ভারতের উত্তর প্রদেশের রায় বেড়েলিতে অবস্থিত ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশন (NTPC) এর ছয় নম্বর ইউনিটের একটি বয়লার বিস্ফোরনে এখন পর্যন্ত ২৬ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছে যাদের অনেকেই এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। এটা সেই কোম্পানি যাদের সাথে বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবনের রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির জন্য চুক্তি করে।
বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদন থেকে এটা পরিষ্কার মূলত যান্ত্রিক ত্রুটি থেকেই এই বিস্ফোরনের সূত্রপাত। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এনডিটিভির ওয়েব সাইটে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে প্রত্যক্ষদর্শীর যে বিবরণ পাওয়া যায় তাতে এই বক্তব্যের সত্যতা মেলে।মূলত বয়লারের ফ্লাই অ্যাশ নির্গমনের চিমনি আটকে যাওয়াতেই বিকট শব্দে এই বিস্ফোরণ ঘটে ছাই, গ্যাস ও ধোয়া ছড়িয়ে পড়ায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এত বৃদ্ধি পায়।
দুই
এই বিস্ফোরনের ঘটনায় বাংলাদেশে অবস্থিত সচেতন মহলের দুশ্চিন্তার যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরোধীতাকারীরা শুরু থেকেই সুন্দর বিধ্বংসী বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে সরে আসার জন্য সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করে চলেছেন। ইউনেস্কো থেকে এই প্রকল্প থেকে সুন্দরবন ক্ষতির সম্ভাবনা উল্লেখ করে প্রতিবেদনও দিয়েছে। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে দেশে এবং দেশের বাইরে প্রতিবাদ প্রতিরোধ জারি আছে।
সরকারের পক্ষ থেকে জোর প্রচারণা আছে যারা এর বিরোধীতা করছে তারা মূলক ভারত বিরোধীতা থেকেই এর বিরোধীতা করছে। এমনকি এও বলা হয়েছে যারা রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প চায় না তারা বাংলাদেশের উন্নয়ন চায় না। তারা চায় না বাংলাদেশ শক্তি খাতে স্বয়ং সম্পূর্ন হোক। এমনকি বলা হয়ে থাকে চুক্তি বিরোধীতা করতে গিয়ে মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। রামপালে ব্যবহৃৎ প্রযুক্তি হচ্ছে 'আল্ট্রা' 'সুপার' 'ক্রিটিকাল' প্রযুক্তি।
সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় এই প্রকল্পের পক্ষ নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন করা হয় যার মূল বক্তব্য হচ্ছে রামপাল প্রকল্প থেকে সুন্দরবনের তো ক্ষতি হবেই না বরং পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর নয় এই প্রকল্প। কারণ হিসেবে তারা বার বার সামনে নিয়ে এসেছে 'আল্ট্রা সুপার ক্রিটিকাল'। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন ডেকে জনগনের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেন।
প্রকল্পের পক্ষালম্বনকারীরা মিডিয়াসহ বিভিন্ন ফোরামে কিছু বক্তব্য দেন যেমন
১) রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প সুন্দরবন থেকে চৌদ্দ কিলোমিটার দূর অবস্থিত বিধায় এখান থেকে দূষন সুন্দরবনকে ক্ষতি করবে না।
২) এই প্রকল্পে ব্যবহৃত হবে আল্ট্রা সুপার ক্রিটিকাল টেকনলজি যা দূষনের মাত্রাকে সহনীয় মাত্রায় রাখবে।
৩) এই প্রকল্প থেকে সুন্দরবন তথা পশুর নদীর জলজ বাস্তুসংস্থানের ক্ষতি হবে না।
৪) কয়লা পরিবহনের সময় ঢেকে পরিবহণ করায় নদী এবং নদী সংলগ্ন বাস্তু সংস্থানের কোন ক্ষতি হবে না।
৫) বড়পুকুরিয়া কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে তো কোন ক্ষতি হচ্ছে না।
৬) এই কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে বাংলাদেশ লাভবান হবে, দেশের শত্রুরাই এর বিরোধীতা করছে।
আসুন এই প্রকল্প নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন দেখা যাক
এই প্রতিবেদনটি থেকে উপরের অনেক বক্তব্যের খন্ডন চলে আসার কথা। প্রায় প্রতিটি বক্তব্যের খন্ডন এখানে চলে এসেছে। বেশ কয়েকটা কেস স্টাডিও দেখানে হয়েছে। যেটা আসেনি সেটা হচ্ছে যারা এর বিরোধীতা করছে তারা দেশ বিরোধী। তারা দেশের উন্নয়ন চায় না। আসলেই কি আমরা দেশ বিরোধী কিংবা আমাদের বিরোধীতা কি শুধুই ভারত বিরোধীতা।
আমার জানামতে মূলত বাম ঘরানার জাতীয় কমিটি যারা এর বিরোধীতা শুরু করেছে তারা পরিবেশ নিয়ে যেমন চিন্তিত তেমনি চিন্তিত জাতীয় স্বার্থ নিয়েও। এখানে পরিবেশের ইস্যু যেমন এসেছে তেমনি এসেছে অর্থনৈতিক ইস্যুও। আদৌ কি আমরা লাভবান হব এই বিদ্যুৎ প্রকল্প দিয়ে ? যেখানে ভারতের মধ্য প্রদেশের ছাতারপুরের একটি প্রকল্প সে দেশের পরিবেশ মন্ত্রনালয় বন্ধ করে দিয়েছে সেখানে কিভাবে আমরা সেই কথিত প্রযুক্তির উপর বিশ্বাস করছি ?
আমরা সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট গ্রোথের কথা বলি। কিন্তু দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ যে কিনা নিজেই নিজের রক্ষার কাজ করতে অভ্যস্ত সেই পাওয়ার হাউজকে ধ্বংস করে দিচ্ছি ! যেখানে সারা পৃথিবীতে কয়লা বিদ্যুতের উল্টো পথে হাটা শুরু করেছে সেখানে আমরা বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হয়ে কিভাবে দেশের অক্সিজেন কারখানা ধ্বংস করে দিচ্ছি ? সিডরের মত প্রলংকরি ঘুর্নিঝড় যেখানে সুন্দরবনকে ধ্বংস করতে পারেনি সেখানে প্রতিনিয়ত স্লো পয়জনিং এর মাধ্যমে এই বনকে ধ্বংস করার প্রকল্প হাতে কেন নিল এবং কেনই বা জিদ ধরে থাকল তা হয়ত পরবর্তী প্রজন্ম খুঁজে বের করবে।
সবশেষে একটি বিতর্কের ভিডিও শেয়ার করছি। চুক্তি সাক্ষরের পরে এই টক শো অনুষ্ঠানটি আপনাদের ভাবনার খোড়াক যোগাতে হয়ত সাহায্য করবে।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:১১