১৮৫২ সালে আলেকজান্দার পার্ক নামের এক উদ্ভাবক নাইট্রো-সেলুলোজ, প্লাস্টিসাইজার ও অন্য দ্রাবক পদার্থের মিশ্রণে প্লাস্টিক তৈরি করার পর থেকে আজ অবধি তৈরিকৃত কোনো প্লাস্টিকই পঁচে বা নষ্ট হয়ে যায়নি। প্রকৃতিতে সরাসরি এখনও সেই প্লাস্টিকগুলো বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রয়ে গেছে। প্লাস্টিক পুরোপুরি নষ্ট হতে আনুমানিক কমপক্ষে ৫০০ থেকে ১০০০ বছর সময় লাগে।
প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা দেশের মধ্যে আছে ব্রাজিল, ভুটান, চীন, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সোমালিয়া, তাইওয়ান, তানজানিয়া, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, ভারত ইত্যাদি। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন রাজ্যে এখন প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ। এ তালিকা প্রতিবছরই বাড়ছে। অথচ তারাই ছিলো পৃথিবীর সর্বাধিক প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহারকারী দেশ। ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করে ইতালি। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোসাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) উদ্যোগে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে পলিথিন বিরোধী আন্দোলন হয়। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ১৭ টি দেশে পলিথিনব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়। ২০১৫ সাল নাগাদ পুরো ইউরোপে প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ হবে।
প্লাস্টিক ব্যাগ মূলত বিভিন্ন জৈব ও অজৈব আঠা যেমন রং, প্লাস্টিসাইসার, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এবং অন্যান্য ধাতু থেকে তৈরি। কলকারখানার ক্ষার জাতীয় পদার্থ যা প্লাস্টিক ব্যাগগুলিকে উজ্জ্বল রং করে দেয়। এদের মধ্যে কিছু খাদ্যে বিষক্রিয়া ঘটায়। রং এর মধ্যে থাকা ভারি ধাতব যেমন ক্যাডমিয়াম স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক।বর্জ্য পদার্থ যেমন ক্যাডমিয়াম , সীসা যখন প্লাস্টিক ব্যাগগুলি তৈরীর সময় ব্যবহৃত হয় সেগুলি খাদ্যে মিশে বিক্রিয়া ঘটায়। অল্প পরিমাণে নেওয়া ক্যাডমিয়াম বমি ভাব, হৃদপিণ্ড বড় হওয়ার প্রবণতা তৈরি করে। দীর্ঘ দিনের ব্যবহারে মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়।
প্লাস্টিক ব্যাগ যদি ঠিকমত ফেলা না হয় তাহলে তারা ড্রেনে চলে যায়, তার ফলে ড্রেন বন্ধ হয়ে যেতে পারে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি হবে এবং জল বাহিত রোগ ছড়াবে।পুনর্ব্যবহৃত বা রঙীন প্লাস্টিকে এমন কিছু রাসায়নিক থাকে যা মাটির তলায় গিয়ে মাটি এবং জলকে দূষিত করে। পুনর্ব্যবহারের জন্য যে সব প্রযুক্তি কারখানাগুলিতে ব্যবহার হচ্ছে তা পরিবেশের দিক থেকে যথাযথ না হলে প্রস্তুতির সময় যে বিষাক্ত গ্যাস উত্পন্ন হবে তা পরিবেশদূষণ আরো বাড়াবে। কোনো কোনো প্লাস্টিক ব্যাগে খাবারের টুকরো থেকে যায় বা অন্য আবর্জনার সাথে মিশে যায় এবং পশুরা খেয়ে ফেলে, এর ফলাফল খুবই ক্ষতিকর।প্লাস্টিক যেহেতু পরিবেশের সাথে মিশে যায় না এবং অভেদ্য বলে জলকে মাটির তলায় পৌঁছনোর ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও, উন্নতমানের প্লাস্টিকের জিনিষ এবং যে সমস্ত প্লাস্টিককে রঞ্জক ব্যবহার করা হয় তার মধ্যে দিয়েও স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়ে।
আমাদের দেশে প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ আইন দ্রুত কার্যকরে সরকারকে সচেতন ভুমিকা পালন করতে হবে। প্লাস্তিক ব্যাগ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমুলুক শাস্তি দিতে হবে। প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগসহ সহজলভ্য ও পরিবেশবান্ধব ব্যাগ ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে।
বাংলাদেশে ২০০২ সালে প্লাস্টিক ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। আইনানুসারে সকল প্রকার প্লাস্টিক শপিং ব্যাগের উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরন, বিক্রয়, বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ বিতরন বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিলো। নামানো হয়েছিলো ভ্রাম্যমান আদালত। মোটামুটি সেই সময় ভালই সারাও পাওয়া গিয়েছিলো। প্লাস্টিক ব্যাগ এর বিপরীতে পরিবেশসম্মত পাটের ব্যাগ ব্যবহার করার কথা হয়েছিলো। কিন্তু বাজার থেকে এই দীর্ঘ একযুগ পরে এসেও প্লাস্টিক ব্যাগ যেমন পুরোপুরি উঠে যায়নি, তেমনি জনপ্রিয় হয়নি পাটের ব্যাগ। যদিও এখন নেটের ব্যাগ ব্যবহৃত হয়ে আসছে কিন্তু হরদম ব্যবহৃত হচ্ছে প্ল্যাস্টিকের ব্যাগ। যার উপর কোন নিয়ন্ত্রন নেই সরকারের পক্ষ থেকে।
২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলিতে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১২৫জন মানুষ মারা যায়। আর এই অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ি ছিল অবৈধভাবে গড়ে ওঠা প্লাস্টিক কারখানায় ব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থের গুদাম।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে পণ্যে পাটজাত মোড়কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক আইন ২০১০ গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। আইনে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যের মোড়ক হিসেবে ৭৫ শতাংশ পাট আছে এমন উপাদান দিয়ে তৈরি মোড়ক ব্যবহারের বিধান রাখা হয়। অথচ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সাশ্রয়ী ও সহজলভ্যতার কারণে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য চালের মোড়কজাতকরণে ৮০ শতাংশ প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার হয়ে আসছে।
আমাদের পাশের দেশ ভারতে ২০১১-১২ সালে পাটজাত দ্রব্য উৎপাদন করে নিজেরা ব্যবহারের পর রফতানি করেছে প্রায় ৭৫ মিলিয়ন কোটি টাকার। সরকারি সহায়তা, উন্নত প্রযুক্তি, উদ্ভাবনী ক্ষমতা ইত্যাদির কারণে ভারতের এই সাফল্য।
অথচ, আমাদের দেশে পাটকে বলা হতো একসময় সোনালী আঁশ তার বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুনামের কারণে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় পাটের উৎপাদন না বেড়ে বরং বন্ধ হয়ে গেছে এই শিল্পের সাথে জড়িত অনেক কারখানা।
সারা বিশ্বে বর্তমানে ৫০০ মিলিয়ন থেকে এক ট্রিলিয়ন পাটের ব্যাগের চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন ও পাটকলগুলো তা কাজে লাগাতে পারছে না। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বছরে মাত্র ১২ লাখ পাটের ব্যাগ রফতানি হয়ে থাকে। ২০১৫ সাল নাগাদ ইউরোপে প্লাস্টিক ব্যাগ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পাটের ব্যাগ রফতানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
সুদীর্ঘ একযুগ আগে দেখা স্বপ্ন কি বাস্তবতার রুপ দেখবে আদৌ ?
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৮