somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লালন ঘরের জ্যান্তে মরা ফকির আব্দুর রব, শিষ্যদের রব সাঁইজি আর ভক্তকূলের লবান শাহ এবং এই মুর্খের ‘মানুষ’ এর স্মরনে

২৯ শে অক্টোবর, ২০০৯ দুপুর ১:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

*আলোকচিত্রী :মুসতাইন জহির
শিরোনামের মানুষটা মারা গেছেন। এইটা বললে মিথ্যা বলা হয়।
তাইলে কি বললে পরে আমরা; বাংলার ভাব-দর্শনের থেকে বহুদুরে বাস করা মানুষেরা বুঝবো।
সেইটা তালাশ করতেই আমার এক বন্ধু আমারে নিয়া গেছলেন নদিয়ায়। এর আগেও গেছলাম তবে অফিসের কাজে। বাংলালিংক কিংবা গ্রামীণফোনের বাউল উৎসবে। ছেউরিয়ায় সুতরাং অনেকবার যাওয়ার পরেও তখন লালনের নদিয়ায় যাওয়া হয় নাই।
এবারো গেছলাম আমরা নদিয়ায়। কি মহিমা করলেন গো সাঁইজি। বোঝা গেলনা। তবুও গেছলাম।
-----------------------------------------------------------------------------

সাধুর তিরোধানে আমার প্রথম যা স্মৃতিতে আসলো সেইটা হইলো-
‘তুই তো মুর্খ রে!’
আমার উৎসুক মুখের ওপর সাধুগুরুর ছুড়ে দেয়া মন্তব্য ছিল ওইটা। তখন তার সাক্ষাত নিতে প্রথমবারের মতো আমি তার সামনে বসছিলাম। গতবারের দোল উৎসবে।

আমার ভালো লাগে নাই। আমি ভাবছিলাম; উনি কথাবার্তা শুরু করার আগেই আমারে আমার নিজের কাছে খাটো কইরা রাখতে চান- যেহেতু উনি আমার চাইতে মহান মানুষ, সংসারত্যাগী মানুষ, তিনি অনেক সাধনা করছেন সেইটা মনে করাইয়া দিয়া আমারে অধমের অধমের তস্য মুর্খ বানাইয়া এইভাবে কথা শুরু করতে সুবিধা- আমি যাতে মনে মনে তার চরনে নত নাখান্দা নালায়েক ভক্ত হয়া কথা শুনি।

সুতরাং শুধু খারাপ লাগা না, সেই সাথে চুপসে যাওয়া মনটা নিয়া চুপ কইরা গেলাম। সাধু বলতেই থাকলেন- ‘মুখস্থ কইরা কইরা তোরা সব মুর্খ হচ্ছিস। বইতে কি জ্ঞান থাকেরে! জানারে কি জ্ঞান কয়রে! যার জ্ঞান চাস তার মধ্যে ডুব দিতে হবে’। সাথে তানিম ভাই ছিল। ভাইজান কি মনে কইরা মিটিমিটি হাসতাছিল। আমি চেহারা থেকে মন খারাপের ছাপ দূর কইরা একটা নির্বিকার চেহারা তৈয়ার করার চেষ্টা করতেছিলাম। পাশ থেকে সাধুর পূর্ব পরিচিত আমাদের বন্ধু একজন তানিম ভাইকে দেখাইয়া বললো- উনি কিন্তু অনেক জ্ঞানী মানুষ সাঁইজি, জার্মানি থেইকা অনেক পাসটাস কইরা আসছে। সাধু তানিম ভায়ের দিকে না তাকাইয়া কেবল আঙ্গুল তার দিকে উঠাইয়া কয়- তাইলে এদের মধ্যে তুই হইলি মহামুর্খ। দেখলাম, ভাইজানের মন খারাপ হয় নাই। বরং সে আরো বেশি হাসতাছে। তারপর তানিম ভায়ের সাথে সাধুর দীর্ঘক্ষন ধইরা দার্শনিক তর্ক হইলো। ম্যালা কথা, বিশাল কাহীনি। সেই কথা কইয়া কাজ নাই এইখানে।

