প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পঞ্চম পর্ব
ষষ্ঠ পর্ব
সপ্তম পর্ব
অষ্টম পর্ব
ফ্রিমেসন, ইল্লুমিনাত্তি কিংবা শয়তানী শক্তির একটি অন্যতম অপকৌশল হল দেশে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে তাদের প্রতিনিধি নিয়োগ করা । কারন এর মাধ্যমে বিস্তার করে ভিন্ন মতাদর্শ আর বাধান যায় হিংসা – গৃহযুদ্ধ। মুসলিম দেশগুলোতে মূলত গণতন্ত্রের চর্চা ছিলনা তারা ইসলামের শাসন তন্ত্র কায়েম করে চলে আসছিলো। কিন্তু এটা সহ্য হলনা আমেরিকার। তারা দেখিয়ে দিল যে কিভাবে যুদ্ধ না করে অন্য দেশে প্রভাব বিস্তার করা যায় । তার অন্যতম কিছু নিদর্শন হল; ৯/১১ টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে মুসলমানদের জঙ্গি হিসাবে আখ্যা দেয়া। মিশর , লিবিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক এবং সব শেষে ইরান নিয়ে তাদের পরিকল্পনা এবং এসব দেশে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দেয়া। কারন ইল্লুমিনাত্তি কাজ করে প্রথমে ধ্বংস এবং পরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করন নীতিতে আর এসব দেশে তাই চলছে। ইসরাইলের পার্লামেন্ট ভবনের মুল ফটকের দেয়ালে খোদাই করে লেখা রয়েছে যে তোমাদের ভূমি নীল নদ থেকে ফোরাত পর্যন্ত অর্থাৎ মিশর থেকে ইরান পর্যন্ত ভূখণ্ড হবে তাদের যা তারা মনে করে যে তাদের মসেস তাদের ঈশ্বর থেকে প্রদত্ত নির্দেশ দেয়া হয়েছিল কিন্তু আসলে এটা সম্পূর্ণ ভিত্তি হীন। আর এরই নীল নকশা বাস্তবায়নের জন্য ইসরাইল কাজ করছে সাথে তাদের আছে আমেরিকা যার মুল চালিকা শক্তি হল ইহুদী। একটা সময় আসবে যখন খৃষ্টানরা তাদের ভুল বুঝতে পেরে মুসলমানদের সাথে মিলে ইহুদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে এবং পরে তারা আবার মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করবে এবং উভয় যুদ্ধে মুসলমানদের জয় হবে এই ভবিষ্যৎ ঘটনাগুলো কোরআন এবং হাদিস দিয়ে সত্যায়িত করা হয়েছে মহান আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিন স্বয়ং নিজেই।
ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেয়ার পর স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র যাতে গঠিত হতে না পারে সেজন্য ইসরাইল ব্যাপক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ফিলিস্তিনকে আপাতত জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেয়া হলেও এর ফলে পরবর্তীতে ফিলিস্তিনকে এ সংস্থার পূর্ণাঙ্গ সদস্য পদের মর্যাদা দেয়ার সুযোগ তৈরি হল বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। পূর্ণাঙ্গ সদস্য পদ পেলে ফিলিস্তিন একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বলে ইসরাইল চিন্তিত হয়ে পড়েছে।
এদিকে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে এক ভোটাভুটিতে বেশির ভাগ দেশ ফিলিস্তিনকে এ সংস্থার পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেয়ার প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়ার পর অধিকৃত এলাকায় ইসরাইলের আগ্রাসী ততপরতা হঠাত বেড়ে গেছে। ফিলিস্তিনের বিভিন্ন শহরকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ইসরাইল এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে বায়তুল মোকাদ্দাসকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হতে না পারে। এরই অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দেয়ার পর এক প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলের মন্ত্রীসভা বায়তুল মোকাদ্দাস ও জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে তিন হাজার নতুন ইহুদি বসতি নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে সম্প্রসারণকামী নীতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ইসরাইল সৃষ্টির শুরু থেকেই ইহুদি উপশহর নির্মাণের কাজ চলে আসছে। দখলীকৃত বেশিরভাগ এলাকায় ইসরাইল ইহুদি উপশহর নির্মাণের কাজ সমাপ্ত করেছে। অবৈধ ইহুদি উপশহর সম্প্রসারণের মাধ্যমে ইসরাইল ফিলিস্তিনের বিভিন্ন শহরকে পরস্পর থেকে আলাদা করার চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে বায়তুল মোকাদ্দাসকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হতে না পারে।
এ ছাড়া, অবৈধ ইহুদি উপশহর বিস্তারের মাধ্যমে ইসরাইল ফিলিস্তিনের জনসংখ্যার কাঠামোয় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে যাতে নির্বিঘ্নে এ অঞ্চলে সম্প্রসারণকামী লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা যায়। ইসরাইল বর্ণবাদী প্রাচীর নির্মানের মাধ্যমেও ফিলিস্তিনিদেরকে বিভক্ত করে রেখেছে এবং এ প্রাচীরের মাধ্যমে কার্যত গোটা ফিলিস্তিন এলাকাকে বৃহত কারাগারে পরিণত করেছে।
ইহুদি উপশহর নির্মাণসহ ইসরাইলের এসব কর্মকাণ্ড জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সব রীতিনীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন। ফিলিস্তিন ইস্যুতে জাতিসংঘের ঘোষিত ২৪২ ও ৩৩৮ নম্বর প্রস্তাব এবং চতুর্থ জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী ফিলিস্তিনে ইসরাইলি জবর-দখল সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনি। কিন্তু ইসরাইল আন্তর্জাতিক এসব আইনের কোনো তোয়াক্কা করছে না এবং আমেরিকাসহ পাশ্চাত্য বিশ্বের সমর্থনে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে চলেছে। জাতিসংঘ মহাসচিবসহ এ সংস্থার অন্য কর্মকর্তারা ইসরাইলের এ আচরণের সমালোচনা করেছেন।
দখলদার ইসরাইলি বাহিনী পশ্চিমতীরে একটি মসজিদ গুড়িয়ে দিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, খুব ভোরে ইসরাইলি বাহিনী আল খলিল (হেব্রন) শহরের দক্ষিণে আল মুফাকারা গ্রামে বুলডোজার ও ভারী যন্ত্রপাতির সাহায্যে মসজিদটি গুড়িয়ে দিয়েছে।
ফজরের নামাজ পড়তে বেশ কিছু মুসল্লি সেখানে জড়ো হয়েছিলেন। কিন্তু দখলদার সেনারা মুসল্লিদের জোর করে মসজিদ থেকে বের করে দেয়। মসজিদের ভেতর থেকে ধর্মীয় বইগুলো সরানোরও সুযোগ দেয়া হয়নি। ইসরাইলি রেডিও মসজিদ ধ্বংসের খবরের সত্যতা স্বীকার করে বলেছে, পূর্ব অনুমতি না নিয়ে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল।
