=================================================
যারা অকালে মা কে হারিয়েছেন তাদের জন্য আমার এই লেখা উৎসর্গ করলাম
=================================================
এই দুপুর বেলাটা আমার সবচেয়ে প্রিয় সময়। আজ প্রায় ২০ দিন হল আমাই এখানে আছি। কোথায় আছি সেটা বলার আগে বলে নিই কেন এই দুপুর বেলা আমার এতো পছন্দের সময়। দুপুর বেলা আমি জানালার গ্রিল ধরে বাইরে অনেকদুর দেখতে পারি। চারদিক এসময় অনেক নিরিবিলি আর শুনশান থাকে। কেউ এসময় আমাকে বিরিক্ত করতে আসে না। আমি মুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে সুন্দর সুন্দর চিন্তা করতে পারি। এই দুপুরের কড়া রোদে দুঃস্বপ্ন গুল উকি দিতে পারে না আমার মগজে। আমি এই সময় আমার আপন মা কে নিয়ে চিন্ত করতে পারি। সে কেমন আছে অপারে ভাবতে পারি আপন মনে। কিন্তু দুপুর বেলার সময়টা এতো কম যে শুরু হতে না হতেই ফুরিয়ে যায়। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি ৪.৪৮ বাজে। এক্ষুনি শেষ হবে।
ঐ তো সিঁড়ি তে কার যেন পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে । নিশ্চয়ই ‘আতিক’ চাচা। উনি আমার বিকাল বেলার ঔষধ দেবার জন্য আসছেন। সে সাথে খাবার জন্য গমের ৩ পিছ রুটি দিয়ে যাবেন।
ঔষধ টা কি না দিলেই না! ঔষধ টা পুশ করার পরপরই আমি যেন অন্য পৃথিবীতে চলে যাই। যেখানে আমি অনেক একা। যেখানে আমার বাবা, মা, আসাদ ভাইয়া কেউই নাই। তখন কিছুই চিন্তা করতে পারি না। তখন মনে হয় আমার Brain চিন্তা বন্ধ করে দিয়ে Summer Vacation এ চলে গেছে। আর মাথা টাও অনেক ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আমার একদম ভাল লাগে না। তখন খুব ইচ্ছা করে খুব জোরে চিৎকার করতে । যাতে পৃথিবীর সব মানুষ এসে পড়ে আমাকে দেখার জন্য। কিন্তু চিৎকার করতে পারি না। মনে হয় কেউ যেন আমার গলায় কাপড় ঠেসে দিয়েছে। যাতে আমি চিৎকার করতে না পারি। এসময় আমি আমার মা কে দেখি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। হাসছেন। তখন ইচ্ছা করে দৌড়ে গিয়ে মায়ের কলে ঝাঁপিয়ে পড়ি। কিন্তু পারি না। আমার হাত-পা শেকল দিয়ে বাঁধা। আমি চিৎকার করে বলি, “মা, আমাকে বাঁচাও , আমাকে কোলে নিয়ে একটু আদর করো”। মা যেমন ছিলে ন তেমন ই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। মনে হয় কিছু ই শুনেন নাই। কিছুক্ষন ওভাবে দাঁড়িয়ে থেকে দরজা দিয়ে চলে যান। আমি আবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার দেই, কনো লাভ হয় না। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না আমার। চিৎকার করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ি। সুর্য টা সকাল বেলা উঠেই আমার কছে চলে আসে। প্রথমে এসে জানালায় বসে। তারপর আমার হাতে এসে বসে। ধীরে ধীরে আমার মুখে এসে পড়ে। সারা চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়া ছাড়া কোন কাজ পায় না এই সুর্য।
সকাল বেলা প্রতি দিন যে জিনিস টা মনে পড়ে তা হল মায়ে ডাকাডাকি। মায়ের ডাকার ভঙ্গি ছিল একটু আলাদা। উনি এসে অনেক জোরে জোরে আমাকে ঝাঁকি দিতেন এবং ঘুম অবস্থায় ই আমাকে বসিয়ে দিতেন। আমি চোখ টেনে শত চেষ্টায়ও খুলতে না পেরে আবার বিছানায় এলিয়ে পড়তাম। মা রান্না ঘর থেকে আবার এসে ওভাবে ঝাকুনি শুরু করতেন। মায়ের ঝাকুনি খেয়ে ঘুম বাবাজী এক দৌড়ে পালাত চোখ থেকে।
এখনও ঝাঁকি খেয়েই ঘুম ভাঙ্গে। তবে মায়ে না ‘আতিক’ চাচার। উনি এসে ঝাঁকি দেয় আর সাথে গালি-গালাজ। এই গালি-গালাজের অর্থ হলঃ “তোর মায়ের সাথে তুইও কেন পার হয় গেলি না ঐ পাড়ে। সব ঝামেলা চুকে যেত”। আমিও চাই কিন্তু, আল্লাহ্ তো আমার সব চাওয়াকে পাওয়াতে পরিনত করেন না। আমার কেন, কোন মানুষেরই না।
