বাংলাদেশের কিছু মানুষের মধ্যে বেশি কথা বলার রোগ আছে। এই রোগ সবচেয়ে বেশি রাজনীতিবিদদের মধ্যে। মন্ত্রিত্ব পেলে তাঁদের অনেকের কথা অসংলগ্নও হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সরকারের আমলে কিছু কিছু মন্ত্রী পিলে চমকানো বা হাস্যকর বক্তব্য দেওয়ার জন্যও ‘প্রসিদ্ধি’ অর্জন করেছেন। কারও কারও বক্তব্যে হাস্যরস আর বিরক্তি ছাপিয়ে ওঠে দুর্ভাবনা। মন্ত্রী হলে কি দেশের মানুষকে বোকা ভাবার বা বোকা বানানোর রোগ জন্মে অনেকের মধ্যে?
আমার ধারণা, তা-ই হয়। না হলে আমাদের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এই ইংগিত দেন কী করে যে বিরোধী দলের মানববন্ধন কর্মসূচিও ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য? ৭ জুলাই এক ঘণ্টার এই নিরীহ কর্মসূচিকে নস্যাৎ করার জন্য পুলিশ পিটিয়েছে কিংবা ছত্রভঙ্গ করেছে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের। অতীতে মানববন্ধনের ওপর এ রকম চড়াও হওয়ার নজির সম্ভবত দেশে নেই। ‘দিনবদল’ এখানেও হচ্ছে বুঝলাম। কিন্তু মানববন্ধন কর্মসূচির সঙ্গে মন্ত্রীর দাবিমতো যুদ্ধাপরাধী বিচার নস্যাৎ করার সম্পর্ক কোথায়, এটা তো বোঝা যাচ্ছে না!
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করে সরকারের লাভ হয়েছে। অন্য কিছু ক্ষেত্রে ব্যর্থতা সত্ত্বেও এই একটি কারণে দেশের অনেক মানুষের সমর্থন এখনো পাচ্ছে তারা। কিন্তু এই মহান দায়িত্ব পালনের অজুহাতে অন্য সব ক্ষেত্রে জবাবদিহির বাইরে থাকার যে চেষ্টা সরকারের মন্ত্রীরা বিভিন্ন বক্তৃতা-বিবৃতিতে চালাচ্ছেন, তা হাস্যকর। একই সঙ্গে অগ্রহণযোগ্য।
২.
বিএনপির সামপ্রতিক হরতালের বিরোধিতা করতে গিয়েও কোনো কোনো মন্ত্রী হরতালকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা হিসেবে অভিহিত করেছেন। বিএনপি যেসব দাবিতে হরতাল ডেকেছিল, তার মধ্যে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রসঙ্গের কোনো উল্লেখই ছিল না। হরতাল আহ্বান করা হয়েছিল পানি-বিদ্যুৎ সমস্যা, বিরোধী দলের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন, বিচার বিভাগ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ নানা ইস্যুতে। অতীতে প্রায় অবিকল এসব ইস্যুতে আওয়ামী লীগ বহুবার হরতাল পালন করেছে। হরতালের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কোনো সম্পর্ক আগে না থাকলে এখন থাকবে কোন যুক্তিতে?
হরতাল প্রতিবাদের ভাষা বা কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। বিশেষ করে হরতালের আগের রাত থেকে শুরু করে হরতালের দিন জনগণকে এটি পালনে বাধ্য করার জন্য যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়, তা গণতন্ত্রের ভাষা নয়। হরতালের সমালোচনা হওয়া উচিত মূলত এ কারণে। এ ছাড়া হরতালের আরও সমালোচনার জায়গা রয়েছে। আমরা বিভিন্ন সময় বলেছি, সরকারের যেসব ব্যর্থতার প্রতিবাদে বিএনপি হরতাল ডেকেছিল, সরকারের থাকার সময় তারাও একইভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। বিদ্যুতের ইস্যুতে সরকারের সমালোচনার আগে বিএনপিকে তাই এই খাতে তার নিজের অতীত ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা চেয়ে ভবিষ্যতে তারা কী কী কর্মসূচি নিয়ে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান করবে, তার বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত। সন্ত্রাস, দলীয়করণ, দুর্নীতি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এসব বিষয়ে সংসদে বলার পর্যাপ্ত চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেই কেবল শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল কর্মসূচি দেওয়া উচিত।
সরকারের মন্ত্রীরা এ ধরনের যৌক্তিক কথা বলে হরতালের সমালোচনা করলে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু সরকার অব্যাহতভাবে ‘ক্রসফায়ার’ বা বিরোধী দলের নেতাদের ‘গুম’ করে ফেললে, সীমাহীন দলীয়করণ চালালে বা সংসদে কথা বলতে না দিলেও হরতাল করা যাবে না, এটি ঠিক নয়। ঠিক নয় এসবের সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুকে অযৌক্তিকভাবে সম্পর্কিত করা। হরতালের তুলনায় মানববন্ধন অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য কর্মসূচি। এই কর্মসূচিতে বাধা দিলে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের আর কি পথ খোলা থাকবে?
