[১]
রাজধানীর হাতিরঝিল, মিরপুর ডিওএইচএসের মত ব্যাস্ততম রাস্তার ফুটপাথ কিংবা বন্যা হতে রক্ষার জন্য দেয়া নদী তীরের বাঁধই হলো বর্তমান কালের উত্তম বিনোদন কেন্দ্র। আসলে কংক্রিটময় যান্ত্রিকতার কোলাহলে পূর্ণ এই নগর তার নগরবাসীর বিনোদনকেও করে তুলেছে যন্ত্রণা প্রিয় করে। যেখানে কোথাও প্রাকৃতিক পরিবেশে বসে পাখিদের কিচিরমিচির শোনার চেয়ে গাড়ির কালো ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত হয়ে হর্ণের শব্দ শোনার মাঝেই যেন প্রকৃত সুখ নিহিত। সব বয়সের মানুষের আনাগোনায় মুখরিত হয়ে থাকে এইসব রাস্তাগুলো। এইসব স্থানে স্যূপ থেকে শুরু করে চটপটি ফুসকা সবই পাওয়া যায়। এইযে আমি বসে আছি; আমার কাছে মনে হচ্ছে যেন আমি লন্ডনের টেমস নদীর তীরে বসে বাদাম চিবাচ্ছি !
স্যার, গান শুনাই ?
গান শুনাবি ! কি গান শুনাবি ?
হিন্দি, বাংলা যেইটা স্যার শুনতে চান ?
আচ্ছা তাইলে একটা হিন্দি গান শুনা।
ছেলেটা সাথে সাথে গান ধরল,
লেজা লেজা সোনিয়ে লেজা লেজা...
গানের সাথে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ছেলেটা নিজেই তার হাততালি দিচ্ছে। চমৎকার ছন্দময় হাততালি। বাদ্যযন্ত্রেও মাঝে মাঝে ছন্দের পতন হয় কিন্তু হাততালিতে ছন্দ পতন হওয়ার অবকাশ নেই। দুই সহোদর হাত একে অপরের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগে আবেগে আত্মহারা হয়ে উঠে। নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়ার উল্লাসে মেতে উঠে। এরই মধ্যে নাচাও শুরু হয়ে গেছে। গান আর নাচ হলো মাথা আর কানের মত। কান টানলে মাথা আসবেই। আমি কিছু না বলার আগেই; হিন্দি গান শেষ হতেই ছেলেটা শুরু করল একটা বাংলা গান।
একবার যদি কেউ ভালোবাসত, আমার নয়ন দুটি জলে ভাসত...
এই দুঃখের গানের সাথেও হাততালি বাজানো হচ্ছে, সাথে থেমে নেই নাচও। দুঃখের গানের সাথে নাচ ঠিক মানায় কিনা আমার জানা নেই ? তবে দেখতে বেশ ভালই লাগছে। পুরো ব্যাপারটাই বিশেষ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। স্বয়ং বেহুলা তার স্বামী লক্ষ্মীন্দরের জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য দেবতাদের তুষ্ট করতে নেচেছিলো। অতএব নাচ অনেক তাৎপর্য পূর্ণ একটি বিষয়। নাচে যেখানে দেবতারা পর্যন্ত তুষ্ট হয়, সেখানে আমি এক পাপী বান্দা তুষ্ট না হয়ে আর উপায় কি ! ক্লাসিক্যাল কিছু নাচের মুদ্রা আছে যেখানে চোখ, হাত আর পা দিয়ে জীবনের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ প্রকাশ করা যায়। হয়ত তেমন কোন ক্লাসিক্যাল নৃত্যশিল্পী হলে চোখে কাজল, হাতে চুরি, পায়ে নূপুর আর পায়জামার মত করে শাড়ি পেঁচিয়ে পরে দুঃখের এই গানটিকে একটি ক্লাসিক্যাল রুপ দান করতে পারত। তবে এই ছেলেটি যেভাবে হাত পা ছুড়ে নাচছে তাতে করে আমার মনে হয় বাংলা সিনেমার কোরিওগ্রাফারদের এর কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখার আছে।
গান আর নাচ শেষ হলো। স্যার, বিশ টাকা দেন। শুধু গান গাইলে দশ টাকা নিতাম। সাথে নাচও দেখাইছি। নাচের জন্য আরও দশ টাকা।
প্রতি গানের জন্য কি পাঁচ টাকা করে নিস ?
ছেলেটা অদ্ভুত ভঙ্গীতে হেসে ফেলল। হাসির সাথে অকৃত্রিম লজ্জা জড়ানো। এই হাসিকে বলা যেতে পারে ‘বিসমিল্লাহ্ হাসি’। বেহেশতে যে ঝর্ণা থেকে নহরের উৎপত্তি হয়ে পানি প্রবাহিত হয় তার নাম বিসমিল্লাহ্। এই হাসি তেমনি অনাবিল অমৃত স্বর্গীয় পানির উৎপত্তি স্থলের মত।
তোর নামি কি ?
আব্দুর রহিম পল্টু। স্যার আমার নামডা সুন্দর না খুব ? আমার বাবায় রাখছিল। আর মায় ডাকত পল্টু কইয়া। পল্টু কোন নাম হইল ? স্যার আপনেই কন দেহি !
ছেলেটা নিজেই নিজের নাম নিয়ে একটা ছড়া করেছে।
পল্টু, তোর মাথায় নাই কোন বল্টু !!
পল্টু, শোন তোর পুরো নামটা আসলেই খুব সুন্দর। আমরা সবাই মহান আল্লাহ পাকের গোলাম। তোর নামের অর্থ ঠিক তাই। এই কথায় পল্টুর মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। সে নাচতে নাচতে তার নাম নিয়ে করা ছড়াটাই বলতে শুরু করল।
পল্টু, তোর মাথায় নাই কোন বল্টু...
পল্টু, তোর বাবা কি করে ?
স্যার, আমার বাপ নাই; মইরা গেছে।
তোর মা ?
মায় আরেক ব্যাডার লগে বিয়া বইছে। হেই ব্যাডারে আমি কহনও দেহিও নাই আর মনের ভিতর দেহার ইচ্ছাও জাগে নাই কোনকালে।
তোর কি এভাবে গান গেয়ে চলে ?
না, স্যার। সবাই কি আর গান শুনতে চায় ! বেশিরভাগেই বিরক্ত হয়। অনেকে আছে মশকরা করে। দুই একজনে আছে আপনার লাহান গান শুইনা খুশি হইয়া টাকা দেয়। মাঝে মাঝে ভিক্ষা করি। মাঝে মাঝে মানুষের মাথা বানায় দেই। স্যার, আমি খুব ভাল মাথা বানাইতে পারি। আপনার মাথা বানায় দেই।
না, মাথা বানিয়ে দেয়া লাগবেনা। আমার সাথে চল।
মনোয়ার সাহেব বিশাল হৃদয়ের একজন মানুষ। পথশিশুদের জন্য একটি দাতব্য সংস্থা খুলেছেন। বিশাল এক অফিস নিয়েছেন। পুরো অফিসের ইন্টেরিওর ডেকোরেশন করিয়েছেন হাইফাই ভাবে। চারিদিকে মেঝে থেকে ছাঁদ পর্যন্ত গ্লাস, মেঝেতে দামী মার্বেল পাথরের কাজ, পুরো অফিস সেন্ট্রাল এসি, অফিসের প্রতিটা কর্মকর্তার ডেস্কে আছে ল্যাপটপ। কর্মকর্তারা সবাই যে যার ডেস্কে বসে ল্যাপটপ নিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজে ব্যাস্ত। মনোয়ার সাহেব নিজেও তার কেবিনে ল্যাপটপে কাজ নিয়ে ব্যাস্ত। এইত কিছুদিন আগেই তিনি পথশিশুদের শীতের জ্যাকেট দিয়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। ইংলিশ মিডিয়াম থেকে কয়েকশত ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সাথে নিয়ে তিনি তার এই মহান কাজটি সম্পাদন করেছিলেন। প্রতিটা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে তার দাতব্য সংস্থার লোগো সম্বলিত গ্যাঞ্জি পরিয়ে রাস্তায় নামিয়ে দিলেন পথশিশুদের হাতে শীতের জ্যাকেট তুলে দেয়ার জন্য। তারপর ইংলিশ মিডিয়ামের সেইসব ছাত্র-ছাত্রীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য পারিশ্রমিক হিসেবে ফাইভ স্টার হোটেলে বুফে খাওয়ালেন। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর টিভি চ্যানেলগুলোর সংবাদের কাভারেজ ছিলো দেখার মতই একটা বিষয়। ইংলিশ মিডিয়ামে সাধারনত বিত্তবানদের ছেলে-মেয়েরাই পড়াশোনা করে। কারন এইসব স্কুল কিংবা কলেজে ইংরেজি শেখাটা ভীষণ ব্যায়বহুল। আর মনোয়ার সাহেব তার এই মহান কাজের জন্য এদেরকেই ভলান্টিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন কারণ এদের কাছে এই ধরনের দাতব্য কাজ এখন অনেকটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকটা দামী কোন রেস্টুরেন্টে বসে হাজার টাকার খাওয়া দাওয়ার পর ওয়েটারকে ডেকে বিল দিয়ে; কিপ দ্যা চেঞ্জ বলার মতই একটা কাজ। বিত্তবানদের যে শুধু বিত্তই আছে তা নয় বৃহৎ মনও আছে; বিত্তের সাথে সেই বৃহৎ মনেরও একটা আত্মপ্রকাশ করা আরকি !
আমি আর পল্টু মনোয়ার সাহেবের অফিসে তার কেবিনে তার সামনে বসে আছি।
আপনার নাম ?
স্যার, আমি গোলাপ ভাই।
মনোয়ার সাহেব মোটা ফ্রেমের চশমা পরে আছেন। চশমার ফাঁক দিয়ে তার ভ্রুযুগল কুঁচকিয়ে জিজ্ঞাস করলেন হোয়াট ডু ইউ সে ?
আমি বললাম স্যার, গোলাপ ভাই। লোকে আমাকে এই নামেই ডাকে। আসলে আমার নাম গোলাপ কিন্তু লোকে গোলাপের সাথে ভাই লাগিয়ে ডাকে। সবার সাথে ভাই ভাই সম্পর্ক থাকাটা অত্যন্ত জরুরী। সকল মুসলমান ভাই ভাই। তাছাড়া ভাই বললে একটা আত্মিক সম্পর্কও তৈরি হয়ে যায়। তবে যেহেতু স্যার, সকল মুসলমান ভাই ভাই; তাই হিন্দু, বৌদ্ধ আর খ্রিষ্টান এরা ভাই হতে পারেনা। এরা হবে ফ্রেইন্ড।
এবার তার ভ্রুযুগল আরও কুঁচকে এলো। চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে তিনি আমাকে বললেন ডোন্ট ট্রাই টু বি ভেরী স্মার্ট উইথ মি। হোয়াটস ইউর নিড ?
