মনে পড়ে যায় আমার কৈশোর
স্মৃতি হারানো সেই সুর আজও ভুলিনি
সেই দিনগুলি মনে পড়ে যায়
আবার ফিরে আসে
আবার ফিরে আসে...
বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের কথা মনে হলেই আমার সঞ্জয়ের গাওয়া এই গানটির কথা খুব মনে পড়ে। এই দেশের ব্যান্ড সংগীত প্রিয়দের মাঝে সঞ্জয় এক অনন্য নক্ষত্রের নাম। ওয়ারফেজ ব্যান্ডের এক সময়কার ভোকাল ছিলেন। যার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায় তার গান। গলার ভোকাল কর্ড ছিঁড়ে যাওয়ার পর মূলত সঞ্জয় ব্যান্ড সংগীত জগত থেকে বিদায় নেন। কিন্তু তিনি যতদিন ছিলেন ওয়ারফেজ ব্যান্ড ছিলো তরুণ প্রজন্মের হৃদয়ের প্রতিধ্বনি হিসেবে। সঞ্জয়ের অবসরের পর মিজান এই ব্যান্ডটির হাল ধরলেও এখনও হৃদয়ে দোলা দেয় সঞ্জয়ের গাওয়া গানগুলোই।
বাংলাদেশের সংগীত জগতটাকে ব্যান্ডের গান অনেকাংশেই দখল করে আছে। বিশেষ করে নব্বই দশকের গানগুলোই চির সবুজ হয়ে আমাদের হৃদয়ে আজও রাজত্ব করে চলেছে। নব্বই দশকের পর আরও অনেক ব্যান্ড দলই এসেছে কিন্তু নব্বই দশকের মতো করে হৃদয়ে আলোড়ন জাগাতে সক্ষম হয়নি। সেই সময়ের গানগুলো একদিকে যেমন ছিলো সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে তেমনি ছিলো প্রেম ঘটিত সুখ দুঃখের অনুভূতিতে গাঁথা। যেমন ছিলো প্রতিটা গানের গীতিকবিতা তেমনি ছিলো মনকাড়া সুর। শুধুই সামাজিক কিংবা প্রেম নয় গ্রাম বাংলার কথা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, দেশাত্ববোধক, মানুষের জীবন যাপনের রূপ প্রায় সবকিছুই উঠে এসেছিলো সেসব গানের মাধ্যমে। আজও যখন গান শোনা হয় কিংবা গানের কথা বলতে গেলে সেই সময়ের গানের কথাই মনে পড়ে। আমার মাঝে মাঝে এই ভেবে গর্ব হয় যে আমি সেই যুগের সাথে বেড়ে উঠতে পেরেছিলাম।
বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত প্রসঙ্গে কিছু বলতে গেলে সবার আগে স্মরণ করতে হয় গুরু আজম খানকে। মূলত গুরুর হাত ধরেই বাংলাদেশের ব্যান্ড জগতের যাত্রা শুরু হয়। বন্ধু নিলু আর মনসুরকে গিটারে, সাদেক ড্রামে আর নিজেকে প্রধান ভোকাল করে শুরু করলেন তার ব্যান্ড উচ্চারণের যাত্রা। বিটিভিতে একটি অনুষ্ঠানে এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে এবং চার কালেমা সাক্ষী দেবে গান দুইটি গাওয়ার মাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসা আর তুমুল জনপ্রিয়তা পান। এরই মধ্যে বন্ধু ইশতিয়াকের পরামর্শে সৃষ্টি করেন একটি এসিড রক ঘরানার গান জীবনে কিছু পাবোনা এ হে হে! তিনি দাবী করেন এটি বাংলা গানের ইতিহাসে প্রথম হার্ডরক! আমাদের মাঝে গুরু যেমন চির ভাস্মর হয়ে থাকবেন তেমনই চির ভাস্মর হয়ে থাকবে গুরুর গাওয়া; রেল লাইনের ঐ বস্তিতে, ওরে সালেকা ওরে মালেকা, আলাল ও দুলাল, অনামিকা, অভিমানী, আসি আসি বলে ইত্যাদি গানগুলো।
