somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বার্মিজ মার্কেট নয় চাই দেশীয় পণ্যের সমাহার

০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





দেখতে দেখতে আরও একটি বিজয়ের মাস এসে উপস্থিত হয়েছে আমাদের মাঝে। সময় এসেছে প্রোফাইল পিকচারে জাতীয় পতাকার ছবি দেয়ার। বাসা-বাড়ি এবং গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড্ডয়নের এখনই শ্রেষ্ঠ সময়। নইলে আমাদের দেশপ্রেমের চেতনার বহিঃপ্রকাশ হবে না। সারা বছর জুড়ে শহীদ মিনার এবং স্মৃতি সৌধ ভ্রাম্যমাণ পতিতাদের অভয়ারণ্য হলেও এবং গাঁজার আশর জমে উঠলেও বছরের নির্দিষ্ট দিনটিতে খালি পায়ে ফুল হাতে সন্মান প্রদর্শনের মাঝেই আমাদের দেশপ্রেম জাগ্রত হয়। ভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার ইতিহাস থাকলেও আমরা আমাদের দোকানের নাম সততা জেনারেল স্টোর রাখতেই পছন্দ করি। এতে করে ইংরেজীর সাথে বাংলা ভাষার একটা মেলবন্ধন রচিত হয়। কাগজে জাতীয়তার স্থানে বাংলাদেশী লিখতে হলেও আসলে আমাদের কার্যক্রমে আমরা বিজাতীয় চেতনার ধারক এবং বাহক হিসেবে থাকতেই বেশী সাচ্ছন্দ বোধ করি। খুব সম্ভবত এই কারণে গ্লোবালাইজেশন শব্দটা দিয়ে সবকিছু থেকে পরিত্রাণ পেতে চাই।

গ্লোবালাইজেশন খারাপ কিছুই নয়। আমি মোটেও এর বিপক্ষে নই। ট্রিট কিংবা জীলেট নামক ব্লেড থেকে শুরু করে টয়োটা কিংবা টাটা নামক গাড়ি ইত্যাদি যে কোন পণ্য ব্যবহারে কোন বাঁধা নেই। কিন্তু তারমানে এই নয় যে আমাদের দেশীয় পণ্য নিগৃহীত হয়ে পড়ে থাকবে। আমাদের গর্ব করার মতো অনেক পণ্যই রয়েছে। যেমনঃ জামদানী, বেনারসি, পাটজাত দ্রব্য, ওষুধ, প্রসাধনী, পোশাক শিল্প, প্ল্যাস্টিক সামগ্রী, সিমেন্ট, সিরামিক শিল্প, কাঁচ শিল্প, মেলামাইন ইত্যাদি। এগুলোর প্রায় সবকিছুই বিদেশে রপ্তানী করা হয়ে থাকে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়।

কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা নিজেরা আমাদের পণ্য সম্পর্কে কতটা উদার ? নাকি দেশীয় পেঁয়াজ, ডাল, তৈরি পোশাক থাকতেও আমরা ভারতীয় পেঁয়াজ, ডাল আর তৈরি পোশাকে বেশী আসক্ত। আমরা ন্যাশনাল টঙ্গী পাখার চেয়ে বেশী সাচ্ছন্দ বোধ করি জিএফসি পাখা ব্যবহারেই। দেশীয় চলচ্চিত্রের চেয়ে বেশী আগ্রহ আমাদের বিদেশী চলচ্চিত্রের রিভিউ লেখা নিয়ে। যেন এই দেশে ভাল চলচ্চিত্র প্রায় হয় না বললেই চলে ! অথবা আমি যে একজন মুভী প্রেমী তার নমুনা প্রদর্শন হিসেবে বিদেশী চলচ্চিত্রই মুখ্য আর যদি এই দেশের চলচ্চিত্র সম্পর্কে কিছু বলতেই হয় শুধুমাত্র অতীত নিয়ে কিছুটা স্মৃতিচারণা ছাড়া আর কিছুই তেমন ভাল নয় বলেই দ্বায়সারা একটা মনোভাব নিয়ে থাকা। তাইতো ঋত্বিক রোশনরা এই দেশে এসে প্রশ্ন রেখে যাওয়ার সুযোগ পায় কেন বাংলাদেশে তাদের দেশের ছবি মুক্তি পায় না ? যদি মুক্তি পায় তাহলে সে আর স্টেজে নাচবেনা, নাচবে আমাদের সকলকে নিয়েই। আর আমাদের দেশের নায়করা আমাদের কাছে রয়ে যাবে খ্যাঁত হিসেবেই। এই যখন আমাদের অবস্থা তখন বার্মিজ মার্কেট নিয়ে ভেবে দেখার অবকাশ আমাদের হওয়ার কথাও না।

