মার বিলাল, মার। শালার ঘাড়ে একটা কোপ দে।
সুমনের রক্তাক্ত দেহটি মুহূর্তে মাটিতে লুটিয়ে পরে। প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে সুমনের লাশ পরে আছে হলের মাঠে। পুরো হল জুড়ে ছাত্রদের মাঝে আতংক, ক্ষণে ক্ষণে গোলাগুলির শব্দে কেঁপে উঠছে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন। কেউ নেই যে সাহস করে যাবে সুমনের লাশটিকে উঠিয়ে আনবে। এরই মাঝে ছাত্র ছাত্রীরা হল ত্যাগ করতে শুরু করেছে।
-সীমানা কীরে তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস ? আচ্ছা রকম মেয়েরে তুই ! চারদিকে আগুন লেগে সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও দেখছি তুই কিছুই টের পাবিনা !
-কেন কি হয়েছে ?
-কি হয়েছে ! শীঘ্রই উঠে সব কিছু গুছিয়ে নে। আমাদের এখনই হল ছেড়ে যেতে হবে। গন্ডগল শুরু হয়ে গেছে। গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাচ্ছিস না ?
-আবার সেই হল দখল কাহিনী শুরু হয়ে গেলো নাকিরে ?
-হুম ! এইত আমাদের দেশের ছাত্র রাজনীতি। জানিস না এখন ক্ষমতায় কারা এসেছে ! হল দখল নেবে এটাইত রীতি। চল, চল দেরী করলেই ঝামেলায় পরে যেতে হবে। সবাই বের হয়ে গেছে। আর তুই কীনা কিছুই টের না পেয়ে এখনো ঘুমাচ্ছিস !
-কিন্তু সুমন ! সুমনের কোন খবর জানিস ? এখনত সুমন ঝামেলায় পরবে নিশ্চিত !
-ঝামেলায় পরলে পরবে! কে বলেছিলো ওকে রাজনীতির সাথে জড়াতে। এখন বুঝুক ঠেলা। রাজনীতি করার সাধ মিটবে এবার।
-কী সব বাজে বকছিস ? আশ্চর্য ! ওর সাথে দেখা না করে, কথা না বলে যাই কি করে ? ওর কি অবস্থা এটা জানতে হবেনা ! রাজনীতি করছে বেশ করছে। আরে ওরা যদি রাজনীতি করে দেশের হাল ধরতে এগিয়ে না আসে তবে দেশের হাল ধরবেটা কে, তুই ?
-না বাবাহ ! আমার এত দেশ নিয়ে ভেবে কাজ নেই। পড়াশোনা করতে এসেছি। বাবা-মা অনেক স্বপ্ন নিয়ে পড়তে পাঠিয়েছেন। মানুষ হতে পাঠিয়েছেন। রাজনীতি করে অমানুষ হতে পাঠায় নি।
-তুই কেন দেশ নিয়ে ভাববি বল !
-দেখ সীমানা, এখন আর পুরনো কথা ভেবে মন খারাপ করার কোন দরকার নেই। চল বেরুই শীঘ্রই।
সীমানা আর নীপা বেরিয়ে এলো হল ছেড়ে। সীমানার সাথে সুমনের শেষ দেখাটা আর হলোনা। অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে দেয়া হলো। সীমানা বাড়ি ফিরে এসেই মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল।
-মা কেমন আছো?
-কীরে এবার কিছু না বলেই চলে এলি যে !
