মাছ ধরা জালে ছিদ্র থাকলে তা দিয়ে চুনোপুঁটি বের হয়ে যায়, কিন্তু রাঘব বোয়ালরা ধরা পড়ে। বাংলাদেশে আইন ও বিচার ব্যবস্থার জালেও ছিদ্র আছে, কিন্তু এ এমন উদ্ভট ছিদ্র যা দিয়ে রাঘব বোয়ালরা বেরিয়ে যায়, ধরা পড়ে চুনোপুঁটিরা! বর্তমানে যেভাবে উচ্চ মানের রাজনৈতিক নেতা, আমলা ইত্যাদি শাসকশ্রেণীর লোকদের বিরুদ্ধে বিশাল মাপের দুর্নীতির মামলা পাইকারি হারে খারিজ করা হচ্ছে তার থেকে এ দেশের বিচার ব্যবস্থা বিষয়ে এছাড়া অন্য ধারণা পোষণ করার উপায় নেই।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে, বলা চলে প্রায় প্রথম থেকেই, এ প্রক্রিয়া চলে এলেও এখন এটা এক প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, শাসক শ্রেণীর লোকেরা, বিশেষত তারা সরকারি ক্ষমতায় থাকার সময় যে চুরি-দুর্নীতি করে তার জন্য ক্ষেত্রবিশেষে তাদের কিছু হয়রানি হলেও শাস্তির কোনো সম্ভাবনা বিচার ব্যবস্থার মধ্যে নেই। নির্বাহী বা প্রশাসন ব্যবস্থার সঙ্গে বিচার ব্যবস্থার সম্পর্কের বিষয়টিও এর মধ্যে ভালোভাবে দেখা যায়। এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ এসব কিছুই নির্ভর করে শাসকশ্রেণীর চরিত্রের ওপর, রাষ্ট্রের চরিত্র এবং রাষ্ট্র পরিচালনার প্রক্রিয়ার ওপর।
একটি দেশে ব্যাপক চুরি, দুর্নীতি, সন্ত্রাস ইত্যাদি ব্যাপকভাবে জারি থাকা তখনই সম্ভব হয় যখন সে দেশে আইন ব্যবস্থা শিথিল থাকে, কেতাবি আইনকানুন অকার্যকর হয়ে পড়ে, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা জনগণের ওপর ব্যাপকভাবে নির্যাতন চালালেও ক্রিমিনালদের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্কের কারণে নানা প্রকার অপরাধের ব্যাপকতা ও নিষ্ঠুরতা হ্রাস না পেয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে শাসকশ্রেণীর অপরাধী রাঘব বোয়ালরা যে শত অপরাধ করে, বড় মাপের চুরি, দুর্নীতি করে শেষ পর্যন্ত নিরাপদ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে এমন ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে চুরি, ঘুষখোরি, দুর্নীতির মামলাগুলো যেভাবে খারিজ করে মামলায় জড়িত ব্যক্তিদের সাধুসন্ত বানানো হচ্ছে তাতে সাধারণভাবে দেশে চুরি, দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি সিন্ডিকেট ব্যবসা ও এসবের সঙ্গে সম্পর্কিত সন্ত্রাস যে ব্যাপকভাবে চলতে থাকবে এটা এক স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার।
‘চোরের মায়ের বড় গলা’ বলে বাংলায় একটা কথা আছে। বাংলাদেশে এই ‘বড় গলা’র আওয়াজ প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় এবং টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়। এর থেকে বোঝার অসুবিধে হয় না যে, শাসকশ্রেণীর উচ্চ মার্গের ব্যক্তিরা উপরোক্ত কাজই যে শুধু বেপরোয়াভাবে করে থাকেন তাই নয়, তাদের লজ্জাশরম বলেও কিছু নেই।
তবে এভাবে বলাটাও ঠিক নয়। কারণ মানুষ কোনো ক্ষেত্রে যখন বেপরোয়া হয় তখন লজ্জাশরমের কোনো বিবেচনা তার মধ্যে থাকে না। বেপরোয়া হওয়ার অর্থই তাই। যারা চুরি দুর্নীতি সন্ত্রাস করে তারা দেশে আইন ও বিচার ব্যবস্থার অবস্থার দিকে তাকিয়েই বেপরোয়া হতে সাহস পায়। বাংলাদেশে এই বেপরোয়া লোকেরা আইন ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যেই এমন নিশ্চিন্ত থাকে যাতে আদালতে সাজা পাওয়ার পরও তারা পুলিশের নাকের ডগায় ঘোরাফেরা করে। এর মধ্যে তারা কোনো বিপদ দেখে না।
অপরাধীদের বেপরোয়ার অন্যতম কারণ হলো চুরি, দুর্নীতি ইত্যাদির ব্যাপারে সাধারণভাবে সমাজের সহনশীলতা। ১৯৭২ সাল থেকে চুরি-দুর্নীতি ক্রমেই খুব দ্রুত ব্যাপকভাবে সরকারি প্রশাসন ও সমাজের প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রে এমনভাবে বিস্তার লাভ করে যাতে এটা পরিণত হয় এক ‘স্বাভাবিক’ প্রক্রিয়ায়। এই ‘স্বাভাবিক’ প্রক্রিয়ায় ধনসম্পদের মালিক হওয়া লোকেরা সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। অন্য সবকিছুর ঊর্ধ্বে থেকে এভাবে অর্জিত টাকাপয়সা, ধনদৌলতের মালিকানা একজনকে সামাজিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করলে সেখানে এসব অপকর্মের জন্য লজ্জাশরমের প্রশ্ন ওঠে না। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ এর মতো ‘ধনসম্পদ যার সামাজিক মর্যাদা তার’ এই বাক্য বাংলাদেশের জন্য এখন সর্বতোভাবে প্রযোজ্য। কাজেই কীভাবে একজন এ ধনসম্পদ অর্জন করছে এটা কোনো বিচার্য বিষয় নয়। সে যে ধনসম্পদের মালিক, এটাই এক্ষেত্রে মুখ্য বিবেচ্য বিষয়। এ পরিস্থিতি তৈরির ক্ষেত্রে শাসকশ্রেণীর সব অংশ, প্রশাসন থেকে নিয়ে বিচার ব্যবস্থা পর্যন্ত অবদান রাখে।