আমরা অনেকেই থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, নেপাল, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, জাপান, চীন কিংবা দুবাই যাই ভ্রমণে। দেশে ফেরার আগে কেনাকাটা করে আনি সেইসব দেশের নাম খোদাই করা পণ্য সামগ্রী। কিন্তু ভেবে দেখার বিষয় হলো আমাদের দেশ থেকে যখন কোন বিদেশী পর্যটক ফিরে যায় তখন তারা কোন দেশীয় পণ্যটা কিনে নিয়ে যায় তাদের সাথে করে তাদের দেশে।

কক্সবাজার হলো দেশের পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অধীক জনপ্রিয় স্থান। আর ভ্রমণের সাথে জড়িয়ে থাকে কেনাকাটার বিষয়টাও। কিন্তু কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে যদি কোন বিদেশী পর্যটক এসে কিছু কেনাকাটা করতে চায় তাহলে সে পাবে বার্মিজ মার্কেট। যাওয়ার আগে সাথে করে কিনে নিয়ে যাবে বার্মিজ আঁচার, চকোলেট, সাবান, স্যান্ডেল ইত্যাদি। তারা চিনবে বার্মিজ পণ্য সামগ্রী। শুধু বিদেশী পর্যটক কেন স্বয়ং আমরা নিজেরাই কক্সবাজার বেড়াতে গেলেই বার্মিজ পণ্য সামগ্রী না কিনে ধন্য হতে পারিনা। যেন বার্মা আমাদের দেশেরই কক্সবাজার জেলার একটি গ্রাম। আমরা না পারলেও বার্মা কিন্তু ঠিকই আমাদের একটা মূল্যবান বাজার দখল করে ফেলেছে অত্যন্ত সুকৌশলে। পুরো কক্সবাজার এলাকাজুড়ে গড়ে উঠেছে বার্মিজ মার্কেট। শুধু পণ্যই নয় পুরো বাজারের নামই রাখা হয়েছে বার্মিজ মার্কেট। আমরা এতটাই বার্মিজ প্রিয় জাতি যে নিজেদের ঐতিহ্যের চেয়ে আমরা বিদেশী ঐতিহ্য ধারণ করতেই বেশী পছন্দ করি।

এসব বার্মিজ পণ্য টেকনাফ দিয়ে আসে চোরাই পথে। খোদ টেকনাফেই আছে বিশাল এক বার্মিজ মার্কেট। এই যখন চোরাকারবারের অবস্থা তখন বার্মিজ মদ, আঁচার, চকোলেট, স্যান্ডেল, সাবান, শ্যাম্পু, পোশাক, মশারি ইত্যাদি পণ্যের মতো রোহিঙ্গারাও করে নিয়েছে তাদের নিরাপদ আশ্রয় স্থল। এমনও দেখা গেছে তাদেরকে এই দেশের নাগরিক সনদপত্র দেয়া হয়েছে স্থানীয় ভাবে, তারা এইদেশে থেকেই বার্মিজ কারেন্সিতে লেনদেনও করছে।

যাই হোক, এই বার্মিজ মার্কেটের ইতিহাস সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো, এক রাখাইন উদ্যোগী মহিলা উনাং তার নিজ বাড়িতে খুবই ছোট পরিসরে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত রাখাইন হস্তশিল্পের কিছু মালামাল-চাদর, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, চুরুট, পুরুষদের লুঙ্গি আর টুকিটাকি জিনিস পত্রের পসরা সাজিয়েছিল। সেখান থেকেই আজকের এই সর্বজন স্বীকৃত বার্মিজ মার্কেটের সূচনা।

যদিও শুরুতে দোকানগুলোতে বার্মিজ কোন পণ্য ছিল না কিন্তু পরবর্তীতে বার্মিজ পণ্য যেমনঃ লুঙ্গি, থামি, স্যান্ডেল, আঁচার, বাম জাতীয় ভেসজ, স্নেখা, বিভিন্ন জাতের পাথর এবং বার্মিজ হস্তশিল্পের কাঠের ও ঝিনুকের তৈরী বিভিন্ন সৌখিন জিনিস সংযোজন হতে থাকে এবং বার্মিজ মার্কেট নামের পরিপূর্ণতা লাভ করে। যদিও বলা হয়ে থাকে এটা মূলত রাখাইন উপজাতিদের দ্বারা পরিচালিত কিন্তু মনে প্রশ্ন জাগে তাহলে কেন এর নাম রাখাইন মার্কেট না হয়ে বার্মিজ মার্কেট রাখা হলো ? এই রাখাইনদের সম্পর্কে যা জানা যায়, এরা মূলত আরাকান উপজাতি। তাহলে কি এটা বার্মিজদের কোন সুদূর প্রসারী বাণিজ্যিক প্রক্রিয়া নয়; যা আমরা আমাদের স্বভাব জাত কারণে টোপ হিসেবে গিলে নিয়ে এখন তার বৈধতা দিয়ে চলেছি।

আমরা কক্সবাজারে বিদেশী পর্যটকদের কাছে দেশীয় পণ্য তুলে দেয়ার বদলে তুলে দিচ্ছি বার্মিজ পণ্য। নিজেদের পরিচিতির চেয়ে যেন আমাদের কাছে মূখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বার্মিজ পণ্য তুলে ধরার প্রয়াস। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো জাতীয় পর্যটন নিয়ে যে ওয়েব সাইটটি আছে সেখানেও কক্সবাজারের বিশেষ আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে এই বার্মিজ মার্কেট সম্পর্কে। যেন এটা আমাদের জাতীয় পর্যায় অত্যন্ত গৌরবের একটি বিষয় !

আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সামান্য কিছু আঁচার আর স্যান্ডেল কিংবা মদ বেঁচে বার্মা আমাদের কাছ থেকে কি আর তেমন অর্থনৈতিক ভাবে লাভবান হচ্ছে। থাকনা ওরা এভাবেই। পাছে আমরা ওদের ওখানে না গিয়েওতো সহজেই ওদের পণ্য পেয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ভেবে দেখার বিষয় হলো ওরা কি এভাবে আমাদের পণ্য পাচ্ছে ? আমরা কি এভাবে ওদের বাজার দখল করতে পেরেছি? বিষয়টা পণ্যের সাথে সাথে আমাদের সামগ্রিক জাতীয়তা বোধেরও।

বার্মিজ পণ্য আমাদের বাজারে পাওয়া যেতেই পারে কিন্তু সেটার পরিচিতি কেন জাতীয় পর্যায় হবে ? এটা আমাদের কেমন ধরনের জাতীয়তাবোধ। তারচেয়ে বরং কক্সবাজারের মতো পৃথিবী বিখ্যাত একটি স্থান হোক আমাদের একান্ত নিজস্ব দেশীয় পণ্যের একটি স্থান। যার নাম হবে বাংলাদেশী মার্কেট। সেখানে পাওয়া যাবে দেশীয় সব তৈরি পোশাক, গহনা, জামদানী কিংবা বেনারসি, মনিপুরী, সাঁওতাল আর চাকমাদের তৈরি পোশাক, হস্তশিল্প, পাটজাত পণ্য, দেশীয় আঁচার আর চকোলেট। বিদেশ থেকে আমরা যেমন সামান্য চাবির রিং কিনে আনলেও দেখি সেখানে সেইসব দেশের নানা উল্ল্যেখ যোগ্য স্থান শোভিত রয়েছে তেমনই যেন কোন বিদেশী পর্যটক এই দেশ থেকে ৫৫৫ লেখা চাবির রিং না কিনে; যাওয়ার আগে সাথে করে কিনে নিয়ে যেতে পারে বগুড়ার মহাস্থানগড় কিংবা কুমিল্লার ময়নামতি অথবা সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চিত্র।

বিজয়ের মাসে এই হোক তবে নব প্রত্যয়। বার্মিজ মার্কেট নয় চাই দেশীয় পণ্যের সমাহার। হৃদয়ে সদা জাগ্রত থাকুক জাতীয়তা বোধ।




সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১:৩৫
৩৫টি মন্তব্য ৩৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসান মাহমুদ গর্ত থেকে বের হয়েছে

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১২


যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল হাসান মাহমুদের সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে। আমি ভাবতেও পারি নাই উনি এতো তারাতারি গর্ত থেকে বের হয়ে আসবে। এই লোকের কথা শুনলে আমার গায়ের লোম... ...বাকিটুকু পড়ুন

দারিদ্রতা দূরীকরণে যাকাতের তাৎপর্য কতটুকু?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:১৮



দরিদ্র দূরীকরণে যাকাতের কোনো ভূমিকা নেই।
যাকাত দিয়ে দারিদ্রতা দূর করা যায় না। যাকাত বহু বছর আগের সিস্টেম। এই সিস্টেম আজকের আধুনিক যুগে কাজ করবে না। বিশ্ব অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শেখস্তান.....

লিখেছেন জুল ভার্ন, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:১৫

শেখস্তান.....

বহু বছর পর সম্প্রতি ঢাকা-পিরোজপু সড়ক পথে যাতায়াত করেছিলাম। গোপালগঞ্জ- টুংগীপাড়া এবং সংলগ্ন উপজেলা/ থানা- কোটালিপাড়া, কাশিয়ানী, মকসুদপুর অতিক্রম করার সময় সড়কের দুইপাশে শুধু শেখ পরিবারের নামে বিভিন্ন স্থাপনা দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের বিয়ের খাওয়া

লিখেছেন প্রামানিক, ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:৪৮


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

১৯৬৮ সালের ঘটনা। বর আমার দূর সম্পর্কের ফুফাতো ভাই। নাম মোঃ মোফাত আলী। তার বিয়েটা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাবা ছিলেন সেই বিয়ের মাতব্বর।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে মৈত্রী হতে পারে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৫ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০০


২০০১ সাল থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে, গত ১৫ বছরে (২০০৯-২০২৪) আওয়ামী লীগ সুদে-আসলে সব উসুল করে নিয়েছে। গত ৫ আগস্ট পতন হয়েছে আওয়ামী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×