এক
যে দু'টি দেশের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত আছে মায়ানমার তার মধ্যে অন্যতম। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ ভারতের পেটের ভেতরে অবস্থান করে অর্থাৎ বাংলাদেশের তিন দিকেই ভারতের সীমানা। শুধুমাত্র দক্ষিন দিকে বঙ্গোপসাগর আর দক্ষিন-পূর্ব কোণে ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে মায়ানমারের সাথে, যা পূর্বে পরিচিত ছিল 'বার্মা' নামে।
বার্মা বা মায়ানমার যে নামেই ডাকা হোক এর সাথে আমাদের এই বদ্বীপের সংযোগ বহু পুরোনো। সেই আরাকান (বর্তমান রাখাইন প্রদেশ) রাজসভার মহাকবি আলাওলের উপস্থিতিকে যদি ভুলেও যাই তাহলে বৃটিশ ভারতে বার্মার সাথে আমাদের সংযোগ অত সহজে অস্বীকার করা সম্ভব না। বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চল ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে গোটা উপকূল অঞ্চলে বার্মিজ বা মগ জলদস্যুদের উপস্থিতি তো ঐতিহাসিকভাবেই স্বীকৃত।
কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে বার্মা বা মায়ানমারের সংযোগ সেই অর্থে হয়ে ওঠেনি। যদিও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বার্মিজ জাতীয়তাবাদীদের আক্রমনের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বাংলাদেশ ছিল প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশ হওয়ার পর কয়েকবার সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও বামার জাতীয়তাবাদীরা সে দেশের সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা নাগরিকদের জাতীয়তা অস্বীকার করে তাদের বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। তাদের উপর রীতিমত গণহত্যা চালিয়েছে সে দেশের সেনাবাহিনী ও উগ্র সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বামাররা এবং তাদের এহেন ঘৃণ্য কাজে উসকানি দিয়েছে আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ হিসেবে স্বীকৃত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা।
দুই: গণতন্ত্র কত দূর?
বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর খুব কম সময়ই বার্মা ছিল সিভিলিয়ান বা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৬২ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে জান্তা সরকার৷ ১৯৮৮ সালে ব্যাপক আন্দোলনের মুখে দুই বছর পর জান্তা সীমিত পরিসরে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও আজকে পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়ার কোন লক্ষন দেখায়নি৷ যদিও এর মধ্যে আন্তর্জাতিক ও আভ্যন্তরীণ চাপের মুখে ২০১০ ও ২০১৫ সালে দুইটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তার মাধ্যমে মায়ানমারে একটি সিভিল সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় কিন্তু মূল ক্ষমতা থেকে যায় জান্তার হাতেই। সর্বশেষ ২০২০ সালের জাতীয় নির্বাচনে গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুকির নেতৃত্বাধীন দল নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানিয়ে পুনরায় অভ্যুত্থান সংগঠিত করে সুকিকে গ্রেফতার ও গৃহবন্দী করে পুনরায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে।
সেই থেকে সমগ্র মায়ানমার জুড়েই জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ সর্বাত্মক গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। যদিও জন্মলগ্ন থেকে বার্মার এথনিক গ্রুপগুলো যারা জনসংখ্যার অনুপাতে মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ, মূল শাসক বামার ও সেনাবাহিনীর সাথে নানান ফরম্যাটে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত ছিল। তবে এবারের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন কারণ এবার সু কি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি ও অপর রাজনৈতিক দলগুলোও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সর্বাত্মক সশস্ত্র যুদ্ধে নেমে পড়ে। ফলে এই সুযোগে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে যুদ্ধরত এথনিক দলগুলোও বার্মিজ সেনাবাহিনীর সাথে পুনরায় যুদ্ধ শুরু করে।
