ঘটনা টা ১৯৮৮'র। বন্ধু বলল সে মাস দেড়েকের জন্য গ্রামের বাড়ি যাবে। আমাকেও যেতে বলল, ওর মা বলেছেন। " মেয়েটার এত গল্প করিস, আনিস সাথে করে সপ্তা কয়েকের জন্য একবার দেখতে মন চায়"। আগেও বলেছি আমার বন্ধু ভাগ্য থেকে "বন্ধুমা" ভাগ্যটা সব সময় ভাল ছিল। ।
গ্রামটার নাম আজ আর আমার মনে নেই। একসময় কোন এক কারনে মাথা থেকে কিছু স্মৃতি মুছে যাবার কারনে আগের কিছু কিছু স্মৃতিও ফাকি দিয়ে চলে গেছে। তবে গ্রামটি নাটোরের চলন বিলের গা ঘেসে দাড়িয়ে। আমার নিজের গ্রামে তখন ইলেক্ট্রিসিটি চলে এসেছে এমন কি খবরের কাগজ ও পাওয়া যেত, পাকা টয়লেট তার অনেক আগেই হয়েছে। মানুষ টেলিভিশনও দেখে সেখানে। আর এই গ্রামে তখন খবরের কাগজ তো দুরের কথা বাতিও আসেনি। কাছের গাড়ি চলা গ্রামটি এখান থেকে ৪ ঘন্টা পায়ে হেটে যেতে হয়। কাছে পিঠ কোন স্কুলও বা বাজারও নেই। যারা স্কুলে যায় তারা ৬ মাইল হেটে একটা স্কুলে যায়, বাজারটাও সেখানে। গ্রামের বাচ্চা গুলো সত্যিই কস্ট করে লেখা পড়ার জন্য। ভোড় বেলা উঠে ডাংগুলি খেলতে খেলতে স্কুলে যায়। শুনেছি এখন ওখানে ওদের গ্রামেই একটা স্কুল হয়েছে ।
সেখানে টয়লেট মানে ৬টা বঁাশের মাঝে একটু খানি ফঁাকা আর সামনে একটা বস্তা ঝুলছে। এই টুকু শুনে আমি একটু দমে গেলাম। টয়লেট আমার জন্য একটা বিরাট সমস্যা। ছোট বেলায় আমার নিজের গ্রামে যখন ভাল টয়লেট হয়নি তখন ৩/৪ দিনের জন্য গ্রামে যদি যাওয়া হতো তবে এই ৩/৪ দিনে আমার শরীরের যাবতীয় ব্যপার গুলোর বাইরে বের হবার পথে এমনিতেই বন্ধ হয়ে যেত। শুধু দিন শুরুর আগে আগে একবার আর দিন শেষের পরে একবার ছোট টয়লেট করা হতো খোলা আকাশের নিচে। বাড়ি ফিরে অন্য সব ব্যাপার গুলো সারতাম ৩/৪ দিন পর।
তো আমি এই মানুষ সপ্তা কয়েক কি করে ওখানে গিয়ে থাকব ভাবতেই না যাবার একটা ইচ্ছা আমাকে পেয়ে বসল। আবার ওকে একথাটা বলতেও পারলাম না মনে কস্ট পাবে ভেবে। মনকে বুঝিয়ে বললাম ভালবাসা VS টয়লেট যদি হয় তবে ভালবাসাটুকু পেতে খোলা আকাশের নিচে টয়লেট ব্যপারটা আমার চ্যালেন্জ হিসেবে নেয়া উচিৎ
কথা হলো আমি ওখানে তিন সপ্তা থাকবো। আমার বন্ধুটি আগে চলে যাবে আর আমি যাবো পরে। তার ভাই আমাকে কাছের গাড়ি চলা গ্রামে থেকে রিসিভ করে নিয়ে যাবে। সেটা ৪ ঘন্টার হাটা পথ।
রাস্তা খারাপ থাকায় ঢাকা থেকে কাছের গ্রামটিতে পৌছাতে ১৩ ঘন্টা লাগলো। এর মাঝে বগুড়া বা সিরাজগঞ্জে সম্ভবত বাস বদলাতে হলো। মনে আসছেনা ঠিকমত।
ওর ভাইটি আমার দিকে হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বলল "আপু সত্যিই চলে এলেন খুব খুশি হয়েছি" মনটা ভরে গেল আমার ভাললাগায়। এর পরে হাটা পথে ৪ ঘন্টা । নানান ফুল পাখি দেখে আর কথা বলতে বলতে কখন যে পৌছে গেলাম টের পেলাম না। বন্ধুটি তাদের বাড়ির উঠোনে আমার অপেক্ষায় ছিল। আমাকে দেখেই বলে "হায় হায় কি সর্বনাশ! এই কাপড় পড়ে গ্রামে এসেছিস কি আমাদের বাড়িতে ডাকাতের টোপ হোয়ে? যা এখুনি শাড়ি পরে আয়।" এমন করে কেউ কাউকে রিসিভ করে ?