তবে আল মুফাকারা গ্রামের বাসিন্দারা বলেছেন, ইসরাইল নতুন করে বিপুল সংখ্যক বাড়ি তৈরির যে ঘোষণা দিয়েছে, তা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই মসজিদটি ধ্বংস করা হল। আল খলিল শহরের গভর্নর বলেছেন, সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের একটি প্রতিনিধি দল আল মুফাকারা গ্রামটি পরিদর্শন করেছেন। আর এরপরই সেখানকার মসজিদটি ধ্বংস করা হল। এর মাধ্যমে ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতি ইসরাইল চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন।
ফ্রান্স জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের জন্য পর্যবেক্ষক সদস্যের পক্ষে ভোট দেয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, মার্কিন সরকার তার তীব্র বিরোধিতা করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড বলেছেন, "আমরা এ ব্যাপারে আমাদের প্রাচীনতম বন্ধু দেশের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করছি। তারা জানে যে, আমরা তাদের সঙ্গে একমত নই।"
ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষের ভারপ্রাপ্ত প্রধান মাহমুদ আব্বাস আগামী ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিনকে এ বিশ্ব সংস্থার পর্যবেক্ষক সদস্য করে নেয়ার আবেদন জানাবেন। গত রোববার আব্বাস দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছেন, সাধারণ পরিষদের বেশিরভাগ দেশ তার আবেদনে সাড়া দেবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী ভোটাভুটি হয় তাহলে আমেরিকা তার বিরুদ্ধে ভোট দেবে। মাহমুদ আব্বাসের এ পরিকল্পনাকে তিনি 'ভুল' বলে আখ্যায়িত করেন।
নুল্যান্ড দাবি করেন, আমেরিকা 'দুই রাষ্ট্রভিত্তিক' সমাধান চায় যেখানে ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলি নাগরিকরা শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারবে। কিন্তু মাহমুদ আব্বাসের এ পরিকল্পনা সে লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে না।
ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লরেন্ট ফ্যাবিয়াস বলেছেন, স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের যে চেষ্টা ফিলিস্তিনিরা করছে তার প্রতি প্যারিসের সমর্থন রয়েছে।
ফিলিস্তিনি স্বশাসন কর্তৃপক্ষ এক বছরেরও বেশি সময় আগে জাতিসংঘের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য নিরাপত্তা পরিষদের দ্বারস্থ হয়েছিল। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে তা বাতিল করে দেয়।
১৯৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেলেই সংস্থাটির পর্যবেক্ষক সদস্যের মর্যাদা পেয়ে যাবে ফিলিস্তিন। এর ফলে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ফিলিস্তিনিদের প্রবেশ করার পথ সুগম হবে। ফলে তারা এসব সংস্থায় ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে পারবে।
ফিলিস্তিনে ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের মুখপাত্র তাহের আল নানু বলেছেন, ইসরাইলের আট দিনের আগ্রাসনে গাজায় অন্তত ১২০ কোটি ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তিনি সাংবাদিকদের আরো বলেছেন, ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজার প্রত্যক্ষ ক্ষতি হয়েছে সাড়ে ৫৪ কোটি ডলার এবং পরোক্ষ ক্ষতির পরিমাণ ৭০ কোটি ডলার।
তিনি বলেন, দখলদারদের হামলায় গাজার ২০০টি বাড়ী পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। আংশিক ক্ষতির শিকার হয়েছে আট হাজার বাড়ী। এ ছাড়া, হামাসের কেন্দ্রীয় দপ্তরসহ ৪২টি অনাবাসিক ভবন ইসরাইলি হামলায় পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনটি মসজিদ ও একটি চিকিতসা কেন্দ্রকেও মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে দখলদার ইসরাইল। এর আগে ইসরাইলের সেনাবাহিনী ঘোষণা করেছে, তারা আট দিনে গাজায় দেড় হাজার দফা হামলা চালিয়েছে।
গত ১৪ নভেম্বর থেকে ইহুদিবাদী ইসরাইল অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার ওপর সামরিক আগ্রাসন চালাতে শুরু করে এবং আট দিন সে আগ্রাসন অব্যাহত ছিল। তবে, ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ও ইসলামী জিহাদ আন্দোলনের যোদ্ধারা আগ্রাসনের জবাবে ইসরাইলের অভ্যন্তরে ব্যাপক মাত্রায় রকেট নিক্ষেপ করেছেন। এক পর্যায়ে উপায়হীন হয়ে ইহুদিবাদী ইসরাইল সরকার মিশরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি করতে বাধ্য হয় এবং তা বুধবার থেকে কার্যকর হয়েছে। ইসরাইলি হামলায় অন্তত ১৬০ জন ফিলিস্তিনি শহীদ ও বারোশ' আহত হয়েছে। হতাহতদের মধ্যে বহু সংখ্যক নারী ও শিশু রয়েছে। আল্লাহর ওপর ভরসা করে ধ্বংসস্তুপের ওপর দাড়িয়েও শয়তানি শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছে গাজার সংগ্রামী মানুষেরা। তাদের প্রতিরোধ আজ সারা বিশ্বেই প্রশংসিত হচ্ছে।
ইহুদিবাদী ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারনের ছেলে গিলাদ শ্যারন বলেছেন, তেলআবিবের উচিত গাজাকে পরমাণু অস্ত্র দিয়ে জাপানের হিরোশিমা শহরের মতই মাটিতে মিশিয়ে দেয়া। মানবতার শত্রু ইসরাইল যখন গাজার নিরপরাধ নারী ও শিশুদের উপর গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে তখন এ আহ্বান জানালেন নরপশু শ্যারনের ছেলে গিলাদ।
সাবরা ও শাতিলা গণহত্যার কুখ্যাত কসাই হিসেবে চিহ্নিত শ্যারনের ছেলে ইসরাইলি দৈনিক 'জেরুজালেম পোস্ট'-এ লেখা এক নিবন্ধে এই অভিমত প্রকাশ করেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করেছিল। ফলে কয়েক মিনিটের মধ্যে লাখ লাখ জাপানি নাগরিক প্রাণ হারিয়েছিলেন। ইসরাইলের কাছেও কয়েক শ' পরমাণু অস্ত্র রয়েছে।
গিলাদ শ্যারন লিখেছেন, ইসরাইলের উচিত গাজাকে হয় ধ্বংস করে দেয়া অথবা আবার শহরটি দখল করে নেয়া।
তিনি এ প্রসঙ্গে আরো লিখেছেন, " পুরো গাজার প্রতিটি অঞ্চল মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া উচিত। আমেরিকানরা হিরোশিমায় হামলা চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি- কারণ, জাপানিরা যখন আত্মসমর্পণ করছিল না তখন মার্কিনীরা নাগাসাকিতেও পরমাণু বোমা হামলা চালায়।"
কুখ্যাত শ্যারনের ছেলে আরো লিখেছেন, গাজার ফিলিস্তিনিরা নিরপরাধ নয়, বরং ইসরাইলি নাগরিকরাই নিস্পাপ। গাজায় আগ্রাসী নানা কৌশল প্রয়োগের পরামর্শ দিয়ে তিনি লিখেছেন, তা না হলে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন সম্ভব হবে না এবং সময় খুব দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে।
