এক
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এবার প্রথম দফা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষনা করেছে নির্বাচন কমিশন। প্রথম দফায় আগামী ৮ই মে ১৫২টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই ১৫২টির মধ্যে ২২টি উপজেলায় ভোটগ্রহন হবে ইভিএম পদ্ধতিতে। এছারা পরবর্তী তিন ধাপে যথাক্রমে ২৩শে মে, ২৯শে মে ও ৫ই জুন মোট চার ধাপে ৪৫০টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বিগত জাতীয় সংসদ বর্জন করায় এবং ভোটার উপস্থিতি আশংকাজনক হারে কম হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচন কমিশন ও সরকারের উপর এক ধরনের অদৃশ্য চাপ আছে বেশি সংখ্যক ভোটার নির্বাচনকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার। যদিও এখন পর্যন্ত বিএনপি ও সমমনা দলগুলো তাদের সিদ্ধান্তে অনড় আছে তবে দলগুলোর অভ্যন্তরে নির্বাচনে অংশ নেয়া নিয়ে একাধিক মতামতের আভাস পাওয়া যাচ্ছে বিধায় শেষ পর্যন্ত কি সিদ্ধান্ত হয় সেটা জানতে হয়ত ঈদ পর্যন্ত অপেক্ষা করা লাগতে পারে।
এই দফায় নির্বাচন কমিশন প্রার্থীর জামানতের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনেছে। চেয়ারম্যান প্রার্থীর ক্ষেত্রে এই জামানত দশ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে এক লক্ষ টাকা করা হয়েছে আর ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে পচাত্তর হাজার টাকা করা হয়েছে। অন্য দিকে জামানতের টাকা ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রের শর্তও কিছুটা কঠোর করে মোট প্রদত্ত ভোটের ১৫% করা হয়েছে যা পূর্বে ১২% ছিল। নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর দিক থেকে প্রতিবাদ এসেছে।
আওয়ামী লীগ
বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রতিযোগীতামূলক দেখানোর স্বার্থে আওয়ামী লীগ ডামি প্রার্থী দাড় করানোর যে কৌশল গ্রহন করেছিল তারই বর্ধিত রূপ দেখা যেতে পারে এবারের উপজেলা নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ ঘোষনা দিয়েছিল এবারের উপজেলা নির্বাচনে তারা দলীয় প্রতীকে অংশ নেবে না, দেবে না কোন দলীয় মনোনয়ন। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিযোগীতা পরিলক্ষিত করা যাচ্ছে। তার উপর বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রেশ যেহেতু এখনও কাটেনি তাই নির্বাচিত সাংসদ ও পরাজিত প্রার্থীদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগীতা দেখা যাচ্ছে উপজেলা নির্বাচনের নিজের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনার। এই রেশারেশিতে তৃণমূল আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীন কোন্দল এখন যেকোন সময়ের তুলনায় সবচেয়ে বাজে অবস্থায় আছে এবং নির্বাচন শেষ হতে হতে সেটা কোন পর্যায়ে যাবে সে ব্যাপারে কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।
বিএনপি
উপজেলা নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে বিএনপির ভেতরে দুই ধরনের মতই আছে। প্রথম মত এই সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে না। তারা মনে করেন এই সরকার ক্ষমতায় থাকলে কারো পক্ষেই সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। বরং নির্বাচনে অংশ নিয়ে যে সকল নেতা কর্মীরা এখনও জেলে যায়নি তাদেরও জেলে যাওয়ার রাস্তা পরিষ্কার হবে। তার চেয়ে বরং দল গুছিয়ে পুনরায় সরকার পতনের রাজনীতিতে মনোনিবেশ করে সরকারকে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিতে বাধ্য করার কৌশল খুজতে তারা অধিক আগ্রহী।