এরপর অনেক ব্যান্ড এসেছে একের পর এক। কোন ব্যান্ডের চেয়েই কোন ব্যান্ডকে এবং তাদের কোন গানকেই খাটো করে দেখার কোন রূপ সুযোগ হয়ে উঠেনি কখনওই। ব্যান্ড সংগীত আমাদের জীবনে স্থান করে নেয় সার্বিক ভাবে। সেই ফিতার ক্যাসেটের যুগ। যে কোন গান বার বার শোনা যে সময়টাতে ছিলো বিশেষ এক কসরত করার যুগ। সেইসব শুধুই এখন স্মৃতি।
যে সময়টাতে প্রেমিক মন নিয়ে ঘুরে বেড়তাম একটি প্রেম করার প্রয়াসে এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে, ঠিক সেই সময় এলো ডিফারেন্ট টাচ তাদের মন কি যে চায় বল যারে দেখি লাগে ভাল গানটি নিয়ে। আহা ! যেন একদম অন্তরের কথাগুলোই গানের ভাষায় প্রকাশিত হলো। লিড ভোকালিস্ট মেসবা এবং গিটারিস্ট পিয়াল অতুলনীয় এক জুটির নাম। শ্রাবনের মেঘ, দৃষ্টি প্রদীপ জ্বেলে, জীবন মাঝি, স্বর্ণলতা, সুখ আসে এই গানগুলো যতই শুনি মনে হয় যেন এই সময়টাকেই ধারণ করা হয়েছে প্রতিটা গানের মাধ্যমে।
মন ছুঁয়ে যাওয়া প্রতিটা গান। এই ক্ষেত্রে আমার তপন চৌধুরীর গাওয়া মন শুধু মন ছুঁয়েছে গানটির কথাই বলতে হয়। ব্যান্ড সোলসের একসময়কার সদস্য ছিলেন তিনি। এই একটি ব্যান্ড যার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো কুমার বিশ্বজীৎ, আইয়ূব বাচ্চু, নকীব খান, পীলু খান, নাসিম আলী খান, সাজিদ উল আলম, লুলু, নেওয়াজ, রনি বড়ুয়া, তাজুল, পার্থ বড়ুয়ার মতো গুণী সব শিল্পীদের। তারা এসেছেন মন জয় করে নিয়েছেন আবার ব্যান্ড ছেড়ে চলে গিয়ে গড়েছেন নিজেদের ভিন্ন ব্যান্ড দল কিন্তু সোলস কখনও ভাঙেনি। টিকে থাকে তার আপন মহিমায় চির ভাস্মর হয়ে। তবে এইজন্য পার্থর কৃতিত্ব অনেকাংশেই। তিনিই এখনও পর্যন্ত ব্যান্ডটির হাল ধরে রেখেছেন আপন মহিমায়। সুপার সোল, কলেজের করিডোরে, মানুষ মাটির কাছাকাছি, ইষ্ট এন্ড ওয়েস্ট, এ এমন পরিচয়, আজ দিন কাটুক গানে, অসময়ের গান, আনপ্লাগড মুখরিত জীবন, তারার উঠোনে, টু-লেট, ঝুট ঝামেলা, জ্যাম এই পর্যন্ত প্রকাশিত এ্যালবাম।
ব্যান্ড জগতের আরেক নক্ষত্র আইয়ূব বাচ্চু যিনি সোলস থেকে বের হয়ে এসে লিটল রিভার ব্যান্ড (এলআরবি) নামক নতুন এক ব্যান্ডের জন্ম দেন। সারা ভারতীয় উপমহাদেশে গীটারে বিখ্যাত এই গুণী শিল্পী ব্যান্ড সংগীত পাগল শ্রোতাদের কাছে আজম খানের পর গুরু হিসেবেই সমান পরিচিত। তিনি একাধারে গায়ক, লিডগিটারিস্ট, গীতিকার, সুরকার, চলচ্চিত্রের প্লেব্যাক শিল্পী। এলআরবি ব্যান্ড দলের আগে তিনি দশ বছর সোলস ব্যান্ডের সাথে লিড গিটারিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন। মূলত রক ঘরানার কন্ঠের অধিকারী হলেও আধুনিক গান, ক্লাসিকাল সংগীত এবং লোকগীতি দিয়েও শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন। রক্তগোলাপ তার সর্বপ্রথম প্রকাশিত একক এ্যালবাম। এই এ্যালবামটি তেমন একটা সাফল্য পায়নি। তার সফলতার শুরু দ্বিতীয় এ্যালবাম ময়না এর মাধ্যমে। তারপর তিনি বের করেন তৃতীয় অ্যালবাম কষ্ট। সর্বকালের সেরা একক এ্যালবামের একটি বলে অবিহিত করা হয় এটিকে। এই অ্যালবামের প্রায় সবগুলো গানই জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে কষ্ট কাকে বলে , কষ্ট পেতে ভালোবাসি , অবাক হৃদয় , আমিও মানুষ। তিনি অনেক চলচ্চিত্রেই প্লে ব্যাক করেছেন। অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম একটি জনপ্রিয় গান। এটি তার গাওয়া প্রথম চলচ্চিত্রের গান। গুরু আমাদের হৃদয়ে চিরকাল বেঁচে থাকবেন তার গাওয়া অবিস্মরণীয় গান; সেই তুমি কেন অচেনা হলে, রূপালী গীটার, রাত জাগা পাখি হয়ে, কষ্ট পেতে ভালোবাসি, মাধবি, ফেরারি মন, এখন অনেক রাত, ঘুমন্ত শহরে, বার মাস, হাসতে দেখ ইত্যাদি গানের মাধ্যমে।
সোলস থেকে বের হয়ে নকীব খান গড়ে তুলেন তার ব্যান্ড রেনেসাঁ। ফয়সাল সিদ্দিকি বগী, পীলু খান, কাজী হাবলু, মোটো, মামুন ছিলেন ব্যান্ডের প্রাথমিক সদস্য বৃন্দ। রেনেসাঁর হৃদয় কাদা মাটির কোন মূর্তি নয় আঘাত দিলেই ভেঙে যাবে এবং আজকের শিশু গান দুটি রেনেসাঁকে দিয়েছে অন্যন্য এক স্থান। এরপর দেশ নিয়ে বেশ কিছু গান করে নামের সার্থকতা রাখতে সক্ষম হয় ব্যান্ডটি।
যারা কিছুটা দুঃখ বিলাসী তাদের জন্য চাইমকে ভোলা কখনওই সম্ভব নয়। আর চাইম মানেই খালিদ। চাইমের প্রাথমিক সদস্য ছিলেন আশিকুজ্জামান টুলু, সাইদ হাসান টিপু, শওকত আলী ইমন, সুমন, বাবু, আল আমিন। পরবর্তীতে তারা সবাই চলে গেলে খালিদ আবারও ঘুরে দাঁড়ান নতুন প্রত্যয় নিয়ে নতুন কিছু মুখ নিয়ে। যাদের মধ্যে বাহাদুর, বীপ্লব, রিয়াজ, নাদিম এবং আশিক ছিলেন চাইমকে নতুনভাবে রূপদান করার সফল রূপকার। আমার কাছে মনে হয় নাতি খাতি বেলা গেল সুতী পারলাম না এই গানটি সেই সময় যারা শুনেছিলেন তারা কখনও চাইমকে ভুলতে পারবেন না। এরপর অসংখ্য জনপ্রিয় গান দিয়ে শ্রোতাদের মন জয় করে নিয়েছেন খালিদ তার সুরেলা কণ্ঠের মাধ্যমে। হাঁসের ছাও, তুমি হিমালয় হয়ে, সরলতার প্রতিমা, হয়নি যাবার বেলা, আকাশনীলা, আবার দেখা হবে, জয় জগা নন্দন, আজকে রাতে, কোনো কারণে ইত্যাদি তাকে দিয়েছে ভক্তদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় গায়কের সন্মান।
চাইম থেকে বের হয়ে সাইদ হাসান টিপু অর্থাৎ আমাদের সকলের প্রিয় টিপু গঠন করেন তার ব্যান্ড অবসকিউর। রোমান্টিক গান মানেই তখন ছিলো টিপু। ছাইড়া গেলাম মাটির পৃথিবী, মাঝ রাতে চাঁদ যদি আলো না বিলায়, তুমি ছিলে কাল রাতে, খোদা তোমায় ডাকবো যখন, আধার ঘেরা স্বপ্ন, সন্ধ্যা আকাশ, দৃষ্টিরই সীমানায় এর মতো চিরসবুজ ও চিরকাল মনে রাখার মতো প্রিয় সব গান গেয়ে অগণিত ভক্ত হৃদয়ে স্থান করে নেন টিপু। এরপরে খানিক বিরতি দিয়ে অবসকিউর এর একটু অন্যরকম রকিং এ্যালবাম স্বপ্নচারিণী আসে যেখানে এতদিনের চেনা শান্ত শিষ্ট রোমান্টিক টিপু অনেক দুর্দান্ত, বুকের ভেতর জমে থাকা কোন ক্ষোভ যেন বারুদ হয়ে বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে সেইরকম একটি এ্যালবাম বের করেন। এই এ্যালবামের আগে খুলনার দুই জনপ্রিয় শিল্পী ফ্রম ওয়েস্ট ও ডীফরেন্ট টাচ কে সাথে নিয়ে একটি অসাধারণ ব্যান্ড