এক
উপমহাদেশে নির্বাচন মানেই সহিংসতা। দুঃখজনক হলেও সত্য, অপরাপর ফৌজদারী অপরাধের বিচার হলেও এই ধরণের অপরাধে এক ধরণের অব্যাহতি পাওয়ার সংস্কৃতি চালু আছে আমাদের দেশে। যেমন ধরেন কোন বিরোধী দলীয় নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যায় এবং তাকে বিচারের সম্মুখীন করানো হয়, সাক্ষী সাবুদসমেত দোষ প্রমানিতও হয় তবুও এর অনুসারীরা বলবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রনোদিত মামলায় তাদের নেতাকে হয়রানি করতে 'গণতন্ত্র' এর মুখ চেপে রাখতে সরকার ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এই রায় দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কিংবা একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায় পরবর্তী বিএনপি-জামাতের কর্মীদের প্রতিক্রিয়ায় এর উদাহরণ পাবেন।
আবার যখন যে দল ক্ষমতায় যায়, ক্ষমতায় গিয়েই তারা প্রথমে কি করবে তা হল দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যা মামলা আছে সত্য মিথ্যা বিবেচনা না করে গণহারে তা বাতিল করতে থাকে। যদি সাজা হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে সেই সাজা মওকুফ কিংবা রাষ্ট্রপতির ক্ষমার ব্যবস্থা করা হয়। যেমন ধরেন সাম্প্রতিক সময়ে বেশ আলোচনার খোড়াক হওয়া লক্ষীপুরের আওয়ামী লীগের নেতা তাহেরের ছেলে বিপ্লবের সাধারণ ক্ষমার ব্যাপারে। আর এটাই একমাত্র ঘটনা না, খোঁজ নিলে এরকম অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে।
আমাদের দেশের রাজনীতির প্রবণতাও মূলত সহিংস, জ্বালাও পোড়াও ঘরানার। আমাদের জনগণও যেন সহিংসতা ভালোবাসে। বিশ্বাস হয় না? ব্রেকিং নিউজের মনস্তত্ব নিয়ে খোঁজ নিলে এর স্বপক্ষে অনেক তথ্য পাবেন। সম্প্রতি একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে 'দহন', রাজনৈতিক সহিংসতার উপর এমন চলচ্চিত্র আসলে সমসাময়িক সময়ে আমি দেখতে পাইনি। মানুষ পুড়িয়ে মারার রাজনীতির বিরুদ্ধের একটা শক্ত মেসেজ দেয়ার চেষ্টা এই সিনেমাটার মধ্যে আছে। চাইলে দেখতে পারেন। তো, এই একটা ব্রেকিং নিউজের জন্য জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মানুষ মেরে ফেলার পেছনে একটা মনস্তত্ব অবশ্যই আছে। ধরেন আপনি শুনলেন/পড়লেন/দেখলেন, শান্তিপুর্ন মিছিলের মাধ্যমে বিরোধী দল তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেছেন এবং তাদের কথা শুনে দাবি দাওয়া বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন। আপনি দেখবেন আপনার ঘুম হবে না।বরং, আপনি যদি শোনেন বিরোধী দলের মিছিল থেকে পুলিশের উদ্দেশ্যে ককটেল নিক্ষেপ, গাড়ি ভাংচুর, অগ্নি সংযোগ, পুলিশের সাথে সংঘর্ষে আহত ৩৫, নিহত ১। অজ্ঞাত পরিচয় ২৫০০ জনের বিরুদ্ধের মামলা, গ্রেফতার শতাধিক। আপনি দেখবেন প্রশান্তির ঘুম হয়েছে আপনার।
দুই