৩.
বিএনপির মানববন্ধন কর্মসূচি ছিল হরতালের দিন গ্রেপ্তার করা তাদের তিন নেতার মুক্তির দাবিতে। আমাদের প্রশ্ন, মীর্জা আব্বাস, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা শমশের মবিন চৌধুরী এবং স্বাধীনতাযুদ্ধকালে শিশুবয়সী শহীদ উদ্দীন এ্যানী কি যুদ্ধাপরাধী? তাঁদের মুক্তির দাবির সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে নস্যাৎ করার সম্পর্ক কোথায়? এই দাবিতে কর্মসূচি দিলে সরকারকে এমনভাবে চড়াও হতে হবে কেন?
মানববন্ধন কর্মসূচি দিয়েছিল জামায়াতও। জামায়াতের মানববন্ধনের দাবি ছিল তাদের দলের তিন নেতার (নিজামী, মুজাহিদ ও সাঈদী) মুক্তির দাবিতে। তাঁদের সরকার যুদ্ধাপরাধের জন্য গ্রেপ্তার করেনি। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ১৯৭৩ সালের আইন অনুসারে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হলে এবং তখন জামায়াত এর প্রতিবাদে কোনো কর্মসূচি দিলে তাকে প্রতিহত করার চেষ্টা অবশ্যই সরকার করতে পারে। তার আগ পর্যন্ত তিন নেতার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার রোধ করার কর্মসূচি হিসেবে আখ্যায়িত করার কোনো সুযোগ নেই। ১৯৯৫-৯৬ সালে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। অপশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অধিকার তখন জামায়াতের থাকলে এখনো তা আছে। তবে এই আন্দোলনকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাৎ করার দিকে ধাবিত করার অধিকার জামায়াত, বিএনপি বা অন্য কারও নেই। দেশের একটি প্রচলিত আইনে এই বিচার করা হচ্ছে। এই বিচারের বিরোধিতা শুধু নৈতিকভাবে নয়, আইনগতভাবেও তাই অবৈধ। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছে বলে এই সরকারের দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বা দমননীতির বিরুদ্ধে কোনো কর্মসূচি দেওয়া যাবে না, এটা বলাও অনুচিত ও অযৌক্তিক।
আমরা মনে করি, আগের বিএনপির সরকারের তুলনায় দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় সাফল্য দেখাতে পারলেই বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরিবেশ আরও সুশক্ত হবে। এটি করা গেলে সরকরের জনসমর্থন বহু গুণে বাড়বে। ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধপক্ষ একে নস্যাৎ করার কোনো কর্মসূচি দিতে ভয় পাবে, দিলেও আদৌ সফল হবে না। আওয়ামী লীগের সরকারকে বুঝতে হবে দলীয়করণ, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি বা নতজানু পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে জনসমর্থন হারালে, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে দুর্নাম কুড়ালে সরকার পতনের যে পরিবেশ সৃষ্টি হবে, তাতেই বরং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সম্ভাবনা বাধাগ্রস্ত হবে।
৪.
আওয়ামী লীগের সরকার দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে তার ব্যর্থতা ঢাকতে যুদ্ধাপরাধের বিচার বা জামায়াত ইস্যুকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে আরও বহুভাবে। আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের অসন্তোষ ও অভিযোগের একটি বড় কারণ ছাত্রলীগের অব্যাহত নৈরাজ্যকর এবং কখনো কখনো পাশবিক সন্ত্রাস। দেশে প্রধানমন্ত্রী নিজেই এতে যে বীতশ্রদ্ধ তার বিভিন্ন প্রমাণ পাওয়া গেছে। তার পরও এ সমস্যার কোনো সমাধান সরকার করতে পারেনি কেন?