সিরিয়ার সংকট নিয়ে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নূরী আল মালিকি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার মধ্যে মত পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। ইরাক থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের আগে এই দুই নেতার বৈঠক হয়েছিলো ওয়াশিংটনে। সে বৈঠকে তাদের এই মত পার্থক্যের বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
এ সময়ে সিরিয়ার আভ্যন্তরীণ বিষয় নাক গলানো থেকে বিরত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেন নূরী আল মালিকি। তিনি বলেন, সিরিয়াসহ অন্যান্য দেশের জনগণের দাবির বিরোধী নয় ইরাক; কিন্তু তা বলে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদকে কোনো অবস্থায় গদি ছাড়ার কথা বলতে পারে না ইরাক। নূরী আল মালিকি আরো বলেন, সিরিয়ার সঙ্গে ইরাকের সীমান্ত রয়েছে আর এ ক্ষেত্রে ইরাকের স্বার্থ রক্ষার বিষয়টিই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবে।
সিরিয়ার বিরুদ্ধে আরবরাষ্ট্রগুলো নিয়ে বৃহত্তর জোট গঠনের চেষ্টায় আদাপানি খেয়ে লেগেছে যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমী কোনো কোনো দেশ সিরিয়া সংকট প্রসঙ্গে যে নীতি অনুসরণ করছে তারই প্রতিফলন ঘটছে আরব লীগের আচরণেও।
এরই মধ্যে সিরিয়ায় বিদেশি হস্তক্ষেপ ও সেনা অভিযানের প্রস্তাব উত্থাপন করেছে আরব লীগের কোনো কোনো দেশসহ যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং তুরস্ক । অবশ্য আরব লীগ এখনো এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
দামেস্কের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিন্তু জর্দান, ইরাক বা লেবাননের মতো সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো এ নিষেধাজ্ঞা আরোপে সম্মত হতে পারেনি। এ তিনটি দেশই মনে করে, সিরিয়ার পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে এ দেশগুলোর নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর তার সরাসরি বিরূপ প্রভাব পড়বে।
ইরাক সরকার বলছে, সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে আত্মাস্থ করা হবে এবং তারা তাদের অস্ত্র ত্যাগ করবে। জর্দান, লেবানন ও তুরস্কে অবস্থিতি ইরাকি এ সব গোষ্ঠীর সঙ্গে বাগদাদ সরকারের আলোচনা চলছে। মার্কিনীরা ইরাক ত্যাগের পরও যদি কোনো গোষ্ঠী যদি সশস্ত্র তৎপরতা অব্যাহত রাখে তবে তা সরাসরি ইরাক বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হবে।
ইরাকি গোষ্ঠীগুলোর মার্কিন ও ইরাকি সেনাসহ সাধারণ মানুষদের ওপর হামলা করার বা এ ধরণের তৎপরতা এখনো অব্যাহত রাখার পেছনে নানা কারণ রয়েছে। গত পবিত্র আশুরার দিনেও এমন হামলায় নিহত হয়েছেন অনেক শিয়া মুসলমান। এ সব হামলার সঙ্গে জড়িতদের কেউ কেউ বাথ পার্টির সমর্থক। এ ধরণের গোষ্ঠীর কোনো কোনোটির সঙ্গে উগ্রবাদী সালাফিদের যোগসাজশ রয়েছে। আর কোনো কোনো গোষ্ঠী তাদের হামলা চালানোর জন্য জোট বেঁধেছে আল কায়েদার সঙ্গে। এদিকে ইরাকে আল কায়েদার অবস্থান দুর্বল হয়ে গেছে। বাথ এবং সালাফিপন্থীরা গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন পেতো সিরিয়া থেকে। বর্তমানে তাও হারিয়েছে তারা। কিন্তু সালাফিদের অব্যাহত সমর্থন যুগিয়ে চলেছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতার। ইরাকে গোলোযোগ সৃষ্টি এবং স্থিতিশীল সরকার গঠনের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার লক্ষ্যে এ সব সমর্থন যুগিয়ে চলেছে তারা।
সাম্প্রতিক সংকট দেখা দেয়ার আগে ইরাকের অনেক গোষ্ঠীকেই প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেব ধরে নিয়েছিলো দামেস্ক ও তাদের প্রতি সমর্থন যুগিয়েছে সিরিয়া। ইরাকে বোমা হামলা ও নাশকতামূলক তৎপরতা চালানোর সঙ্গে জড়িত গোষ্ঠীগুলোকে নির্বিচারে সমর্থন দেয়াকে সে সময়ে ভাল ভাবে গ্রহণ করেনি ইরাক সরকার। বাগদাদ সে সময়ে পরিষ্কার ভাষায় এ ধরণের পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানিয়েছে। এমনকি প্রতিবাদ জানানোর জন্য তখন বাগদাদে নিযুক্ত সিরিয়ার রাষ্ট্রদূতকে ইরাকের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা পর্যন্ত হয়েছিল।
কিন্তু এখন পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। সিরিয়ার এখন ইরাকের সমর্থন একান্তই দরকার। আর গত কয়েকমাস ধরে সিরিয়ার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে চলছে ইরাক। সংবাদ মাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, কেবল মাত্র রাজনৈতিক সমর্থনই দিচ্ছে না ইরাক; বরং যুগিয়ে চলেছে অর্থনৈতিক ও তেল সংক্রান্ত সহযোগিতাও।
আরব লীগ সিরিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সিরিয়া- বিরোধী সে পদক্ষেপে যোগ দেয়ার কোনো ইচ্ছা নেই ইরাকের। অবশ্য আরব দেশগুলোর সাধারণ সিদ্ধান্তের সরাসরি বিরোধিতাও করতে চায় না ইরাক। এ ছাড়া, আগামী মার্চে আরব লীগের পরবর্তী বৈঠক বাগদাদে হওয়ার কথা রয়েছে।
দখলীকৃত দেশে এ ধরণের শীর্ষ বৈঠকে যোগ দেবে না বলে এর আগে কোনো কোনো আরব দেশ দাবি করেছিলো। মার্কিন সেনাদের শেষ দলটি চলতি মাস অর্থাৎ ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ ইরাক ত্যাগ করবে বলে কথা রয়েছে। এরপর 'দখলীকৃত ভূমি'র কথিত অজুহাত আর দিতে পারবে না ও সব আরব দেশ।
এদিকে কয়েকটা আরব দেশ দাবি করেছে, ইরাকে নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে এবং এ পরিস্থিতিতে তাদের নেতারা বাগদাদে যেতে পারবেন না। অবশ্য এ ধরণের অজুহাতের জবাবে ইরাক সরকার বলেছে, আগের চেয়ে নিরাপত্তা পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো শেষ পর্যন্ত তাদের অস্ত্র ত্যাগ করবে। এদিকে সিরিয়া সরকারের বিরোধিতা করছে সৌদি আরবসহ অনান্য আরব দেশ। বাগদাদ বৈঠকে তাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করার চেষ্টা কররেছ ইরাক। এ জন্য মধ্যম পথ গ্রহণ করেছে ইরাক। এ ছাড়া, আরব লীগ ও সিরিয়ার মধ্যে বিরাজমান সংকট নিরসনে মধ্যস্থতার চেষ্টা চালাতে পারে বলেও ঘোষণা করেছে বাগদাদ।