মিক্সড এ্যালবাম আবেগ বের করে অবসকিউর। যে এ্যালবামের প্রতিটা গানই ছিল আবেগ নিয়ে খেলা করা দুর্দান্ত সুন্দর সব গান। এরপর অবসকিউর কে আর পাওয়া না গেলেও শ্রোতারা প্রিয় টিপু কে পেয়েছিল সবসময় বিভিন্ন মিক্সড এ্যালবামের চরম জনপ্রিয় ও দুর্দান্ত সব গানে। সেই মিক্সড এ্যালবামের যুগে শ্রোতারা পায় প্রিয় টিপুর প্রথম একক এ্যালবাম একাকী একজন। সেই এ্যালবামের একাকী একজন, আমার আমি ছাড়া, আমার মন গানগুলো ছিল চোখে পানি আসার মত সব গান।
চাইম থেকে বের হয়ে এসে আশিকুজ্জামান টুলু আরেক জনপ্রিয় শিল্পী ভিন্ন মাত্রার গায়কী ঢঙয়ের হাসান ও অসাধারণ সুরকার পঞ্চম কে নিয়ে গঠন করেন ব্যান্ড আর্ক। যাদের প্রথম এ্যালবাম ছিলো তাজমহল। তারপর জন্মভূমি, স্বাধীনতা নামে আরও দুটি এ্যালবাম বের হয় তাদের। গুরু তোমার এমন বাণী, তাজমহল, একাকী, পাগল মন, সুইটি, মনে পড়ে, আকাশের নীলে, এই দূর পরবাসে, অভিমানে নয়, বাংলাদেশ গান দিয়ে জয় করে নেয় অগণিত ভক্তের হৃদয়। পরবর্তীতে হাসান বিভিন্ন মিক্সড এ্যালবামে একক ভাবে গান গেয়ে তার জনপ্রিয়তা ধরে রাখেন।
নোভা বাংলাদেশের আরেকটি জনপ্রিয় ব্যান্ডের নাম যার সাথে হৃদয়ে আজও নাড়া দেয় আহমেদ ফজল করিমের নামটি। মাদক বিরোধী গান আহবান দিয়ে যিনি স্থান করে নেন অগণিত ভক্তের হৃদয়। তারপর আরেকটি তুমুল ঝড় তোলা গান রাজাকারের তালিকা চাই গেয়ে চিরদিনের জন্য বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত জগতে স্থান করে নেন। তারপর স্কুল পলাতক মেয়ে, সজনী সাঁঝেরও তারা হয়ে গানদুটি গেয়ে সমান ভাবে সমাদৃত হন তিনি।
পপ সম্রাট আজম খানের ব্যান্ডের কিছু সদস্য সিদ্ধান্ত নেন নিজেরা কিছু গান করার। তখন উইনিং ব্যান্ডটি গঠিত হয় যার সদস্য ছিলেন হায়দার হোসেন, মিতুল, রঞ্জন, শেলী, রানা, ফাহিম। একটা সময় মিতুল, হায়দার, ফাহিম ও রানা আমেরিকাতে পাড়ি জমান উন্নত জীবন এবং পড়াশোনার জন্য। তখন ব্যান্ডে কিছু নতুন সদস্য যোগ দেন। বাবু, রেজা এবং বিপ্লব। একটা সময় উইনিং ব্যান্ড তাদের মূল ভোকালের খোঁজ শুরু করে। তখন বর্তমানে নগর বাউল ব্যান্ডের জেমসকে তারা কিছু সময়ের জন্য ব্যান্ডের সাথে অনুশীলনে রাখে। পরে চন্দন ব্যান্ডে যোগ দেয় গিটারিস্ট ও ভোকাল হিসেবে। তারপর রঞ্জন ক্রিকেট খেলতে গিয়ে আহত হয়ে আংগুল ভেঙ্গে ফেলেন এবং আর ড্রামস বাজাতে সক্ষম ছিলেন না। এ অবস্থাতে টিপু ব্যান্ডে যোগ দেন ড্রামার হিসেবে। তাদের সেলফ টাইটেল এ্যালবাম উইনিং বের হয় এবং বাবু ও রেজা ব্যান্ড ত্যাগ করেন। তখন ব্যান্ডের নতুন সদস্য হিসেবে যোগ দেয় কিবোর্ডে বিপ্লব ও সজল। একটা সময় আবারও ব্যান্ডটি ভেঙে যায়। শেলী সিলেটে চা বাগানে তার কর্মজীবন শুরু করেন ও সজল তাঁর ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ সময় দলে যোগ দেন মবিন যিনি পরে সড়ক দুর্ঘটনাতে নিহত হন। এসবের মাঝেও ব্যান্ডের দ্বিতীয় এ্যালবাম অচেনা শহর মুক্তি পায়। তারপর আরও অনেকবার ব্যান্ডের