-মা হল দখল নিয়ে গন্ডগোল হয়েছে। অনির্দিষ্ট কালের জন্য ভার্সিটি বন্ধ। হঠাত করেই এই অবস্থা হলো বলে তোমাকে জানাতে পারিনি।
মঞ্জিলার বুকের ভেতরটাতে হাহাকার করে উঠল। মঞ্জিলা তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। সীমানার বুঝতে বাকি রইলনা তার মায়ের চোখের এই অশ্রুর কারন। একটু বড় হবার পর যখন সে সব কিছু বুঝতে শিখেছে তখন তার মায়ের কাছ থেকে শুনেছিলো তার জন্ম নেয়ার সেই হৃদয় বিদারক কাহিনী। সীমানার চোখের কোনে অশ্রু নেমে এলো।
২৫ শে মার্চ, ১৯৭১। তখন প্রায় মাঝ রাত। সুইপার মালা বেগম পাক সেনাদের একটি ক্যাম্পে বন্দী ছিলেন। যেটি ছিলো পুলিশদের একটি হেড কোয়ার্টার। যা পাকবাহিনীর একটি বিরাট ক্যাম্পে পরিণত করা হয়। পুলিশদের প্রতিরোধ ব্যর্থ হবার পরে ধর্ষিত হন মালা বেগম। সুইপার বলে প্রাণে বেঁচে যান কারণ রক্ত ও লাশ পরিস্কার করার জন্য তাকে দরকার ছিলো সেনাবাহিনীর। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেয়েদের ধরে আনা হয়। আসা মাত্রই সৈনিকরা উল্লাসে ফেটে পড়ে। তারা ব্যারাকে ঢুকে প্রতিটি যুবতী, মহিলা এবং বালিকার পরনের কাপড় খুলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে ধর্ষণে লিপ্ত হতে থাকে। মালা বেগম ড্রেন পরিস্কার করতে করতে এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। পাকসেনারা ধর্ষন করেই থেমে থাকেনি, সেই মেয়েদের বুকের স্তন ও গালের মাংস কামড়াতে কামড়াতে রক্তাক্ত করে দেয়, মাংস তুলে নেয়। মেয়েদের গাল, পেট, ঘাড়, বুক, পিঠ ও কোমরের অংশ তাদের কামড়ে রক্তাক্ত হয়ে যায়। এভাবেই চলতে থাকে প্রতিদিন। যেসব মেয়েরা প্রাথমিকভাবে প্রতিবাদ করত তাদের স্তন ছিড়ে ফেলা হতো, যোনি ও গুহ্যদ্বা্রের মধ্যে বন্দুকের নল, বেয়নেট ও ধারালো ছুরি ঢূকিয়ে হত্যা করা হতো। বহু অল্প বয়স্ক বালিকা উপুর্যুপুরি ধর্ষণে নিহত হয়। এর পরে লাশগুলো ছুরি দিয়ে কেটে বস্তায় ভরে বাইরে ফেলে দেয়া হতো।
মেয়েদের ধরে নিয়ে এসে, ট্রাক থেকে নামিয়ে সাথেই সাথেই শুরু হতো ধর্ষন। হেড কোয়ার্টারের দুই, তিন এবং চারতলায় এই মেয়েদের রাখা হতো, মোটা রডের সাথে চুল বেঁধে। এইসব ঝুলন্ত মেয়েদের কোমরে ব্যাটন দিয়ে আঘাত করা হতো প্রায় নিয়মিত, কারো কারো স্তন কেটে নেয়া হতো, হাসতে হাসতে যোনিপথে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো লাঠি এবং রাইফেলের নল। কোন কোন সৈনিক উঁচু চেয়ারে দাঁড়িয়ে উলঙ্গ মেয়েদের বুকে দাঁত লাগিয়ে মাংস ছিড়ে নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ত, কোন মেয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে তখনই হত্যা করা হতো। কোন কোন মেয়ের সামনের দাঁত ছিলো না, ঠোঁটের দু’দিকের মাংস কামড়ে ছিড়ে নেয়া হয়েছিলো, প্রতিটি মেয়ের হাতের আঙ্গুল ভেঙ্গে থেতলে গিয়েছিলো লাঠি আর রডের পিটুনিতে। কোন অবস্থাতেই তাঁদের হাত ও পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হতো না, অনেকেই মারা গেছে ঝুলন্ত অবস্থায়। অবিরাম ধর্ষণের ফলে কেউ অজ্ঞান হয়ে গেলেও থামত না ধর্ষণ। বেশির ভাগ মেয়ের লাশ পরে থাকতো উলঙ্গ অবস্থায়। অনেকের শরীর গুলিতে ঝাঝরা থাকত। সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত, জমাট বাঁধা ছোপ ছোপ রক্ত সারা গায়ে লেগে থাকত। ধর্ষণ শেষে কারো কারো দুই পা দু’দিক থেকে টেনে ধরে নাভি পর্যন্ত ছিড়ে ফেলা হতো।
এমনই এক রাতের আঁধারে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল থেকে ট্রাকে করে কিছু মেয়েদের ধরে আনা হয়। তাদেরই একজন হলেন মঞ্জিলা। তাকে আরো ৩০ জন মেয়ের সাথে একটি কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। সার্বক্ষণিক প্রহরায় থাকতো দুজন সশস্ত্র গার্ড। এই মেয়েগুলোকে বিভিন্ন ক্যাম্পের সামরিক অফিসারদের খোরাক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। প্রতি সন্ধ্যায় নিয়ে যাওয়া হতো ৫/৬ জন মেয়েকে এবং ভোরবেলা ফিরিয়ে দেয়া হতো অর্ধমৃত অবস্থায়। প্রতিবাদ করলেই প্রহার করা হতো পূর্বোক্ত কায়দায়। এই বন্দীশালায় খাবার হিসাবে দেয়া হতো ভাত এবং লবন। একরাতে মালা বেগম এসব আর সহ্য করতে না পেরে ভোর হবার কিছু আগে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পালানোর সময় গাছের সাথে মঞ্জিলাকে বাঁধা অবস্থায় দেখতে পায় সে। প্রথমে ভেবেছিলো মেয়েটি বুঝি মরেই গেছে। কিন্তু মঞ্জিলার গোঙানির শব্দ কানে এলে তার বাঁধন খুলে দিয়ে তাকে নিয়ে বহু কষ্টে দেয়াল টোপকে পালাতে সক্ষম হয় মালা বেগম। পালিয়ে মালা বেগম চলে আসে মঞ্জিলাকে নিয়ে তার গ্রামের বাড়িতে। সারাদেশে তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ একসময় শেষ হয়। বাংলাদেশ নামের এই স্বাধীন দেশেটির জন্ম হয়। আর মানচিত্রের ন্যায় পৃথিবীর মাটিতে নতুন আলোকময় প্রহর নিয়ে বিজয়ের সেই দিনই জন্ম হয় সীমানার। নির্ধারিত হয় মঞ্জিলার জীবনের নতুন সীমানা।
সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের ছাত্রী এখন সীমানা। পরদিন পত্রিকায় ছাপা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সুমনের হত্যাকান্ডের খবর। সীমানার চোখে আজ অশ্রু নেই। সব কান্না জমে আজ তার কণ্ঠে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সীমানা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে এসে সব ছাত্র ছাত্রীদেরকে সংঘটিত করতে শুরু করে সুমন হত্যার বিচার দাবি করে।
-বিলাল কি করিস?
