তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাকি হবে পানি নিয়ে। কে জানে কে বা কারা- কার বা কাদের বিরুদ্ধে লড়বে। যুদ্ধ করে এই পানি সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে কি না তাও কি আমরা জানি? আচ্ছা, এই পানির প্রকৃতি আর উৎস নিয়েই বা আমরা কতটুকু জানি?
পৃথিবীর বুকে পানি-বন্টনের শতকরা হারের হিসেবটা তিনভাগ জল আর একভাগ স্থলের সরল সমীকরণে বরাবরই ব্যাখ্যা করে গিয়েছে আমাদের বিজ্ঞান বইগুলো! শতকরার অংক টা যাই হোক- পানি বন্টনের পূর্ণাংগ হিসেবটা বড্ড অদ্ভুত। প্রথম জানায় কারোই বিশ্বাস হওয়ার নয়! পৃথিবীর তাবৎ পানির ৯৭ ভাগ থাকে সমূদ্রে। আর মাত্র ৩ ভাগ হল স্বাদুপানি। নগন্য এই স্বাদুপানিকে যদি ১০০ ভাগ ধরি আবার- এর ৭৯ ভাগই থাকে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে- বরফাবৃত গ্ল্যাসিয়ার হিসেবে। ২৯ ভাগ হল ভূগর্ভস্থ পানি – মাটির নিচে থাকে। মাত্র ১ ভাগ পানি আমরা স্থলভাগে দেখতে পাই। এখন দৃশ্যমান এই পানিকে পুরো ১০০ ভাগ ধরলে ৫২ ভাগ পাই আমরা লেক বা হ্রদে। মাটির আদ্রতা ধরে রাখে ৩৮ ভাগ পানি। জলীয় বাষ্প হিসেবে বাতাসে মিশে থাকে ৮ ভাগ। আর নদী? শক্তিশালী, প্রমত্তা যত যা-ই বলি, পৃথিবীর সব নদীতে সমষ্টিগত পানির পরিমাণ মাত্র ১ ভাগ!
চিত্রঃ শতকরার অংক টা যাই হোক- পানি বন্টনের পূর্ণাংগ হিসেবটা বড্ড অদ্ভুত
স্বাদু পানি কিংবা এর মাঝের জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে খুব বেশি একটা চর্চা হরহামেশা হয়না। গ্লেসিয়ার, লেক, নদী, ঝরনা কিংবা জলপ্রপাতে পাওয়া এই স্বাদুপানি আর সংশ্লিষ্ট পরিবেশে বেড়ে ওঠা বিচিত্র প্রাণিকূল নিয়েই প্ল্যানেট আর্থ এর তৃতীয় পর্ব- Fresh Waters ।
পর্বের শুরুটা ভেনিজুয়েলা’র রহস্যাবৃত আকাশচুম্বী টেপুই (সমতল ছাঁদের উঁচু খাড়া পর্বত) দিয়ে। এর বিশুদ্ধ আর অবিকৃত সৌন্দর্য্য “দ্যা লস্ট ওয়ার্ল্ড” উপন্যাস লেখাকালীন সময়ে স্কটিশ কল্পকাহিনীকার স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের চোখে ধরা দেয় প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীর রুপে। শতবর্ষ ধরে বায়ু আর বৃষ্টি মিলে এখানে খোদাই করে রেখেছে বেলেপাথরের দারুণ সব ভাস্কর্য! ভাবছেন পানির সাথে এই উঁচু পর্বতের সম্পর্ক কোথায়? আছে। সমূদ্রের পানি বাষ্প হয়ে উপরে উঠতে উঠতে এইসব পর্বতের উপরে এসে ঘন আর ঠান্ডা হয়। ফলাফল – বৃষ্টি; যা স্বাদু পানির একমাত্র মাতৃ-উৎস। এই উঁচু পর্বতেই তাই শুরু হয় স্বাদু পানির যাত্রা। শান্ত ঝরণা ধারা থেকে শুরু করে উঁচু জলপ্রপাত কিংবা খরস্রোতা নদী হয়ে সাগরে মেশার আগে কত শত মাইল যে সে পেরোয়! আয়ানতেপুই পর্বত যে জলপ্রপাতের জন্ম দেয় তা পৃথিবীর সবচে গভীর (প্রায় ১০০০ মিটার )- ‘এঞ্জেলস ফলস’ এর নাম!
চিত্রঃ আয়ানতেপুই পর্বত যে জলপ্রপাতের জন্ম দেয় তা পৃথিবীর সবচে গভীর - ‘এঞ্জেলস ফলস’ এর নাম!