জী স্যার, এই ছেলের নাম আব্দুর রহিম পল্টু। বাবা নাম রেখেছেন আব্দুর রহিম। অর্থাৎ মহান আল্লাহ পাকের গোলাম আর মা রেখেছেন পল্টু। পল্টু, যার মাথায় নাই কোন বল্টু। তবে স্যার পল্টুর মাথায় আসলে কিন্তু অনেক বল্টু আছে, যা সে নিজেও জানেনা। পল্টুর বাবা মারা গেছে, মা আরেকটি বিয়ে করেছে। স্যার, আপনিত অনেক পথশিশুদের জন্যই অনেক কিছুই করেছেন। এর জন্যেও কিছু করতে পারেন। পল্টুকে যদি ভাল নাচ-গান করার সুযোগ করে দেন, তাহলে সে অবশ্যই একদিন এইদেশের একজন বড় শিল্পী হতে পারবে। অনেক প্রতিভাবান একটি ছেলে।
লুক ! মিঃ গোলাপ দিস ইজ নট এনি কাইন্ড অফ প্লেস ফর মেকিং জোক্স।
অবশ্যই স্যার। আমি কোন জোক্স করছিনা না। পল্টু এতিম একটা ছেলে। আপনি চাইলে প্রমাণ স্বরূপ সিটি কর্পোরেশন থেকে ওর বাবার ডেথ সার্টিফিকেট এনেও আপনাকে দেয়া যাবে। পল্টু খুব সুন্দর নাচ-গান করতে পারে। ওকে স্যার আপনি একবার সুযোগ করে দিলেই এই এতিম শিশুটি বেঁচে যায়। দেশও পায় একজন ভবিষ্যৎ গুণী শিল্পীকে। নাহলে এমন প্রতিভা শুধুমাত্র অর্থের অভাবে অকালেই ঝারে যাবে। আর আপনি নিশ্চয় এমনটা আপনার চোখের সামনে হতে দিতে চাইবেন না ! এই পল্টু স্যারকে নাচ-গান করে দেখা।
পল্টু হাততালি বাজিয়ে নাচের সাথে গান ধরেছে।
আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান, সেদিন থেকে গানই জীবন, গানই আমার প্রাণ...
মনোয়ার সাহেব বেশ চটেছেন। পারলে হাতের কাছের ল্যাপটপটাই আমার মাথায় ভাঙবেন এমন একটা অবস্থা।
স্যার, পল্টু খুব ভাল মাথা বানাতে পারে। আপনার মাথাটা বানিয়ে দিক। মনে হচ্ছে আপনি খুব রেগে যাচ্ছেন। রেগে গেলেন, তো হেরে গেলেন। এই পল্টু নাচ-গান বন্ধ। স্যারের মাথাটা খুব সুন্দর করে বানিয়ে দে। স্যার চাইলে তোকে খুব ভাল স্পার কারিগর হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ করে দিতে পারেন। স্যারকে খুশি করতে পারলেই তোর ভাগ্য খুলে যাবে। তখন দেখবি ভাল মাথা বানায় যে, গাড়ি-ঘোড়ায় চরে সে।
মিঃ গোলাপ ডোন্ট মেক মি বাউন্ড টু পুশ ইউ থ্রো আউট দ্যা ডোর। জাস্ট গেট লস্ট !
আমাদের দেশে ইংরেজিটা আসলে মনোয়ার সাহেবদের মত অভিজাত সমাজসেবক শ্রেণীর মানুষদের মুখেই মানানসই। আমার মত মানুষ ইংরেজি বললে মনে হবে; ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম। মনোয়ার সাহেব যেভাবে ইংরেজি বলা শুরু করেছেন তাতে করে তার রাগ সহজে কমবে বলে মনে হচ্ছেনা। এই শ্রেণীর লোকেরা বেশিরভাগ সময়ে ক্ষেপে গেলে ইংরেজি বলা শুরু করে। তখন আর এদের রাগ সহজে কমে না। বরং ভেতরের যত ইংরেজি আছে বের হয়ে না আসা পর্যন্ত রাগ বাড়তেই থাকে।
এমন অবস্থায় এই ধরনের মানুষের রাগ হঠাৎ করে থামিয়ে দেয়ার জন্য একটাই ওষুধ আছে। আচমকা ঠাশ করে গালে একটা চড় মারা। আমি সাধারনত এমন আরোগ্য দানে দেরী করিনা। গালে ঠাশ করে একটা চড় দিয়েই পল্টুকে নিয়ে বের হয়ে এলাম।
[২]
পল্টু, আমার আবার চা আর সিগারেট খাওয়ার খুব নেশা আছে । রোজ সাকিলের দোকান থেকে চা আর সিগারেট না খেলে আমার রাতে ঘুম আসেনা। যদি কখনও বেহেশতে যেতে পারি সাকিলের চায়ের দোকানের একটা শাখা খুলে দিব। চল তোকে সাকিলের দোকানের চা খাওয়াই।
সাকিল উদাস ভঙ্গিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝলাম আজকে সারাদিন তার ব্যবসা মন্দা গেছে। সাকিল দুই কাপ চা দে।
ভাইজান আপনার আগের অনেক বাকি পইরা গেছে। আগে হেগুলা মিটাইয়া লন। তারপর চা দিমু।
কি সাংঘাতিক কথা সাকিল। তুই আমার কাছে টাকা চাইছিস । তুই জানিস না আমি বেকার।
বেকার হইছেন তয় এত চা, সিগারেট খান কেন!
আহা তুই এইসব কি বলিস বেকার মানুষদের কি চা, সিগারেট খেতে নেই ? তুই চা খাওয়াতে পারবিনা তোঁ কি হয়েছে । আমি অন্য দোকান থেকে চা খাব। দোকানের কি অভাব আছে নাকিরে!
এহ! যান দেহি আপনার মত বেকাররে কে এমন ফিরিতে চা খাওয়ায় আমি দেখমুনে।
বলছিস তাহলে যাই তোর দোকান থেকে আর চা খাব না ।
কিন্তু আমি জানি এই দুনিয়ায় সাকিল ছাড়া আমাকে আর কেউ এভাবে বছরের পর বছর ফ্রিতে এই রকম যন্ত্রণা পেয়ে চা, সিগারেট খেতে দিবেনা । দুনিয়াটা অনেক কঠিন এক জায়গা । এখানে সাকিলের মত কিছু মানুষ আছে বলেই আমার মতো গোলাপরা এখনো টিকে আছে।
সাকিল ঠিক আছে এইবারের মত একটা সিগারেট দে আর পল্টুকে এক কাপ চা দে। আমি আর তোর দোকানে এসে কখনও জ্বালাতন করব না।
সাকিল একটা না; পুরো এক প্যাকেট সিগারেট দিয়ে একটা হাসি দিলো। যেন এমন সুখের , এমন খুসির কথা এর আগে সে কারো কাছ থেকে শুনে নাই।
এইটা আপনার কি হয় ?
কিছু হয়না; মনে হলো ছেলেটাকে সাথে নিয়ে একটু ঘোরাঘুরি করি, তাই ঘুরছি।
আপনে ভাইজান আসলেই একখান চীজ ! আপনার লীলা বোঝা কোন সহজ কাম না। তয় ভাইজান আপনে মানুষটা খুব ভালা।
তমিজুদ্দিন মোল্লা সাহেবের একটা মেসে আমি একটা রুম ভাড়া করে থাকি। মেসের ভাড়া আজ প্রায় সাত আট মাস বাকি পরে আছে দেয়া হয়না। এই নিয়ে মোল্লা সাহেব বেশ কয়েক বার চিৎকার চ্যাঁচামেচি করে গেছেন কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হয় নাই। চাচার একমাত্র মেয়ে খুব ছোট বেলায় হারিয়ে যায়। সেই শোকে একসময় তার স্ত্রী দীর্ঘদিন মানসিক রোগে ভুগে মারা যান। কিন্তু চাচা এখনও তার মেয়ের অপেক্ষায় আছেন। তার বিশ্বাস একদিন তিনি ঠিকই তার মেয়েকে খুঁজে পাবেন এবং তার সহায় সম্পত্তি সব মেয়ের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে তিনি নিশ্চিন্তে মৃত্যু বরণ করতে পারবেন। এবং তিনি এও বিশ্বাস করেন যে, তার মেয়ের বিয়েটাও তিনি নিজ হাতে করিয়ে যেতে পারবেন। বয়সে আমার মুরুব্বী বলে মোল্লা সাহেবকে আমি চাচা বলেই ডাকি। তবে মামা বলে ডাকি না। কারণ মামা বলে যে কোন বয়সের মানুষকেই ডাকা যায়। রিক্সাওয়ালা, চাইয়ের দোকানদার, বন্ধু সবাইকে মামা বলে ডাকা গেলেও চাচা বলে ডাকা যায় না। চাচা বলে কেবল মুরুব্বী টাইপ মানুষকেই ডাকা যায়। সেই সূত্রে আমার মেস মালিক মোল্লা সাহেবকে আমি চাচা বলেই ডাকি। চাচাকে আমি আসস্থ করেছি তার মেয়েকে আমি খুঁজে বের করে এনে দিব। এই জন্য তার কাছ থেকে মেসের ভাড়া অনাদায় নিয়ে তেমন বিপাকেও আমাকে পড়তে হয়না তেমন একটা।
এই মেসেরই শেষ মাথায় একটা রুম আছে যেখানে যূথী ভাড়া থাকে। মাঝে মাঝে যূথী এসে আমাকে খাবার দিয়ে যায়। তাতে অবশ্য আমি কোন আপত্তি করিনা। আমি মাঝে মাঝে মেয়েটির সরল মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। যেন আমার মায়ের মত ভরা পূর্ণিমার রূপ এসে এক অপরূপ মায়া ভরিয়ে দিয়ে গেছে মেয়টির পুরো মুখশ্রীতে।
যুদ্ধের সময় পাক সেনারা আমার মাকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত আর আমার মায়ের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমার বাবা তার কিছুদিন পরেই পাগল হয়ে যান। একটা সময় তার পাগলামি এমন পর্যায় গিয়ে দাঁড়ায় যে তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। তার চিকিৎসার জন্য বাড়িতে প্রায়ই এক কবিরাজকে আনা হতো। কবিরাজ এসেই বাবাকে লাঠি দিয়ে প্রচণ্ড রকম মারা শুরু করত। এতে নাকি পাগল সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু বাবা আর কখনও সুস্থ হলেন না। বরং তিনি ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লেন। একটা সময় বুঝতে পারি আমার বড় চাচা ছিলেন একজন রাজাকার। মূলত পুরো সম্পত্তি একাই গ্রাস করার জন্য সবটাই ছিলো তার সুগভীর এক ষড়যন্ত্র। আমার মাকেও তিনিই পাক সেনাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। আমার বাবা মোটেও পাগল ছিলেন না। কিন্তু তাকে ক্রমাগত পাগল বানিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিলো। আমি পরবর্তীতে মানুষ হই আমার তিন খালার কাছে। খালাদের কাছে আমি পালা করে থেকে মানুষ হয়েছি। তবে প্রকৃত মানুষ হয়ত হতে পারিনি। তবে যদি গঠনের দিক দিয়ে বলা হয় তাহলে বলতে হবে মানুষ। নতুবা আমাকে আসলে মানুষ বলা যায় কিনা এই বিষয়ে আমার নিজেরই যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তবে মানুষের কাছে আমি এখন গোলাপ ভাই।
[৩]
যূথীর ঘরের দরজা খোলাই আছে। যূথী কি ঘরে আছো ?