সরকারের মন্ত্রীদের একটি তৈরি উত্তর আছে এই প্রশ্নের। তাঁদের বক্তব্য, ছাত্রলীগের ভেতর শিবির ঢুকে গেছে, তারাই অনেক ক্ষেত্রে এসব সন্ত্রাস করছে। আমরা বুঝতে অক্ষম আওয়ামী লীগের অভিভাবকত্বে থাকা এই সংগঠনে শিবির ঢোকে কীভাবে, কারা এ জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কেন তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না?
প্রশ্ন আরও আছে। ঢাকা বা অন্য কোথাও ছাত্রলীগের হাতে খুন-জখম হলে কেন গ্রেপ্তার করা হয় শুধু গুটিকয়েক মাঠপর্যায়ের কর্মীকে? দেশের সব পত্রপত্রিকায় জাহাঙ্গীরনগরের পাশবিক সন্ত্রাসের ঘটনায় সেখানকার ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে দায়ী করা হলেও তাঁদের দুজনকে কেন গ্রেপ্তার করা হলো না? শমশের মবিন চৌধুরী গাড়ি পুড়িয়েছেন, এহসানুল হক মিলন হাতঘড়ি ছিনতাই করেছেন এমন অদ্ভুত অভিযোগে তাঁদের রিমান্ডে নেওয়া গেলে হত্যা, সন্ত্রাস আর চাঁদাবাজির পর ছাত্রলীগের আসল হোতাদের কেন রিমান্ডে নেওয়া হয় না?
আমার খবর পাই, গোটা দেশের পুলিশ প্রশাসন ছাত্রলীগের সন্ত্রাস দমনে অনীহ থাকে অন্য একটি কারণে। কোনো পুলিশ কর্মকর্তার ছাত্রলীগ বা এর নেতাদের আশ্রয়ে থাকা সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের কোনো পদক্ষেপ নিলেই তাকে ‘জামায়াত-শিবিরের লোক’ হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয় ছাত্রলীগ এমনকি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের তাই গ্রেপ্তার করা হয় কেবল ব্যাপক সন্ত্রাস সংঘটিত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশ পেলে। এর আগ পর্যন্ত এমনকি সংঘর্ষ চলাকালেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তারের সাহস পায় না। হরতাল চলাকালে বিরোধী দলের ওপর পুলিশের উপস্থিতিতে হামলা এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। কোনো পুলিশ কর্মকর্তা এ ধরনের পরিস্থিতিতে আইন অনুসারে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করলে তাকে জামায়াত-শিবিরের লোক বলে অপদস্থ করা হবে না এই গ্যারান্টি কেউ কি দিতে পারবে?
এই গ্যারান্টি সরকারকেই দিতে হবে। বাছবিচার না করে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের সুস্পষ্ট ও আন্তরিক নির্দেশ পুলিশের ওপর না থাকলে, ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালন করলে জামায়াত-শিবির অপবাদ পেতে হবে, এই আশঙ্কায় পুলিশ গুটিয়ে থাকলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের কোনো দিনও দমন করা যাবে না, এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির আগের সুনামও ফিরিয়ে আনা যাবে না।
৫.
সরকারকে আরেকটি জিনিস বুঝতে হবে। জামায়াত-শিবির অপবাদে চাকরি হারানোর ভয়ে পুলিশ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিস্ক্রিয় থাকতে পারে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বাধাদানের অপবাদ পেতে হতে পারে এই ভয়ে দেশের বিরোধী দলগুলো সরকারের কোনো ব্যর্থতার প্রতিবাদ করবে না, কর্মসূচি দেবে না, এটা আশা করা ঠিক নয়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে প্রকৃতই কোনো বাধা থাকলে বা এলে তার উপযুক্ত প্রতিকার অবশ্যই সরকারকে করতে হবে। কিন্তু সবকিছুকে যুদ্ধাপরাধী
বিচারের বাধা হিসেবে দেখালে আসল বাধাকে বরং দূর করা সরকারের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে।
সরকারকে বুঝতে হবে, একটি ভালো কাজ করলে সাত খুন মাফ হয়ে যায় না। তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করলেই সরকারের অন্য নানা ব্যর্থতা
ঘুচে যাবে না। এর প্রতিবাদও থেমে থাকবে না।
লেখক ---- ড. আসিফ নজরুল
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৫৫