ইরাকি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা আলী আল-মুসাভি বলেছেন, তার সরকার সিরিয় সরকারের বিরোধীদের বাগদাদে যাওয়ার আহবান জানিয়েছে। সিরিয়ার সরকার বিরোধী গোষ্ঠীগুলো এরই মধ্যে এ আহবান গ্রহণের কথা জানিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এ সব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলা সত্ত্বেও বাগদাদে শেষ পর্যন্ত আরব লীগের সম্মেলন হবে কি না সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
অবশ্য আরব লীগের নেতারা যদি এ বৈঠকে যোগ না দেন এবং বৈঠকটি যদি বাতিল করতে হবে তবে তা মালিকি সরকারের জন্য একটি রাজনৈতিক বিপর্যয় হয়ে দেখা দেবে।
আরব লীগের শীর্ষ সম্মেলন নিয়েই কেবল ইরাককে মাথা ঘামাতে হচ্ছে না। বরং সিরিয়ার পরিস্থিতির যদি আরো অবনতি ঘটে তবে ইরাকের নিরাপত্তা পরিস্থিতির হয়ত আরো অবনতি ঘটতে পারে। সিরিয়া সরকারের যদি পতন ঘটে এবং দেশটিতে যে কোনো নামে সালাফিরা ক্ষমতা দখল করতে পারে তবে ইরাকে তাদের মিত্রদের জন্য তা সুখবর হয়ে দেখা দেবে। তখন সিরিয়ার সে সরকার কেবল ইরাক সংলগ্ন সীমান্ত খুলেই দিবে না বরং ইরাকের সালাফিদের সমর্থন জানানোকে তাদের জন্য নৈতিক কর্তব্য বলেও মনে করবে।
উদ্ভুদ এ রকম পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক ভাবেই ইরাকের নিরাপত্তা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটবে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ও সাম্প্রাদায়িক সংঘাতের আঘাত যেয়ে লাগবে লেবানন, জর্দান, এমনকি তুরস্কেও। সিরিয়ার প্রসঙ্গে তুরস্কের গৃহিত নীতিতে নাখোশ হয়ে আছে দেশটির আলাভি সম্প্রদায়। সিরিয়ায় যদি বিদেশি হস্তক্ষেপ হয় এবং শেষ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধের আগুন ছড়িয়ে পড়ে তাহলে সে আগুনের আঁচ থেকে নিস্তার পাবে না পার্শ্ববতী দেশগুলোও। আঞ্চলিক কোনো কোনো দেশকে সিরিয়া নিয়ে এ রকম সাত-পাঁচ ভাবতে হচ্ছে। ফলে সিরিয়ার পরিস্থিতির প্রতি লক্ষ্য রেখে তাদেরকে আরো সর্তক পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।
অবশ্য কোনো কোনো আরব দেশ দাবি করছে, সিরিয়ার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো গেলেই কেবল দেশটিতে গৃহযু্দ্ধ এড়ানোর পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু এ ধরণেল পরিকল্পনা বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন আরব লীগের মহাসচিব আল নাবিল আল আরাবি। তিনি বলেছেন, লিবিয়ার মতো কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি সিরিয়ার ঘটনো সম্ভব হবে না। অবশ্য তিনি মনে করেন, ইয়েমেনের আদলে কিছু ঘটানো গেলে তা সিরিয়ার জন্য খাপ খাবে। অর্থাৎ ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলকে শেষ পর্যন্ত একটি চুক্তিতে নিয়ে আসতে হবে।
ধর্ম এবং ধর্মীয় নানা গোষ্ঠী ভিত্তিক ধারা মধ্যপ্রাচ্যে প্রাধান্য বিস্তার করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ইরাক আগ্রাসন চালানোর পরবর্তীতে নির্বাচনের মাধ্যমে মালিকি সরকার বাগদাদের ক্ষমতায় আসে। তখন সৌদি কর্মকর্তারা মার্কিনীদের বলেছিলো, ইরাক চলে গেছে শিয়াদের হাতে; এ অবস্থায় মধ্যপ্রাচ্যে সুন্নিদের ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে সিরিয় সরকারের পরিবর্তন ঘটাতে হবে । অন্যদিকে আল কায়েদা ও বেশির ভাগ সালাফি গোষ্ঠী এ চিন্তধারার অনুসরণ করেছে এবং ইরাককে সাম্প্রদায়িক ও গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। এরকম গোষ্ঠীগুলোকে অতিমাত্রায় তৎপর দেখা যাচ্ছে সিরিয়ায়।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ইহুদিবাদী ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র এবং বৃটেন ইরান সম্পর্কে আতঙ্ক ছড়ানোর প্রচারণা জন্য জোরদার করেছে। পর্যবেক্ষকরা একে মধ্যপ্রাচ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ বাধানোর রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টির প্রচেষ্টা বলে মনে করছেন।
ইরান-আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়ার এক অশুভ ত্রিভূজ বা অক্ষ সৃষ্টিকারী এই ত্রয়ী বা ত্রিশক্তির সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা সম্প্রতি ঢাক-ঢোল পেটানো কয়েকটি গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে ইরানের বিরুদ্ধে অভিন্ন ফ্রন্ট গড়ে তুলেছে।
বৃটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকা জানিয়েছে, দেশটির প্রধান প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা ডেভিড রিচার্ড সম্প্রতি গোপনে তেলআবিব সফর করেছেন। তিনি ইসরাইলের শীর্ষস্থানীয় সেনা কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। এসব বৈঠকে ডেভিড ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোর ওপর ইসরাইলের সম্ভাব্য হামলার ব্যাপারে বৃটিশ সরকারের আগাম সমর্থনের আশ্বাস পুনরায় ব্যক্ত করেছেন। গত বুধবার ইসরাইলের যুদ্ধমন্ত্রী ইহুদ বারাক লন্ডনে এসে তার বৃটিশ সমকক্ষের সাথে বৈঠক করেছেন।
এদিকে মার্কিন সরকারও ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলার পরিকল্পনা ত্বরান্বিত করার কথা ভাবছে এবং বৃটেন এ ধরণের সম্ভাব্য হামলায় অংশ নিতে প্রস্তুত বলেও বৃটিশ কর্মকর্তারা ঘোষণা করেছেন। গত শুক্রবার ওয়াশিংটনে একজন সিনিয়র মার্কিন সেনা কর্মকর্তা বলেছেন, " বিশ্বে ইরানই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের স্বার্থের প্রতি সবচেয়ে বড় হুমকি"। একই দিনে ইসরাইলের প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজও বলেছেন, পরমাণু অস্ত্র অর্জনে ইরানকে বিরত রাখার জন্য সামরিক পন্থা ব্যবহারের সময় ঘনিয়ে আসছে।
ওদিকে ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি জি-টুয়েন্টি গ্রুপের নেতৃবৃন্দের বৈঠকে বলেছেন, " ইরানের আচরণ এবং পরমাণু অস্ত্র অর্জনের উচ্চাভিলাষ আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি এবং ইসরাইলের অস্তিত্ব হুমকির মুখোমুখি হলে ফ্রান্স নিরব থাকবে না"।
আসলে ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার ও তার মিত্রদের বাগাড়ম্বর ও প্রচারণা জোরদার নতুন কোনো ঘটনা নয়। তাই ইরান সব সময়ই সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী আকবর সালেহি সম্প্রতি লিবিয়ার বেনগাজি শহরে বলেছেন, মার্কিন সরকার আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো মোকাবেলার ক্ষেত্রে যুক্তি বা বিবেক-বুদ্ধির আশ্রয় না নিয়ে কেবল শক্তির ওপর ভরসা করছে, কিন্তু ইরানের সাথে সংঘাতে নামার আগে এর পরিণতি সম্পর্কে তারা আরো দুইবার ভেবে দেখবে বলে আমরা আশা করছি।"
ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার ও তার মিত্রদের কখনোই অভিযোগের অভাব হয়নি। ইরানে মানবাধিকার নেই, দেশটি সন্ত্রাসবাদের মদদদাতা, দেশটি পরমাণু অস্ত্র বানাচ্ছে- এসব ভিত্তিহীন ও পুরনো অভিযোগ শুনতে শুনতে বিশ্বও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আগামী সপ্তায় জাতিসংঘের পরমাণু শক্তি সংস্থা বা আই এ ই এ'র পক্ষ থেকে ইরানের পরমাণু কর্মসূচী সম্পর্কে প্রতিবেদন প্রকাশের কথা রয়েছে। এই উপলক্ষ্যকে সামনে রেখে ইরান বিরোধী নতুন অভিযোগের অধ্যায়ে বলা হচ্ছে, তেহরান স্টিলের এক বিশাল কন্টেইনার বা পাত্র নির্মাণ করেছে যাতে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক পরীক্ষা করা যায় এবং এ পাত্রটি পরমাণু অস্ত্র নির্মাণে ব্যবহৃত হতে পারে। এ ছাড়াও ইরান নাকি পরমাণু অস্ত্রের কম্পিউটার মডেল তৈরি করেছে... দেশটি অতীতেও পরমাণু বিষয়ক অনেক তথ্য গোপন রেখেছে... ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগের পর অভিযোগের পাহাড় গড়ে তুলছে মার্কিন সরকার ও তার মিত্ররা। ইসরাইল-বৃটেন-যুক্তরাষ্ট্রের ত্রিপক্ষীয় বলয় এসব অভিযোগ প্রচার করে ইরানের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করতে চায় এবং নানা ধরণের খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ইরানের সম্পদ লুট করাই তাদের আসল উদ্দেশ্য।
তবে ইরানও আগ্রাসী শক্তিগুলোকে শান্তিতে থাকতে দিবে না। গত আগস্ট মাসের ১১ তারিখে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বা রেভ্যুলুশনারী গার্ড বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা আলী শদমানি সম্ভাব্য হামলা মোকাবেলার জন্য ইরানের তিনটি কার্যকর পদক্ষেপের কথা বলেছেন। এ পদক্ষেপগুলো হল, প্রথমত যুক্তরাষ্ট্রের উঠান হিসেবে বিবেচিত ইসরাইলের শান্তি বিনষ্ট করা এবং তাতে মার্কিন সরকারের শান্তিও তিরোহিত হবে। দ্বিতীয়ত, ইরান হরমুজ প্রণালীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। এ সাগর-পথ দিয়ে বিশ্বের দেশগুলোতে তেল-সম্পদের শতকরা ৪০ ভাগ সরবরাহ করা হয়। তাই ইরানের সাথে যুদ্ধ করার অর্থ হল বিশ্বে তেল সরবরাহে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি এবং তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেলে এরিমধ্যে শোচনীয় হয়ে পড়া বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা আরো কাহিল হয়ে পড়বে।
তৃতীয়ত, ইরান আফগানিস্তান ও ইরাকসহ আশপাশের দেশগুলোতে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালাবে।
বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল হয়তো ইরানের বিরুদ্ধে একটি পারমাণবিক মহাপ্রলয় বা ধ্বংসযজ্ঞেরও পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। ইরানের বিপুল সম্পদ তাদেরকে বহু বছর ধরে প্রলুব্ধ করছে। বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের অশুভ জোটের মধ্যে কোন দেশটি ইরান-আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী তা পুরোপুরি স্পষ্ট না হলেও এটা স্পষ্ট যে বৃটিশ ও মার্কিন কুকুরের ইসরাইল নামক লেজটিই এখন কুকুরকে নাড়া দিচ্ছে।
সম্প্রতি সন্ত্রাসবাদের ব্যাপারে পাক ও মার্কিন নীতি নিয়ে পারস্পরিক অভিযোগ বা বিতর্ক জোরদার হয়েছে। ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদ উভয়ই পরস্পরকে সন্ত্রাস বিরোধী সংগ্রামে অকার্যকর কৌশল এবং দ্বিমুখী নীতির জন্য অভিযুক্ত করছে। এসব অভিযোগের প্রেক্ষাপট ও বাস্তব পরিস্থিতি নিয়েই আমাদের এ বিশেষ আলোচনা।
চলতি বছর অর্থাৎ ২০১১ সালের প্রথম থেকে শুরু হওয়া পাক-মার্কিন সম্পর্কের উত্তেজনা এখনও অব্যাহত রয়েছে। লাহোরে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ'র কর্মী রেমন্ড ডেভিসের হাতে দু'জন পাকিস্তানি নাগরিক নিহত হওয়ার পর থেকে এই উত্তেজনা শুরু হয়। পাকিস্তান সরকার তাকে আটক করে বিচারের উদ্যোগ নিলে মার্কিন সরকার দাবি করে যে ডেভিস ছিল কূটনীতিক এবং আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী কূটনীতিকদের বিচার করা যায় না। ডেভিস যে পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন কূটনীতিক ছিল সে ব্যাপারে মার্কিন সরকার কখনও কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি।
মার্কিন সরকারের এই কৌশল ব্যর্থ হওয়ার পর হোয়াইট হাউজ পাকিস্তানে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দেয়। এ অবস্থায় মার্কিন রাজনৈতিক চাপ বৃদ্ধির মুখে ইসলামাবাদ ডেভিসকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। অবশ্য পাকিস্তান সরকার নিহত দুই পাকিস্তানি নাগরিকের পরিবারকে অর্থ ক্ষতিপূরণ দিয়ে তাদের শান্ত করার ব্যবস্থা নেয়।
মার্কিন সরকার ২০০১ সালের পর থেকেই ইসলামাবাদকে "সন্ত্রাসবাদের ব্যাপারে নমনীয়" বলে অভিযুক্ত করে আসায় পাক-মার্কিন সম্পর্কে উত্তেজনা ও আস্থাহীনতার পরিবেশ অব্যাহত ছিল। এ অবস্থায় ডেভিসের ঘটনা উত্তেজনার নতুন কিছু পথ খুলে দেয়।
এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ কমান্ডো বাহিনী পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের অদূরে এবোটাবাদ শহরে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আলকায়দার নেতা ওসামা বিন লাদেনের বাসভবনে হামলা চালায়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মার্কিন কর্মকর্তারা পাক সরকারের বিরুদ্ধে আরেক দফা সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেয়। ইসলামাবাদ লাদেনের অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানত না বলে যে দাবি করেছে, ওয়াশিংটন তাকে সন্ত্রাসবাদের ব্যাপারে পাকিস্তানের দ্বিমুখি নীতির প্রমাণ এবং এ নীতি অগ্রহণযোগ্য বলে অভিহিত করেছে। অবশ্য আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে পাকিস্তান তার ওই দাবি থেকে সরে আসে। পাক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি ওয়াশিংটন পোস্টে লেখা এক নিবন্ধে এটা উল্লেখ করেন যে, লাদেন হত্যার অভিযানে পাক নিরাপত্তা বাহিনী অংশ নেয়নি এবং তার সরকার লাদেনের গোপন আস্তানা সম্পর্কে মার্কিন সরকারকে প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ সরবরাহ করেছিল।
পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালে বিন লাদেনের অবস্থানকে সন্দেহজনক স্থান হিসেবে উল্লেখ করে এ সম্পর্কে মার্কিন সরকারকে তথ্য দিয়েছিল বলে প্রেসিডেন্ট জারদারি উল্লেখ করেছেন। বিন লাদেন নিহত হওয়ার কয়েক ঘন্টা পরই তার অবস্থান সম্পর্কে পাকিস্তান সরকার কিছুই জানতো না বলে এক বিবৃতি দিয়েছিল। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশের সামরিক ও রাজনৈতিক কর্মকর্তারা পাকিস্তান সরকারের এ বিবৃতিকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেনি। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও আফগানিস্তানের কর্মকর্তারা বিন লাদেনের গোপন আস্তানা সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের অন্ধকারে থাকার দাবিকে গ্রহণযোগ্য বলে ভাবতে পারেনি। আর এ কারণেই পাকিস্তান সরকার তার ওই অবস্থান বা দাবি থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহির্বিশ্ব তো দূরে থাক, পাকিস্তানের ভেতরেও কেউ লাদেনের অবস্থান সম্পর্কে পাক সরকারের অজ্ঞতার দাবিকে বিশ্বাস করেনি। তাই পাক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটা স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, তারা ২০০৯ সালেই এবোটাবাদে লাদেনের লুকিয়ে থাকার স্থান সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। আসলে পাকিস্তান সন্ত্রাসের বিরদ্ধে কথিত মার্কিন যুদ্ধের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা বা বিশেষ ছাড় আদায়ের জন্যই লাদেনের গোপন আস্তানার বিষয়টি গোপন রাখতে চেয়েছিল। জারদারির স্বীকারোক্তি ও লাদেন হত্যার অভিযানে পাকিস্তানি সেনাদের অংশ নিতে না দেয়ার ব্যাপারে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ'র তৎকালীন প্রধান লিয়ন পেনেট্টার বিবৃতি মিলিয়ে দেখলে এটা স্পষ্ট হয় যে পাক সরকার লাদেনের গোপন আস্তানা সম্পর্কে অবহিত ছিল। তাই এটা স্পষ্ট, পাকিস্তানের মাটিতে গোপনে লাদেনের বসবাসের খবর ফাঁস হওয়ার বিষয়টি পাক-মার্কিন সম্পর্কে উত্তেজনা বৃদ্ধি ও ইসলামাবাদের ওপর মার্কিন চাপ বৃদ্ধির একটি বড় কারণে পরিণত হয়েছে।
মার্কিন প্রচার মাধ্যমগুলো সন্ত্রাসের ব্যাপারে তাদের ভাষায় "পাকিস্তানের দ্বিমুখী নীতি" আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক মাত্রায় প্রচার করে দেশটির সীমান্ত প্রদেশে পাইলটবিহীন মার্কিন বিমান বা ড্রোন হামলার পথ প্রশস্ত করেছে। পাকিস্তান সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর নয়, এমন দাবি বিশ্বময় প্রচারিত হওয়ায় দেশটিতে মার্কিন ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদও জোরদার হয়নি। এ অবস্থায় মার্কিন প্রচার মাধ্যমের হামলায় পাক সরকারের অবস্থান বহির্বিশ্বে নড়বড়ে হয়ে পড়ার পাশাপাশি দেশের ভেতরেও সংকটের সম্মুখীন হয়।
পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন পিপলস পার্টির সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিন লাদেনের গোপন আস্তানার ব্যাপারে পাক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জটিল নীতির তীব্র সমালোচনা করেছে। তারা পাক সরকারের ওপর মার্কিন চাপ বৃদ্ধির বিষয়টিকে ইসলামাবাদ সরকারের অদূরদর্শিতার ফসল বলে উল্লেখ করেছে। এদিকে অ্যাবোটাবাদে মার্কিন অভিযানের পর পাক সেনাবাহিনী মার্কিন সরকারের সাথে গোয়েন্দা সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়। পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গোয়েন্দা সহযোগিতা বন্ধ করায় মার্কিন কর্মকর্তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
হোয়াইট হাউজের অনেক কর্মকর্তা মনে করেন আফগানিস্তানে বিদেশী সেনা বা ন্যাটোর সামরিক অভিযানের নানা সাফল্যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সহযোগীতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাই পাকিস্তানের ওপর মার্কিন সরকার কখনও এত বেশি রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে চায়নি যাতে দু-দেশের সামরিক বা গোয়েন্দা সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়।
সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের সহযোগী দেশ হিসেবে উল্লেখ করেনি, বরং ইসলামাবাদকে সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ে ওয়াশিংটনের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র বলে উল্লেখ করেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কিত এ প্রতিবেদনের সমালোচকরা বলছেন, মার্কিন সরকার একদিকে তালেবানকে সহায়তা দেয়ার জন্য পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করে এবং সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াইয়ে পাকিস্তান কার্যকর ভূমিকা রাখছে না বলে উল্লেখ করছে। অন্যদিকে একই সরকার পাকিস্তানকে সন্ত্রাস বিরোধী লড়াইয়ে ওয়াশিংটনের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র বলেও উল্লেখ করেছে। এটা পরস্পর বিরোধী বা দ্বিমুখী নীতিরই প্রকাশ।
কিছু দিন আগে মার্কিন সরকার তার ভাষায় সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াইয়ে কার্যকর ভূমিকা না রাখার অভিযোগে পাকিস্তানকে ৮০ কোটি ডলারের অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য দেয়া স্থগিত করে। সম্প্রতি আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে মার্কিন দূতাবাসে তালেবানদের হাক্কানি গ্রুপের হামলার সঙ্গে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতা ছিল বলেও মার্কিন কর্মকর্তারা দাবি করেছেন।
অন্যদিকে পাক কর্মকর্তারা বার বার এটা বলে আসছেন যে, এ অঞ্চলে ও বিশেষ করে আফগানিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা জোরদারের জন্য সন্ত্রাসবাদ বা চরমপন্থার ব্যাপারে মার্কিন সরকার ও ন্যাটোর ভুল নীতিই দায়ী। এ ভুল নীতি পাকিস্তানকেও প্রভাবিত করছে।
এভাবে ইসলামাবাদ ও ওয়াশিংটন উভয়ই পরস্পরকে সন্ত্রাস বিরোধী সংগ্রামে অকার্যকর কৌশল এবং দ্বিমুখী নীতির জন্য অভিযুক্ত করছে। ফলে বিশ্ব জনমতের কাছে এ প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে যে, সন্ত্রাসবাদের ব্যাপারে কে দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করছে? মার্কিন সরকার না পাকিস্তান?
