আরো মজার মজার গল্প, কবিতা পড়তে ভিজিট করুনঃ- http://anupamdkan.blogspot.com
১.
বাঙ্গালীর আসলেই সিভিক সেন্স খুব কম। নইলে এমনিতেই ঢাকা শহরে ঘুরতে যাওয়ার মতো জায়গা খুবই কম, তার মধ্যে যা আছে সেগুলোও এতো নোংরা করে রাখে, যে একবার গেলে আর দ্বিতীয়বার যেতে ইচ্ছে করেনা। এই যেমন ধানমন্ডি লেকের কথাই ধরা যাক। এতো রোমান্টিক একটা পরিবেশ। বিশেষ করে সন্ধ্যার পর শৈলীর হাত ধরে লেকের পাড়ে বসে থাকলে কোথায় যায় যানজট আর কোথায় যায় মানুষের কোলাহল…। এখনকার যুগটাই এমন। একসময় মানুষের ভীড়ে একা থাকাটা দুঃখবোধের চরম পর্যায় বলে বিবেচিত হতো। আর এখন? কোলাহল এতো মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যে হাজার মানুষের মধ্যে একা থাকতে পারার গুণটা এখন বিশাল সৌভাগ্যই বলতে হবে।
শৈলীর সাথে কতো মজার সময় কেটেছে এই লেকের পাড়ে। শৈলীর আবার হাসির রোগ আছে, একবার হাসতে শুরু করলে কোনভাবেই থামানো যায় না, ধমক দিয়েও না। একবার মনে আছে, কি একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে যেনো দুইজন মিলে এতো হাসছিল, যে আশেপাশের জুটিরা এসে পর্যন্ত অনুরোধ করছিল ‘এট লিস্ট আস্তে’ হাসার জন্য। মনের অজান্তেই রবিনের মুখে হাসি চলে আসলো, যদিও তার এখনকার অবস্থাটা ঠিক হাসার উপযুক্ত নয়।
উফ আর কতো??? আর কতক্ষণ যে অপেক্ষা করতে হয় কে জানে। সিগারেট খাওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই। কিন্তু এই অবস্থায় সিগারেটই বা কতক্ষণ ভালো লাগে? আশেপাশে সব জুটি হাত ধরে বসে আছে, আর সে হ্যাবলার মতো গত একঘন্টা ধরে একা একা লেকের পাড়ে অপেক্ষা করছে। সোজা হয়ে বসে থাকতে থাকতে পিঠে ব্যাথা শুরু হয়ে গেলো। শৈলী সাথে থাকলে মনেই পড়তো না ব্যাথা-ট্যাথার কথা।
নাহ! একটু হেঁটে আসা দরকার। ইস! লেকের পানি কেনো যে লোকে ময়লা করে। আবারো মনে পড়ে গেলো সিভিক সেন্স সংক্রান্ত যে প্রবন্ধটা সে মনে মনে ভাবছিল তার কয়েকটা লাইন। যে পানিতে ঘুরতে এসেছে, যে পানিতে প্রেমিকা নিয়ে নৌকা চালাচ্ছে, সে পানিকেই নোংরা করছে। ছোট বেলায়…।
যাক, আর ছোটবেলার কথা ভাবতে হবে না। জলিলকে দেখা যাচ্ছে। ছোটখাট, চার্লি চ্যাপলিনের মতো দেখতে জলিল। জীবনে এই প্রথম এই অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে রবিনের। তাই বুকটা একটু ধুকপুক করতে শুরু করলো। জলিল অবশ্য এই বিষয়ে অনেক অভিজ্ঞ। খুব ভালভাবেই বুঝিয়ে দিল পদ্ধতিটা কি। আআহ! আজ রবিন ধাক্কাধাক্কি করে বাসে ঝুলবে না। আজ তার অদ্ভুত আরামের দিন, আজ পকেটে একটা সিরিঞ্জ, আর এক পোঁটলা হেরোইন। অপেক্ষার পালা শেষ…।
২.
