রাত প্রায় এগারোটা, বসে আছি স্টেশনে। ট্রেন ছাড়তে এখনো প্রায় এক ঘন্টা সময় বাকি। এই একটি ঘন্টা যেন কিছুতেই কাটতে চাইছেনা। অপেক্ষা জিনিসটা মানুষকে বেশ অস্থির করে তোলে। অস্থিরতা কাটাতে তখন প্রয়োজন হয় অতিরিক্ত নিকোটিনের। একের পর এক সিগারেট টেনে যাচ্ছি। হঠাত করে সামনে দেখলাম একটি মেয়ে দাড়িয়ে আছে। পরনে তার গোলাপি রঙের শাড়ি। গোলাপি রঙের প্রতি একধরনের বিশেষ দুর্বলতা কাজ করার কথা, কিন্তু আশ্চর্য ! আমার তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হচ্ছেনা এই মুহূর্তে। মেয়েটি আকাশের দিকে উদাস ভঙ্গিতে তাকিয়ে অন্ধকারে কি যেন খুঁজছে ! মেয়েটিকে দেখে খুব চেনা চেনা মনে হলো। মনে হলো মেয়েটির সাথে আমার পূর্বের কোন পরিচয় রয়েছে। কোন এক অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে আমাদের মাঝে বিচ্ছেদ হয়েছিলো। আজ তাকে নতুন করে পুনরায় সামনে পেলাম। আর এ কারনেই বুঝি আজকে ট্রেনের শিডিউল চেঞ্জ হয়েছে। ঈশ্বরের খেলা বোঝা মুশকিল ! প্রতিনিয়ত তিনি আমাদের সাথে খেলতে পছন্দ করেন। আমরাও সেই খেলায় কখনও জয়ী হই, কখনওবা হেরে যাই, তবে এখানে জয় পরাজয় আমাদের জন্য আপেক্ষিক হলেও ঈশ্বর ঠিকই এখান থেকে তার প্রাপ্তিটুকু বুঝে নেন।
ভীষণ চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে। দেখি কোথাও চা পাই কিনা । চায়ের দোকান খুঁজতে খুঁজতে সময়টা কেটে যাবে, এর মাঝে হয়ত ট্রেন ছাড়ার সময়ও হয়ে আসবে। বেশি খোঁজা খুঁজি করতে হলোনা। একটি চায়ের দোকান পেয়ে গেলাম। দোকানে এক বৃদ্ধা বসে আছেন। আর কেউ নেই। বুঝলাম এই রাতে আমিই এখন তার একমাত্র কাস্টমার। তাই চা চাইতেই বেশ খুশি মনে অনেক যত্ন করে চা বানাতে লাগলেন। যেন বহুদিন পর ছেলে বাড়িতে ফিরে মায়ের কাছে চায়ের আবদার করেছে। এখন পৃথিবীর সবচেয়ে অমৃত চাটাই বানিয়ে ছেলেকে পরম যত্নে খাওয়াবেন। খালা এত রাতে দোকান খোলা রেখেছেন ? দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাবেন কখন ? আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার কোন ইচ্ছে বৃদ্ধার মাঝে দেখতে পেলাম না বরং তিনি রাগান্বিত চোখে আমাকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন, আজ যেন আমি এই ট্রেনে করে না যাই। এতে নাকি আমার জন্য অশুভ কিছু অপেক্ষা করছে। আমি বৃদ্ধার কথায় হেসে উঠলাম। আমার হাসি থামিয়ে দিয়ে বৃদ্ধা আমাকে গালি দিয়ে তার দোকান থেকে তাড়িয়ে দিলেন। চাটা শেষ করতে পারলাম না। বৃদ্ধা আমাকে যাচ্ছে তাই বলে তাড়িয়ে দিলেন। ফিরে এসে মেয়েটিকে দেখতে পেলাম না। ওদিকে ট্রেন থেকে বাঁশির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্রেন ছেড়ে দেবে। যে স্টেশনটি এতক্ষন ছিলো জনমানব শূন্য সেখানে কোথা