লাইন আপে পরিবর্তন আসে। টিপু ব্যান্ড ত্যাগ করলে তার জায়গায় আসেন ইমন, মবিন ব্যান্ড ত্যাগ করেন। এসময় বর্তমানে মাইলস ব্যান্ডের সদস্য জুয়েল ব্যান্ডে কিছুদিন কাজ করেন। সবশেষে মোর্শেদ এবং রাসেল ব্যান্ডে যোগ দেন। এরপর ইমন ব্যান্ড ত্যাগ করেন ও চন্দন ব্যান্ড ছেড়ে এক বছরের জন্য ইংল্যান্ডে উচ্চ শিক্ষার জন্য পাড়ি জমান। তারপর ব্যান্ডের কার্যক্রম প্রায় স্থবির হয়ে পড়ে। তবে এত ভাঙা গড়ার মাঝেও আজও উইনিং মানেই অচেনা শহরে, ইচ্ছে করে, ঐ দূর পাহাড়ের ধারে এখনও আমাদের হৃদয়ে স্থায়ী ভাবে জায়গা করে রেখেছে।
সময়ের সঙ্গে পথ চলার ব্যান্ড প্রমিথিউস। মূলত দেশাত্মবোধক গানের জন্যই বিখ্যাত হয়ে আছে এই ব্যান্ডটি। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে একসময় আরিফ, রেজওয়ান, শারেক, কোয়েল এবং বিপ্লব মিলে ব্যান্ডটি গঠন করেন। প্রকাশিত এ্যালবামগুলো হচ্ছে স্বাধীনতা চাই, মুক্তির প্রত্যাশায়, প্রজন্মের সংগ্রাম, স্লোগান, যোদ্ধা, প্রমিথিউস ২০০০, স্মৃতির কপাট, অ-আ, পাঠশালা, ঢোল, টাকা, নাগরদোলা, রাজপথ, প্রমিথিউস আনবাউন্ড, প্রমিথিউস আনবাউন্ড ওয়ান ও ছায়াপথ। বেশির ভাগ এ্যালবামেই দেশের সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা ও দেশাত্মবোধক গান রয়েছে।
লাল শাড়িতে গানটির কথা সবারই মনে আছে নিশ্চয়। অরবিট ব্যান্ডের পলাশের গাওয়ার একটি তুমুল জনপ্রিয় গান সেই সময়ের যা ছিলো আমাদের মুখে মুখে।
তারপর মনিটর, পালস, নেক্সাস, উইন্ডস, সলিড ফিঙ্গারস, ওয়েভস, শিঞ্জন, রং নাম্বার, অর্কিড, চার্মিং, অডিসি, ডিজিটাল, রকস্টারটা, ইন ঢাকা, স্পন্দন, ইকারাস, ব্লু ওশেন, তীর্থক, কেইড্যান্স, কেওজ, লিজেন্ড, অরবিট, নরদানস্টার, ড্রিমল্যান্ড, মাইক্রো, স্টারলিং, ফেইথ, মিউজিক টাচ, সফট টাচ, সিম্ফনি, লেসন, সানডে, পেপার রাইম এর মতো অনেক ব্যান্ড আসে।
আরেক শিল্পী আদনান বাবুর গাওয়া মৌচাক মার্কেটে হলো দেখা, রং নাম্বার টেলিফোনে, ও পরানের পাখিরে, চিত্র নায়িকা মৌসুমির সাথে ডুয়েট গান পাশের বাড়ির ঐ মেয়েটি ছিলো তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে যা এখনও আমাদের হৃদয়কে দোলা দেয়। তাছাড়া পার্থ, চারু ও আশরাফ বাবুর ব্যান্ড ত্রীরত্নের ক্ষ্যাপার চলছে, গায়ে হলুদ, সারাদিন গানগুলো ছিলো বাংলা ব্যান্ড জগতে র্যাপ গান হিসেবে নতুন এক সংযুক্তি।
ব্যান্ডের গান ছাড়াও এখানে আরও মনে পড়ছে দীঘল কালো লম্বা চুলের সুন্দর মুখশ্রীর গায়িকা সুমনা হকের গাওয়া মায়াবী এই রাতে, ডলী সায়ন্তনীর রং চটা জিন্সের প্যান্ট পরা যুবক, বেবী নাজনিনের গাওয়া এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ির আঁচল, শুভ্র দেবের মন আমার পাথর নয়, সাবিনা আক্তার রুনার নীল চাঁদোয়া, দিলরুবার পাগল মন, মুরাদের আমি আগের ঠিকানায় আছি, আবদুল মান্নান রানার যেখানেই যাও ভালো থেকো, কুমার বিশ্বজীতের যেখানেই সীমান্ত তোমার, সাইফের কখনও জানতে চেয়েও