২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মাত্রায় রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছে বাংলাদেশের মানুষ। বাসে অগ্নিসংযোগ, ট্রেন লাইন উপরে ফেলা, দোকানপাটে আগুন দেয়া, বাড়িঘর লুটপাট, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা, গুম। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা আবার রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধের রাজনৈতিক সহিংসতাও পরিলক্ষীত হয়। এক সাইদিকে চাঁদে পাঠিয়ে হতাহত হয়েছিল শতাধিক যার মধ্যে ২০১৩ সালের ২৮শে ফ্রেব্রুয়ারী গাইবান্ধার পুলিশ ফাড়ি আক্রমনে নিহত হয় ৩ পুলিশসহ ৬ জন। এই পুরোটা সময় জুড়ে সরকারী দলের পাশাপাশি পুলিশও আক্রমনের লক্ষ্য ছিল সমানভাবে।
শুধুমাত্র ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারী ভোটের দিন নির্বাচনী সহিংসতায় নিহত হয় ১২ জন। পুড়িয়ে ফেলা হয় শত শত ভোটকেন্দ্র। যদিও সে সময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন না, সহায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন না, কারাবন্দী নেতাদের ছাড়া নির্বাচন না বলে ভোট বর্জন করা এবং সহিংসতার মূল কুশীলব বিএনপি জামাত এবার নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। যদিও সে সময় তাদের কথামত সহিংসতায় লিপ্ত হয়ে সরকারী দল ও পুলিশের হামলার শিকার হওয়া, মামলার শিকার হওয়া কর্মীদের তারা কোন গ্রহনযোগ্য জবাব দিয়েছেন বলে শুনিনি। যাই হোক, সেটা ভিন্ন আলোচনা।
যা বলছিলাম, এই নির্বাচন এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য যে সহিংসতা সেটা থেকে সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকবে কি না, রাজনীতির লেলিহান শিখায় পুড়ে আবার কাবাব হবে কি না যদিও সেটা এখনও বোঝা যাচ্ছে না, তবু আমার মনে হয় আমার মত আরো অনেকেই আছেন যারা শংকিত। শংকাটা শুধু নিজেকে নিয়ে না, দেশের ভবিষ্যত নিয়ে। দেশে এক ধরণের দমবন্ধ পরিবেশ আছে এটা সত্য। ক্ষমতাসীনরা খুব স্পষ্টভাবে বিরোধীমতের সে যে ঘরানারই হোক টুটি চেপে ধরতে চাচ্ছে। শান্তিপুর্ন উপায়ে আন্দোলনের কোন জায়গা নেই। জবাবদিহিতা তথা আইনের শাসনের অভাব স্পষ্ট। প্রশাসনে দলীয়করণ স্পষ্ট। উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু এর চেয়েও হয়ত ভালোভাবে, আরও দ্রুতগতিতে হয়ত হতে পারত। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই সরকার যদি ক্ষমতায় না থাকে এবং ঐক্যফ্রন্ট (এখন পর্যন্ত তারা ঐক্যবদ্ধ আছে, আশা করা যায় নির্বাচনেও ঐক্যবদ্ধভাবে যাবে এবং সরকারও ঐক্যবদ্ধভাবে পরিচালনা করবে) ক্ষমতায় গিয়ে বিরোধীমত দমন করবে না, বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড করবে না, আইনের শাসন, জবাবদিহিতা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে, উন্নয়ন হবে কিন্তু দুর্নীতি হবে না? বিশ্বাস করেন বিএনপির কট্টরপন্থীরা কর্মীদেরও এগুলো বিশ্বাস করতে কষ্ট হওয়ার কথা।