এইতো আছি, আসেন।
যূথী, আজ তুমি কাজে যাও নি ?
না, আজ ছুটি। মাঝে মাঝে ছুটির প্রয়োজন আছে। নাহলে শরীর ফিট থাকেনা। আর আমার যে পেশা, তাতে শরীর ফিট রাখাটা খুবই জরুরী।
সবাই জানে যূথী একটা গার্মেন্টসে কাজ করে। কিন্তু সে শুধু আমাকেই সত্যটা বলেছে। আমার কাছে নাকি কোন প্রকার মিথ্যা বলতে গেলেই তার বুক কাঁপে। কিন্তু কেন কাঁপে তার কোন কারণ সে জানে না। যূথী নিজেকে হুর বলে মনে করে। বেহেশতে যেমন হুর আছে, তেমনই পৃথিবীর হুর হলো যূথী।
যূথী আজ কি রান্না করেছো ?
তেমন কিছুই না। আজকে শুধু আলু ভর্তা। বাজারে এখন মাছ ,সবজী, চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ এমন কি কাঁচা মরিচের যে দাম তাতে করে আমাদের মত মানুষদের এখন বেঁচে থাকাটাই পাপের কাজ হয়ে গেছে।
ওহ! চমৎকার। দাও আমাকে আর পল্টুকে খেতে দাও। আর শোন পল্টুকে কদিনের জন্য তোমার এখানে রাখো। ভাল কোন ব্যবস্থা হলেই আমি এসে ওকে নিয়ে যাবো।
আমার স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে ভাল করেই যূথীর জানা আছে। তাই কোনরূপ প্রশ্ন না করেই পল্টুকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল আয় ভাই তোর আর কষ্ট করে নিজ হাতে খাওয়া লাগবেনা। দে দেখি আমি খাইয়ে দিচ্ছি। যূথী পল্টুর মুখে ভাতের নলা তুলে দিচ্ছে। আর পল্টুও চোখ বন্ধ করে গিলছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন বড় বোন তার একমাত্র আদরের ছোট ভাইটিকে মুখে তুলে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে।
আরে গোলাপ নাকি ?
চাচা স্লামুয়ালাইকুম !
ওয়ালাইকুম আসসালাম ! তা এতদিন পর কোন সাগর থেকে ডুব দিয়া ফিরলা ?
চাচা এবার গিয়েছিলাম পদ্মা সাগরে ডুব দিতে।
দেখো গোলাপ ফাইজলামি করবানা। আমি মোটেও ফাইজলামি করা পছন্দ করিনা। আমার মেয়ের কোন সন্ধান পেয়েছো ?
জী চাচা পেয়েছি। তবে কিছু সময় লাগবে তাকে আপনার সামনে হাজির করতে।
কি বলছো ! সত্যি তুমি আমার মেয়ের খোঁজ পেয়েছো ?
জী চাচা সত্যি আমি আপনার মেয়ের খোঁজ পেয়েছি।
তাহলে আবার সময় লাগবে কেন ? চল আজই আমরা দুজনে যেয়ে মেয়েটাকে নিয়ে আসি।
চাচা এতকাল যখন অপেক্ষা করেছেন তখন না হয় আর কিছুদিন অপেক্ষা করলেন। এতে করে আর আপনার মেয়েকে হারাতে হবেনা। নতুবা হুট করে মেয়ের সামনে হাজির হলে হয়ত চিরদিনের জন্যই মেয়েকে হারিয়ে ফেলবেন।
চাচার মুখটা হঠাৎ বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল। চাচা শুনুন আমরা মানুষ বড়ই বিচিত্র। আমরা কাকতালীয় বিষয়ে বিশ্বাস করি। কিন্তু কোন কিছুই যে আসলে কাকতালীয় নয় এটা মানতে চাইনা। আমাদের জ্ঞান আর দৃষ্টির অগোচরে হয় এমন কিছুই আসলে কাকতালীয় কিন্তু সব কিছুরই যথাযথ কারণ আছে। শুধু আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। তবে আমরা তারপরেও কাকতালীয় ভেবেই আনন্দিত হতে পছন্দ করি। আমরা লৌকিকতার চেয়ে অপার্থিবতাকেই বেশি প্রাধান্য দেই। অনেক সময় জেনেও না জানার ভান করে থাকি নিজের পারিপার্শ্বিক অবস্থানের কথা ভেবে। অনেক সময় আত্মগ্লানিতে ভোগার জন্য এমনটা হয়ে থাকে। তবে আমরা সময়ের উপর বিশ্বাসী বলেই আশা নিয়ে বেঁচে থাকি। এখন এই মুহূর্তে যা সুখের চেয়ে দুঃখই বেশি বয়ে আনবে, সময় তাকে পরিপূর্ণ সুখ দান করবে। আপনার মেয়ের বিষয়েও ঠিক তাই। আমি জানি আপনিও আপনার মেয়ের সন্ধান জানেন। কিন্তু আপনিও সময় নিচ্ছেন তাকে ফিরে পাওয়ার জন্য। আমরা অনেক সময় সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে ভীষণ ভয় পাই। আপনার ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। আর এই কারনেই আপনি সঙ্গী হিসেবে আমাকে চাইছেন।
মোল্লা সাহেবের বিষণ্ণ মুখে এখন বর্ষার কালো মেঘ ভর করেছে। হালকা বাতাস লাগলেই তিনি এখন কাঁদতে শুরু করবেন। তবে এখনই তাকে কাঁদিয়ে কান্নার আনন্দটা নষ্ট করতে চাইছিনা। কিছু কান্না আছে আনন্দ নিয়ে কাঁদতে হয়। এই জন্য বিশেষ আয়োজনের দরকার হয়। চাচা চলেন মেঘনার তীর থেকে দুজনে মিলে ঘুরে আসি। মেঘনার তীরে বাঁধের উপর জমে থাকা কচুরিপানার উপর বসে নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে সন্ধ্যা দেখবো।
চাচা আপনি কি কবি হুমায়ুন কবিরের লেখা মেঘনায় ঢল কবিতাটি জানেন ?
না, বল শুনি।
আমি সাথে সাথে আবৃত্তি শুরু করলাম।
শোন মা আমিনা, রেখে দে রে কাজ
ত্বরা করে মাঠে চল,
এল মেঘনায় জোয়ারের বেলা এখনি নামিবে ঢল।
নদীর কিনার ঘন ঘাসে ভরা
মাঠ থেকে গরু নিয়ে আয় ত্বরা
করিস না দেরি--আসিয়া পড়িবে সহসা অথই জল
মাঠ থেকে গরু নিয়ে আয় ত্বরা মেঘনায় নামে ঢল।
এখনো যে মেয়ে আসে নাই ফিরে--দুপুর যে বয়ে যায়।
ভরা জোয়ারের মেঘনার জল কূলে কূলে উছলায়।
নদীর কিনার জলে একাকার,
যেদিকে তাকাই অথই পাথার,
দেখতো গোহালে গরুগুলি রেখে গিয়েছে কি ও
পাড়ায় ?
এখনো ফিরিয়া আসে নাই সে কি ? দুপুর যে বয়ে যায়।
ভরবেলা গেলো, ভাটা পড়ে আসে, আঁধার জমিছে আসি,
এখনো তবুও এলো না ফিরিয়া আমিনা সর্বনাশী।
দেখ্ দেখ্ দূরে মাঝ-দরিয়ায়
কাল চুল যেন ঐ দেখা যায়--
কাহার শাড়ির আঁচল-আভাস সহসা উঠিছে ভাসি ?
আমিনারে মোর নিল কি টানিয়া মেঘনা সর্বনাশী ?
সন্ধ্যা হতে এখনও প্রায় ঘন্টা দুয়েক সময় আছে। এরই মধ্যে আমরা পৌঁছে যেতে পারব।
চল, ড্রাইভারকে তাহলে আমার গাড়িটা বের করতে বলে দিচ্ছি। আর আচ্ছা ভাল কথা আজকেই কি আমরা আবার ফিরে আসবো ? নাকি ওখানে কোথাও থেকে যাবো ?
থেকে যাবো। রাতের বেলায় জেলেরা নৌকা নিয়ে বের হয় মাছ ধরতে। আমার এক পরিচিত মাঝি আছে তালেব মিয়াঁ। আমরা ওর নৌকায় করে সারারাত নদীতে কাটিয়ে দিব। মাছ কিছু পেলে পেলাম; আর না পেলেও কোন সমস্যা নেই। তালেব মিয়াঁ খুব চমৎকার গান গায়। গান শুনে জোছনা দেখতে দেখতে ভোরে মাঝ নদীতে সূর্য উঠা উপভোগ করব। আচ্ছা চাচা বেহেশতে যে নহর বইবে ওখানে কি এমন সুখ নিয়ে মাছ ধরা যাবে ?