ওর মা এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে, ভাগ্য আর কাকে বলে !! ১০ মিনিটে কাপড় বদলে একটা নতুন সাদা শাড়ি পরে বের হলাম গ্রাম দেখতে। আমাকে নিয়ে গেল সে ধান খেতের আইল ধরে হাঁটতে, সাথে ওর বোনরা। ধান খেতে যেতে হলে ছোট একটা পানির ড্রেন পার হতে হয়। এই ড্রেন দিয়ে পানি খেতে যায় পাম্প থেকে। এটা পার হতে গিয়ে আমার পা কাদায় আটকে নিজে প্রথমে পরলাম ড্রেনে আর বন্ধু যখন তুলতে এলো হাত বাড়িয়ে, পা পিছলে ওকেও ফেললাম কাদার ভেতর । এই মাত্র নতুন একটা শাড়ি পরে বেড়াতে বের হয়ে এই আমার প্রথম অবস্থা । গায়ে, মাথায়, মুখে কাদা মেখে বাড়ি ফিরতেই ওর মা তো হতভম্ব হয়ে আমার কাদা মাখা চেহারার দিকে তাকালেন তার পর হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরলেন , ওর বোনদেরও একই অবস্থা। আমাকে নিয়ে বাড়ির দিঘীতে ফেলল ওরা সেই সন্ধা বেলায় আমি তখন সাঁতার পারিনা। আমাকে দেখতে ততক্ষনে পাড়ার সবাই চলে এসেছে :#> কি করুন চচ্চরে অবস্থা আমার তখন। দিঘীর পানিতে মাথা ঢুবাতেও জানিনা । পানির নিচে মাথা নিতে ভয় লাগে
রাতে তুষারের (আমার বন্ধুটা) মা হ্যারিকেনের আলোয় খুব আদর করে মজার মজার গ্রামের তাজা মাছের রান্না খাওয়ালেন। তুষার বলল "মা ফকিরদের বেশি আল্লাদ দিও না, এ তোমার ভাঁড়ার তো চুরি করবেই আর বছর না ঘুরতেই আবার আসতে চাইবে।"
ওদের বিশাল এক দিঘী ছিল বাড়ির সাথে, রাতে খাবার শেষে মাদুর পেতে দিঘীর পাশে শুয়ে তারা ভড়া আকাশ দেখলাম আমারা সবাই মিলে। ওর বোনরাও আমার খূব ফ্যান হয়ে গেল । টয়লেটের ব্যপারটার সমাধান হলো পাশের বাড়ির সবেধন নীলমনি এক মাত্র পাকা টয়লেট টার চাবি আমার হাতে দিয়ে। রাতে ভুতের ভয়ে অতদুর একা একা যেতেও ভয় লাগে, গভীর রাতে সেখানে গেলে সাথে কাউকে নিতে হয় ।
দিন গুলো চমৎকার কাটছিল, এমন কোন কাজ নেই যা আমরা করলাম না, পরের গাছের ফল চুড়ি করা থেকে শুরু করে কাকে কোথায় ভুতে ধরেছে তাকে দেখতে যাওয়া, কার ১০ বছরের ছেলে মেয়ের বিয়ে হচ্ছে, কার খেতের তরমুজ ভেঙ্গে খেতে হবে, কার ঢেকি তে পাড় দিতে হবে, কাবাটি খেলা, গাদন খেলা, ছি বুড়ি........সবই করলাম। ৯ মাইল হেঁটে পাশের গ্রামেও গেলাম কাবাটি খেলা দেখতে। একটা বিয়ে খেতে গরুর গাড়ি চরে ১৫ মাইল দুরের একটা গ্রামে গেলাম....আমার প্রথম গরুর গাড়ি চড়া! কি এক্সাইটেড যে ছিলাম! পরের দিন গায়ের ব্যথায় করুন অবস্থা আমার । প্রথম দু'টো সপ্তা কেমন করে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। পরের সপ্তা শেষে আমার চলে যাবার কথা। এমন সময় ভিষন বৃস্টি শুরু হলো।