তিন: রক্তাক্ত আরাকান ও রোহিঙ্গা শরনার্থী
খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ মায়ানমার বরাবরই সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর লোলুপ দৃষ্টির মধ্যেই ছিল। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ছিল চীনের প্রভাব। চীন বরাবরই সেখানকার জান্তা সরকারকে অস্ত্র ও আন্তর্জাতিক সমর্থন দিয়ে এসেছে। দেয়ার কারণও আছে। বাংলাদেশ ছাড়াও যে চারটা দেশের সাথে মায়ানমারের সীমান্ত রয়েছে তার মধ্যে আছে ভারত, চীন, লাওস ও থাইল্যান্ড। এর মধ্যে মায়ানমারের শান রাজ্য লাগোয়া লাওস ও থাই সীমান্তে রয়েছে কুখ্যাত 'গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল'। এই শান রাজ্যের সাথে চীনেরও সীমান্ত রয়েছে এবং মায়ানমারের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটা বড় অংশ চীনের সাথে এই সীমান্ত এলাকা দিয়েই হয়। এই অঞ্চলের অধীবাসিদের মধ্যে চীনা বংশদ্ভুতদের উপস্থিতিও লক্ষ্যনীয়। তার চেয়েও বড় কথা এই অঞ্চলে চীনের ব্যপক ব্যবসায়ীক ও সামরিক স্বার্থও জড়িত।
আরাকান, যা বর্তমানে রাখাইন নামে পরিচিত, সেই রাখাইনের সিত্তো বন্দর মূলত চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের একটু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। এই বন্দরকে ঘিরে গোটা আরাকান জুড়ে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ আছে। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উত্তর রাখাইনে বেশ কয়েকটি বিনিয়োগ অঞ্চলও গড়ে তোলার পরিকল্পনা ছিল/আছে চীনের। তাছারা চীনের গলার কাটাখ্যাত মালাক্কা প্রণালীকে এড়িয়ে জ্বালানি তেল ও গ্যাস পরিবহন সহজীকরণের লক্ষ্যে চীন যে ভারত সাগর জুড়ে 'স্ট্রিং অফ পার্ল' তৈরির পরিকল্পনা করছে তার অংশ হিসেবেই সিত্তো বন্দর এবং সেখান থেকে এই সিনো-মায়ানমার পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের কুনমিংকে সংযুক্ত করবে। একই সাথে এই পাইপলাইনের মাধ্যমে চীন মায়ানমারের গভীর সমুদ্র থেকে প্রাপ্ত তেল-গ্যাসে তার যে হিস্যা সেটা সহজেই চীনে নিতে পারবে।
কিন্তু এর সাথে রাখাইনের রক্তাক্ত হবার কি সম্পর্ক? প্রথমত, যেকোন বিনিয়োগ অঞ্চল গড়তে স্থানীয় অধিবাসীদের উচ্ছেদ করার দরকার পড়ে। রোহিঙ্গারা অনেক আগে থেকে মায়ানমারে সংখ্যালঘুর চাইতেও খারাপ অবস্থায় আছে। সংখ্যাগুরু বামাররা তাদের আগে থেকেই নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। তার উপরে রাখাইনের উগ্র ধর্ম গুরুদের মুসলিম বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে সেখান থেকে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করতে চীনা মদতপুষ্ট সামরিক জান্তা গণহত্যা চালিয়ে কয়েক দফায় সেখান থেকে প্রায় দেড় মিলিয়ন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পুশ-ইন করে।
চার: গণতন্ত্র বনাম স্বায়ত্তশাসন