গোলাপ তওবা পড়। সব বিষয় নিয়ে ফাইজলামি করতে নাই। ফাইজলামি করাটা তোমার একটা বাজে অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আর যাই কর ধর্ম নিয়া একদম ফাইজলামি করবানা। তওবা পড় শীঘ্রই।
জী চাচা তওবা আস্তাগফিরুল্লাহ।
গোলাপ সাথে কি কিছু খাবার দাবার গাড়িতে করে নিয়ে নিব ?
চাচা অবশ্যই নিতে পারেন। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কাচ্চি বিরিয়ানি আর বোরহানি হলে খুবই ভাল হয়। সাথে অবশ্যই ফিন্নিও নিয়ে নিতে হবে। খাওয়ার পর মিষ্টি খাওয়া সুন্নত। চাচা পাঁচ প্যাকেট বিরিয়ানি, দুই লিটার বোরহানি আর পাঁচ কাপ ফিন্নি অতিরিক্ত নিয়ে নিয়েন। তালেব মিয়াঁকে কথা দিয়েছিলাম কোন এক সময় গিয়ে তাকে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়াবো। তালেব মিয়াঁর তিন মেয়ে আর স্ত্রী সহ পরিবারের মোট পাঁচ জন সদস্য। তালেব মিয়াঁ একা কাচ্চি বিরিয়ানি খাবে আর অন্যরা হা করে তাকিয়ে থাকবে সেটাত আর হয়না। তাই সবার জন্যই আমরা খাবার নিয়ে যাবো। তালেব মিয়াঁর তিন মেয়ের নাম যথাক্রমে নূপুর, ঝুমুর, টুপুর। ওদের মায়ের নাম রুপা। রুপা দিয়ে বানানো নারীর তিন প্রকার অলংকার। মায়ের মতই রুপ পেয়েছে তিনটা মেয়েই।
মোল্লা চাচা এক খিলী পান মুখে নিয়ে চিবাতে চিবাতে গাড়িতে উঠে বসলেন। আমিও চাচার সাথে উঠে বসলাম। চাচা ড্রাইভারকে বলে দিলেন প্রথমে পুরান ঢাকায় যেতে তারপর সেখান থেকে মেঘনা।
[৪]
আমার মাঝে মাঝে কি ইচ্ছা হয় জানো গোলাপ ?
জী না জানিনা না।
ইচ্ছা হয় আত্মহত্যা করি। কিন্তু ধর্মে বলা আছে আত্মহত্যা মহাপাপ তাই করতে পারিনা।
চাচা ইচ্ছাকে কখনও অবহেলা করতে নেই। মানুষ চিরকাল বাঁচেনা। যতদিন বাঁচে যত ইচ্ছা আছে পূরণ করার চেষ্টা করা উচিত।
মানে কি ! তুমি আমাকে পাপ করতে বলছো ?
জী না পাপ করবেন কেন। আপনার যদি আত্মহত্যা করার ইচ্ছা জাগে খুব; তাহলে চাইলে পাপ এড়িয়েও আত্মহত্যা করতে পারেন। মরাও হবে পূণ্যও কামানো হবে। এক ঢিলে দুই পাখি শিকার।
তুমি কি আমার সাথে ফাইজলামি করছো ? দেখো একদম ফাইজলামি করবানা।
ফাইজলামি করছিনা চাচা। আপনার যদি খুব বেশি আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে; তাহলে আপনি আমাকে একটা পিস্তল কিনে দেন। আমি আপনাকে গুলী করে মেরে ফেলি। তাহলেতো আর আত্মহত্যা হলো না। পত্র-পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হবে ভাতিজার হাতে চাচার নৃশংস হত্যা। অথবা যদি আপনি পূণ্য কামাতে চান; তাহলে ফিলিস্তিন কিংবা সিরিয়ায় চলে যেতে পারেন। সেখানে কোন ইসরাইলী ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারেন আর যদি একটা গুলী চলে, আর যদি তোদের হাতে একটা মুসলমান মরে তবে আমি তোদের মারবো। ব্যাস দেখবেন আপনার আত্মহত্যা আর ঠেকায় কে ? আপনার মাথা একদিকে আর দেহ একদিকে। আপনি শহীদ নিশ্চিত।
গোলাপ তুমি আমার সাথে খুব বেশিই ফাইজলামি করতেছো। আমি তোমার বেয়াই হইনা যে তুমি আমার সাথে এভাবে ফাইজলামি করবা।
চাচা শুনুন আসামে একজাতীয় পাখি আছে। এরা দলবেঁধে আগুনে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। পাখিদের খুব সম্ভবত কোন ধর্ম নেই। নতুবা এভাবে তারা দলবেঁধে আত্মহত্যা করতো না। কিন্তু মানুষের ধর্মে আত্মহত্যা মহাপাপ। কিন্তু যদি পাপ না হতো তাহলে পৃথিবীতে প্রায় সব মানুষই দল বেঁধে আত্মহত্যা করতো।
আত্মহত্যা নিয়ে প্রতিযোগিতা মূলক রিয়েলিটি শো হতো। “তোমাকেই খুঁজছে আত্মহত্যা”
বিচারক মন্ডলী টেবিল পেতে বসে আছেন। একে একে প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণকারীরা আসছে তাদের আত্মহত্যার কৌশল বলতে।
আমি চব্বিশ তলা বিল্ডিঙের ছাঁদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করবো।
বিচারক মন্ডলীঃ নেক্সট।
জী আমি বিষ খাবো।
বিচারক মন্ডলীঃ নেক্সট।
আমি পদ্মা সেতুর উপর থেকে নদীতে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করবো।
বিচারক মন্ডলীঃ নেক্সট।
আমি আমার কলিজা ছিঁড়ে আপনাদের ফ্রাই করে খাওয়াবো।
বিচারক মন্ডলীঃ বাহ! বেশ চমৎকার। তোমার আত্মহত্যার অভিনব কৌশলে আমার আত্মহত্যা নিয়ে একটি গান গাইতে ইচ্ছে হচ্ছে। ও পদ্মার ঢেউ রে... এই নাও কার্ড। তুমি যাচ্ছ আমাদের সাথে আগামী পর্বে।
এভাবে দশজন সেরা আত্মহত্যাকারী বাছাই শেষে গ্র্যান্ড ফিনালে। সবাই তাদের জন্য মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে ভোট চাইছে।
প্লীজ আমার আত্মহত্যার কৌশলে যদি আপনারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকেন তবে বেশি বেশি আমাকে এসএমএস করে ভোট দিন। ভোট দেয়ার জন্য আপনার মোবাইল অপশনে যেয়ে বেকুব লিখে একটা স্পেস দিয়ে আত্মহত্যা লিখে পাঠিয়ে দিন ২২২২ নাম্বারে। প্লীজ আমি আপনাদের অত্যন্ত পছন্দের একজন বেকুব। আমাকে আত্মহত্যা করতে দিন।
সেরা আত্মহত্যাকারীর জন্য প্রাইজ থাকতো শেষ বিদায় স্টোর হতে একটি রুপার তৈরি কফিন। দেশি ঢং ফ্যাশন হাউজ থেকে জামদানি কাজ করা কাফনের কাপড়। আত্মহত্যার সময় বেকুব যে পাঞ্জাবী পরেছিলেন সেটার ডিজাইন করেছে আলতা ফ্যাশন হাউজ।
টেলিভিশনের টক শোতে আত্মহত্যার উপকারিতা নিয়ে চরম তর্কের আয়োজন হতো।
সরকার দলীয় নেতাঃ বিরোধী যে করেই হোক নানা ভাবে সুষ্ঠ আত্মহত্যার জন্য উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডে বাঁধা দিচ্ছে। এভাবে হরতাল আর বোমা মেরে, মানুষ পুড়িয়ে আত্মহত্যা রোধ করা যাবেনা। আমাদের সরকারই একমাত্র মানুষকে দিয়েছে নিরাপদে আত্মহত্যা করার নিশ্চয়তা।
বিরোধী দলীয় নেতাঃ আত্মহত্যার জন্য চাই সঠিক আইন প্রণয়ন। সরকার শুধু নিজেদের সুবিধা মতো আইন বানিয়ে সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী ভাবে আত্মহত্যা দখল করে রেখেছে। আমরা এমন আত্মহত্যা মানিনা, মানবোনা। আমরা ক্ষমতায় গেলে বৈদ্যুতিক পাখার সাথে শাড়ি কিংবা ওড়না গলায় বাঁধার মতো সস্তা আত্মহত্যা প্রথা বাতিলের জন্য আইন প্রণয়ন করবো। তখন বাংলার মাটিতে কেউ আর সস্তায় আত্মহত্যা করবেনা।
উপস্থাপকঃ একটু প্লীজ ! একজন দর্শক আছেন টেলিফোন লাইনে। আমরা লাইনটি নিয়ে নেই। হ্যাঁ হ্যালো ! প্রিয় দর্শক আপনার নামটা বলুন। আপনি আপনার টেলিভিশনের ভলিউমটা কমিয়ে নিন। হ্যালো ! প্রিয় দর্শক আপনার নামটা বলুন, আপনার প্রশ্নটা বলুন।
আব্বে হালায় ! অহন আমি আত্মহত্যা করবার লাগছি। নাম দিয়া কাম কি ? ভাবতাছি আমার লগে তগর সবডিরে লইয়া আত্মহত্যা করুম।
দুঃখিত ! প্রিয় দর্শক লাইনটি কেটে গেলো। তো আমরা আবার আজকের অতিথিদের সাথে মূল আলোচনায় ফিরে যাচ্ছি। কথা হচ্ছিলো আত্মহত্যার উপকারিতা নিয়ে। তার আগে ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপন বিরতি নিয়ে নিচ্ছি। ফিরে আসছি খুব অল্প সময়ে ততক্ষণ সঙ্গেই থাকুন।
এরই মাঝে চ্যানেলের সবাই আত্মহত্যা করে ফেলেছে। অতএব লাইভ টক শো সম্প্রচার স্থগিত।
চাচা ঘুমাচ্ছেন। খুব সম্ভবত ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আত্মহত্যা করার স্বপ্ন টপ্ন কিছু দেখছেন। চোখ বন্ধ করেই ঘুমের মাঝে তিনি বলছেন, গোলাপ আমি আমার একমাত্র মেয়েটাকে কাছে পেয়েও বলতে পারছিনা আমি তোর বাবা। তুই আমার ছোট্ট বেলায় হারিয়ে যাওয়া সেই খুকু সোনা।