অপর দিকে যারা নির্বাচনে যেতে আগ্রহী তাদের মত হচ্ছে, বিএনপি নানানভাবে সরকার পতন ও নির্বাচন ঠেকানোর চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সাফল্যের মুখ দেখতে পারেনি। এমনকি একই যুক্তি দিয়ে বিগত উপজেলা নির্বাচন ও অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত ছিল। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে যে বা যারাই এই সকল নির্বাচনে অংশ নিয়েছে তাদেরকেই দল স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করেছে। যেহেতু বিএনপি একটি নির্বাচনমুখী দল এবং নির্বাচন বর্জন করে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে সেই অর্থে কোন সাফল্য অর্জন করতে পারেনি বরং দল থেকে অনেক পরীক্ষিত ও ত্যাগি নেতাকে হারাতে হয়েছে। এতে করে দল হিসেবে বিএনপি ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এই অংশের নেতাদের এমন মতও আছে যে ঢাকায় বসে কেন্দ্রীয় নেতারা স্থানীয় নেতাদের চাপ বুঝতে অক্ষম। কাজেই অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হলেও তারা নির্বাচনে যেতে চান।
এই দুই মতই জোড়ালো অবস্থায় আছে। তবে দলীয়ভাবে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোন ধরনের সিদ্ধান্তই নেয়নি।
জামায়াত
দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হয়েছে তাও প্রায় দশ বছর হতে চলল। কিন্তু দল হিসেবে জামায়াতের অস্তিত্ব কিন্তু এখনও প্রকাশ্য দিবালোকের মতই সত্য। কেউ মানুক বা না মানুক বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াত ফ্যাক্টর এখনও জীবিত। যদিও দলটি নানান সময়ে সরকারের নানান চাপে ছিল বিধায় বেশ কোনঠাসা অবস্থায় আছে, তারপরও স্থানীয় পর্যায়ে জামায়াতের ভোট ব্যাংক এখনও অক্ষত আছে বলেই মনে হয় বরং কোন কোন স্থানে তাদের ভোট বিশেষ নারীদের মধ্যে বাড়তেও পারে এমন মত আছে বিশেষজ্ঞদের। যেহেতু জামায়াতও সেই অর্থে বিগত দশ বছরে নির্বাচনে অংশগ্রহন করেনি তাই এই ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না।
জামায়াত এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবে। এই ইস্যুতে তারা কয়েক দফা নিজেদের মধ্যে এবং সম্ভবত বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সাথেও অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। যেহেতু নিবন্ধন নেই তাই জামায়াতের প্রার্থীরা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেবেন। তবে বিএনপি যদি নির্বাচনে আসে তাহলে তারা ভিন্ন কৌশল গ্রহন করবেন। সেক্ষেত্রে সমঝোতার ভিত্তিতে সর্বোচ্চ সংখ্যক উপজেলায় দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করাই হবে লক্ষ্য। আর নইলে ৪৫০টির মধ্যে দেড় শতাধিক উপজেলায় নির্বাচনে অংশ নেবে জামায়াত। এর মাধ্যমে তারা তাদের জনপ্রিয়তা যাচাই করতে পারবে।
জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য
ভোটের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির যাও আবেদন ছিল বিগত নির্বাচনে সরকারী কৌশলে দল আবারও বিভক্ত হওয়ায় সেটুকুও তারা হারিয়েছে। তারপরও উত্তরাঞ্চলের উপজেলাগুলোতে তাদের স্থানীয় নেতারা কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলতে সক্ষম বলে মনে করি। অপর দিকে ইসলামী আন্দোলন বা চরমোনাই পীরেরও একটা ভোট ব্যাংক আছে। তারাও যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসে অথবা কোন প্রার্থীকে সমর্থন দেয় তাহলে ভোটের ডায়নামিক্স পরিবর্তন হয়েও যেতে পারে।
এর বাইরে আওয়ামী লীগের সাথে থাকা চৌদ্দ দল বা নির্বাচন বর্জন করা বামপন্থী দলগুলো তথা গণতন্ত্র মঞ্চ, সিপিবি-বাসদ ইত্যাদি দলগুলোর সেই অর্থে ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব আছে বলে মনে করি না।
সুষ্ঠু নির্বাচন ?