হতে যেন একগাদা লোক এসে হই হুল্লোড় শুরু করে দিয়েছে। আমি আমার হাতের টিকেটটি নিয়ে দেখলাম তাতে চ নাম্বার বগীর বত্রিশ নাম্বার সীট লেখা রয়েছে। চ নাম্বার বগী খুঁজতে বেশি কষ্ট করতে হলোনা। যেখানে দাড়িয়ে ছিলাম তাকিয়ে দেখি সামনেই চ নাম্বার বগী। বগীতে উঠেই বত্রিশ নাম্বার সীট খুঁজে পেলাম ঠিকই কিন্তু বুকের ভেতরটা আবার কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। আমার সামনের সীটে বসেছে সেই মেয়েটি সাথে খুব সম্ভবত তার কোন বান্ধবী।
ট্রেন ছুটে চলেছে। পেছনে অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে দূরের আকাশ আর নাম না জানা সারিবদ্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকা গাছগুলো। বাতাসের কারণে মেয়েটির চুলগুলো উড়ছে। কিন্তু সেই অবাধ্যতাকে শাসন করতেই মেয়েটি চুলগুলোকে যত্ন করে খোঁপায় বেঁধে নিলো। সিগারেট খাওয়ার নাম করে বার বার উঠে গিয়ে মেয়েটিকে দেখছি। এমন অপরূপ মেয়ে এর আগে আমি কখনও দেখিনি। পৃথিবীর কোন কিছুর সাথেই তুলনা করা যাবেনা এমন রূপের। পৃথিবীতে এমন কোন উপমা সৃষ্টি হয়েছে কিনা জানা নেই। আমার শুধু মিরিন্ডার আঁকা ওর নিজের স্কেচটিই চোখে ভেসে আসছে। মিরিন্ডার সাথে ব্লগে পরিচয় হলেও এর আগে বাস্তবে কখনও দেখা হয়নি। এমনকি কথাও হয়নি। তবে ব্লগে কারও সাথে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হতে পারে ভাবাই যায়না যেমনটা মিরিন্ডার সাথে হয়ে গেছে। মিরিন্ডা কারও নাম হতে পারেনা কিন্তু ব্লগে এটা খুব স্বাভাবিক। সাধারনত ব্লগে ব্লগাররা এভাবেই নিজেদের নানা রকম ছদ্দনাম ব্যবহার করে থাকেন। মিরিন্ডাও ঠিক এমনই একজন। তবে আসল নাম কখনও না বললেও একবার ওর নিজের একটি স্কেচ এঁকে পোস্ট দিয়েছিলো। সেই থেকে ওর মুখটি আমার মনের মাঝে গেঁথে আছে। ট্রেনের এই মেয়েটির সাথে মিরিন্ডার সেই স্কেচের ভীষণ মিল খুঁজে পাচ্ছি। একবার মনে হলো স্বপ্ন দেখছি নাতো। স্বপ্ন দেখছি কিনা যাচাই করতে যেয়ে অনিচ্ছা স্বত্বেও মেয়েটিকে পেছন থেকে কাঁধে স্পর্শ করলাম। মনে হলো নাত আমি স্বপ্ন দেখছিনা। আমি জেগেই আছি। আমার সামনের মেয়েটিই মিরিন্ডা।
হঠাত মেয়ে দুটি পেছন ফিরে আমাকে যাচ্ছে তাই বলে গালি দেয়া শুরু করল। ওদের রক্তচক্ষুকে আমি কিছুতেই বোঝাতে পারছিনা যে আমি কোন পাপ বোধ থেকে এভাবে ছুঁয়ে দেইনি। আমাকে শুধু শুধু আপনারা গালি দিচ্ছেন। আমি আসলে, আমার এক পরিচিতা রয়েছেন নাম মিরিন্ডা তাকে ভেবে; ভুল বশত দেখতে চাইছিলাম যে আপনি আসলেই সেই মিরিন্ডা কিনা। এই কথা শোনার পর যেন আরও কয়েকগুন বেড়ে গেলো ওদের গালাগালি। ট্রেনের বাকি সবাই যেন কেমন হিংস্র চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এখনই বুঝি আমাকে মারা হবে ইভ টিজিং করার অপরাধে। আমি