মাথা নিচু করে মাঠ ছাড়লেন। হলুদ ক্যাপটায় যথাসম্ভব আড়াল করে রাখতে চাইলেন মুখ। কিন্তু তার পরও রিকি পন্টিংয়ের হতাশা বোঝা যাচ্ছিল স্পষ্ট। অস্ট্রেলিয়ার সাম্রাজ্য পতন নিয়ে অনেক আলোচনাই হয়েছে গত দু-তিন বছরে। বিশ্ব-শ্রেষ্ঠত্বের আসনে এসেই আসল রাজত্ব হারাল অস্ট্রেলিয়া। গত তিনবারের বিশ্বকাপজয়ীদের কোয়ার্টার ফাইনালেই বিদায় জানিয়ে দিল ভারত।
ক্লাইভ লয়েডকে ছাপিয়ে যাওয়া হলো না পন্টিংয়ের। অথচ পায়ের তলা থেকে সরে যাওয়া মাটি, চারদিক থেকে ছুটে আসা সমালোচনার বিষাক্ত তীর—সবকিছুকে কাল যেন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। করেছেন অধিনায়কোচিত দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। পন্টিংয়ের সবচেয়ে বিষাদময় সেঞ্চুরি নিশ্চয়ই!
পন্টিংয়ের মতোই গল্পটা ছিল আরেকজনের। বলা ভালো, পন্টিংয়ের চেয়েও বেশি দুঃসহ যাতনা সইতে হয়েছিল। দল থেকে বাদও পড়েছিলেন। খেলাও ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন একসময়। যুবরাজ সিং যেন নিজেকে নতুন করে চেনানোর প্রতিজ্ঞা করেছেন। বিশ্বকাপে নিজের প্রথম তিন ইনিংসে ফিফটি করেছেন। চতুর্থ ইনিংসে মাত্র ১২ রানে আউট হওয়াটা পুষিয়ে দিয়েছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে। কাল যুবরাজের ব্যাট থেকে এল অপরাজিত ৫৭। এই বিশ্বকাপে চতুর্থবার ম্যান অব দ্য ম্যাচ!
১৮৭ রানের মধ্যে শেবাগ, টেন্ডুলকার, গম্ভীর, কোহলির পর ধোনিকে হারিয়ে ফেলে যখন শঙ্কার মুখে দল; সুরেশ রায়নার সঙ্গে যুবরাজের অবিচ্ছিন্ন ৭৪ রানের জুটি। ভারত জিতল ৫ উইকেটে।
এই জয় ঘোষণা করল ভারত-পাকিস্তান সেমিফাইনালের বার্তা। ৩০ মার্চ মোহালিতে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মুখোমুখি। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ এমনিতেই জিবে জল আনা এক লড়াই। তার ওপর ম্যাচটা যখন বিশ্বকাপে ফাইনালে ওঠার, এর উত্তাপ তো কাল রাত থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে। এবং যুবরাজ সিং হয়ে রইলেন মধ্যমণি।
কোয়ার্টার ফাইনালের মতো চাপের ম্যাচ, ১০০ মিটার দূরত্বে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে যাওয়া ৫০ হাজার দর্শকের চিৎকার—অথচ মাথা ঠান্ডা রেখে খেলে গেলেন যুবরাজ। ২৬১ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নামা ভারত অবশ্য শুরু থেকেই ঠান্ডা মাথায় এগোতে চেয়েছে। যদিও বিরাট কোহলি ও গৌতম গম্ভীরের আউট হওয়ার ধরনে ধরা পড়ল অস্থিরতা। ৪৪ রানের ব্যবধানে কোহলি, গম্ভীর ও ধোনিকে হারিয়ে দর্শকদের ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিল ভারত।
দলকে অবশ্য ভালো শুরু এনে দিয়েছিলেন টেন্ডুলকার। শেবাগকে দলীয় ৪৪ রানের মাথায় হারিয়ে ফেললেও গম্ভীরের সঙ্গে তাঁর ৫০ রানের জুটি চাপটা শুরুতেই সরিয়ে নিয়েছিল। টেন্ডুলকার যেন পন্টিংয়ের সেঞ্চুরির পাল্টা জবাবই দিচ্ছিলেন। কিন্তু ৭ চারে খেলা ৫৩ রানের ইনিংসটা থেমে যায় টেন্ডুলকার উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিলে। গম্ভীর-কোহলি ৪৯ রানের জুটি গড়ে এগিয়ে নিচ্ছিলেন দলকে। এর পরই ওই আকস্মিক আঘাতে দ্রুত ৩ উইকেট হারিয়ে ফেলা।
মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। আগের এমন পরিস্থিতিতে যে ধোনির সঙ্গে জুটি গড়ে দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে গিয়েছিলেন; সেই ধোনি অযাচিত আউট হয়ে যুবরাজকে রাজা হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেন। বল হাতেও এদিন ভারতের সবচেয়ে সফল বোলার যুবরাজ যেন সম্রাট হয়ে উঠলেন! বিশ্বকাপে ১১ উইকেট, ৩৪১ রান। বিশ্বকাপটাই বুঝি হয়ে যাবে তাঁর!