একটা নির্বাচন সুষ্ঠু হতে হলে কয়েকটা মিনিমাম ক্রাইটেরিয়া পূরন করতে হয়। যার মধ্যে নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন, সুষ্ঠু ও যাচাইযোগ্য ভোটার তালিকা, ভোটার-প্রার্থী ও কর্মীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, কালো টাকা, পেশি শক্তি ও মিডিয়ার প্রভাব থেকে মুক্তি ইত্যাদি ইত্যাদি। যার কোনটাই আসলে এই সরকারের অধীনে করা সম্ভব বলে সাধারন মানুষের কাছে মনে হয় না। এমনকি বিরোধী দলবিহীন একটি নির্বাচনেও নির্বিচার কারচুপির অভিযোগ করেছে সরকার দলীয় প্রার্থী ও কথিত ডামি প্রার্থীরা। ভোটার উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। বিভিন্ন আসনে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও অভিযোগ এসেছে বিস্তর। ফলে একই ফরম্যাটে নির্বাচন হলে সেটা সুষ্ঠু হবে এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। বরং ক্ষমতাসীন দল থেকে যেহেতু প্রার্থীতা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে তখন ধারনা করা যায় সংঘাত বিগত যেকোন সময়ের রেকর্ড ভাঙতে যাচ্ছে। ফলে সুষ্ঠু ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচন করা কমিশনের জন্য মহা চ্যালেঞ্জই বটে।
কোন পথে যাবে বিএনপি?
এই অবস্থায় দল হিসেবে বিএনপি কিছুটা দ্বিধাবিভক্তিতেই পরেছে বলা যায়। যদিও এরই মধ্যে তাদের অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা রুহুল কবির রিজভি নির্বাচনে অংশ নেয়ার ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়ে নির্বাচনে অংশ নিলে দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষনা দিয়ে রেখেছেন। তবে এই সিদ্ধান্ত দলীয় কি না সেটা পরিষ্কার করেননি।
আমি মনে করি বিএনপির উচিত নির্বাচনে যাওয়া বা না যাওয়ার কারো সাথে জোটবদ্ধ হওয়া বা না হওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত তৃণমূলের নেতৃত্বের উপর ছেড়ে দেয়া উচিত এবং এই সিদ্ধান্তটা তাদেরকে দেয়া হোক অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে। একটা উপজেলা বিএনপির নিজস্ব কমিটি আছে, আছে ছাত্রদল, যুবদল ও অন্যান্য গণসংগঠন। এদের উপরই ছেড়ে দেয়া হোক নির্বাচনে যাওয়ার বা যাওয়ার সিদ্ধান্ত এরা সবাই মিলে নিক। শর্ত থাকতে হবে সিদ্ধান্ত হতে হবে নিরংকুশ এবং একবার নির্বাচনের অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে ফল ঘোষনা থেকে এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করা হবে। এতে করে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দলটিতে যেমন সম্প্রীতি বাড়বে, আসবে শৃঙ্খলা। একই সাথে জনগণও তাদের হারানো আস্থা ফিরে পাবেন।
নির্বাচনে গেলে বিএনপির নেতা কর্মীরা সরকারের নানান ব্যর্থতা বিশেষ করে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি, কৃষিতে উতপাদন খরচ বৃদ্ধি, কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে স্থানীয় রাজনৈতিক টাউটদের ভূমিকা এহেন বহু ইস্যু নিয়ে জনগণের দরজায় কড়া নাড়ার সুযোগ পাবে। আবার এই নির্বাচন থেকে এটাও যাচাই করতে পারবেন তাদের কি জামায়াতকে আসলেই দরকার নাকি জামায়াতকে ছাড়াও অপর বিরোধী দলগুলোর সাথে সম্মিলিতভাবে এগুলোও তাদের ভোটব্যাংক ও সাধারণ ভোটারদের সমর্থন নিয়ে তারা জয়ী হতে পারবেন।
শেষ কথা
সারা জীবন শহরে বড় হওয়ায় স্থানীয় সরকারের ভোটের হিসেবটা আমার কাছে অতটা পরিষ্কার না। ফলে এই ব্লগে আমার কোন মতামত ভুল হতে পারে। ভুল মনে হলে ধরিয়ে দেবেন। জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের জন্য এক সময় রাজপথে সক্রিয় রাজনীতি করলেও এখন মনে হয় নিষিদ্ধের চাইতে রাজনৈতিকভাবে জামায়াতকে মোকাবেলা করাটাই হচ্ছে উপযুক্ত কৌশল।
সমস্যা হচ্ছে যাদের নিয়ে এই লড়াইটা লড়ার কথা তারাই হয় এদের সাথে আঁতাত করেছে অথবা নিজেরা কয়েক টুকরা হয়েছে অথবা আমলাতন্ত্র আর বিদেশী শক্তির সমর্থনের দিকে বুভুক্ষের মত তাকিয়ে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
আফসোস ! সত্যিই বড় আফসোস।
আপনাদের সুচিন্তিত মতামত আমার কাছে অত্যন্ত মূল্যবান।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:২৮