সবটাই আমার দোষ। না আমি সেদিন ওকে নিয়ে পহেলা বৈশাখের মেলায় যেতাম, না মেয়েটি ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যেতো। তাহলে আজকে আর আমার মেয়েটি এভাবে বেঁচে থাকতে হতো না। আমি লজ্জায় আমার নিজের মেয়ের সামনে বাবার পরিচয়ে দাঁড়াতে সাহস পাইনা। ভয় যদি আমার মেয়েও লজ্জায় কিছু একটা করে বসে। মেয়েকে পেয়েছি কিন্তু আরেকবার হারাতে চাইনা। তাই ভীষণ ভয় হয়।
বুকের ভেতর এত যন্ত্রণা হয় যে, মনে হয় আত্মহত্যা করে ফেলি। আমার আর বেঁচে থাকার কোন অর্থই হয়না।
আমি কিছু বলতে যেয়েও থেমে গেলাম। মনে হলো একটা গালি দেই। শালার শালা ঢং করস। এত ইজ্জত দিয়ে কি হবেরে শালা ? নিজের মেয়েকে পিতৃ পরিচয় জানাবি তো এতো ভয় কিসের ? যা গিয়ে বলে ফেল। সবই তোর ঢং। তোকে আচ্ছা মতন কিছুক্ষণ প্যাদাতে পারলে তোর সব ঢং বের হয়ে যেতো। বাপ-মেয়ে মিলে সুখে থাকতিস।
কথাগুলো বলতে যেয়েও বলতে পারলাম না। কিছু কথা আছে মনের ভেতরেই জমা রাখতে হয়। এভাবে কত কথাই আমরা মনের ভেতর জমা রাখি। কথা জমতে জমতে আমাদের মেমরি লুজ হতে থাকে। একসময় বয়স হলে একেবারেই স্মৃতিশক্তি তখন লোপ পায়।
সন্ধ্যা নাগাদ মেঘনার তীরে পৌঁছানো সম্ভব হলোনা। আমরা নিয়তির কাছে অসহায়। নিয়তি না চাইলে মনে যত সাধই থাকুক না কেন পূর্ণ হয়না। যত পরিকল্পনা করাই হোকনা কেন জয় হয় শেষে নিয়তিরই। নিয়তি নানা বেশ ধরে আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত হয়। আজকে নিয়তি বেশ ধরেছে মহা যানজটের। তালেব মিয়াঁর খুপরিতে যখন আমরা পৌঁছাই তখন এশার সময় হয়ে গেছে। মোল্লা চাচা অবশ্য গাড়িতে বসেই এশার নামায আদায় করে নিলেন।
তালেব মিয়াঁর ঘরে আমাদের জন্য এক অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃখ অপেক্ষা করছিলো। অতএব সকল পরিকল্পনা এখানেও বাতিল করতে হলো। এখানে নিয়তি বেশ ধরেছে ক্যান্সার রোগের। তালেব মিয়াঁর স্ত্রীর ক্যান্সার ধরা পড়েছে। শরীরের লোহিত রক্ত কণিকাগুলো খুব দ্রুত নিঃশেষ হয়ে আসছে। বাঁচার আশংকা একেবারে নেই বললেই চলে। এমনিতেই এই রোগের ব্যায়বহুল চিকিৎসা করাবার মত আর্থিক সামর্থ্য তার নেই। তাছাড়া চিকিৎসায় এই রোগ হতে কদাচিৎই আরোগ্য লাভ সম্ভব। তালেব মিয়াঁর স্ত্রী বিছানায় শুয়ে আছেন। কিন্তু এই নিষ্ঠুর রোগ তার রূপকে বিন্দু পরিমাণ পরাভূত করতে পারেনি। কিছু রূপ এমন হয় যে তাকালেই চোখ ভস্য হয়ে যেতে চায়। এমন রূপের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকা অসম্ভব। নির্ঘাত নার্ভ সিস্টেম এলোমেলো সিগন্যাল দেয়া শুরু করে দিবে। নতুবা মনের ভেতর রূপবতী দেবীর প্রতি ভক্তি চলে আসবে। বালিশের উপর ছড়িয়ে থাকা চুলের মাঝে অদ্ভুত মায়াময় মুখটা দেখে মনে হচ্ছে যেন অন্ধকার আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ ভেসে আছে। আল্লাহ খুব সম্ভবত তার সৃষ্টির উদারতার নমুনা এক ঝলক মানুষকে দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েই খুব দ্রুত আবার তার কাছে ফেরত নিয়ে নেন। দামী কোহিনূর হীরা সবার পক্ষে সামলে রাখা সম্ভব নয়। তবে অপাত্রে পড়লে এই নিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও বেঁধে যেতে পারে। তাই হয়ত যার সৃষ্টি তার কাছে যত দ্রুত ফিরে যাবে ততই মঙ্গল জনক।
তালেব মিয়াঁর তিন মেয়ে ইতিমধ্যে মোল্লা চাচার সাথে খুব ভাব জমিয়ে ফেলেছে। পালা করে তিনজনেই মোল্লা চাচার কোলে উঠে বসছে। চাচা তিনজনকেই তার নিজ হাতে মুখে তুলে কাচ্চি বিরিয়ানি খাইয়ে দিচ্ছেন। এরই মধ্যে তাদের মাঝে নানা নাতনীর সম্পর্কও স্থাপিত হয়ে গেছে। মেয়ে তিনটাই তাকে নানা বলে ডাকছে। মানুষ বড়ই বিচিত্র। অনেক সময় আপন মানুষের চেয়ে পর মানুষের সাথেই খুব দ্রুত আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। আপন মানুষের সাথে সম্পর্ক ছেঁদ হয়ে যাবে কিন্তু কোন পর যখন খুব আপন কেউ হয়ে যায়; তখন সেটা ভয়ংকর আবেগী রুপ ধারণ করে। তমিজুদ্দিন মোল্লার সাথে এই মুহূর্তে তাই হয়েছে। এখন তিনি ঘোড়া সেজেছেন। তার ছোট নাতনীকে পীঠের উপর বসিয়ে তিনি ঘোড়া চড়াচ্ছেন। পেছনে পেছনে বড় দুই নাতনী বলছে হাট ঘোড়া হাট ! ঘোড়াও সাথে সাথে হ্রেষা ধ্বনি তুলছে। ঘোড়ার ডাক শুনে তিন মেয়েই খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে। তালেব মিয়াঁ এর মাঝে কয়েকবার তার মেয়েদেরকে ধমক দিলেন। কিন্তু চাচা উল্টো তালেব মিয়াঁকেই ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন।
চাচা আপনি কি আজ রাতটা এখানেই থেকে যাবেন।
হু !
তাহলে চাচা আপনি থাকুন। আমার কিছু কাজ আছে। আমি যাই। আপনার যখন ইচ্ছা হয় আসবেন। আপনার সাথে গাড়ি আছে; অতএব ফিরে আসা নিয়ে চিন্তার কোন কারণ নেই।
শোন তুমি গাড়ি নিয়ে যাও। আর ড্রাইভারকে বল তুমি যেখানে যেতে চাও যেন তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আবার এখানে ফিরে আসে।
আমি ওদেরকে রেখে চলে এলাম। সুখ মানুষের জীবনে খুব স্বল্প সময়ের জন্য আসে। দুঃখ নিয়েই মানুষ বেঁচে থাকে। দুঃখ নিয়ে বেঁচে থাকে বলেই সুখের অনুভূতি তীব্র আনন্দের হয়। সুখের জন্য মানুষ অপেক্ষায় থাকে। নতুবা যদি শুধু সুখেই মানুষ থাকত কেউ আর দুঃখের জন্য অপেক্ষা করে থাকত না। দুঃখ এলেই বলত; মাফ করেন।
[৫]
সাকিলের চায়ের দোকানে বিরাট হট্টগোল বেঁধেছে। মনোয়ার সাহেবের সাথে তার তুমুল বাকবিতন্ডতা হচ্ছে। মনোয়ার সাহেব এসেছিলেন আমার খোঁজে। আমাকে না পেয়ে সাকিলের দোকানে এসেছেন চা আর সিগারেট খেতে। সাকিল চা বানিয়ে ফেনা সহ চা দেয়াতেই এই ঝগড়ার উৎপত্তি। চামচ দিয়ে ফেনা না সরিয়ে চা পরিবেশন করা অভদ্রতা আর মনোয়ার সাহেবের মত একজন স্মার্ট মানুষের পক্ষে এতটুকু অভদ্রতা মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। তিনি সাকিলকে এই বিষয়ের উপর এক বিশাল লেকচার দেয়াতেই সাকিল তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে তার মুখের উপরেই বলে দেয় যে তার মতন এমন ভদ্র কাস্টমার তার দরকার নাই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বেশ উপভোগ করলাম দুইজনের ঝগড়া। তবে আরও মজা পেলাম যারাই ভিড় করে ঝগড়া দেখছে তারা সবাই আমার মতই উপভোগ করছে এই ঝগড়া। ঝগড়ার মাঝ খানেই আমি সাকিলকে বললাম সাকিল আমাকে ফেনা যুক্ত এক কাপ চা দেত। ব্যাস মনোয়ার সাহেবের চেহারা তখন দেখার মত হলো। আমার দিকে রক্তবর্ণ চোখে তাকিয়ে তিনি ঝগড়া থামিয়ে দিয়ে হুড়মুড় করে তার গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলেন।