লজ্জায় মাথা নত করে বসে আছি। কি করব ভাবতে ভাবতে ট্রেনের চেন ধরে টান দিলাম। ট্রেনটি থেমে গেলে আমার সাথে একটি ছোট ব্যাগ আছে কাঁধে নিয়ে ট্রেনের দরজা দিয়ে নিচে নামতে যাবো এমন সময় অনুভব করলাম কে যেন আমার ডান হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। কিন্তু ততক্ষনে আমি ট্রেন থেকে নেমে পরেছি। পেছনে ফিরে দেখি মেয়েটি আমার ডান হাত ধরে আছে আর পেছনে দাড়িয়ে আছে ওর বান্ধবী। হঠাত করে ট্রেনটি ছেড়ে দিলো। এমন একটি জঙ্গলে দাঁড়ান নিরাপদ নয় মনে করেই ট্রেনটি ছেড়ে দিলো। আর তাছাড়া আমার নেমে যাওয়া ছাড়া অন্য আর কিছুই তারা খুঁজে পেলোনা। মেয়েটি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে শুধু একটিবার কান্না জড়ানো কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল। আমার কানে শুধু ভেসে এলো মিরিন্ডা, হ্যাঁ আমি সেই মিরিন্ডা।
রাতের বেলা অন্ধকার জঙ্গল দিয়ে হাটছি। সম্পূর্ণ অপরিচিত অচেনা এমন একটি জঙ্গলে হাটা মোটেই নিরাপদ নয়। কিন্তু পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছে। হাটতে হাটতে অনেকটা দূরের পথ চলে এসেছি। হাঁটছি আর খশ খশ শব্দ হচ্ছে ঝোরে পরা শুকনো পাতার। অন্ধকারের নিস্তব্ধতা ভেঙে জোনাক পোকাদের সুরের মূর্ছনা আর মিট মিট করে জ্বলতে থাকা পথ ধরে হাটছি। যেন পোকাগুলো আমাকে এই অন্ধকারে দিক নির্দেশনা দিয়ে চলেছে। সামনেই একটি গ্রাম নজরে এলো। গ্রামের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভোর হয়ে এলো। দূরের কোন মসজিদ হতে আযান এর ধ্বনি ভেসে এলো। আকাশটাও ক্রমে সাদা হয়ে আসছে। একটি টিউবওয়েল নজরে এলো। তৃষ্ণায় গলাটা একবারে শুকিয়ে গেছে। কিছুটা পানি পান করে নেয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। টিউবওয়েলের কাছে যেতেই একটি আম গাছের সাথে একটি মেয়েকে ফাঁসিতে ঝোলা অবস্থায় দেখে চমকে উঠলাম। দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে আসব সেই অবস্থা পর্যন্ত রইল না। মাটি যেন আমার পা আঁকড়ে ধরেছে। চিৎকার করবো যে তাও পারছিনা কেউ যেন আমার কণ্ঠ চেপে ধরেছে। কতক্ষণ এভাবে দাড়িয়ে আছি বলতে পারবো না। ঘর থেকে সবাই ছুটে এসেছে। চারিদিকে ছোটা ছুটি শুরু হয়ে গেছে। এরই মধ্যে গ্রামের সবাই এসে ভিড় করেছে। গ্রামের সবাই মেয়েটিকে নিয়ে এতই ব্যাস্ত হয়ে পরেছে যে আমাকে কেউ যেন দেখতেই পায়নি। এমন পরিস্থিতিতে আগে কখনও পরিনি। তাই শুধু দূর থেকে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছি। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম মেয়েটির নাম অনিলা। আজ রাতেই শহর থেকে বাড়িতে এসেছিলো। অনিলার পরিবারের ধারনা মেয়েটি শহরে যেয়ে প্রতারনার স্বীকার হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। ক্রমাগত নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে অবশেষে গ্রামে নিজ বাড়িতে ফিরে আত্মহত্যা করে।