বৃস্টি আর থামে না। আমারা বৃস্টিতে ভিজে বড়শি হাতে মাছ ধরে সময় কাটাই সাথে আচারের তেল দিয়ে মুড়ি মাখা। এর মাঝে ওরা আমাকে সঁাতার শিখিয়ে দিল। ওদের বিশাল দিঘীটা এপাড় ওপাড় করা আমার জন্য কোন ব্যপার নয় তখন আর। একবার পানিতে নামলে আমার আর উঠতে ইচ্ছে করেনা। নতুন নতুন সঁাতার শিখলে যা হয় দিঘীর পদ্ম ফুলের মালা বানাই তুষারের বোনদের সাথে। আবার সেই মালা বাড়ি এনে ভেজে খেয়ে ফেলি
বৃস্টির পানি বাড়তে থাকলো....চলন বিলের পানি বাড়তে থাকলো, আমরা নৌকো চড়ে শাপলা ফুল তুলি, কলমি শাক তুলি, মাছ ধরা তো আছেই। একদিন সকালে উঠে দেখলাম পানিতে সব ডুবে গেছে, রাস্তা ঘাট সব পানির নিচে। নাটোরে থেকে কোন গাড়ি আসছে না কাছের গ্রামটিতে। শোনা গেল নাটোরের রাস্তাটাও পানির নিচে। ঢাকার সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ, আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কবে পানি নামবে? তুষার বলল ভাবিসনা পানি নেমে যাবে দু'দিনেই তখন ফিরে যাবো দেখিস। আমি সাহস পাই একটু, ভাবি পানি নেমে যাবে। তুষার আর ওর মা বোনদের কাছে আমি যেন একটা জ্যান্ত পুতুল তখন, ওরা আমাকে নিয়ে নানান খেলায় মগ্ন, নানান ভাবে সাজায় নানান জিনিস ট্রায় করায়, ক'জন মানুষ যেন এক জ্যান্ত পুতুল নিয়ে খেলায় মেতে আছে। আমি ওদের ভালবাসায় অভিভূত হয়ে ওদের পুতুল হয়ে থাকি, সুন্দর দিন গুলোকে সারা মন দিয়ে ধরে রাখি।
পানি নামেনা, পানি বাড়তেই থাকে, একদিন বাড়ির উঠোনে পানি চলে এলো। আমরা কলা গাছ দিয়ে ভেলা বানালাম চলাচল করবার জন্য। দিঘী ডুবে গেল, শুধু পাশের বাড়ির টয়লেটটা উচুতে বলে সেটা ডোবেনি তখনও। এর পরে এক সকালে দেখি ঘরের ভেতর পানি, ঘরের ভেতরই মাছ ছুটছে ।
দিঘীর মাছ সব বেড়িয়ে পরেছে। আমারা ইট দিয়ে চৌকি উচু করে দিলাম, বিছানায় বসে তাস খেলি আর মাছ ধরি। এদিকে চাল ছাড়া অন্য কোন খাবার নেই বললেই চলে, মাছও তেমন পাওয়া যায় না পোনার ঝাক ছাড়া, বন্যায় সব ভেসে যাচ্ছে। এর মাঝে বিলে স্নান করতে গিয়ে আমার থাই এ একটা বিশাল জোঁক লাগলো, আমি তো ভয়ে আধা সিদ্ধ। ইয়া মোটকা একটা জোঁক, রক্ত খেয়ে পেট ফুলিয়ে আড়াই ইঞ্চি মোটা হয়ে গেল, কি ভয়াবহ দৃশ্য!