সাকিলের মুখে যে হাসি দেখা গেলো কয়েক কোটি টাকা খরচ করলেও এমন হাসি কেনা সম্ভব হবে না এই পৃথিবীতে। সাকিল নিজ থেকেই আমার দিকে একটি সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বলল আর কইয়েন না বুঝলেন ভাইজান, আরে এতই যদি উনার প্রেস্টিজ তাইলে ফাইভ স্টার হোটেলে গিয়াই চা খাইলে পারে; এই সাকিল মূর্খের দোকানে কি ? আমি সিগারেট ধরিয়ে তার কথার সাথে মাথা নাড়ালাম। সাকিল মাঝে মাঝে খুব দার্শনিকদের মত কথা বলতে শুরু করে। এইটা করে যখন সে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে। সাকিলের উত্তেজিত মস্তিষ্ক এখন তাকে দার্শনিক করে তুলেছে। এখন সে বিভিন্ন রকম দার্শনিক তত্ত্ব দেয়া শুরু করবে। সাকিল উত্তেজিত কণ্ঠেই বলতে শুরু করল, ফজরের আযানের সময় শয়তান তার অস্তিত্বের ধ্বংসের ভয়ে শঙ্কিত হয়ে কুকুরের পেটে ঢুকে গিয়ে সুরসুরি দেয়। এতে করে কুকুরগুলো চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করে দেয়। আযানের পবিত্রতা নষ্ট করার কৌশল হিসেবে শয়তান এই কাজ করিয়ে থাকে। ব্যাখ্যাটা আমার কাছে দুর্বল বলে মনে হলোনা। কিন্তু এই মুহূর্তে ঠিক কোন প্রসঙ্গে এমন দর্শন তার মাথায় এলো সেটাও বুঝতে পারছিনা। সক্রেটিস রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে ডেকে ডেকে মানুষকে তার দর্শন তত্ত্ব শোনাত। দাই ইউর সেলফ। মানুষের ভেতরেও এক কুকুর স্বত্বা বাস করে। সেও মাঝে মাঝে তার অস্তিত্বের জানান দেয়ার জন্য কুকুরের মত আচরণ করে। সাকিল নিশ্চয় তেমনই কোন দর্শন তত্ত্ব বোঝাতে চাইছে। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে পরিপূর্ণ ব্যাখা দাঁড় করাতে পারছেনা। সাকিল হয়ত বলতে চাইছে দাই ইউর সেলফ।
পেছনে ফিরে দেখি মনোয়ার সাহেব এখনও তার গাড়ি থামিয়ে রেখে ভেতরেই বসে আছেন। বোঝা গেল আমার সাথে কথা না বলে তিনি যাচ্ছেন না। আমি দূর থেকেই ইশারা করলাম চা আর সিগারেট খাবে কিনা ? তিনি সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালেন।
সাকিল তোর কাছে কি শ্যাম্পু আছে ? থাকলে শ্যাম্পু মিশিয়ে আরও বেশি করে ফেনা তুলে এক কাপ চা বানিয়ে দে। ব্যাটাকে আজ জন্মের মত ফেনা চা খাইয়ে দেই। সাকিল হাসতে হাসতে বলল না ভাইজান থাক। আমিত আর কুকুর না যে ওর মত বাপ-মার নাম নিয়ে ইংরেজিতে গালি দিব। তারচেয়ে জটিল এক কাপ কফি বানিয়ে দিচ্ছি। কফি খেয়ে এই সাকিলের কথা আজীবন মনে রাখবে।
মনোয়ার সাহেব এরই মধ্যে চোখে কালো রঙের সানগ্লাস পরে ফেলেছেন। মানুষের চোখ হলো তার মনের আয়না। মনে কি আছে সেটা চোখের আয়নায় রিফ্লেক্ট করবেই। এই মুহূর্তে মনোয়ার সাহেব তার মনের খবর গোপন রাখতে চাইছেন বলেই রাতের বেলাতেও চোখে কালো রঙের সানগ্লাস পরে ফেলেছেন। কফিতে চুমুক দিতে দিতে তিনি বললেন দেখুন মিঃ গোলাপ আমি এসেছি আপনার ঐ ছেলেটার জন্য। আগামীকাল বিকালে আপনি ছেলেটাকে নিয়ে সরাসরি আমার বাসায় চলে আসবেন। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো আপনাদের দুজনকে এসে নিয়ে যাবে। মনোয়ার সাহেবের মুখে বাংলা শুনে বেশ ভাল লাগছে। এই ধরণের মানুষ খুব আবেগের মাঝে থাকলেই কেবল মাত্র খুব সুন্দর করে বাংলা ভাষায় কথা বলে।
স্যার আগামীকাল আমরা আসতে পারছিনা। আমার মেস মালিক বাড়িতে নেই। তিনি গেছেন তার নাতনীদের সাথে ঘোড়া ঘোড়া খেলতে। ঘোড়া ক্লান্ত হওয়া না পর্যন্ত তিনি ফিরবেন না। তিনি ফিরে এলেই পল্টুকে নিয়ে আপনার সাথে দেখা করবো।
ঠিক আছে। আমার কার্ডটা রাখুন। এখানে আমার মোবাইল নাম্বার দেয়া আছে। আসার আগে আমাকে শুধু একবার ফোন করলেই আমি আপনাদের জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিবো। ড্রাইভারকে কোন নির্দেশনা দেয়ার প্রয়োজন হলো না। গাড়িটা কথা শেষ হতেই এমন ভাবে টেনে চলে গেল যেন চাবি দিয়ে স্টার্ট দেয়াই ছিলো। শুধু এক্সিলেটরে পা দিয়ে স্টেয়ারিং ঘুরাতে যেটুকু সময়ের প্রয়োজন লাগে। মনোয়ার সাহবেদের মত মানুষদের গাড়ির ড্রাইভারগুলো হয় অনেকটা রোবটের মতই। আগে থেকেই সব এপ্লিকেশন ইন্সটল করাই থাকে বাই ডিফল্ট হিসেবে। সব কিছুই সময় অনুযায়ী প্রোগ্রামিং করাই থাকে। একবার শুধু এক্সিকিউশন চালালেই হয়ে যায়। তারপর অটোমেটিক শুধু চলতেই থাকে। মোল্লা চাচার গাড়ির ড্রাইভার আবার তেমন নয়। এই শ্রেণীর ড্রাইভাররা মোটেও বিশ্বস্ত হয়না। এরা সব সময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে কখন গাড়ির তেল-গ্যাসের টাকা চুরি করবে। এদেরকে ডানে যেতে বলা হলে যাবে বামে, আর বামে যেতে বলা হলে যাবে ডানে, ধীরে বললে গতি বাড়িয়ে দিবে, গতি বাড়াতে বললে ধীরে চালাবে। কিছুই বললেই বলবে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা তার প্রায় কয়েক যুগের। অতএব তাকে ইন্সট্রাকশন দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। গাড়ি চালানোর ব্যাপারে কেবলমাত্র সেই একমাত্র অভিজ্ঞ ড্রাইভার। এরা অবশ্য চাকরীতে টেকেও বেশি দিন না। কিছু দিন পর পর ড্রাইভার বদলানোর প্রয়োজন হয়। আর মালিকের দামী গাড়ির অবস্থা হয় শোচনীয়। তবে এদের সাথে সিগারেট খাইয়ে খুব সহজেই সখ্যতা করে নেয়া যায়।
[৬]
খুব সম্ভবত বেহেশতে পৌঁছে গেছি। আমার হাতে বেহেশতের কোন এক হুরের হাতের কোমল স্পর্শ অনুভব করছি। পাশে দাঁড়িয়ে জীবনানন্দ দাশ হুরদের নিয়ে তার স্বরচিত কবিতাগুলো একেরপর এক আবৃত্তি করে যাচ্ছেন।
সুরঞ্জনা, ওইখানে যেও নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে – আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেও নাকো আর।
কি কথা তাহার সাথে? তার সাথে!
আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয়ে আজ ঘাস
বাতাসের ওপারে বাতাস—
আকাশের ওপারে আকাশ।
.................
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে-সব নদী-ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
কিন্তু কি আশ্চর্য ! কবিরতো মুখে দাড়ি থাকার কথা না। কিন্তু এই জীবনানন্দ দাশের মুখ ভর্তি দাড়ি। তবে কি কবি বুঝতে পেরেছেন যে কবিদের ক্লীন শেভ থাকতে নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত লম্বা দাড়ি না থাকলে প্রকৃত কবি হওয়া যায় না। হয়ত এমনটা ভাবা আমার ভুল হচ্ছে। মৃদু বাতাস বইছে। সেই বাতাসের সাথে অচেনা এক ফুলের গন্ধ এসে নাকে লাগছে। বেহেশতে আছি বলেই হয়ত ফুলটা পরিচিত বলে মনে হচ্ছেনা। বেহেশতে অনেক রকমের ফুলইতো থাকতে পারে। এই ফুলের গন্ধ ওষুধের গন্ধের মতো। মাঝে মাঝে ফিনাইলের গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। এইটা মনে হয় ফিনাইল ফ্ল্যাভার দিয়ে সৃষ্ট ফুল। তবে হুরের হাতের কোমল স্পর্শটা বেশ ভাল লাগছে।
শুয়ে আছি। হয়ত ঘুমিয়েও পড়েছি। চোখ খোলার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছিনা। শরীর, মস্তিষ্ক সব কিছু নিস্তেজ হয়ে আছে। শুধু মস্তিষ্কের অবচেতন অংশটাই কাজ করছে বলে কিছু কিছু ইন্দ্রিয় কাজ করছে। মনোজগতের আলফা, বিটা লেভেল অতিক্রম করে এখন আছি গামা লেভেলে। নিউরনগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারছেনা খুব সম্ভবত এই কারনেই। তাই নিউরোনের এলোমেলো সিগন্যালের জন্য পাঁচ ইন্দ্রিয় এক সাথে কাজ করছেনা। অসুস্থ নিস্তেজ শরীর সব সময় খোঁজে আরাম। আর সেই জন্য দরকার কোমল কিছু। প্রকৃতি একমাত্র নারীকেই সেই কোমলতা দান করেছে। এই কোমলতা কাশফুলের নরম ছোঁয়ার মতো। এই কারণেই অসুস্থ শরীর সব সময় পরম মমতাময়ী মায়ের কোলের উষ্ণতা পেলে সুস্থতা অনুভব করে। শিশু তার মায়ের কোলকেই পৃথিবীর একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল বলে মনে করে। মমতাময়ী শব্দটা এই জন্যই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মায়ের মতো স্ত্রীর সেবাও একইরকম টনিক হিসেবে কাজ করে। এই কারণেই অসুস্থতা কিংবা শরীরের নিস্তেজতায় প্রাণ সঞ্চারিত হতে কেবলমাত্র প্রয়োজন একজন নারীর সান্নিধ্যই। আমার ক্ষেত্রেও কি তাহলে এই মুহূর্তে এমনটাই কাজ করছে। নতুবা হুরের স্পর্শ এতটা প্রশান্তি এনে দিচ্ছে কেন ? বেহেশতে নিশ্চয় কেউ অসুস্থ থাকবেনা। তবু প্রশান্তির জন্যই হয়ত হুরের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
