দশ বছর বিয়েবার্ষিকী উপলক্ষে আমি ছুটি নিয়েছি আজ । মিঠু চেয়েছিল মানুষজন নিয়ে একটু হৈহুল্লোড় করতে। আমাদের পরিচিত কয়েকটি পরিবারকে নিমন্ত্রণ করতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি চাই না। অন্তত পক্ষে আমাদের বিয়ের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে তো নয়ই। সবাই আসলেই যত যন্ত্রণা!
রিমা আপু বেশ উপদেশ দিয়ে আদুরে আদুরে কণ্ঠে বলবে,
--- এবার তো একটু সংসারের দিকে মনযোগী হও, ক্যরিয়ার ক্যরিয়ার করতে করতে আর কত!
শ্রাবন্তি ভাবী খিল খিল করে তার গুল্টু বাবুটাকে মিঠুর কোলে দিয়ে আমাদের দুজনের সাথে গুল্টু বাবুর ছবি নিতে নিতে বলবে,
--- সবাই দেখ মিঠু-মন্টিকে কি দারুন মানিয়েছে!
সবাই তখন হৈ হৈ করে বলে উঠবে,
---- মিঠু-মন্টির গুল্টু চাই, গুল্টু ছাড়া রেহাই নাই।
আর এদিকে আমি বুকের ভেতরের ছাই পোড়া মরুভূমির হাহাকারে তলিয়ে যাবো, যেটা কেউ দেখবে না।
আমার নাম মিশু। কিন্তু বন্ধুরা এসো গান শিখির মিঠু মন্টির সাথে মিলিয়ে আমাকে মন্টি বানিয়ে ফেলেছে। লন্ডনের পরিচিত সবাই আমাকে মন্টি নামেই ডাকে।বন্ধুরা আদর করে মিঠু-মন্টি পায়রা জুটি বলে।
সিরাজ ভাই তো সব সময়ই বলে,
--- এই জুটির প্রেমের দিন আর শেষ হয় না।
এর মানে হচ্ছে, তার ধারণা এখনো আমরা বাচ্চা নেই না ইচ্ছা করেই । যেদিকেই যাই, সবাই শুধু উন্মুখ হয়ে জানতে চায়,
--- বাচ্চা কয়ট?
--- বাচ্চা নেবে কবে?
এসব প্রশ্ন শুনতে শুনতে আমার কান পচে গিয়েছে।
বিয়ের ছয় বছর পর থেকেই অক্টোবরের ১০ তারিখ আসলেই আমার মনটি ছোট হয়ে আসে। বিয়েবার্ষিকী উদযাপনের মন মানসিকতা আর থাকে না এর ওর বাচ্চা নিচ্ছি না কেন? বাচ্চা হচ্ছে না কেন? এই প্রশ্ন গুলো শুনতে শুনতে।
ঘর জুড়ে সেই কবে থেকে আমারা দুজনই আছি । এই দুজন থেকে তৃতীয় একটি প্রাণ আসেনি এপর্যন্ত । চার বেড রুমের বাড়ির কোণায় কোণায় শূন্যতা। ঘর একদিন পরিষ্কার করে রাখলে সপ্তাহ জুড়ে একই রকম থাকে। কেউ নেই ঘর ময়লা করবার । বেডরুম গুলো খালি পরে থাকে। রুমগুলোতে বাতাস পূর্ণ হয়ে থাকে। সে বাতাস ভেদ করে মানুষের চলাচল হয় না সচরাচর । মাস্টার বেডরুমে আমরা দুজন একাকীত্বের ব্লাংকেটে জড়িয়ে থাকি বেশিভাগ সময়। আমাদের একাকীত্বের দুটি দ্বিপে ব্রিজ তৈরি করে একটি সন্তানও দিচ্ছে না সৃষ্টিকর্তা। কেন এই নিষ্ঠুরতা আমার সাথে!