কোটিপতি বাপ থাকতে কোনদিনই কিছুর অভাব টের পায়নি রুবেল। এই একবার ছাড়া। অনেকদিন ধরেই মেয়েটার দিকে খেয়াল রাখছে সে। বর্ণনাটা সিনেমায় দেখানো বখাটে ছেলেদের সাথে মিলে গেলেও কিছু করার নেই, এটাই সত্যি। পাড়ার অন্য মাথায় যে দোকানের সামনে তার আড্ডা ঠিক সেই দোকানের উলটো দিকেই শৈলীদের বাসা।
বাবার ব্যবসা দেখার কাজটা ছোটবেলা থেকেই করতে হয় রুবেলকে। এই করতে করতে পড়াশোনা লাটেই উঠেছিল। আর সেই সাথে বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি যোগ হয়ে তাকে একেবারে চুকেবুকেই দিল। পড়াশোনার অবশ্য দরকারও নেই রুবেলের। জন্মের পর থেকে আদরের দুলাল যাকে বলে, মুখ থেকে কোন আবদার বাতাসে মিলানোর আগেই তা হাজির করেছেন রুবেলের বাবা। এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী হয়ে এই মাথায় তোলা আদরের যোগ্য প্রতিদানও দিয়েছে সে।
মনে মনে এই মেয়েটাকে একসময় ভালবেসেছিল রুবেল। কথাটা সে তার বন্ধুদের জানিয়েওছিল। কিন্তু মেয়েটা, মানে শৈলী, তার মন ভেঙ্গে দিয়েছে। প্রতিদিন মেয়েটা একটা ছেলের সাথে প্রেম করতে যায়, দেখে বুকটা……। এমনিতেই ইদানিং মন-মেজাজ অনেক খারাপ যাচ্ছে রুবেলের। সাধারণতঃ গভীর রাতের আগে বাসায় ফেরে না সে, ঘুম থেকেও উঠে অনেক দেরীতে। ঐদিন, একটা কাজে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে দেখে ……। …ভাবতেই নিজের জন্মের জন্য ঘৃণা হতে শুরু করে। নিজের মা……তাও নিজের বাসায়……ছিঃ।
যাক, শেষ পর্যন্ত এতোদিন পর হরিণী বাগ মানলো। নিজের কামনা বাসনা সাধারণতঃ শহরের নামীদামি হোটেলে পেশাদার দেহপসারিণীদের দিয়ে মিটিয়েই অভ্যস্ত রুবেল। কিন্তু ভদ্র ঘরের দুষ্টু মেয়েদের নিজের ঘরে লুটেপুটে খাওয়ার মজাই আলাদা। রুবেল চিন্তা করে দেখলো এক ঢিলে কতগুলো পাখি মারতে যাচ্ছে সে। যাকে নিজের জন্মদাত্রী বলতে ঘৃণা হয়, তার কুকর্মের প্রতিশোধ আর ভালোবাসা চেয়ে না পাওয়ার প্রতিশোধ, সাথে মজাটা তো আছেই। কিন্তু এতোক্ষণ লাগছে কেন শৈলী মেয়েটার?
৩.
খুব ভালো ছাত্রী হিসেবে বরাবরই সুনাম শৈলীর। তবে দারিদ্র্য আর পরিবারের অসেচতনতার কারণে জীবনে খুব একটা উন্নতি করতে পারল না সে। ঐ…অন্য আর দশটা ছেলেমেয়ের মতো পাড়াগাঁয়ের একটা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে একটা কলেজেই অনার্সে ভর্তি হতে হলো। অথচ, একসময় কত স্বপ্ন ছিল, মেডিকেল, বুয়েট, অন্ততঃ ঢাকা বা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। আর সে কিনা শেষ পর্যন্ত ভর্তি ফরমের টাকাটাই জোগাড় করতে পারলো না!
অবশ্য এই দুর্ভাগ্যে সে বিশেষ খুশি। ভাগ্যের এমন বিড়ম্বনা না হলে তো রবিনের সাথে দেখা হতো না। পড়াশোনায় ভালো না, দেখতেও আহামরি কিছু না, চালচুলা নেই, নেই কোন টাকা-পয়সা। কিন্তু ছেলেটার মধ্যে এমন কি যেন আছে, যা শৈলীকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। খুব যে মজার মজার কথা বলে ছেলেটা, তাও না, কিন্তু তারপরও কেন যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো রবিনের কথা শুনে যায় সে। এমন সৌভাগ্য ক’জনের হয়?