টের পাচ্ছি নিউরোনে উত্তেজনা হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছে। মনোজগতের গামা লেভেল থেকে নামতে শুরু করেছে আমার অবচেতন মস্তিষ্ক। এখন আর আমি বেহেশতে নেই। এখন আমি শাকিলের দোকানে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছি। পেছন থেকে হঠাৎ মাথায় কে যেন লোহার মতো শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করল। আমি মুহূর্তে মাটিতে পরে গেলাম। আমার চারদিক ক্রমশ সাদা হয়ে আসছে। আমি দুচোখে সাদা রঙ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা। মানুষ অন্ধ হয়ে গেলে তার বাহ্যিক পৃথিবী কালো অন্ধকার হয়ে যায় কিন্তু তার কর্ণিয়ার আড়ালে সব কিছু আলোকিত সাদা হয়ে যায়।
অবশেষে চোখ খোলা গেল। পাশে দাঁড়িয়ে মোল্লা চাচা কোরআন শরীফ হাতে নিয়ে তেলাওয়াত করছেন। যূথী আমার হাতে হাত রেখে বসে আছে। আমি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছি। ওষুধ আর ফিনাইলের গন্ধটা প্রকট ভাবে নাকে এসে লাগছে। মাথায় ব্যান্ডেজ করে রাখা হয়েছে। পল্টু পায়ের কাছে বসে আছে। তার চোখ হতে টপ টপ করে পানি ঝরছে। ভয়ানক সব মরনাস্ত্রের এই যুগে যেহেতু মাথায় লোহার মতো শক্ত কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছে, তাই আমাকে মেরে ফেলা মূল উদ্দেশ্য ছিলো না। নতুবা মাথায় পিস্তল দিয়ে গুলী করা যেত। মৃত্যু নিশ্চিত হতো। কিন্তু সেটা করা হয়নি। শুধু একবার মাথায় আঘাত করা হয়েছে। আমাকে জীবিত রেখে একটা শিক্ষা দেয়াই ছিলো আসল উদ্দেশ্য। আমার শত্রু আমার সাথে তার হিসাব এভাবেই চুকাতে চেয়েছে। এখন আর পরবর্তী আঘাতের কোন সম্ভাবনা নেই। অতএব আমার শত্রু কে তা আর খোঁজার কিংবা এই নিয়ে মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করারও কোন যথার্থতা নেই।
হাসপাতাল থেকে রিলিজ পেতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে গেলো। এই কদিন যূথী আর পল্টু সর্বক্ষণ হাসপাতালে আমার সাথেই ছিলো। সুস্থ হয়ে মেসে ফিরেও আরও কিছুদিন বিছানাতেই শুয়ে থাকতে হলো। উঠে দাঁড়ালেই মাথা ঘুরায়, বসলেও মাথা ঘুরানোটা বন্ধ হয়না। কেবলমাত্র বিছানায় শুয়ে থাকলেই কিছুটা স্বস্তি লাগে। এরই মাঝে এক সন্ধ্যায় যূথী হলুদ রঙের সিল্কের শাড়ি পরে হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা নিয়ে ঘরে এলো। হলুদ শাড়ির সাথে ম্যাচ করে হলুদ ব্লাউজ, কপালে হলুদ রঙের টিপ পরেছে, হাতে হলুদ কাঁচের চুড়ি, চোখে হলুদ আই শ্যাডো, কানে হলুদ রঙের দুল। এমনিতেই যূথীর গায়ের রঙ দুধে আলতা তার উপর হলুদ সাঁজে অনিন্দ্য সুন্দরী লাগছে তাকে। মনে হচ্ছে সত্যিই বেহেশতের কোন হলুদ হুর এসেছে আজ আমার ঘরে। মহাদেব সাহার একটা কবিতা খুব আবৃত্তি করতে ইচ্ছা হলো। মনে হলো যূথীকে শোনান যেতে পারে। আজকে যূথীকে এই সাঁজে মেঘনার তীরে নিয়ে যেতে পারলে খুব ভালো হতো। আমি আর যূথী সন্ধ্যায় মেঘনা নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকতাম। চোখে চোখ, হাতে হাত রেখে কখনও জীবনানন্দ, কখনও মহাদেব সাহার কবিতা আবৃত্তি করে সময়গুলো কাটিয়ে দিতাম। কিন্তু সেটা এখন শরীরের জন্য সম্ভব হচ্ছেনা। কিন্তু হয়ত সুস্থ হলে মনের এই ইচ্ছাটুকু পূর্ণ করতে আর ভাল লাগবেনা। মানুষের মন বড় বিচিত্র !
করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙ্গুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।
চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও ...
বর্ণণা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দিও!
ঘরে কোন ফুলদানী নেই। তাই গোসল খানার মগে পানি দিয়ে টেবিলের উপর ফুলগুলো খুব যত্ন করে রাখল যূথী।
মাথার যন্ত্রণাটা কি একটু কমেছে ?
পুরোপুরি না।
হুম ! আরও কিছুদিন সময় লাগবে।
কোথাও গিয়েছিলে ?
হুম ! আপনাকেতো বলাই হয়নি। আমি বেশ্যাগিরি ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমি একজন সিনেমার নায়িকা।
মানে কি !
মানে আমি এখন বাংলা সিনেমার নায়িকা হয়েছি।
বল কি ?
জী ! যূথীর চোখে মুখে হাসির ঝিলিক।
গতকাল ছিলো আমার প্রথম শুটিং। আজকে ছিলো দ্বিতীয় পর্যায়ের শুটিং। আজকে এভাবে সাঁজতে হয়েছে একটা গানের শুটিং ছিলো বলে। গানে আমি পুরো হলুদ আর নায়ক পুলিশের পোশাকে। হলুদ এক হুরকে নিয়ে ফুলের বাগানে পুলিশ নাচানাচি করছে আর গান গাইছে। দারুণ মজার না ব্যাপারটা ?
অবশ্যই মজার। চোর ডাকাত রেখে পুলিশ নাচতেছে এইটা অবশ্যই মজার একটা ব্যাপার। তবে আমাদের দেশের জন্য এটাই বাস্তবতা। পরিচালক সাহেবের মেধা আছে বলতেই হয়।
সিনেমার পুরো কাহিনী শুনবেন। পুরো সিনেমা নায়িকা কেন্দ্রিক সিনেমা। এখানে নায়িকাই সবকিছু।
আমি আগ্রহ নিয়ে যূথীর সিনেমার কাহিনী শুনছি। সিনেমার নাম “রানী কেন আসামী ?”
রানী গ্রামের একজন সহজ সরল মেয়ে। শহর থেকে কিছু গুন্ডা গ্রামে যায়। গ্রামে গিয়ে তারা রানীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে ধর্ষণ করে বসে। তারপর প্রতিশোধের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে রানী শহরে গিয়ে আধুনিক মেয়ে সেজে গুন্ডাদের কাছে যায় একে একে। শহরে যেয়ে শাড়ি পরা গ্রামের সহজ সরল মেয়ে রানী হয়ে যায় শর্ট স্কার্ট আর স্লিভলেস ব্লাউস পরা মিস ডায়না। শুরু হয় প্রতিশোধের পালা। এরই মাঝে সিনেমার নায়ক মানে থানার ওসির সাথে রানীর প্রেম হয়। শেষে অনেকগুলো খুনের দায়ে রানীকে থানার ওসি রাজা নিজেই হ্যান্ডকাপ পরিয়ে জেলে নিয়ে যায়। অবশেষে জেলের শাস্তি শেষ করে যখন রানী বের হয়ে আসে তখন সে দেখে রাজা তার জন্য জেল গেটের বাইরে ফুল হাতে অপেক্ষা করছে। দৌড়ে দুজন দুজনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। এখানেই সিনেমার শেষ।
সিনেমায় প্রচুর নগ্ন দৃশ্যে যূথীকে অভিনয় করতে হবে। বেশিরভাগ দৃশ্যই গানের সাথে বিছানায় নগ্ন হয়ে গুন্ডাদের সাথে মাখামাখির দৃশ্য। এইগুলাকে ঠিক টু এক্স কিংবা থ্রি এক্স এর মতো পর্ণ বলা যাবেনা। যৌনতা নির্ভর দৃশ্য কিন্তু সেটা পর্ণের মতো নয়। বাংলা সিনেমা জগতে এই ধরণের সিনেমাকে বলা হয় থার্ড গ্রেড অথবা ফোর্থ গ্রেডের সিনেমা। যূথীর রুপালী পর্দার জগতে হয়ত থার্ড গ্রেড কিংবা ফোর্থ গ্রেড সিনেমার নায়িকা হিসেবে পথ চলা শুরু হলো; হয়ত একদিন এভাবে সে প্রথম সারির নায়িকা হিসেবে সুপার স্টার হয়ে যাবে। বাংলা সিনেমায় এমন দুই একজন আছে যারা বেশ নাম করেছে। অতএব যূথীর ভবিষ্যৎ এই ক্ষেত্রে উজ্জ্বল। লোকে যেখানে বেশ্যাবৃত্তিকে খারাপ চোখে দেখে, তারচেয়ে সিনেমার নায়িকা হয়ে খোলামেলা দৃশ্যে অভিনয় করলে যদি লোকে বাহবা দেয়; সুপার স্টার হওয়া যায় তাহলে আর ক্ষতি কোথায় ? আগে যেখানে পর পুরুষের সামনে পুরো নগ্ন হয়ে যৌন কাজ সম্পাদন করতে হতো, তারচেয়ে এখন অর্ধ নগ্ন হয়ে শুধু যৌনতার অভিনয় করাটা যূথীর জন্য অধিক যৌক্তিক এবং মর্যাদার।
যূথী এমন ভাল একটা সংবাদ মিষ্টি মুখ করা ছাড়া ঠিক জমছেনা।
মিষ্টি খাওয়াবো; আগে আপনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠুন তারপর।
শুনবেন না সিনেমায় কিভাবে চান্স পেলাম ?
বল ?