মিঠুই শপিং সেন্টার ঘুরে ঘুরে আমার জন্য ইভিনিং ড্রেস পছন্দ করে নিয়ে এসেছে দশ বছর বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে ।সাথে নিজের জন্যও রং মিলিয়ে শার্ট কিনে এনেছে। আমার এই রং মিলিয়ে কাপড় পরা একদমই পছন্দ নয়।নিজের পছন্দের রঙের সাথে পার্টনারের জন্য একই রঙের পোশাক কেনাটা আমার কাছে স্বৈরাচারী আচরন মনে হয়। বেশ রাগ হচ্ছিলো কাপড় দেখে। কিন্তু কিছুই বলিনি। বললেই ওর আনন্দটা নষ্ট হয়ে যাবে। এমনিতেই একটা বাচ্চা দিতে পারি না।মিঠু বেশ ফিট ফাট হয়ে ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে আনন্দ শেয়ার করতে পছন্দ করে। আমি খুব প্রাইভেট মানুষ, আমার পছন্দ না হলেও ওর পছন্দে বাগড়া দেই না কখনোই। করুক না যেটা ভালো লাগে।
লন্ডনের প্রাণকেন্দ্রে থেমস নদীর উপরে ক্রুজ ডিনারের আয়োজন করা হয়েছে । মিঠু সারপ্রাইজ দিতে পছন্দ করে। বিয়ের দশ বছরের জীবনে কোন কিছুই আর সেভাবে এক্সাইটেট করে তোলে না আমাকে ।আমার জানাই ছিলো, কোন না কোন জায়গায় রোমান্টিক ডিনারের আয়োজন হবেই। মিঠু আনন্দ করতে খুব পছন্দ করে। ওকে দেখানোর জন্য হলেও আমাকে মুগ্ধতার ভান করতে হয় । নাহলে বেচারা মন খারাপ করে বসে থাকে। জীবনে কত কত সুন্দর জায়গায় যে ঘুরেছি আমরা দুজনে। আনন্দের পরিমাণটা একটু বেশীই হয়ে গিয়েছে, তাই কোন প্রকার আনন্দকে আর আনন্দ মনে হয় না আমার কাছে। এটা যদিও আমার কথা নয়। মিঠুর বড় ভাবীর কথা। সে সব সময়ই বলে, বেশী বেশী আনন্দ ফুর্তি করে করে সময় নষ্ট করেছি বলেই আমার সন্তান ধারন করার ক্ষমতা নাকি নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
চার পাঁচ বছর আগের কথা, বড় ভাবীর দ্বিতীয় সন্তান হবার ছয় মাসের মাথায় তৃতীয়বার কন্সিভ করেছিলো , কিন্তু সেটাকে ইচ্ছাকৃত এবরশন করে নেয় ভাবী, কারণ সেই মুহূর্তে ওরা তৃতীয় সন্তান চাচ্ছিল না। আমার বিয়ের বয়স তখন ছয় বছর। তখনই আমরা বুঝতে পারছিলাম আমাদের সন্তান হওয়া নিয়ে বেশ জটিলতা রয়েছে। আমরা ঐ সময়টাতে সবাই মিলে মিঠুদের গ্রামের বাড়িতে ছিলাম ওদের সর্ব কনিষ্ঠ চাচাতো বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে। সেখানে তখন ওদের কাজিনরা, দুলাভাই, ভাবীরা ছিল ।একদিন গল্পে গল্পে ভাবী বেশ রহস্য আর গর্বের সাথে বলছিল,
--- আমার তো চাবি ছোঁয়ালেই বাচ্চা বের হয়, হি হি হি ।
এমন ভাব যেন এতো এতো বাচ্চা বের হয়, সেখান থেকে দু একটা এবরশন করে মেরে ফেলাটা কোন ব্যপারই না। আর আমার এতো চেষ্টার পরেও কিছু হয় না। এতো ডাক্তার, এতো কিছু। কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।
মিঠুর দেয়া ড্রেসটা পরে চলে এলাম ক্রুজ ডিনারে। আমাদের টেবিলটা থেকে এতো সুন্দর লাগছে রাতের লন্ডন শহর, আর থেমস নদীটাকে। মিঠু নানা ভঙ্গিতে ছবি তুলছে আমাদের দুজনের।এতো সুন্দর রোমান্টিক জ্যাজ গান ভেসে আসছিলো! কিছুক্ষণ ঝিম মেরে শুনছিলাম। ওদিকে অন্য এক টেবিলের একটি জুটির আনন্দ খিল খিল করে ক্রুজের এ মাথা থেকে ও মাথা গড়াগড়ি করছে। মাঝে মাঝে আছড়ে পড়ছে থেমস নদীর বুকে। জীবনটাকে সত্যিই উপভোগ্য লাগছিলো। এর মধ্যে হঠাৎ আমার শ্বশুরের ফোন বেজে উঠলো। , এই সময় ফোন দেখে চমকে উঠলো মিঠু , তাই ফোনটা ধরলো। ফোনে কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রাখলো।তারপর আমাকে মিঠূ বলছিল যে বড় ভাবী আবার কন্সিভ করেছে, তাই আমারা যদি বাচ্চাটা চাই তাহলে বড় ভাবী বাচ্চাটা রাখবে, আর না হলে এবরশন করে ফেলবে।
আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিলো, সাথে সাথেই মিঠুকে জানিয়ে দিলাম,
--- আমি ওদের দয়া চাই না।
আমাকে কষ্ট দেয়ার জন্যই ভাবী চল্লিশ বৎসর বয়সে তৃতীয় বারের মত মা হতে চলেছে এবং সবাইকে দেখিয়ে দিতে চাইছে সে কতখানি উত্তম ব্রিডার।ভাবীর আবার বাচ্চা হবে শুনে কেমন যেন একটি ঈর্ষা হচ্ছিলো, আর মনে হচ্ছিলো আমার কেন এতো জটিলতা বাচ্চা হওয়া নিয়ে! আমি কি কোন দিন মা হতে পারবো না! প্রতি বৎসর মা দিবস আসলে আমার কোথাও লুকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। আমাকে কেউ কোন দিন মা দিবসের কার্ড দেয়নি। আমি জানি না কিরকম অনুভূতি হয় মা দিবসে সন্তানের কাছ থেকে কোন উপহার পেলে।
পরের দিন ভাবী ফোন দিয়ে আমাকে কয়েকটি কথা শুনিয়ে দিল। বলল,
--- থাকো তুমি পাতা বাহার হয়ে। এতো সৌন্দর্য দিয়ে কি করবে, জীবনে যদি মা ডাকই শুনতে না পাও? তোমার জন্য আমি আবার কন্সিভ করলাম, আমার বাচ্চাটা নিঃস্বার্থ ভাবে দিয়ে দিতে চাইলাম। অথচ তুমি নেবে না। পাতা বাহার সুন্দর হয়, কিন্তু তার কোন ফল থাকে না।
ভাবীর কথা গুলো আমার কানে বার বার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো, আমি সত্যিই তো পাতা বাহার। আমার কোন ফল হয় না। আমি ছোট বেলা থেকেই কেন জানি পাতা বাহার পছন্দ করতাম। বাংলাদেশে থাকতেও ঘরে সবসময় পাতা বাহার রাখতাম, এখানেও আমার ঘর ভর্তি পাতা বাহার। বুক ফেটে কান্না আসছে। মিঠু আমাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছিলো। আমি তখন রাগে ঘর থেকে সবগুলো পাতা বাহার বাইরে নিয়ে ফেলে দিলাম। মিঠু বাঁধা দিলো, কিন্তু আমি চাই না আর পাতা বাহার রাখতে ঘরে।
আমার মন শান্ত হবার পরে আমরা দুজনে " লায়ন" নামে একটি ইংলিশ সিনেমা দেখলাম। এই সিনেমাটি ম্যজিকের মত আমার মন, চিন্তা চেতনা এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করে দিলো। সিনেমাটি ভীষণ কষ্টের, কিন্তু সেখানে শক্তিশালী একটি প্রেরণা বার্তা রয়েছে। যেটা আমার জীবনকে যাদুর মত পরিবর্তন করে দিলো।
অস্ট্রেলিয়ান একটি দম্পতি ইচ্ছা করেই নিজেদের সন্তান নেয়নি। কারণ পৃথিবীতে অনেক অনাথ বাচ্চা রয়েছে যাদের একটি আশ্রয় নেই, সামান্য খাদ্য নেই, বস্র নেই। সেই দম্পতি পৃথিবীতে আর মানুষ বাড়াতে চায় না । নিজেদের বাচ্চা হওয়া নিয়ে কোন সমস্যা নেই, তারপরও তারা চায় না মানুষ বাড়াতে । অনাথ বাচ্চাদের কাউকে নিজের সন্তানের মত প্রতিপালন করতে চায়।তাই তৃতীয় বিশ্ব থেকে অনাথ দুটি বাচ্চা এনে তাদেরকে নিজের সন্তানের মত পালে। এই সিনেমাটি একটি সত্য ঘটনাকে অবলম্বন করে তৈরি। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এরকম উদার মানুষও আছে পৃথিবীতে! আর আমারা কতটা স্বার্থপর। আমারা দুজনেই ঠিক করলাম, আমারা আর বাচ্চার জন্য চেষ্টা করবো না। আমাদের যেহেতু ক্ষমতা আছে তাই কোন অনাথ বাচ্চাকে নিজের সন্তান হিসেবে রাখবো। কি দরকার পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে। সৃষ্টিকর্তা পাতা বাহার পৃথিবীতে এমনি এমনি পাঠায়নি, নিশ্চয়ই যথেষ্ট কারণ আছে।পৃথিবীর অনাথ বাচ্চাদের মা করার জন্যই আমাকে পাতা বাহার বানিয়েছে। না হয় রইলামই পাতা বাহার হয়ে। অনাথ কোন বাচ্চার মা হয়েই না হয় পৃথিবীর জীবনটা পার করে দেবো। লোকে কে কি বলল না বলল তা দিয়ে আমার কিছুই যায় আসে না আর।
ছবি সূত্রঃ অন্তর্জাল থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০২০ বিকাল ৫:৪৪