আস্তে আস্তে খাবারের খুবই অভাব শুরু হলো, টাকা থাকলেও কোন লাভ নেই, মানুষ পানি বন্দি, বাড়ির মুরগি শেষ করে আর কিছু নেই চাল ছাড়া। আমরা কাঁচা হলুদ বা কাল জিরা ভর্তা দিয়ে সকালে একবার আর রাতে একবার ভাত খাই। ভাগ্য ভাল থাকলে গামছা দিয়ে কোন কোন দিন পোনার ঝাক ধরি। এভাবে ২ মাস চলল। অবস্থা আরো খারাপ হলে সরকারের ত্রান থেকে হেলিকপ্টার করে বিস্কিট, ব্রেড, টিন খাবার ফেলা হলো গ্রামের বাঁধে।
আমার কলা গাছের ভেলায় চেপে গেলাম সেগুলো আনতে। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই টিন ট্যুনা বা কর্ন বীফ খেতে পারলো না। দু'একজন খিদের জ্বালায় থাকতে না পেরে তাইই খাওয়া শুরু করল। আমি টিনের খাবারে অভ্যস্থ, কর্ন বীফ আর ট্যুনা আমার প্রিয়। তো ওগুলোর বেশির ভাগই আমার পেটে গেল, তবে খুবই খারাপ লাগছিল ওরা এসব খান না বলে। আমি এগুলো কে নানান ভাবে বাংগালী কায়দায় রান্নার চেষ্টা করলাম ওদের জন্য। এর মাঝে রান্নার কাঠ কয়লাও শেষ হয়ে যেতে থাকলো। আমাদের মাছের শিকারের পাশে খড়ি কুড়িয়ে দিন কাটাছিল, খড়ির অভাবে রান্না বসে দিনে তখন একবার।
এদিকে পাশের বাড়ির টয়লেটটিও পানির নিচে। ভেলায় করে দুরে যাই টয়লেট করতে। যে পানিতে টয়লেট সেই পানিতেই স্নান, সেই পানিই কলসিতে রেখে ট্যাবলেট দিয়ে খাওয়া ও রান্না, ভাগ্য বিলের পানি বয়ে চলছিল। ১৯৮৮র চলন বিলের ভয়াবহ বন্যা, জানি না আপনাদের কেউ এই বন্যার ভয়াবহতার কথা জানেন কিনা। কৃষকরা সর্বসান্ত হয়ে গেছিলেন। প্রচুর মানুষের আর ফসলের ক্ষতি হয়েছেিল। আশে পাশের বাড়ি ও গ্রাম থেকে মৃত্যুর সংবাদ আসতে থাকল। কলেরা আর ডায়রিয়ায় মানুষ মরছে, আমারও ডায়রিয়া হলো। তবে সেরে উঠলাম দ্রুতই তুষারের মা'র বিশেষ লতা পাতার ওষুধে।
মাছ আর খড়ির সন্ধান করা ছারা আমাদের আর করার কিছু নেই। লুডু বা তাস খেলে সন্ধ্যে কাটাই, তখনই শিখেছিলাম ব্রিজ আর গামছা পাতা খেলা দু'টো। খিদেয় সব সময় সবাই অস্থির হয়ে থাকতো, তবু সবার মুখেই হাসি। পানিতে সব ফসল নস্ট হয়ে গেল, তবু আশায় বুক বাঁধে কৃষকরা। এরই মাঝে আমরা জীবনে একটু আধটু আলো আনতে ঢেকিতে চাল ভেঙ্গে আটা বানাই, পিঠা বানাই, গান করি, নাটক করি, ভেলায় করে ঘুড়ে বেড়াই, বয়ে চলা পানিতে সঁাতার কাটি, রাতে নৌকা চড়ে বিলে গিয়ে শুয়ে শুয়ে তার ভড়া আকাশ দেখি।
এভাবে ৩ মাসের উপর চলে গেল পানি সরতে। পানি সরলে আমদের ঢাকা ফেরার পালা। ফেরার সময় এই একসাথে কস্টে আনন্দে কাটানো দিন গুলো খুব মনে হতে লাগল। গ্রামের অনেক মানুষ এলো আমাকে বিদায় দিতে। সাড়ে তিন মাস বন্যায় আটকে থাকা, দীর্ঘ সময়, তবু মনে হয় দিন গুলো কেমন চমৎকার কেটেছিল সুখে দুঃখে, খেয়ে না খেয়ে...........।
The initial flood that began in late 1987 and continued throughout 1988 was caused by the synchronization of peak flow of the Ganges, Brahmaputra and Meghna Rivers. All four types of floods including, storm surge flood, rain flood, flash flood and riverside flood that occur in Bangladesh contributed to the 1988 flooding.
Deforestation may be partly to blame, causing soil erosion which reduces the ability of the land to absorb water.