়েছে মেয়েটি। চাইলে খুব সহজেই ইন্ডিয়ান নায়িকা হতে পারে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় জানা যেতে বলেছে বলে আমি একটু অবাক হলাম, কারণ শুক্রবার সন্ধ্যা হচ্ছে ওর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, জানা সারা সপ্তাহ ধরে শুক্রবারের এই রাতের অপেক্ষায় থাকে। শুক্রবার ওর আমোদ প্রমোদের রাত। ভাবছি এই থৈ থৈ আনন্দের রাতে আমার মত বোরিং মানুষের সাথে ওর ভালো লাগবে তো!
ভাবতে ভাবতে জানার বাড়ি চলে এলাম। কলিং বেল চাপতেই একেবারে হোলিউড স্টার ফিবি কেটের মত একটি অল্প বয়সি মেয়ে দরজাটি খুলে দিয়ে সালাম দিলো। আরে, এতো সেই ছোট্ট মেয়ে জেসিকা! এতো সুন্দর হয়েছে, একটু একটু বলিউড স্টার ক্যাটরিনা কাইফের মতও লাগছে।বহু দিন মেয়েটিকে দেখি না। ও মুসলিম না হয়েও আমাকে সব সময়ই সালাম দেয়। সালাম না দিলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না এটা জেসিকা। মেয়েটি খুব মেধাবী। সম্পূর্ণ স্কলারশিপ নিয়ে খুব ভালো একটি প্রাইভেট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলো। সেখান থেকেও অনেক ভালো রেজাল্ট করে ক্যাম্রিজ ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়েছে। আর আমাদের ঈশা ফিল্ম মেইকিং এর উপরে ডিগ্রী নিচ্ছে। সে ফিল্ম বানাবে। এই দুঃখে ঈশার বাবা ঈশার সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছে। আমারও মন খারাপ ছিল বহু দিন মেয়ের এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ফলে। ভাবছিলাম, বাবা মা কি চায় আর সন্তান কি হয়। তবে এখন আর কোন খেদ নেই। মেয়ে আমার পছন্দের সাবজেক্টে বেশ ভালো ফল করছে। হয়তো গভীর প্যাশন থাকলে ক্যরিয়ারে বহুদূর এগিয়েও যাবে। আর এগিয়ে যাক বা না যাক ও যদি ওর অবস্থানে খুশী থেকে আনন্দের একটি জীবন যাপন করে, আমার তাতে কোন আপত্তি নেই।
জানার বাড়ির দেয়াল ভর্তি ওদের পার্সোনাল ছবি।ঘরে ডুকেই ওগুলোর দিকে চোখ চলে যায়। জানার বিভিন্ন দেশ বিদেশ ভ্রমণের ছবি টাঙ্গানো রয়েছে দেয়াল জুড়ে । জানা দেখতে একসময় ভীষণ সুন্দর ছিল। জেসিকার বাবা ওকে ছেড়ে যাওয়ার পর পরই ও বেশ মুটিয়ে যায়। ও সব সময় বলে জীবনে ওর একটি প্লেজারই বাকী রয়েছে সেটা হচ্ছে খাওয়া দাওয়া করা আর মদ্যপান করা ।ও জানে এটা ওর শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তারপরও এটা ওর গিল্টি প্লেজার হিসেবেই রয়ে গেছে।
জেসিকা অনেক এশিয়ান খাবার পছন্দ করে। রান্না করাও শিখে গেছে। আজ মেলা কিছু রান্না করেছে আমার জন্য। আমি মুগ্ধ হলাম জেসিকার আন্তরিকতায়। মনে হচ্ছিলো আমার আরেকটি মেয়ের কাছে বেড়াতে এসেছি।
জানা আর আমি খাওয়া শেষে বাগানে বসে গল্প করছিলাম।
আমি জানাকে জিগ্যেস করলাম,
-আজ তুমি বাইরে কোথাও জাবে না? তুমি তো প্রতি শুক্রবারেই বের হও।
জানা বলল,
-অনেক দিন থেকেই আমি তোমার মত জীবন যাপন করতে শুরু করেছি।মদ্যপান প্রায় ছেড়েই দিয়েছি।আমি অনেক ভেবেছি। তোমার সাথে আমার দেখা না হলে আমার মেয়েটি আমার থেকেও খারাপ জীবন যাপন করতো। আমার মত আনকন্ট্রোল জীবন হতো ওর। আজকে ও ভালো একটি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। পড়তে পড়তেই একটি বড় কোম্পানি থেকে জব অফার পেয়ে গেছে। একটি ভালো ছেলের সাথে ওর সম্পর্কও হয়েছে। মনে হচ্ছে ওর জীবনটা সুন্দর ভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। যদিও দুঃখী হবার জন্য অনেকটা সময় এখনো বাকী আছে । জীবনের অর্ধেকটা সময়ও পার করেনি এখনো। আমার মনে হয় তুমি ওর চলার পথে একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছো। সেই আলো ধরে ও খুব সহজে জীবনের কঠিন সময় গুলো সহজে পার করতে পারছে।
আমার খুব আনন্দ হচ্ছিলো জেসিকার অগ্রগতিতে। জেসিকা খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে , জীবনে কীভাবে সুখী হতে হয় সে কৌশল হয়তো ও জানে বা শিখে গিয়েছে মায়ের দুঃসহ জীবন দেখে দেখে। আমাকে এই ক্রেডিট জানা দিচ্ছে, কারণ ওর সুন্দর একটি মন রয়েছে বলে।
জানা মদ্যপান ছেড়ে দিলেও জাংফুডে ওর এখনো আসক্তি রয়েছে। অতি মাত্রায় খাওয়া দাওয়া করা এখন ওর একমাত্র গিল্টি প্লেজার। আমার আনা বিফ ভুনার প্রশংসা করে হাসতে হাসতে বলছে,
-আমার এখন একটিই গিল্টি প্লেজার বিভ ভুনা খাওয়া, যেটা আমার ব্লাড প্রেসার বাড়িয়ে দেয়। আচ্ছা তোমার গিল্টি প্লেজার কি?
আমি চিন্তা করে খুঁজে পেলাম না কিছুই ।বেশী বেশী খাওয়াটাই অনেকের গিল্টি প্লেজার। কিন্তু আমি তো খেতেও বেশী ভালোবাসি না। আর পান, বিঁড়ি মদের নেশাও নেই। আসলে আমাদের সমাজে মেয়েদের সব ধরনের আমোদে গা ভাসানোও নিষেধ। আমাদের কোন প্রকার অশুদ্ধ আমোদ নেই। আমি রক্ষণশীল পরিবারের একজন মানুষ। আমি পরিশুদ্ধ একটি এক রঙা জীবন যাপন করি। সেখানে কোন প্রকার দাগ নেই। আনন্দ আছে কি নেই তার খবর জানি না। ঘর সংসার আর সন্তান ঠিক ঠাক লালন পালন করতে করতে নিজের জীবনের কোন চাহিদা আছে কি নেই তাও জানি না।
আমি হাসতে হাসতে উত্তর করলাম,
-নো গিল্টি প্লেজার।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০২০ রাত ৮:৪০