লিবিয়ার প্রাণঘাতি যুদ্ধ ও সংকট দিনকে দিন আরো জটিল হয়ে উঠছে। বিপ্লবী সেনা ও গাদ্দাফির ভাড়াটে সেনাদের মধ্যে যুদ্ধ অব্যাহত থাকার পাশাপাশি ন্যাটো জোটের সামরিক হস্তক্ষেপ উত্তর আফ্রিকার এই দেশটির সংকটকে কেবল আরো জটিল করতেই সহায়তা করছে। ন্যাটো জোটের সামরিক হস্তক্ষেপের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে জর্দান, কাতার, আরব আমিরাত ও সুইডেন।
লিবিয়ার ওপর জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের পক্ষ থেকে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি এ সংকটের দু'টি গুরুত্বপূর্ণ দিক। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ গাদ্দাফি ও তার ঘনিষ্ঠ দশ সহযোগীর সম্পদ আটক সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবও পাস করেছে। এই দশ জনের মধ্যে রয়েছে গাদ্দাফির চার সন্তান যারা লিবিয়ার সবচেয়ে ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব এবং পিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী।
লিবিয়ার চলমান সংকটের বিষয়ে চিন্তাবিদ, সাংবাদিক ও বিশেষজ্ঞ মহলে বিভিন্ন ধরনের পরস্পরবিরোধী মতামত দেখা যায়। কেউ কেউ বলছেন, প্রথম দিকে লিবিয়ার ঘটনাবলীকে তিউনিশিয়া ও মিশরে সংঘটিত বিপ্লবের প্রভাবিত বলে মনে করা হয়েছে। কিন্তু ছয় মাস আগে শুরু হওয়া বেনগাজিভিত্তিক গাদ্দাফি বিরোধী গণ-আন্দোলন এখন এমন এক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের রূপ নিয়েছে যা নিকট ভবিষ্যতে বন্ধ হবে বলে মনে হচ্ছে না।
গর্ডন ডাফ, স্টিফেন লেন্ডম্যান ও ফ্রান্সিস বয়লি'র মত কোনো কোনো পশ্চিমা বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞ বলছেন, পাশ্চাত্য তেল সম্পদের জন্যই গাদ্দাফির বিরুদ্ধে সামরিক অবস্থান নিয়েছে, ঠিক যেভাবে ২০০৩ সালে সাদ্দামের কাছে গণ-বিধ্বংসি অস্ত্র থাকার অজুহাত দেখিয়ে ইরাকে হামলা করা হয়েছিল। আসলে ওই দাবি প্রচার করে সাদ্দামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা জরুরি বলে ওয়াশিংটন মার্কিন জনগণকে ধোঁকা দিয়েছিল । অথচ সে সময় মার্কিন গণমাধ্যমের মূলধারা এ কথা চেপে গিয়েছিল যে ওয়াশিংটন ও তার ইউরোপীয় মিত্ররাই ইরানের বিরুদ্ধে ৮ বছরের যুদ্ধের সময় সাদ্দামকে ওইসব গণবিধ্বংসী অস্ত্র দিয়েছিল। পরে ইরাকের তেল সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ওইসব অস্ত্রকেই অজুহাত করা হয়েছে। পাশ্চাত্য তেল-সমৃদ্ধ লিবিয়ার বিরুদ্ধেও একই নীতি অনুসরণ করেছে। অর্থাৎ মানুষ রক্ষা নয়, তেলই তাদের মূল লক্ষ্য। বিশ্বে তেল সম্পদের রিজার্ভের দিক থেকে লিবিয়ার স্থান নবম। বিশ্বের তেল সম্পদের শতকরা তিন দশমিক ৩৮ ভাগ রিজার্ভ রয়েছে উত্তর আফ্রিকার এই দেশটিতে।
পাশ্চাত্যের এসব বিশ্লেষক আরো বলছেন, বর্তমানে গাদ্দাফির অনুগত সেনারা বিদ্রোহীদের মোকাবেলায় যা করছেন তা প্রতিরক্ষা বা আত্মরক্ষা মাত্র। বিদ্রোহীরা পাশ্চাত্যের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জাম পেয়েছে। অন্য একদল বিশ্লেষক বলছেন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে লিবিয়ার আকাশকে নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা এবং বিপ্লবীদেরকে সামান্য কিছু সামরিক সহযোগিতার উদ্দেশ্য গাদ্দাফিকে উৎখাত করা নয়। বরং গাদ্দাফির সাথে গোপন সম্পর্ক বজায় রেখেছে পাশ্চাত্য। এই বিশ্লেষকদের মতে, গাদ্দাফি পুরোপুরি পশ্চিমা-বিরোধী শাসক নন। পাশ্চাত্যের সাথে সম্পর্ক ও লেনদেনেরও বিরোধী নন তিনি। গত কয়েক বছরে গাদ্দাফির পশ্চিমা-বিরোধী বাগাড়ম্বর বা শ্লোগানগুলোর কঠোর সুর নাটকীয়ভাবে নমনীয় হয়েছে। তিনি মার্কিন ও ইউরোপীয় সরকারগুলোর সঙ্গে আঁতাত এবং পুনর্মিলনের নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
পাশ্চাত্যের সাথে গাদ্দাফি সরকারের সম্পর্ক জোরদারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন তার দ্বিতীয় পুত্র সাইফুল ইসলাম। পাশ্চাত্যের সংবাদ মাধ্যমগুলোর সাথে তার বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বি বি সি, সি এন এন, লা ফিগারো, বোস্টন গ্লোব ও অন্য আরো অনেক প্রধান পশ্চিমা মিডিয়া নিয়মিত সাইফুল ইসলামের সাক্ষাৎকার প্রচার করছে।
গত কয়েক বছরে পাশ্চাত্যের অনেক নেতা ও রাজনীতিবিদের সাথে সাক্ষাৎ করেছেন সাইফুল ইসলাম। গাদ্দাফি এখন আর আগের মত কঠোর পশ্চিমা বিরোধী নন। অথচ অতীতে আফ্রিকা মহাদেশে রাজাদের রাজা হতে ইচ্ছুক গাদ্দাফি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জোটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
লিবিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারের একতরফা নিষেধাজ্ঞা এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও ফ্রান্স ২০০৭ সালে গাদ্দাফির কাছে ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র বিক্রি করতে সম্মত হয়। ওই চুক্তি স্বাক্ষরের মূল অভিযুক্ত ছিলেন সাইফুল ইসলাম। ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি ২০০৭ সালে ত্রিপোলিতে তার সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন।
সাইফুল ইসলাম ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন এবং সেখানে তিনি তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডোলিৎজা রাইসের সাথে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকে রাইস ও সাইফুল ইসলাম অনেক ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন। রাইস এক পর্যায়ে লিবিয়ার ভিন্ন মতাবলম্বী ও গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক নেতা ফাতহি আল জাহমির প্রসঙ্গ তোলেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সুবাদে গাদ্দাফি সরকার বিভিন্ন সুবিধা আদায় করতে সক্ষম হয়। যেমন, ২০০৫ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সন্ত্রাসবাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষক সরকারগুলোর তালিকা থেকে লিবিয়ার নাম সরিয়ে নেয়। যুক্তরাষ্ট্র ঘোর শত্রু দেশগুলোকেই কেবল এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে আসছে। কিউবা, সুদান ও সিরিয়ার মত স্বাধীন দেশগুলো মার্কিন এ তালিকায় স্থান পেয়েছে।