না কী আমার সুখ, আগুনের আমার স্বপ্নগুলো কেন এমন স্বপ্ন হয়, জুয়েলের দুঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট জ্বলে পুড়ে যায় গানগুলো শুনলে আজও শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে। এখানে আরও দুইজন মহান গায়কের কথা না বললেই নয়। লাকী আখন্দ এবং শেখ ইশতিয়াক। আমায় ডেকোনা, এই নীল মনিহার, নীলাঞ্জনা কিংবা তোমার মনের ফুলদানীতে গানগুলোর জন্য যাদের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে আজীবন ধরে।
যাই হোক ফিরে আসি আবারও ব্যান্ডের মাঝে। ফীডব্যাক, মাইলস, ওয়ারফেজ এবং নগর বাউল বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত জগতে যারা দিয়েছেন চারটি ভিন্ন মাত্রার সংযুক্তি।
প্রথমেই আসি মেটাল ব্যান্ড ওয়ারফেজের কথা নিয়ে। যদিও পরবর্তীতে ব্ল্যাক, অর্থহীন, শিরোনামহীন, ভাইকিংস নামের আরও কিছু মেটাল ব্যান্ড আসে কিন্তু ওয়ারফেজের মতো করে হৃদয়ে কেউ আর তেমন করে স্থান করে নিতে পারেনি। সঞ্জয়, বাবনা, টিপু, কমল আর রাসেল মিলে গঠন করেন প্রিয় ব্যান্ড ওয়ারফেজ। কৈশোর, মনে পড়ে, ধূপছায়া, হতাশা, মহারাজ, বিচ্ছিন্ন আবেগ, আলো, অসামাজিক, ইত্যাদি গান দিয়ে আজও যেভাবে মোহময় করে রেখেছে তার কোন তুলনা হয়না। ওয়ারফেজ, অবাক ভালবাসা, জীবনধারা, অসামাজিক, আলো, মহারাজ, পথচলা, সত্য প্রকাশিত এ্যালবাম।
মাইলস মানেই আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে দুর্দান্ত সব গানের জনক। শাফিন আহমেদ, হামিন আহমেদ, মানাম আহমেদ, ইকবাল আসিফ জুয়েল নিয়ে বর্তমান লাইন আপ হলেও একসময় হ্যাপি আখন্দ, ইশতিয়াকের মতো জনপ্রিয় গুণী শিল্পীরা ছিলেন এই ব্যান্ডের সদস্য হিসেবে। মাইলস সর্বপ্রথম ইংরেজীতে ব্যান্ডের নামেই একটি এ্যালবাম বের করেছিলো। তারপর বের করে প্রতিশ্রুতি। মূলত এই দ্বিতীয় এ্যালবামের পড়ে তাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মাইলস খুব সম্ভবত জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যায় বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি সংগীত শ্রোতার হৃদয়ে। তারপর একে একে বের হয় তাদের প্রত্যাশা, প্রত্যয়, প্রয়াস, প্রবাহ ও প্রতিধ্বনি এ্যালবামগুলো। চাঁদ তারা সূর্য, জ্বালা জ্বালা, ধ্বিকি ধ্বিকি, সে কোন দরদীয়া, ফিরিয়ে দাও, এক ঝড় এসে, আর কতকাল খুঁজব তোমায়, পলাশীর প্রান্তর, পাহাড়ী মেয়ে, নীরবে কিছুক্ষণ, হৃদয়হীনা, সোনালী রোদে, গুঞ্জণ শুনি গানগুলো এমন ভাবেই এখনও জীবনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে যে সুখ দুঃখ যাই বলি না কেন; এই গানগুলোই সকল সময়ের সঙ্গী।