বেশ কিছুদিন আগে সংসদ ভবনে দাঁড়িয়ে আছি। সন্ধ্যা থেকে বেশ রাত পর্যন্ত দাঁড়িয়ে আছি। কিন্তু সেদিন কোন খদ্দের পাইনি। মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ আমার সামনে একটা প্রাইভেট কার এসে থামল। আমাকে একটা হোটেলে নিয়ে গেলো। যে আমাকে হোটেলে নিয়ে গেলো সেই এই সিনেমার পরিচালক। তার নাম হলো এস. এম. গণি। খুব সম্ভবত আমি তাকে পুরোপুরি তৃপ্ত করতে পেরেছিলাম। কাজ শেষে আমাকে বলল তোমার রূপের কোন তুলনা হয়না আর ফিগার খুব আকর্ষণীয়। সিনেমার নায়িকা হিসেবে তুমি একদম পার্ফেক্ট। তুমি সিনেমায় এলে সব নায়িকাকে ছাড়িয়ে একদম মাত করে দিতে পারবে। আমি তোমাকে সুপার স্টার বানিয়ে ছাড়বো। আমি খুব শীঘ্রই নতুন একটা সিনেমার কাজে হাত দিতে যাচ্ছি। তুমি হবে এই সিনেমার নায়িকা। তোমাকে আমি কাস্ট করলাম। তোমার বাংলা সিনেমায় নায়িকা হয়ে আজ থেকেই পথ চলা শুরু। এই বলেই আবারও আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।
গতকাল থেকে সিনেমার শুটিং শুরু হয়েছে। প্রথম দৃশ্যেই অভিনয় করলাম এক গুন্ডার সাথে প্রায় নগ্ন হয়ে বিছানায়। এই দৃশ্যের বর্ণনা অবশ্য আপনাকে দিতে পারবনা। আমার এমন কাজে অভ্যাস হয়ে গেছে; তাই নতুন করে ক্যামেরার সামনে এমন দৃশ্যে অভিনয় করতে কোন সমস্যা হয়নি।
কি অদ্ভুত ! যূথী কতটা অবলীলায় বলে যাচ্ছে একজন নারীর মূল অলংকার হারানোর কথা। অবশ্য হুরদের জন্য এটাই নিয়তি। এর জন্য লজ্জা পাওয়ার কোন কারণ নেই।
যূথী আজকে আর না। আরেকদিন শুনবো তোমার সিনেমার গল্প। একদিনেই সব বলে ফেললে সিনেমা দেখার আর কোন আগ্রহ থাকবেনা। সিনেমা হচ্ছে এমন জিনিস যার সম্পর্কে সব কিছু আগেই জেনে ফেললে সিনেমা দেখার আর কোন অর্থ থাকেনা। সিনেমার শেষ পর্যন্ত কি হতে যাচ্ছে তার জন্য দর্শক টান টান উত্তেজনা নিয়ে পর্দায় চোখ রেখে হলে বসে থাকবে। নতুবা সিনেমা ফ্লপ !
প্লীজ এই সিনেমা আপনি দেখবেন না; কথা দিন। আপনি এই সিনেমা দেখলে আমি আর কখনওই আপনার সামনে এসে লজ্জায় দাঁড়াতে পারবোনা। নারী আর যাই হোক তার প্রেমিকের কাছে কখনওই মূল্যহীণ হতে চায়না। আমার কাছে যূথী কোন কিছুই লুকায় না কিন্তু তারপরেও মুখের কথা আর চোখের দেখা এক বিষয় নয়। মুখের কথা শূণ্যে ভেসে যায় কিন্তু চোখের কর্ণিয়ায় ধারণকৃত দৃশ্য মনের সেলুলয়েডে রেকর্ড যায় চিরদিনের জন্য। যদিও আমার সাথে যূথীর কোন প্রেমের সম্পর্ক নেই; তবু যূথী তার নারী সূলভ আচরণ করবে এটাই প্রাকৃতিক।
কথা দিলাম। আমি কখনওই তোমার সিনেমা দেখবোনা। আচ্ছা যূথী পল্টু কোথায় ? ওকে দেখছিনা !
পল্টুর আজ শুটিং। ওকে পাবেন না।
তুমি কি ওকেও সিনেমায় নামিয়েছো নাকি ?
হুম ! গণি ভাইকে অনেক অনুরোধ করে ওকেও সিনেমায় ঢুকিয়ে দিয়েছি। শিশুশিল্পী হিসেবে সিনেমায় অভিনয় করবে। ভাল পারিশ্রমিক পাবে। তাছাড়া পল্টুর নাচ আর গানের চর্চাটাও থাকবে। একসময় পল্টু হবে সুপার স্টার কিং খান বাদশাহ খান।
বাদশাহ খান মানে কি !
গণি ভাই ওর নাম দিয়ে দিয়েছে বাদশাহ খান। পল্টু এইটা আবার কেমন নাম ! দর্শক এই নাম নেবেনা। বাদশাহ খান নামের মধ্যে একটা আলাদা ভাব আছে। এখন থেকে পল্টুকে সবাই চিনবে বাদশাহ খান নামে।
পল্টুকে সিনেমায় দিয়ে ভাল করেছিনা ?
মহা পূণ্যের কাজ করেছো।
আমি জানতাম আপনি খুশি হবেন।
আচ্ছা যূথী পরিচালক সাহেব না হয় তোমার রূপে মুগ্ধ হয়ে তোমাকে সিনেমার নায়িকা করেছেন। কিন্তু পল্টুকে নিলেন কোন হিসাবে ?
পল্টুর জন্য আমি এই সিনেমার প্রযোজককে একরাত খুশি করেছি। আমার ছোট্ট ভাইটির জন্য বোন হিসেবে এতটুকু করবোনা ? কি আশ্চর্য ! এইটা আবার জানতে চাওয়ার কি আছে ?
[৭]
যূথী চলে গেলো কিনা বুঝতে পারছিনা। চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে গেছি। মাথার যন্ত্রণাটা ভীষণ বেড়েছে হঠাৎ। মনোজগতের আলফা, বিটা লেভেল অতিক্রম করে আমি এখন গামা লেভেলও ছাড়িয়ে যাচ্ছি। মস্তিষ্ক এবার তার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। পাঁচ ইন্দ্রিয়তে খুব ম্যালফাংশনিং দেখা দিয়েছে। নিউরোন তার প্রচন্ড রকম ভাবে উল্টা পাল্টা সিগন্যাল পাঠাচ্ছে। আমি এখন বেহেশতের ফুল বাগানে শুয়ে ঘুমিয়ে আছি। রজনীগন্ধ্যা ফুলের ঘ্রাণ পাচ্ছি। পাশে দাঁড়িয়ে কবি জীবনানন্দ দাশ তার স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি শুরু করতে যাচ্ছেন। কবির মুখ ভর্তি দাড়ি। বেহেশতে জীবনানন্দ দাশের উপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভর করেছেন। দাড়ি ছাড়া কি আর প্রকৃত কবি হওয়া যায় !
গোলাপ কি ঘুমিয়ে পড়েছো ?
জী দেখতেই পাচ্ছেন চোখ বন্ধ। অতএব আমি এখন ঘুমাচ্ছি।
ভাল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলছো মানে তুমি এখন স্বপ্ন জগতে আছো। স্বপ্ন জগতে তোমার কেমন লাগছে ?
চায়ের খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। কফি হলে আরও ভাল হয়। সাথে অবশ্যই সিগারেট লাগবে।
বেহেশতে সিগারেট খেতে পারবেনা। এখানে আগুনের কোন ব্যবস্থা নেই। সিগারেট খেতে হলে তোমাকে দোযখে যেতে হবে।
আপনি ভুল বলছেন কবি। বেহেশতে চাইলে সবই পাওয়া যায়।
গোলাপ ফাইজলামি করবানা। এটা তোমার পৃথিবী না যে এখানে ফাইজলামি করবা।
কে বলেছে কবি ? বেহেশতে সব কিছু করাই জায়েজ আছে।
গোলাপ অযথা আমার সাথে তর্ক করোনা। তোমার কাছে যূথী মেয়েটাকে কেমন লাগে ?
ভাল।
শুধুই কি ভাললাগা ?
হে প্রিয় কবি, যূথী হলো জোছনার মতো। যাকে দেখা যায়, অনুভব করা যায় কিন্তু হাত দিয়ে ধরতে পারা যায় না।
যূথী যে তোমাকে মারাত্মক ভাবে ভালোবাসে সেটা কি তুমি বোঝ ?
বুঝি।
ঐযে বলেছিনা প্রিয় কবি, যূথী হলো জোছনা। সে তার সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারকে আলোকিত করবে, অনুভর করতে দিবে নিজেকে কিন্তু কারও হাতে ধরা দেবে না। আমিও অতি সাধারণ একজন মানুষ; তাই আমার বেলাতেও যূথী তাই করবে।
কবি কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে একটা দীর্ঘশাস ফেলে কবিতা আবৃত্তি শুরু করলেন।
আলো-অন্ধকারে যাই মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয়, শান্তি নয়, ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ হয়, পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা প্রার্থনার সকল সময়
শূণ্য মনে হয়,
শূণ্য মনে হয়!
সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো! তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর! কোনো নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার!
হে প্রিয় কবি, আপনিতো অনেক কবিতাই আবৃত্তি করলেন। যদি অনুমতি দেন তাহলে আপনার লেখা একটা কবিতা এবার আমি আবৃত্তি করতে চাই।
কবি খুশি মনেই অনুমতি দিলেন। আমি চোখ বন্ধ রেখে ঘুমের মাঝেই আবৃত্তি করছি,
শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে - ফাল্গুনের রাতের আধাঁরে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ।
বধূ শুয়ে ছিল পাশে - শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল - জোৎসনায়, - তবে সে দেখিল
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেলো তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল - লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।
এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!
রক্তফেনা-মাখা মুখে মড়কের ইদুঁরের মত ঘাড় গুজি
আধার ঘুজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনোদিন জাগিবেনা আর।
গোলাপ, গোলাপ উঠো। তাকিয়ে দেখো একবার আমার সাথে কাদের নিয়ে এসেছি। আমার সাথে আমার নাতনীরা এসেছে। খুব খারাপ লাগছিলো। চোখের সামনে মেয়েটা আমার কোলেই মাথা রেখে মারা গেলো। এখন এই মা মরা এতিম বাচ্চাগুলো কিভাবে থাকবে! ওদের বাবার পক্ষে সম্ভব হবেনা। বেচারা সারাদিন সারারাত কাজই করবে, না মেয়েগুলোকে দেখাশোনা করবে। তাই ওদেরকে সাথে করে নিয়ে এলাম। আজ থেকে ওরা আমার সাথেই থাকবে। জানো মেয়েগুলো ভীষণ শক্ত মনের। মায়ের মৃত্যুতে একজনও কাঁদল না। যেন ওরা আগে থেকেই ওদের মায়ের মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতী নিয়ে রেখেছিলো। বরং তালেব মিয়াঁ একেবারে ভেঙে পড়লো। শেষে আমাকেই কবরে নামতে হলো।
আমার যূথী মামণি কোথায় ? যাই, ওকে খবরটা দেয়া লাগবে। আমারও একার পক্ষে বাচ্চাগুলোকে দেখাশোনা করা সম্ভব হবেনা। খালা হিসেবে ওর উপরেওতো কিছু দায়িত্ব বর্তায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ রাত ২:৪৮