২০২১ থেকে তাতমাদৌকে মূলত কয়েকটি ফ্রন্টে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। একদিকে গণতন্ত্রের জন্য লড়ছে 'পিপলস ডিফেন্স ফোর্স' অন্যদিকে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন তথা স্বাধীনতার জন্য লড়ছে আরাকান আর্মি, কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি, কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি, কারেননি রেসিস্টেন্স ফোর্স, তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি, শান স্টেট আর্মি, মায়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি, ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি, চিন রেসিস্টেন্স ফোর্স, যোমি রেভ্যুলেশনারী আর্মি। এর মধ্যে PDF, MNDWAA, AA ও TNLAর সাথে বর্তমানে তাতমাদৌয়ের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলমান। যদিও এই চারটি সংগঠনের বাইরে বেশ কয়েকটি সংগঠনের সাথে জান্তার দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধবিরতি চলমান৷ তবে চলমান সংঘাতের সুযোগে এই গেরিলা বাহিনীগুলোর পুনরায় পুর্নাঙ্গ যুদ্ধের ডাক দিয়েছে বা যেকোন সময় দিতে পারে।
যদিও চলমান যুদ্ধে যদিও একাধিক শক্তি সক্রিয় তবে এখন পর্যন্ত যুদ্ধে একটি একক প্লাটফর্ম হিসেবে অন্তত আমাদের সামনে আসেনি বা এরকম কোন উদ্যোগও লক্ষনীয় নয়। ফলে এই যুদ্ধের ফলাফল কি হবে মানে যুদ্ধে যদি জান্তা পরাজিত হয়ে ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয় তাহলে যারা ক্ষমতায় আসবে তারা কোন ফরম্যাটে আসবে বিশেষ করে এথনিক গ্রুপগুলো যারা স্বায়ত্তশাসন বা কোন কোন ক্ষেত্রে স্বাধীনতার জন্য লড়ছে তাদের সাথে সংখ্যাগরিষ্ঠ বামারদের যারা গণতন্ত্রের জন্য লড়ছ তাদের মিথস্ক্রিয়াটা কেমন হবে এটা আসলেই ভাবনার বিষয়। বিশেষ করে যেখানে বছরের পর বছর ধরে যেখানে তারা এই এথনিক গ্রুপগুলোকে ধারণ করতে সম্পুর্ণ ব্যর্থ। ফলে, বামারদের জন্য যেটা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই একই সাথে সেটা আবার জাতীয় ঐক্য রক্ষার প্রশ্নও বটে আর এথনিক গ্রুপগুলোর জন্য আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার নিজের দেশের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার সুবর্ন সুযোগ।
পাচ: ভারত ও বাংলাদেশের বিষফোঁড়া
ভারতের সাথে মায়ানমারের সীমান্ত হচ্ছে ১৬৪৩ কিমি। এর মধ্যে আছে মিজোরাম, মনিপুর, নাগাল্যান্ড ও অরুনাচলের সীমান্ত। আপার আসামের সর্বোচ্চ বিন্দু থেকে খুব বেশি দূরে নয় মায়ানমার সীমান্ত। স্মরণে রাখা দরকার, ভারতের এই পাচটা রাজ্যই বিচ্ছিন্নতাবাদের স্বর্গভূমি হিসেবে পরিচিত ছিল। অরুনাচলকে তো চীন নিজের দেশের অংশ হিসেবে দাবি করে। আবার অভিযোগ আছে এই সব অঞ্চলের যুদ্ধরত এথনিক গ্রুপগুলো ব্যাপক মাত্রায় চাইনিজ অস্ত্র ব্যবহার করছে। যদিও বলা হচ্ছে এই অস্ত্র নানান উপায় পাচার হয়ে এই সকল গেরিলাদের হাতে পৌছেছে। এটা নিশ্চয়ই কেউ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারবে না যে এই অস্ত্র হাত বদল হয়ে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে যাবে না।
বরং উলফাদের কর্মকাণ্ড ছিটেফোটা যাও টিকে আছে সেটাও ওই জোড়হাট থেকে উপরের দিকে আপার আসামে সেই আপার আসাম লাগোয়া মায়ানমার সীমান্তে নাকি চীনের তত্ত্বাবধায়নে উলফাদের বেশ কয়েকটি ঘাটি ও প্রশিক্ষনকেন্দ্র বিদ্যমান। মনিপুরে চলমান জাতিগত সংঘাত যা গৃহযুদ্ধে রূপ নিয়েছে তার একটি পক্ষ কুকি-চিনরা মূলত মায়ানমারের চিন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের কুকি জনগোষ্ঠীর আত্মীয় স্বজন আর মিজোরা তো নিজেদের বৃহত্তর কুকি-চিন-মিজো তথা জো জাতি হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসে। কুকিদের উপস্থিতি আছে মেঘালয় ও নাগাল্যান্ডেও। ফলে, মায়ানমারের এথনিক গ্রুপগুলোর এই বিজয় যে পুনরায় এই ভারতের অঞ্চলকে আবারও বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে ঠেলে দেবে না এটা কেউই নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারে না। আর তাই তো ভারত তড়িঘড়ি করে পুরো মায়ানমার সীমান্ত জুড়ে কাটাতারের বেড়া, চেকপোস্ট ও ওয়াকওয়ে নির্মানের মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সেই সাথে বাতিল করেছে সীমান্তে মায়ানমারের নাগরিকদের জন্য এত দিন ধরে চলমান 'ফ্রি মুভমেন্ট রেজিম'!