যুবরাজের দিনে ম্লান হয়ে গেছেন টেন্ডুলকার। তাতে টেন্ডুলকারের কোনো আপত্তি নেই। তবে পন্টিংয়ের জন্য কারও কারও দুঃখ হতেই পারে। নানা বিতর্কে অধিনায়কত্ব ঝুলছিল সুতোয়। সেই রিকি পন্টিং বোঝালেন, বড় মঞ্চে আলো ছড়াতে তাঁর জুড়ি নেই। দাঁতে দাঁত চেপে চোয়ালবদ্ধ লড়াই করে দলকে এনে দিয়েছেন লড়াই করার মতো রান। লোকটা পন্টিং বলেই সম্ভব!
রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে শট থার্ড ম্যানে জহিরের হাতে ক্যাচ। বোলার ছিলেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। পন্টিংয়ের ইনিংসে ঔদ্ধত্য ছিল না। দলকে সামনে টেনে নেওয়ার প্রতিজ্ঞাই ফুটে বেরিয়েছে। তাই তো পন্টিংয়ের এই ইনিংসে ৭টির বেশি চার নেই, ছয় নেই একটির বেশি। ১৭২ মিনিটের লড়াই থামল ১১৮টি বল খেলে। অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসে তখন মাত্র ৯ বল বাকি। ওয়ানডেতে এটি পন্টিংয়ের ৩০তম সেঞ্চুরি, বিশ্বকাপে পঞ্চম। ভারতের বিপক্ষে ষষ্ঠ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২৬ হাজার রানও পূর্ণ করে ফেলেছেন পন্টিং।
অস্ট্রেলিয়ার পেস বনাম ভারতের ব্যাটিং—চারদিকে ওঠা এই আওয়াজ ফলল না। অস্ট্রেলিয়ার পেস ট্রায়োর শিকার মাত্র দুটি উইকেট। শন টেইট টেন্ডুলকারকে ফেরালেও ৭ ওভারে দিয়েছেন ৫২ রান। মিচেল জনসন ৮ ওভারে খরচ করেছেন ৪১ রান। ব্রেট লি ৪৫ রানে ১ উইকেট।
ওদিকে প্রথম স্পেলে জহির ৪ ওভারে দিয়েছিলেন ১৬। ৩৪তম ওভারে জহির বোল্ড করলেন হাসিকে। অস্ট্রেলিয়ার মিডল অর্ডারের মেরুদণ্ড খানিক বাঁকা হয়ে গেল। এরপর ৪২তম ওভারে তৃতীয় স্পেলের শুরুতে নিজের বলেই ক্যাচ নিয়েছেন হোয়াইটের।
ধোনি পেস আক্রমণ রাখলেন ১৭ ওভার। বাকি ৩৩ ওভারই স্পিন। এর মধ্যে টেন্ডুলকারের দুই ওভারও আছে। নানাভাবে বোলিং পরিবর্তন করেছেন। যুবরাজ, অশ্বিন, হরভজন এমনকি টেন্ডুলকারকেও বোলিং করালেন দুই প্রান্ত থেকে।
চেন্নাইয়ের মতো এখানেও শুরুটা স্পিন দিয়ে। উইকেট আসছে না দেখে প্রান্ত বদলে এক ওভার বিরতি দিয়ে আনা হলো অশ্বিনকে। দশম ওভারে তাঁর প্রথম পাঁচ বলে রান নিতে না পারা শেন ওয়াটসন শেষ বলে চালাতে গিয়ে বোল্ড (২৫)। প্রথম স্পেলে ৪ ওভারে ২১ রান দেওয়া অশ্বিন দিলেন কাঙ্ক্ষিত ব্রেক থ্রু।
৬২ বল, ৬ চার, ১ ছয়—ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে ওঠা হাডিনকে যুবরাজ ফেরালেন রায়নার হাতে ক্যাচ বানিয়ে। মাইকেল ক্লার্ককেও (৮) ফেরালেন যুবরাজ, ডিপ মিড উইকেটে জহিরের হাতে ক্যাচ। যুবরাজ ১০ ওভারে ৪২ রান দিয়ে নিয়েছেন ২ উইকেট।
তবে আসল যুবরাজ রাজত্ব করলেন ব্যাট হাতেই। ১৯ বছর পর ফাইনালের আগেই তাই বিদায় নিতে হলো অস্ট্রেলিয়াকে। হলুদ সাম্রাজ্যের পতন আহমেদাবাদে!