মসজিদের ইমাম সাহেবকে ডাকা হলো জানাযা পড়ানোর জন্য। কিন্তু ইমাম সাহেব এই জানাযা পড়তে নারাজ। আত্মহত্যাকারীদের জানাযা পড়ানো যাবেনা। কারন এরা নাকি আর তখন দীনের পথে থাকেনা। আর কোন অদীনদ্বার মানুষের নাকি জানাযা পড়তে নিষেধ আছে। তাই ইমাম সাহেবের ফতোয়া অনুযায়ী জানাযা ছাড়াই মেয়েটিকে কবর দেয়া হলো। একবার ভাবলাম ইমাম সাহেবের কাছে তার এইসব ভণ্ড বানানো দীন সম্পর্কে জানতে চেয়ে প্রতিবাদ করি। কিন্তু গ্রামের সবাই যেভাবে তাকে মান্য করে তাতে করে আমাকে যে বিনা বিচারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়া হবে সেই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই। তাই নীরবে সব কিছু মেনে নিলাম। সেখান থেকে চলে এসে বাজারে এসেছি এখান থেকে ট্রেনে করে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা আছে কিনা খোঁজ নিয়ে দেখতে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম কোন ট্রেন নেই তবে বাস আছে। বাস পেয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচা গেলো। সারাদিন অনেক ধকল গেছে মনের উপর দিয়ে। বাসে উঠে চোখ বন্ধ হয়ে এলো নিমিষেই। রাজ্যের যত ঘুম সব যেন আজ আমার চোখে এসে ক্লান্ত হয়ে পরেছে। স্বপ্নে মিরিন্ডার মুখটা ভেসে উঠলো।
বাড়িতে ফিরে ল্যাপটপ ওপেন করে ব্লগে লগইন করে দেখি অনুসারিত ব্লগে মিরিন্ডার একটি পোস্ট। পড়তে শুরু করলাম।
জীবনের অর্থ যদি হয় শুধুই বেঁচে থাকা তবে বেঁচে থাকতে আমার ভীষণ আপত্তি রয়েছে। মানুষ তার বর্তমানের কাছে বন্দী। আমি এই বন্দী দশা হতে মুক্তি পেতে চাই। আমি দেখেছি, কোন মানুষ যখন মারা যায় সেই মানুষটিকে ঘিরে যারা এতকাল বেঁচে ছিলো তাদের জীবন যাপনের জন্য সৃষ্টি হওয়া নতুন কৌশল। কিন্তু আমার মৃত্যুর পর আমাকে ঘিরে যারা বেঁচে আছে, তারা কিভাবে তাদের জীবন যাপন করে; বেঁচে থেকেই দেখার খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু জানি এমনটা ঘটা কখনও সম্ভব নয়। তবু একবার মরে গিয়ে সেই সাধ পূরণের চেষ্টাটুকু করে দেখা যেতে পারে।
আমাকে মেঘ চুরির সাঁজা দেয়া হয়েছে;
শুনেছি গুনে গুনে একশত দোররা মারা হবে,
আমার অমানিশা ঘরের কট মট করে ওঠা চকিতে শোয়ায়ে ।
প্রিয়তম তুমিও কি আমার ঈশ্বরের মতো এমনই নিষ্ঠুর ?
আমি শূন্যতার কাছে প্রশ্ন করে জেনেছি
আমার চেয়ে সেই অনেক বেশি পূর্ণ,
আমি পূর্ণতার কাছে প্রশ্ন করে জেনেছি
আমার চেয়ে সেই অনেক বেশি শূন্য,
তাই শূন্যতা আর পূর্ণতার মাঝেই সুখ খুঁজে ফিরি।
পোস্ট পড়ে আমার কানে শুধু ভেসে এলো মিরিন্ডা, হ্যাঁ আমি সেই মিরিন্ডা।