আমারে মুর্খ বলার শানে নুযুল কই। আমি জিগাইছিলাম- ‘আচ্ছা আপনার কি মনে হয়, এই সময়ে আইসা কেউ একজন আপনার বয়সে সাধু হইতে চাইবে কেন? মানে আপনে যেই বয়সে দীক্ষা নিছিলেন।’ এই প্রশ্নের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিশাবে আমার মুর্খতার ব্যাপারে নিশ্চয় ঘোষনা দিয়া তিনি কথা শুরু করলেন। স্মৃতি থেইকা যতটুকু মনে করতে পারি সেইগুলান ছিলো অনেকটা এরকম;
তোরে কি আমি সাধু হইতে কইছি? এমনকি তোরে কি আমি এহানে ডাইকা নিয়া আসছি? তুই আসছস ক্যা? (আখড়াবাড়ীর পাশে লালন একাডেমী ওরফে গ্রামীণ ফোনের মেলার দিকে আঙুল তুইলা) ডাকাডাকি তো করে ওরা। যা ওদিকে যা। বাউল দেইখা আয়। লালন দেখতে আসছিস, দ্যাখ। ওদের প্রশ্ন কর। দেখবি মজা পাবি। কত সাধন পথের কথা কইবো। তোরা তো ওগুলোতে মজা পাস। তাইলে এদিকে আসো ক্যান? জানলেই কি সাধু হওয়া যায়? নেংটি পড়লেই সাধন হয়? তাহলে আমি সত্তর বছর বসে রইলাম কেনো? জীবন দেখে দেখে তোরা জীবন মুখস্থ করিস। জীবনে তো ডুব দিতে জানিস তা। তাহলে কি হলো! সাধুর জীবন তো দূরের কথা। নিজের জীবনও পাবি না। যে যেই জীবন চায়, সেই জীবনের সন্ধানে ডুব দিতে হয়। আমি কি জানি আমি নিজেই পারলাম কি না!

আমি ধরতে পারলাম ততক্ষনে। আমার অজ্ঞানতার ঘোষনা দেয়ার জন্য নয়। আমার প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্যই সাধু তথ্য-জ্ঞান আর মুর্খতার বয়ান দিলেন। মুর্খ আমি নিজের ওপর তথ্যভারাক্রান্ততার স্বীকৃতি পাইয়া আনন্দিত হইলাম!

তারপর নিজের কথা বললেন জ্যান্তে মরা ফকির আব্দুর রব, শিষ্যদের রব সাঁইজি আর ভক্তকূলের লবান শাহ। পরের তিনদিনও আসরে গান আর আসরের পেছনে অনেক কথা হলো। তবে আমি আর কখনো প্রশ্ন করিনি। একবারও না। কেবল শুনেছি। এবার লালন তিরোধান উৎসবেও আমি শুধু শুনেছি। নিজের মরমের মধ্যে ধরতে পেরেছি কি না জানিনা। যে মানুষটি ছিয়াশি বছরের জীবনে সত্তর বছর কাটিয়ে দিলেন জ্যান্তে মরা হয়ে তারে আবার প্রশ্ন করতে হবে কেন? তিনি তার ডুব সাতারের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে যেটুকু জল-ঝাপটা তুলে দেবেন আমাদের জন্য সেটুকুটুই যথেষ্ট। সাধুর এবং তার এক ছেলে’র (শিষ্য) কাছ থেকে নদিয়া আর তার ভাব-বিপ্লবের বয়ান শুনে মরমে ধরার চেষ্টা করছি শুধু। মানুষ-জীবন-পৃথিবী-জীবনের ওপারের জীবন সর্ম্পকে লোকপ্রিয় সব ধারণাকে নদিয়া’র নিত্যানন্দ থেকে লালন আর রব সাইজির মতো লালন শিষ্যরা যেভাবে বাতিল করেছেন তা অবাক করার মতো। অথচ সবই তারা করেছেন অসম্ভব লোকপ্রিয় সব প্রচলিত ধারণা আর কাহীনির আশ্রয় নিয়ে। সবচেয়ে বড়ো করে তুলেছেন মানুষকে। মানুষের ভেতরে যে পরম শুভ আছে, তারে প্রধান করে তোলার উপায় বাতলেছেন। মানুষের ওপরে থাকা আল্লাকে মানুষের ভেতরে নিয়ে এসেছেন। সবচেয়ে বড়ো কথা হলো- মানুষ আর প্রকৃতি আলাদা করেননি তারা। কথা আর জীবনাচারে ফারাক করেননি।