এখন যেহেতু ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায় থাকলেও আমার লাভ নাই, বিরোধীরা ক্ষমতায় গেলেও আমার লাভ নাই। কিন্তু এই ক্ষমতায় যাওয়া আর টিকে থাকা নিয়ে লড়াই করবে আর আমি ক্ষতির সম্মুখীন হব এটা হতে পারে না। জঙ্গলে যখন দুইটা গণ্ডার বা হাতী লড়াই করে তখন আশেপাশের অনেক গাছপালা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আমি সেইরকম ক্ষতির মুখে পড়তে চাই না। গত তিনটা বছর বাংলাদেশের মানুষ অনেক শান্তিতে ছিল। হরতাল অবরোধ সহিংসতাবিহীণ এই সময়টা অনেক শান্তির ছিল। আমি জানি না আপনাদের কেমন গেছে কিন্তু আমি বলতে পারি আমার পরিবার নিশ্চিন্তে ছিল যে তাদের সন্তান বাইরে গেলেও ঘরে কাবাব হয়ে ফিরবে না বা ল্যাংরা হয়ে ফিরবে না। সরকারের অনেক সমালোচনা আছে। ভ্যাট আন্দোলন, কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এমন আরো অনেক ইস্যুতে সরকার গণবিচ্ছিন্নতার প্রমাণ দিয়েছে। কিন্তু প্রায় প্রতিটা ঘটনাতেই উসকানী দিয়ে, গুজব ছড়িয়ে বিএনপি জামাত গং তাদের মুখোশের আড়ালে থাকা সেই পুরোনো ঘৃণ্য চেহারাটা দেখিয়ে দিয়েছে। তবে এই সব ছেলে মেয়েরা রাজনীতির কূটচাল ততটা না বুঝলেও দাবি আদায় করতে পেরেছে, যেটা বিএনপি কিংবা জামাত করতে পারেনি এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এক রকম আর ২০১৮ সালে এসে আরেক রকম কথা বলে নীতিহীনতা এবং বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয় দিয়েছে নিজের দলের কর্মীদের সাথে, তাদের পরিবারগুলোর সাথে।
তিন
নির্বাচনের আগে যে সহিংসতা হবেই সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। এর মধ্যে বেশ কয়েকটা খুন ও হতাহতের খবর আমরা পেয়ে গেছি। কিন্তু সেই সহিংসতারোধে আমরা প্রস্তুত তো ? আমার মনে হয় না। কারণ সবাই একটা পার্টি মুডে আছে। একদল মনে করছে বিএনপি জামাতের আসলে সহিংসতা করার ফান্ড নাই, আরেকদল মনে করছে সরকার এমন পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছে যে সহিংসতা করতে চাইলেও বিরোধী দলের পক্ষে কিছু করা সম্ভব না। আমার ধারণা দু'টো ধারনাই সর্বৈব ভুল। পাশার দান উল্টাতে সময় লাগে না। কাজেই, তাদের খেলা তারা খেলুক আমাদের প্রস্তুতি আমরা নেই। আর এর বাইরে জঙ্গীদের তৎপরতার সম্ভাবনাও একদম উড়িয়ে দেয়া যায় না।
প্রথমত, কোথায় যাচ্ছেন বা যাবেন তার একটা ট্র্যাক পরিবারকে দিন। মেসেজ অথবা ফোনের মাধ্যমে কানেক্টেড থাকুন। কলিগ, বন্ধু অথবা সহপাঠীর ফোন নম্বর যেন থাকে আপনার পরিবারের কাছে। কিছু ক্যাশ টাকা রেখে দিন ব্যাক আপ হিসেবে। বাসে বা পাবলিক পরিবহনে, চায়ের দোকানে রাজনৈতিক আলাপ না করাই ভালো। জটলা এড়িয়ে চলুন। আশেপাশে সন্দেহজনক কোন কিছু দেখলে পুলিশকে খবর দিন (৯৯৯ এ কল করুন)। প্রতিবেশীদের মধ্যে সন্দেহজনক কিছু বা কাউকে দেখলে পুলিশকে খবর দিন।
আর পাড়ায় মহল্লায় দল মত নির্বিশেষে লাঠি-বাশি কমিটি স্থাপন করুন। নির্বাচন যেভাবেই হোক আর যেই জিতুক, আপনার প্রতিবেশি সে যে দলেরই সমর্থক হোক তার বাড়িঘরের ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার দায়িত্ব আপনি নিন। তার বাড়ির মেয়েটা যেন আপনার মা, মেয়ে, বোন, স্ত্রীর মতই নিরাপত্তা পায়। প্রয়োজনে লাঠি হাতে পাহাড়া দিন দুর্বৃত্তদের হাত থেকে জান-মাল ও ইজ্জত বাঁচাতে।
৫ই ডিসেম্বর, ২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:৫৭