পর্বতে সৃষ্টি হওয়া এই জলধারা ভীষণ শক্তি নিয়ে এগোয় সামনের দিকে। চলার পথে ভাঙ্গে- গড়ে। মাঝে মাঝে দু’য়ে মিলে সৃষ্টি করে নদী। তীব্র গতি নিয়ে এগোনো এই পানিতে পুষ্টি উপাদানের বড্ড অভাব, তাপমাত্রাও ঠান্ডা। কিন্তু অক্সিজেন ঠিকই আছে। তাই প্রাণও। পানির গতির সাথে তাল মিলিয়ে নেয়ার জন্য অমেরুদন্ডী এইসব প্রাণির শরীরে আছে বিশেষ ব্যবস্থা।
জাপানে – যেখানে ঝরণাগুলো শীতে জমে বরফ হয়ে যায়- সেখানে বসন্তের আগমনের দিন গোনে পৃথিবীর সবচে বড় উভচর প্রানী- দৈত্যাকার স্যালামান্ডার। খাবারের দুর্যোগের দিনে আশীর্বাদসরূপ আগমন ঘটে স্যামন মাছের যারা ডিম পাড়ার জন্য স্বাদু পানির জগতে দীর্ঘতম পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছায় মেরুর কাছাকাছি। আর রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে গ্রিজলি বেয়ার বা ভালুক।
উজানের দিকের এই নদীগুলো খুব একটা প্রাণচঞ্চল না হলেও এদের আছে ভাঙ্গার দারুণ ক্ষমতা! গত পঞ্চাশ লক্ষ বছর ধরে আমেরিকার আরিযোনার কলরাডো নদী মরুর বেলেপাথর ভেঙ্গে ভেঙ্গে দৈতাকৃতির গিরিখাত তৈরি করেছে- যাকে সবাই গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন নামে চেনে। ১ মাইল গভীরতা আর প্রায় ১৭ মাইল লম্বা এই গিরিখাতের পাশাপাশি এই নদী প্রায় ১০০০ মাইলের আঁকাবাঁকা রেখা টেনে দিয়েছে – মহাশূন্য থেকে যাকে দেখলে মনে হয় পৃথিবীর বুকে দগদগে কালো ক্ষত!
চিত্রঃ মহাশূন্য থেকে যাকে দেখলে মনে হয় পৃথিবীর বুকে দগদগে কালো ক্ষত
নদী যতই পাহাড় পেছনে ফেলে রেখে আসে ততই প্রাণের প্রাচুর্যের সূচনা করে। সর্পিলাকার আফ্রিকান ‘মারা নদী’র ধার ঘেষে প্রতি বছর প্রায় ২০ লক্ষ প্রাণীকে মাইগ্রেট করতে দেখা যায়। কেউ কেউ পানি পানের সময়টুকুতে অসাবধানতা বশতঃ হয়ে যায় দৈত্যাকার আফ্রিকান নাইল কুমির’র খাবার।
সব নদীই কী সাগরে গিয়ে শেষ হয় ? নাহ। অনেক নদীর চূড়ান্ত গন্তব্য লেক বা হ্রদ-এ। পূর্ব আফ্রিকার রিফট ভ্যালির তিন লেক – লেক মালাওয়ি, লেক তাংগানিইকা এবং লেক ভিক্টোরিয়া শুধু আকারেই পৃথিবীর সবচে বড় নয়- প্রাণপ্রাচুর্যেও দারুন ভরপুর। এমনকি লেক মালাওয়ি’র ৭০০ মিটার নিচের অতল গহবরও ‘লেক ফ্লাই মিজেস’ (এক প্রকার পতংগ) এর মত প্রানীদের বাঁচিয়ে রাখে। কোনো কোনো ভোরে লক্ষ লক্ষ মিজেস লেকের পানির উপরে দল বেঁধে উড়তে থাকে । দূর থেকে দেখলে মনে হবে খন্ড খন্ড মেঘ পথ ভুল করে নেমে এসেছে হ্রদের পানিতে।
এ পর্যায়ে প্ল্যানেট আর্থ আমাদের নিয়ে যায় পূর্ব সাইবেরিয়ার ‘বৈকাল’ - পৃথিবীর সবচে বড় হ্রদে। ৪০০ মাইল দীর্ঘ আর ১ মাইল গভীরতার এই লেক একাই ধরে রাখে পৃথিবীর মোট স্বাদু পানির এক পঞ্চমাংশ। মেরুর কাছাকাছি বলে বছরের পাঁচ মাস ধরেই এই প্রাচীনতম লেক ১ মিটার বরফের চাদরে আচ্ছাদিত থাকে। তবু প্রাণের স্পন্দন থেমে থাকেনা। এই অদ্ভুত পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য চাই বিশেষ শারীরিক সক্ষমতা। হয়তো তাই এই লেকের ৮০ ভাগ প্রাণীই পৃথিবীর আর কোথাও দেখা যায় না।