ফীডব্যাক বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে দিয়েছে মেলায় যাইরের মতো এক মাইল ফলক গান। বৈশাখের মেলা মানেই এই গান বাজাতেই হবে। নইলে বৈশাখ উদযাপন বৃথা। ফুয়াদ নাসের বাবু, লাবু রহমান, পিয়ারু খান, পন্টি, লুমিন, রায়হান এই নিয়ে প্রিয় ব্যান্ড ফীডব্যাক। একসময় মাকসুদ ব্যান্ডের মূল ভোকাল হিসেবে থাকলেও পরে তিনি গড়ে তুলেন নিজের ব্যান্ড ঢাকা যেখান থেকে তিনি বের করেন নিষিদ্ধ নামের এ্যালবামটি। যা আজও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর একমাত্র সেরা একটি এ্যালবাম হিসেবে ইতিহাস হয়ে রয়েছে। বিশেষ করে গণতন্ত্র গানের কথা না বললেই নয়। তাছাড়া নিজের দেশ হতে পারে গরীবের দেশ গানটি যখনই শুনিনা কেন চোখে পানি চলে আসে। যাই হোক ফীডব্যাকের কথায় ফিরে আসি। আসলে ফীডব্যাকের কথা বলতে গেলে মাকসুদের কথা না বলে পারা যায়না। চলচ্চিত্রেও তার গাওয়া তোমাকে দেখলে একবার মরিতে পারি শতবার এখনও যেন মাথার ভেতর অনুরণন তোলে। ফীডব্যাকের ফীডব্যাক, উল্লাস, মেলা, জোয়ার, বাউলিয়ানা, বংগাব্দ-১৪০০, দেহঘড়ি ছিলো এক একটা মাইল ফলক এ্যালবাম। গীতিকবিতা-১,২, মামা, টেলিফোনে ফিসফিস, পালকি, চিঠি, বিদ্রোহী, মৌসুমি গানগুলো আজও চির সবুজ।
জেমস গুরুর কথা বললেই হৃদয়ে কাঁপন ধরে যায়। বাংলাদেশের ব্যান্ড মূলত গুরুর হাত ধরেই পায় নতুন এক মাত্রা। যার গায়কী ঢঙের সাথে কারও কোন তুলনাই আসলে হয়না। প্রথমটায় ফিলিংস নামে ব্যান্ড দিয়ে শুরু করলেও পরে নগর বাউল নামে ব্যান্ড করে এখনও গানের জগতে চির অম্লান রয়েছেন। গুরু দেশীয় চলচ্চিত্র এবং ভারতীয় চলচ্চিত্রেও প্লে ব্যাক শিল্পী হিসেবে বেশ কিছু গান করেন। বের হয় একক শিল্পী হিসেবেও বেশ কিছু এ্যালবাম। তরুণ প্রজন্মের হার্টথ্রব জেমস আসলে যাই গেয়েছেন তাই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। তার গাওয়া বাংলাদেশ গানের কথা বিশেষ ভাবে না বললেই নয়। যদিও ব্যান্ড জগতের আরেক গুরু আইয়ূব বাচ্চুর গাওয়া বাংলাদেশ গানটিও অসাধারণ কিন্তু জেমসের গানটি এক অনন্য ইতিহাস সৃষ্টি করে রেখেছে চিরদিনের জন্য। গুরুর সবচেয়ে মজার যে ব্যাপারটি হলো তিনি সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষদের জীবন ই জীবিকা নিয়ে গান করেছেন। যেমনঃ লেইস ফিতা, মান্নান মিয়াঁর তিতাস মলম, হাউজি, বায়োস্কোপ, বাংলার লাঠিয়াল, বিজলী, মীরা বাঈ ইত্যাদি অনন্য সব গান। জেমস একদিকে যেমন কবিতা, লিখতে পারিনা কোন গান, ভালোবেসে চলে যেও নার মতো প্রেমের গান গেয়েছেন তেমনি আবার আধ্মাতিক গানও করেছেন যেমনঃ ঈশ্বর, যিকীর। দুঃখিনী দুঃখ করোনা তার সেরা এ্যালবাম। মা এবং বাবা গান দুটিতো আরেক মাইল ফলক গান হিসেবে অত্যন্ত সুপরিচিত। জেমসের এত এত জনপ্রিয় গান আছে যে লিখে শেষ করা যাবেনা। জীবনের সঙ্গে, রক্তের স্রোত ধারার সাথে মিশে আছে প্রায় সবগুলো গানই।