অপর দিকে, বাংলাদেশ বছরের পর বছর ধরে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের বোঝা বহন করে চলেছে। চলমান সংঘাতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোর দুর্গম এলাকায় ও কক্সবাজারে আরেক দফা শরনার্থীর ঢল নামার হুমকির মুখে আছে। ইতিমধ্যে গেরিলাদের ধাওয়া খেয়ে শত শত বার্মিজ সেনা, সীমান্ত রক্ষী, সরকারী কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার পরিজন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আবার গত দুই বছর ধরে পার্বত্য এলাকায় ধীরে ধীরে অশান্ত হয়ে উঠছে। এখানে বিবাদমান গোষ্ঠীগুলোও বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন এই সকল গেরিলাদের মাধ্যমে অস্ত্র সংগ্রহ করে পাহাড়কে অশান্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। ফলে বাইরে থেকে যেমন হুমকি আছে, হুমকি আছে ভেতর থেকেও।
ছয়: এমতাবস্থায় বাংলাদেশের করনীয়
পুরো ঘটনায় বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র চরিত্র হলেও সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি শরনার্থীর ভার বহনকারী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের করনীয় আছে অনেক কিছু। বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। একই সাথে, রাখাইন ও চিন প্রদেশে চলমান সংঘাত যাতে বাংলাদেশে ছড়িয়ে না পড়ে সেদিকে সদা সজাগ দৃষ্টি রাখাও জরুরী। ফলে প্রয়োজনে গোটা সীমান্ত সিল করে যৌথ বাহিনীর অভিযান পরিচালনা করে নিজেদের নিরাপত্তা বিধান করতে পদক্ষেপ নিতে হবে৷ একই সাথে স্থানীয় জনগণকে সাথে নিয়ে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে৷
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রয়োজনে আরাকান আর্মি ও জান্তা উভয়ের সাথে টেবিলের উপরে নিচে কথা চালিয়ে যেতে হবে৷ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ টের পেয়েছিল মুখে বন্ধুত্বের কথা বলে ফেনা তুলে ফেলা ভারত ও চীন আসলে কতটা বন্ধু! এই সুযোগে তাদেরকে একটা ছবকও চাইলে বাংলাদেশ দিতে পারে। যদিও এখানে একটা কূটনীতির চাল দিতে হবে। মানে টেকনিক্যালি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সামনে এনে আরাকান আর্মির মাধ্যমে নাফ নদীর ওপারে রোহিঙ্গাদের জন্য একটা বাফার জোন বা মুক্ত অঞ্চল গড়ে তুলতে পারে, যেখানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী রোহিঙ্গাদের দায়িত্বে থাকবে। আরাকান আর্মি রাজী না হলে রোহিঙ্গাদের জন্য একটা আস্ত দেশও গড়ে উঠতে পারে সেখানে। এতে একই সাথে কয়েকটা ঢিল মারা হবে। এই অঞ্চলে একটা ঘাটি গড়ার বহু দিনের মার্কিন স্বপ্ন পুরন হবে। পুরন হবে ইন্দো-প্যাসিফিক পরিকল্পনাও! চীনের সিত্তো ব্যবহার করে নির্বিঘ্নে তেল-গ্যাস পরিবহনের স্বপ্নও কিছুটা বাধা পাবে এতে। আর ভারতও কিছুটা নরম হবে।
সমস্যাটা হচ্ছে বাংলাদেশ এটা করতে পারবে না৷ কারণ বাংলাদেশের বর্তমান সরকার টিকেই আছে মূলত ভারত, চীন আর মায়ানমারের আরেক মিত্র রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সমর্থনে। ফলে, এই সরকারের এত টেকনিক্যাল কোন পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতাই নেই। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের কূটনীতি সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে চিঠি কূটনীতিতে। ফলে, আরেক দফা শরনার্থীর ধাক্কাই সম্ভবত আমাদের নিয়তি এবং একই সাথে তিন দিকে হিন্দুত্ববাদের উত্থান দেখার পাশাপাশি আরেক দিকে উগ্র বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের উত্থান দেখা আর দেশের ভেতরে সাম্প্রদায়িক মোল্লাদের আস্ফালন দেখাই মনে হয় আমাদের কপালে আছে।
তবে জনগণ হিসেবে আমাদের উচিত এই সকল হুমকি সম্পর্কে সচেতন থাকা, সরকারের উপর চাপ অব্যাহত রাখা এবং যতটা সম্ভব মায়ানমারের জাতিগত, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোতে জ্ঞান অর্জন করা।
মায়ানমার কিন্তু আমাদের খুব ভালো বন্ধু দেশ হতে পারত। শুধুমাত্র দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শাসন এবং দেশটিকে দেয়া অব্যাহয় অর্থনৈতিক অবরোধ দেশটিকে আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এখন আবার নতুন করে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। দেখা যাক, এই যাত্রায় বঙ্গোপসাগরের পানি গড়িয়ে কোন সাগর পর্যন্ত যায়!
আরাকানসহ গোটা মায়ানমারে ক্রমবর্ধমান বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বি উগ্রপন্থীদের উত্থান ও সে দেশের জাতীয় রাজনীতিতে তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে পরবর্তীতে লেখার ইচ্ছা আছে। আপনাদের মূল্যবান মন্তব্য দিয়ে পাশে থাকবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ সকাল ৯:২৬