-ভাই চা খাই।
-চা খাওয়া ভালো অভ্যাস। নিয়মিত চা খাবি। যত চা খেতে চাস আমি তোকে খাওয়াবো। কোন সমস্যা নাই। কিন্তু তোকে ওই সীমানাকে আমার কাছে এনে দিতে হবে। ওর কণ্ঠে আমি চিৎকার শুনতে চাই।
-জী ভাই এনে দেবো।
-গুড।
রাজপথে গুটি কয়েক ছাত্র ছাত্রী হাতে পোস্টার নিয়ে জড়ো হয়েছে। লাল, সবুজ আর হলুদ রঙের কাগজের সেইসব পোস্টারে কালো কালি দিয়ে লেখা রয়েছে সুমন হত্যার বিচার চাই। সবার সামনে দাড়িয়ে সীমানা। হঠাত ওদের শ্লোগান থামিয়ে দিয়ে বিলালের সন্ত্রাসীরা ওদের উপর হকিস্টিক দিয়ে আঘাত করতে শুরু করে দিলো। মুহূর্তে ছত্র ভঙ্গ হয়ে গেলো প্রতিবাদ জনসভা। সীমানাকে সকলের সামনে থেকে একটি মাইক্রোতে করে উঠিয়ে নেয়া হলো। সীমানার মুখ, হাত, পা বেঁধে রাখা হয়েছে। মাইক্রো চলছে, পেছনে খুব দ্রুত ছুটে চলেছে চেনা শহরটাকে বড় অচেনা করে দিয়ে সবকিছু। সন্ত্রাসীরা গাড়ির ভেতরেই সীমানার শরীরটাকে ছিঁড়ে উল্লাসে ফেটে পড়তে লাগলো। সীমানার চিৎকার আর আর্তনাদে যেন দূর হতেই কেঁদে উঠল মায়ের বুক। কেউ একজন দৌড়ে এসে মঞ্জিলাকে খবর দিলো যে তার মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে একটি ধান ক্ষেতে পরে থাকতে। সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় সমস্ত শরীর ক্ষতবিক্ষত, জমাট বাঁধা ছোপ ছোপ রক্ত সারা গায়ে লেগে আছে। ধর্ষণ শেষে সীমানার দুই পা দু’দিক থেকে টেনে ধরে নাভি পর্যন্ত ছিড়ে ফেলা হয়েছে।
উৎসর্গঃ প্রিয় ব্লগার *কুনোব্যাঙ*
*******************************************************
প্রিয় ব্লগার স্বপ্নবাজ অভি আহবান করেছিলো মা নিয়ে বেশি বেশি পোস্ট দিতে । তার আহবানে সাড়া দিয়ে ব্লগ পাতা ভরে যায় মায়ের প্রতি ভালোবাসায় । আমাদের প্রিয় মা আর মাতৃভাষা এবং প্রিয় মায়ের এই দেশটাকে সকল পঙ্কিলতা থেকে দুরে রাখার এই শুভ উদ্যোগ বয়ে যাক অনাদি কাল । মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা বুকে ধারণ করে ঐতিহাসিক আজকের এই ৭ ই নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসকে স্মরনে রেখে লিখলাম সীমানা শিরোনামের এই গল্পটি। গল্পের কাহিনী ও চরিত্র বিন্যাস নিতান্তই আমার কল্পনাকে কেন্দ্র করে লিখেছি।
*******************************************************
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মে, ২০১৫ রাত ১১:৪৪