হ্রদ পর্ব শেষে এবার চোখ ফেরানো যাক নদীর দিকে। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন নদীকে মহা-নদী বললেও ভুল হবেনা। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ এ নদী এতটাই পানি প্রবাহিত করে যে এর পরের সেরা দশ নদীর সম্মিলিত পানির পরিমাণও এর কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। পেরুভিয়ান আন্দিজ থেকে শুরু হয়ে পূর্ব দিকে দক্ষিণ আমেরিকার এক-তৃতীয়াংশ পথ (৪০০০ মাইলেরও বেশি) পাড়ি দিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে মেশে এই নদী। এ নদীতে প্রাণের ছড়াছড়ি- এখন পর্যন্ত ৩০০০ প্রজাতির মাছের সন্ধান পাওয়া গেছে এখানে।
নদীগুলোর সমূদ্রযাত্রা খুব বেশি একটা যে মসৃণ- তা নয়। মাঝে মাঝেই তাদের পাড়ি দিতে হয় বিশাল সব জলপ্রপাত! ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার সীমান্তে প্রায় ২ কিলোমিটার ধরে বিস্তৃত ইগোয়াসু জলপ্রপাত পৃথিবীর প্রশস্ততম জলপ্রপাতদের একটি।
চিত্রঃ প্রায় ২ কিলোমিটার ধরে বিস্তৃত ইগোয়াসু জলপ্রপাত পৃথিবীর প্রশস্ততম জলপ্রপাতদের একটি
সাগরে মেশার আগে প্লাবন সমভূমির (Flood Plain) পাশ ঘেষে যাওয়ার সময় নদী হয়ে যায় স্তুলকায়। প্রতি বর্ষায় ব্রাজিলের ‘পারানা নদী’- ইংল্যান্ডের আয়তনের সমান এলাকা নিমজ্জিত করে। গড়ে তোলে ‘পান্টানাল’- পৃথিবীর বৃহত্তম জলাভূমি। জলজ বিভিন্ন প্রাণী প্রজাতির পাশাপাশি এর চারপাশের উদ্ভিদের প্রাচুর্যও লক্ষণীয়। বিভিন্ন প্রজাতি আর স্তরের মাছের মাঝে নির্দোষ অভিব্যক্তি নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ভয়ংকর পিরানহা। এক দেখায় কে বলবে- সুযোগ পেলে একটা বিশাল জলজ্যান্ত মাছ মিনিটেই গায়েব করে দিতে পারে এরা! মাছ আছে বলেই এসব জলাভূমির আশেপাশের এলাকা প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর।
চূড়ান্ত পরিণতির কাছাকাছি এসে নদীর গতি হয়ে যায় ভীষণ স্লথ। উজান থেকে বয়ে আনা পলিমাটি জমিয়ে জমিয়ে এরা তৈরি করে বদ্বীপ। গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্র – এ দু’নদী মিলে গড়ে তুলেছে পৃথিবীর সবচে বড় বদ্বীপ- বাংলাদেশ। ফি-বছর হিমালয় থেকে বয়ে আনা ২০ লক্ষ টন পলিমাটি তাদের স্থান খুঁজে পায় বঙ্গপোসাগরে। এই বদ্বীপের মুখের দিকটায় সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন- সুন্দরবন।
চিত্রঃ গংগা আর ব্রহ্মপুত্র – এ দু’নদী মিলে গড়ে তুলেছে পৃথিবীর সবচে বড় বদ্বীপ- বাংলাদেশ
এ তো গেলো উষ্ণাঞ্চলের কথা। শীতপ্রধান দেশের এই অঞ্চলগুলো নোনা-জলাভূমির ঘাসে (salt marsh grass) আবৃত থাকে। প্রাণীদের আবাস্থল হিসেবে এর জুড়ি নেই। আমেরিকার আটলান্টিক উপকূলের এমনই এক নোনা-জলাভূমিতে একসাথে ৪ লক্ষ গ্রেটার স্নো গিজ (সাদা রঙের হাস)-কে তাদের দীর্ঘ পরিভ্রমণের আগে বিশ্রাম নিতে দেখা যায়।
চিত্রঃ একসাথে ৪ লক্ষ গ্রেটার স্নো গিজকে তাদের দীর্ঘ পরিভ্রমণের আগে বিশ্রাম নিতে দেখা যায়
Planet Earth-এ এভাবেই শেষ হয় নদীর ভ্রমণকাহিনী। এ ভ্রমণ শুরু হয়েছিল কোনো এক উঁচু পাহাড়ের চূড়ায়। নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এ নদী পথ খুঁজে পায় মহাসাগরের। মাঝের সময়টুকুতে লক্ষ কোটি প্রাণকে বাঁচিয়ে রাখা- স্বাদু পানির এইতো ধর্ম!
৩য় পর্বটি ডাউনলোড করা যাবে এই লিংক থেকে।
১ম পর্বের লিংক
২য় পর্বের লিংক