নৈতিক বক্তৃতা দিয়ে অপরাধ দমন তো দূরের কথা, অপরাধ কমিয়ে আনাও সম্ভব নয়। কারণ অপরাধের ধরন, মাত্রা ইত্যাদি সব কিছুই নির্ভর করে সমাজের চরিত্রের ওপর, সমাজ যে অসংখ্য সম্পর্কের মাধ্যমে সচল থাকে সেসব সম্পর্কের ওপর। বাংলাদেশে এ সম্পর্কের জাল ১৯৭২ সাল থেকে যেভাবে তৈরি হয়ে এসেছে তার মধ্যেই বর্তমান পরিস্থিতির বাস্তব শর্তগুলো কাজ করছে। বাংলাদেশে অসংখ্য ক্ষেত্রে এ শর্তের অধীনে চুরি, দুর্নীতি, ভূমি দস্যুতা, নদী দখল ইত্যাদি সব কিছুই হচ্ছে। নদী দখলের বিষয়টি এখানে উল্লেখ করা চলে। নদী দখলমুক্ত করা নিয়ে সরকার মাঝে মাঝেই উচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা দেয়, কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করে, কিন্তু আজ পর্যন্ত এর দ্বারা পরিস্থিতির কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেনি। এর কারণ নদী দখলকারীরা যেসব স্থাপনা নদীর ওপর তৈরি করেছে সেগুলো কিছু কিছু ভেঙে দিলেও যারা এ কাজ করছে তাদের কোনো প্রকৃত শাস্তির ব্যবস্থা নেই। জনগণের এবং কিছু সংগঠিত সংস্থার দাবির মুখে সরকার নদী দখলমুক্ত করার কর্মসূচি ঘোষণা করলেও অপরাধীদের কোনো পরোয়া নেই। কারণ তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই, তাদের জেল-জরিমানার কোনো ব্যবস্থা নেই। কাজেই তাদের দখলকৃত জায়গায় তাদের স্থাপনা ভেঙে দিলেও অল্প দিন পরে তারা আবার নির্ভয়ে সেখানে নতুন করে নিজেদের স্থাপনা পুনর্নিমাণ করে। নদী আবার তাদের দখলে যায় আগের মতোই।
এটা যে কতগুলো সম্পর্কের কারণেই সম্ভব হয় তা বলাই বাহুল্য। এ সম্পর্কের চরিত্র বোঝা কোনো কঠিন কাজ নয়। যারা নদী দখল মুক্তকরণ কর্মসূচি ঘোষণাকারী, যারা আইন প্রয়োগকারী, যারা আইনের অভিভাবক তাদের সঙ্গে এসব নদী দখলকারী অপরাধীর যোগসাজশ ও সম্পর্কের কারণেই নদী দখলমুক্ত করা সম্ভব হয় না। মুক্ত হওয়ার পর নদী আবার দখল হয়। রক্ষক যেখানে ভক্ষক সেখানে এটাই স্বাভাবিক।
শুধু নদী দখলের ক্ষেত্রেই নয়, মূল্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও একই ধরনের সম্পর্ক সূত্রের কারণে জিনিসপত্রের দাম কমানো সম্ভব হয় না। সিন্ডিকেট তৈরি করে ব্যবসায়ীরা যে মূল্য বৃদ্ধি করছে এটা সরকার কর্তৃকও স্বীকৃত। তাদের লোকজন, বাণিজ্যমন্ত্রীসহ আমলা-ফয়লা সবাই এ ব্যাপারে একমত। কিন্তু তা সত্ত্বেও সিন্ডিকেটগুলো অপ্রতিহতভাবে তাদের কাজ করছে। সরকারি লোকদের সঙ্গে, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যদি এ সিন্ডিকেটওয়ালাদের সুসম্পর্ক, লেনদেনের সম্পর্ক না থাকত তাহলে সরকার ইচ্ছে করলেই এ পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে না পারলেও অন্তত একে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে পারত। কিন্তু তা হচ্ছে না। বাংলাদেশের সমাজে যেসব সম্পর্ক দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হয়েছে, তার কাঠামোর মধ্যে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব নয়। শুধু নদী দখল বা মূল্য বৃদ্ধিই নয়, প্রত্যেক ক্ষেত্রে এ একই কারণে বাংলাদেশে অপরাধীদের রাজত্ব কায়েম হয়েছে। অপরাধীরা জানে তাদের কোনো শাস্তির ব্যবস্থা এখানকার আইন ও বিচার ব্যবস্থার মধ্যে নেই, প্রশাসনের কোনো ক্ষেত্রে নেই।
আগেই বলা হয়েছে যে, এর পরিবর্তন কোনো নৈতিক বক্তৃতা বা আবেদনের দ্বারা সম্ভব নয়। এ পরিবর্তনের সংগ্রাম সর্বতোভাবে রাজনৈতিক সংগ্রাম। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগ্রামের মাধ্যমে বর্তমান শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি ও কাঠামো আমূল পরিবর্তন করা ছাড়া এ পরিস্থিতি পরিবর্তনের অন্য কোনো পথ জনগণের জন্য খোলা নেই।