এবারের লালন তিরোধান উৎসবে শেষদিন আসরে তিনি সবশেষে কথা বলছিলেন, গান গাইছিলেন নবপ্রাণ আখড়াবাড়ীতে। আমি ভক্ত-শ্রোতাদের একদম পেছনে সেই ডুমুর গাছটির গোড়ায় বসছিলাম। বলছিলেন- আমি যদি আমার মধ্যে আমার পরম’রে না পাই তবে সাধনার কি হবে? আমি যদি আমার আল্লার সাথে এক হতে না পারি তবে সাধনায় কি ফল? আল্লা আর মানুষ মিলে এক না হলে তো শান্তি হবে না। সে চেষ্টাই তো করে যাচ্ছি।

সাধুর সেই চেষ্টা এবার আমাদের চোখের সামনে থেকে আড়াল হয়ে গেল। দশকের পর দশক জীবিত থেকেও যে পরম মানুষের জীবন যাপন করেছেন তার তিরোধান ঘটলো আমাদের সময়ের মধ্য থেকে।
-----------------------------------------------------------------------------

এই পোস্টটা আসলে নদিয়া-লালন-লালনের ঘরের সাধনা বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অনুভব-অভিজ্ঞতার অতি ক্ষুদ্রাংশ। কিছুই ব্যাখ্যা করতে পারি নাই।

যে কাজটা এইখানে একজন করেছেন চমৎকার ভাবে। দেখতে পারেন।

আমাদের আর বর্ণ ও অক্ষরের জ্ঞান পাওয়া হলো না: চলে গেলেন ভাবান্দোলনের উজ্বল সাধক লবান শাহ
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১০ সকাল ১১:২৯
৪১০ বার পঠিত
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাঘ আর কুকুরের গল্প......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:৩২

বাঘ আর কুকুর দুটোই হিংস্র এবং সাহসী প্রাণী। বাঘ, কুকুর যতই হিস্র হোক মানুষের কাছে ওরা নেহায়েতই পোষ মেনে যায়। আমাদের সমাজে, রাজনীতিতে অনেক নেতাদের 'বাঘের বাচ্চা' বলে বিরাটত্ব জাহির... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমরা উকিলরা কেউ চিন্ময়ের পক্ষে দাঁড়াবো না , না এবং না

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৪২




সাবাস বাংলাদেশের উকিল । ...বাকিটুকু পড়ুন

আগরতলায় হাইকমিশনে হামলা কাকতালীয় না কি পরিকল্পিত?

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৩২

গতকাল (২ ডিসেম্বর) ভোরে আগরতলার হিন্দু সংগ্রাম সমিতির বিক্ষোভকারীদের দ্বারা বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনের প্রাঙ্গণে হিংসাত্মক বিক্ষোভের পর ন্যাক্কারজনকভাবে আক্রমণ করে। বিভিন্ন তথ্যে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত যে বিক্ষোভকারীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের সাথে যুদ্ধ করে ভারত লাভবান হবে বলে মনে করি না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ৮:১০



আমাদের দেশে অনেক মুসলিম থাকে আর ভারতে থাকে অনেক হিন্দু। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম যুদ্ধে মুসলিমদের সাফল্য হতাশা জনক নয়। সেজন্য মুসলিমরা ভারতীয় উপমহাদেশ সাড়ে সাতশত বছর শাসন করেছে।মুসলিমরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড. ইউনূস গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড - শেখ হাসিনা।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৩৬


৫ই আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পলায়নের পর বাংলাদেশের ক্ষমতা গ্রহণ করা নতুন সরকার কে বিপদে ফেলতে একের পর এক রেকর্ড ফোন কল ফাঁস করতে থাকেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×