আজ প্রায় এক মাস স্কুলে যাই না। ভুল বললাম কলেজে যাই না। স্কুলে পড়া তো শেষ করেছি। গোল্ডেন A+ পেলাম সেবার। ভাবলাম সবাই অনেক খুশি হবে। কিন্তু ঠিক উল্টা হল। বাবা তো রেগে খ্যাঁক। ছোট মা তো মনে হল পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ সংবাদ টি শুনেছে এমন একটা ভঙ্গী করেছিল। যেমন হাসি মুখে বাড়িতে ঢুকেছিলাম তার ছিটেফোঁটাও আর বাকি থাকল না। দুঃখে পরিণত হল সবটাই। বাড়ি থেকে বের হয়ে, ‘সামু’ চাচার ফোনের দকানে গেলাম। ‘আসাদ’ ভাইয়া কে ফোন করব। ভাইয়া নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে। পর পর ৬ জন কে ফোন করলাম। ভাইয়া, বড় খালু, ছোট খালু, সাঈদ, শোভন আর আতিক চাচাকে। সব থেকে খুশি হল ভাইয়া। আর সবাই দায়সারা খুশি। মা থাকলে উনি সবচয়ে খুশি হতেন। খুশিতে কাঁদতেন। এই যা ! “আমিই তো কেঁদে দিলাম।
আমার কাছে ১০০ টাকার মত জমানো আছে, মিষ্টি কেনা দরকার। কিন্তু খাবে কে ! আর আজকে তো মিষ্টি র অনেক দাম। তারচেয়ে নানু বাড়ি যাই। খালামনিরা আজ ভাল ভাল রান্নাবান্না করবে, উনাদের ছেলেরাও A+ পেয়েছে”।
আতিক চাচার দেয়া রুটি খেতে খেতে এসব ভাবছিলাম এতক্ষন। এখনি ওষুধ পুশ করবে আর শুরু হবে যন্ত্রনা।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখাই ৬.৪১। আজ মাথায় জন্ত্রনা হলেও চিন্তা করতে পারছি। আজ মনে হয় আমার ব্রেইন summer vacationএ যায় নাই।
মায়ের ও অনেক কষ্ট হয়েছিল। বেচারি অনেক কষ্ট করেছিল শেষের কয়টা দিন। মায়ের breast censure না হলে মা এতো তাড়াতাড়ি যেতেন না । উনাকে কেমো দেয়ার সময় খুব বেশি কষ্ট হয়েছিল। সব চুল পড়ে গেল। আর মা আমার ঘুম ভাঙ্গাত না সকালে। কাছেও ডাকত না। কোলে নিয়ে আদর করা তো দুরের কথা কাছে গিয়ে বসলেই তাড়িয়ে দিত। আমি বাথরুমে ঢুকে হাউমাউ করে অনেকক্ষণ কাঁদতাম। মসজিদে গিয়ে ৫ অয়াক্ত নামাজের সময় দয়া করতাম মায়ের জন্য। হাউমাউ করে কেঁদে আল্লাহকে বলতাম যেন মাকে ভাল করে দেয়। আমি তখন ক্লাস 7 এ পড়ি। কুরবানি ঈদের দিন মা চলে গেলেন ওপাড়ে । আমাই এতিম হয়ে গেলাম।
বছর ঘুরতে না ঘুরতে অন্য সব পরিবারের মত বাবাও ছোট মা কে ঘরে তুললেন। আবার বিয়ে করলেন বাবা। আমাকে ছোট মা প্রথম প্রথম আদর করতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে সব আদর চলে গেল। আমি হয়ে উঠলাম ছট মায়ের চাকর। কাপড় ধোয়া থেকে শুরু করে থালাবাসন মাজা, ঝাড়ু দেয়া, বাজার করা সব কাজ করতাম। কাজের ফাকে ফাকে ভুল হলে থাকত উনার লাত্থি আর মার। একদিন এমন লাত্থি দিলেন যে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে কনুই ছিলে ফেললাম। রাত বারটায় থালাবাসন ধয়ার পর আমার ছুটি হত । আমি যে বাবার ছেলে এটা ভুলেই গেছিলাম, ঘরের কাজ করতে করতে। সব কজ শেষ হলে পড়তে বসতাম । সারা রাত পড়তাম। তারপর ঘুম। এভাবে স্কুল জীবন পার করলাম। S.S.C তে গোল্ডেন A+ পেলাম। ভর্তি হলাম কলেজে।
একদিন দুপুরে কল-পাড়ে কাপড় ধুচ্ছি ছোটমায়ের । উনি এসে বললেন বাবার পাঞ্জাবি নাকি ধোয়া লাগবে। পাঞ্জাবি ধুচ্ছি এমন সময় উনি বললেন , “দোকানে যা , মেহমান এসেছে”। আমি বললাম পারবনা। এতেই হল কাল। চুলার খড়ি কাঠ হাতে ছিল, ওটা দিয়েই মার শুরু করল। মার দিয়েই শান্ত হল না, ধাক্কাও দিল। কল-পাড় এমনিতেই পিচ্ছিল, পিছলে গিয়ে পড়লাম। আর কলের হাতল টায় বাড়ি খেলো আমার মাথা। জ্ঞান হারালাম।
জ্ঞান হল পরদিন সকালে। সকালে উঠেই কেমন যেন রাগ লাগল। মাথায় অনেক ব্যথা।কী যেন মনে হল, ছোট মা কে মারতে গেলাম। বাবাকেও ছাড়লাম না। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলাম বারান্দায়।
এর পর থেকে আমি এই ঘরে শেকল দিয়ে বাঁধা। ঘরটা আমাদের বাড়ির দোতলায়। এখানে আমাকে কুকুরের মত রাখা হয়েছে। আতিক চাচা বলেছে আমি নাকি পাগল হয়ে গেছি, তাই ডাক্তার বেধে রাখতে বলেছে। আমি ছিলাম মায়ের সবচেয়ে আদরের ছোট ছেলে,ভাবলে চোখের পানি আটকাতে পারি না । এখন আমি পাগলা কুকুরের চেয়ে কম না, যাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হয় । যার মা নেই। বাবা থেকেও নেই। যাকে হয়তো কেউ এখান থেকে উদ্ধার করবে। যার শুধু আছে জানালার গ্রিল আর সকালের দুষ্ট সুর্য।
:'( :'(: :'(