২০০৯ সালে ইসলামী সংগঠন হিজবুত তাহরিরের যুক্তরাজ্য শাখা এক প্রেস রিলিজে লিবিয়ার স্বৈরতান্ত্রিক গাদ্দাফি সরকারকে সমর্থন দেয়ার জন্য বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালি সরকারের নিন্দা জানায়। ওই বিবৃতির একাংশে গাদ্দাফির সঙ্গে আলিঙ্গনের জন্য পশ্চিমা সরকারগুলো ব্যাকুলতা বা অধীর আগ্রহের বিষয়টি খুব বুদ্ধিদৃপ্তভাবে তুলে ধরে বলা হয়েছে, "গাদ্দাফি সরকারের চরম একনায়কতান্ত্রিক শাসনের রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও গর্ডন ব্রাউন, ওবামা ও বার্লুসকোনির মত পশ্চিমা নেতারা গাদ্দাফির তাঁবুতে তার সাথে আলিঙ্গনের জন্য উন্মুক্ত বাহু বাড়িয়ে দিতে এবং তাকে রাজনৈতিক বৈধতা দিতে আগ্রহী। পশ্চিমা দেশগুলোতে অনেকেই তেলসমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গুরুত্ব দিচ্ছেন লিবিয়াকে। বিশ্বের তেল রিজার্ভের শতকরা তিন ভাগ রয়েছে লিবিয়ায়। তাই পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা এবং বি পি (ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম), শেল ও এক্সনমবিলের মত পাশ্চাত্যের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো লিবিয়াতে প্রবেশ করতে আগ্রহী। "
গাদ্দাফির মত ডিক্টেটর বা একনায়কের সঙ্গে পাশ্চাত্যের আলিঙ্গন পুঁজিবাদী বিশ্বের পররাষ্ট্রনীতির প্রকৃত চেহারা তুলে ধরেছে। তাদের ওই নীতির প্রকৃত অর্থ হল, মুসলিম বিশ্বের একনায়কদের মদদ দেয়া এবং নিজ দেশে গণতন্ত্রের ফেরি করা। অথচ এই একনায়ক বা জালেম শাসকদের একমাত্র নীতি হল বিরোধী রাজনীতিবিদদের হত্যা করা এবং তাদের ওপর দমন-পীড়ন বা নির্যাতন চালানো।
এখন মনে হচ্ছে লিবিয়ার সব কিছু জটিল জালে আটকা পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইতালি একদিকে গাদ্দাফির কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলার জন্য প্রতিনিধি পাঠাচ্ছে এবং তাদেরকে এ নিশ্চয়তা দিতে চাইছে যে গাদ্দাফি অন্তর্বর্তী পরিষদের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা ছাড়লে তার বিচার করা হবে না কিংবা তাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হবে না। অন্যদিকে ন্যাটোর নির্বিচার বিমান হামলায় প্রতিদিন মারা যাচ্ছে অনেক নির্দোষ বেসামরিক নাগরিক এবং কখনও কখনও মারা পড়ছে বিপ্লবীরা। এর পাশাপাশি লিবিয়ার অসহায় বেসামরিক নাগরিক ও বিপ্লবী সেনারাও গাদ্দাফির অনুগত সেনাদের নির্দয় হামলায় প্রাণ হারাচ্ছে প্রতিদিন। এভাবে লিবিয়ার ব্যাপারে পাশ্চাত্যের দ্বিমুখী নীতি বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে।
আফগানিস্তানের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে ভারত ওতপ্রোত ভাবে জড়িত থাকলেও মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পদক্ষেপে নতুন করে উদ্বেগের মুখে পড়েছে নয়াদিল্লি। ভারত মনে করছে এমনটি ঘটলে আফগানিস্তানে তাদের তৎপরতা হুমকির মুখে পড়বে।
পাকিস্তানের দৈনিক নেশনে প্রকাশে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, আফগানিস্তান নিয়ে ভারতের উদ্বেগ মোটেও অবাস্তব বা কাল্পনিক কিছু নয়। তালবানদের সঙ্গে পাকিস্তানের দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক এ ধরনের উদ্বেগের প্রধান কারণ।
এ ছাড়া, ভারত আরো মনে করছে, যদি নতুন করে জোটবদ্ধ হয় তালেবানরা তবে ভারত বিরোধী গেরিলা গোষ্ঠিগুলো বিশেষ করে লকশরে তৈয়্যবা আফগানিস্তানে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ পাবে। কোনো কোনো ভারতীয় বিশ্লেষক আরো মনে করছেন, তালেবানরা হয়ত তেহরিকে পাকিস্তানের মতো উগ্র দলগুলো এবং পাকিস্তান সরকারের মধ্যে শান্তি চুক্তি করতে সহায়তা করবে। এরপর তারা হয়ত গেরিলা বিভিন্ন গেরিলা গোষ্ঠির মধ্যকার অন্তর্দ্বন্দ্ব নিরসন করবে এবং তাদের সামগ্রিক ক্ষোভকে ভারতের দিকে বিশেষ করে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের দিকে ঠেলে দিবে এবং সেখানে গেরিলা তৎপরতা বাড়বে।
এ ছাড়া, তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তান হয়ত উজবেকিস্তানসহ মধ্য এশিয়ার সমমনা গোষ্ঠিগুলোর সঙ্গ যোগাযোগ করবে। এ সব এলাকার জ্বালানি সম্পদ ও বাজারের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের ঐকান্তিক তৎপরতা চালাচ্ছে ভারত। কিন্তু দিল্লির সে সব তৎপরতা এ কারণে ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে।
তবে এবার হয়ত ভারত দেয়ালের লিখন পড়তে পেরেছে। গত মাসের মাঝামাঝি ভারত মত পরিবর্তনের আভাস দেয়। আফগান সরকারের নেতৃত্বে তালেবানদের সঙ্গে সংহতির প্রচেষ্টা দিল্লি সমর্থন করবে বলে আভাস দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। এর আগে ভারতে তালেবানদের সঙ্গে যে কোনো সংহতি প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছে।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নেয়ার পরবর্তী পর্যায়ে নিজ স্বার্থরক্ষার গরজ থেকেই ভারত এ ধরণের নমনীয় মনোভাব প্রদর্শনে বাধ্য হয়েছে। এদিকে, আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের আগে সেখানকার বাস্তব অবস্থা বিবেচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পুণরায় আহ্বান জানিয়েছে ভারত। নয়াদিল্লি বলেছে, আফগানিস্তানে যাতে আবার তালেবানরা সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটাতে না পারে সে দিকে যুক্তরাষ্ট্রকে নজর রাখতে হবে।
গতকাল নয়াদিল্লিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস.এম. কৃষ্ণার যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ আহ্বান জানানো হয়েছে।
( চলবে............ )
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৫ রাত ১২:৩০