দলছুট হলো একমাত্র ব্যান্ড যারা নব্বই দশকের পর এখনও মনে স্থান করে রেখেছেন। নতুবা অন্যান্যগুলো শুধু এসেছেই দুই একটা গান গেয়ে উধাও হয়ে গেছে। তবে ব্ল্যাক আর বাংলা ব্যান্ড দুটির কথা সম্পূর্ণ ভিন্ন। যাই হোক, বাপ্পা মজুমদার আর সঞ্জীব দা মানেই প্রাণের স্পন্দন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় সঞ্জীব দা অকালেই চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। নতুবা আমরা পেতাম আরও কিছু কালজয়ী গান। তোমার বাড়ির রঙের মেলায়, গাড়ি চলেনা, বাজী, ছুঁয়ে কান্নার রং, নাম না জানা মাস্তান গানগুলো কখনও হৃদয় থেকে মুছে যাবার নয়। তাছাড়া আমাদের সুপ্রিয় ব্লগার রানা ভাইয়ের লেখা পরী গানের কথা বিশেষ ভাবে না বললেই নয়।
ব্যান্ডগুলো যখন একটা সময় ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছিলো ঠিক তখনই এলো মিক্সড এ্যালবাম। বিভিন্ন ব্যান্ডের একটি বা দুটি করে গান নিয়ে একটি করে এ্যালবাম বের হতে থাকলো। সে এক অন্যরকম অনভূতি শুরু হলো। বিশেষ করে ক্যাপস্যুল এবং স্ক্র ড্রাইভার এ্যালবাম দুটি ছিলো সেই সময় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। এই মিক্সড এ্যালবাম বলতেই তখন বুঝতাম মূলত প্রিন্স মাহমুদের সুরের কথা। তিনি দি ব্লুজ নামের একটি ব্যান্ডের ভোকালিস্ট ছিলেন বেশ কিছু দিন। এরপর নব্বই দশকের শুরুতে তিনি গঠন করেন ফ্রম ওয়েস্ট নামক একটি ব্যান্ড যেখানে ব্যান্ড লিডার এবং মূল ভোকাল ছিলেন তিনিই। সেই ব্যান্ড এর আলোচিত একটি গান ছিলো রাজাকার আলবদর কিছুই রইবো নারে উপরে দালাল ভিতরে চোর কিছুই হইবো নারে সব রাজাকার ভাইসা যাইবো বঙ্গোপসাগরে গানটি। ফ্রম ওয়েষ্ট এর প্রকাশিত প্রথম অ্যালবাম এর নাম ছিল সে কেমন মেয়ে। পরবর্তীতে তিনি নিজের ব্যান্ড বাদ দিয়ে হাত দেন মিক্সড এ্যালবামের কাজে। একের পর এক উপহার দেন আমাদের মাঝে শক্তি, দাগ থেকে যায়, এখনও দু চোখে বন্যা, ঘৃণা, ক্ষমা, শেষ দেখা, ব্যবধান, ওরা এগারো জন, স্রোত, পিয়ানোর মতো দুর্দান্ত সব এ্যালবাম। এই কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে প্রিন্স মাহমুদের যাদুকরী সব সুরে ব্যান্ডগুলোর জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দিয়েছিলো আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে।
বাংলাদেশের ব্যান্ডের গান যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন এই ব্যান্ডগুলো ইতিহাসের এক একটি উজ্জ্বলতম তারা হয়ে জ্বলজ্বল করে বাংলা গানের আকাশে জ্বলবে। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, গানের প্রতি ভালোবাসা আর শ্রোতাদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে সবসময় বাংলা গানের সম্ভারকে করেছেন সমৃদ্ধ। আজকের এই ভালো ও শ্রুতিমধুর মানসম্পন্ন বাংলা গানের দুর্ভিক্ষের সময়কে কেবলমাত্র এরাই দূর করতে পারেন। তাদের ফিরে আসাটা এবং আবার সেই কাণ্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ দেখার জন্য কোটি কোটি বাংলার মানুষ আশায় বুক বেঁধে আছে। যাদের গান আমাদের মুক্তি দিবে মানহীন বস্তাপচা গানের এই আকালের যুগ থেকে।
সবশেষে জেমসের গানের সুরে সুর মিলিয়ে বলে যাই;
যেদিন বন্ধু চলে যাবো বহু দূরে
ক্ষমা করে দিও আমায়...
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:২১