রবিনের সাথে শৈলীর প্রেম ইন্টারমেডিয়েটে পড়ার সময় থেকেই। শৈলী এই কলেজেই অনার্স পড়বে শুনে সে আর কোথাও ভর্তির ফরমই তোলেনি। রবিনের পড়াশোনায় অনেক যত্ন করতো শৈলী। নিজের হাতে নোট তৈরী করে রুবেলকে দিতো। নিজের পড়াশোনার চেয়ে রবিনের দিকেই মনযোগ ছিল তার বেশী। দারিদ্র্য, দুঃখ-কষ্ট, এসব ঘুচিয়ে রবিনের সাথে একটা সুন্দর সংসার গড়ে তুলবে, শৈলীর জীবনে আর বেশী কিছু চাওয়া ছিলনা।
কিন্তু সবার কপালে সব হয় না। সব মেনে নিয়েছে শৈলী। যতটা সহজে এই চিন্তাটা করছে, সিদ্ধান্ত নেয়াটা এতো সহজ ছিল না। পৃথিবী দুই ভাগ হয়ে যাচ্ছিল তার সামনেই, প্রলয় যেনো সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল। এখন অবশ্য শৈলী অনেকটাই নিজের মনকে বুঝিয়ে এনেছে। পৃথিবীতে তার একমাত্র সম্বল, তার বাবা। সেই বাবা আজ দুই মাস হলো হাসপাতালে ভর্তি। এমনিতেই টানাটানির সংসার, গ্রামে যা একটু জমি ছিল, কমদামে বিক্রি করে দিয়ে এই দুই মাস কোনরকমে ওষুধ আর টেস্টের খরচটা যোগানো গেছে। কিন্তু এবার ডাক্তার সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন কিডনি না লাগালে তার বাবাকে আর বেশীদিন বাঁচানো সম্ভব নয়।
কিডনি জোগাড় হয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু টাকা? কিডনির জন্য কিডনির মালিক দাবী করেছে দুই লাখ টাকা। এতো টাকা শৈলী পাবে কোথায়? রবিনের পক্ষেও কোনভাবেই জোগাড় করা সম্ভব না। তাই শৈলী বলা যায় অনেকটা বাধ্যই হয়েছে। অবশ্য সে প্রতারণা করেনি কারো সাথে। জলিলের প্রস্তাব শুনে একদিন সময় নিয়েছিল সে। ঐ একদিনই ঠিক করে দিয়েছে তার জীবনের ভাগ্য। রবিনকে পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে, এই সম্পর্ক রাখা আর সম্ভব নয়। কেন? কোন কারণ নেই, অথবা বড়লোকের কোন ছেলেকে বিয়ে করবো। আর দেরী সহ্য হচ্ছে না। যে কোন মুহুর্তে মত পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু রুবেল ছাড়া এক রাতের জন্য দুই লাখ টাকা দেবে এমন পাগল আর কে আছে? এতো দেরী করছে কেন জলিল? কখন থেকে শৈলী রাস্তার উপরে দাঁড়িয়ে আছে…
৪.
জলিলের আশা অনেক বড়, যাকে এক কথায় বলে উচ্চাকাংখা। আর হবে নাই বা কেন? মাত্র দুই বছরের মাথায় একজন সামান্য মুদী দোকানদার থেকে এখন সে একজন বিশাল ব্যবসায়ী, যার পুরো ব্যবসাটাই চলে অন্ধকারে। তার দোকানের সামনে যে সব মাস্তান আড্ডা দিতো আর চা-বিড়ির হুকুম চালাতো, তারা এখন তাকে দেখলে দশ হাত দূর থেকে সালাম ঠুকতে থাকে। এ সবই সম্ভব হয়েছে রুবেল ভাইয়ের বদৌলতে। ফ্রি চা-সিগারেট খাওয়ানোটা কয়েক হাজারগুণ উসুল হয়ে গেল জলিল মিয়ার।
হঠাৎ একদিন মোটরসাইকেল বসে চা খেতে খেতে রুবেল ভাই ডাক দিয়ে বলে, ‘জলিল, আর কতোদিন মাইনষেরে চা খাওয়াইবা, সালাম দিবা? বয়স তো কম হইলো না। নিজে কিসু কইরা খাও, ফুর্তি কর, জীবন আর কতদিনের?’ হঠাৎ এই কথার মর্ম বুঝতে পারেনি জলিল। বরং মনে মনে একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিল, ‘কোন অন্যায় করে ফেলিনিতো রুবেল ভাই? চায়ে কিসু লাগবো?’ হেসে ফেলে রুবেল, ‘না রে ব্যাটা। রাতে আইসো বাসায়, কথা আছে’।
ধুকপুক বুক নিয়ে সন্ধ্যার পর রুবেলের বাসায় হাজির হয় জলিল। ধুকপুকানি আরো বেড়ে যায় যখন রুবেল নিজের হাতে ধরে তাকে মেঝে থেকে তুলে দামি সোফায় বসায়। ‘শৈলীরে চেন?’ ‘কোন শৈলী?’ ‘আরে ঐ যে তোমার দোকানের উলটা দিকে থাকে যে মেয়েটা’। শৈলীর কথা কেন উঠলো বুঝতে পারলো না জলিল, ‘ওহহো। করিম ভাইয়ের মেয়ে?’ ‘আরে, ঐ মেয়ে তোমার ভাতিঝি লাগে নাকি? ভালই তো।’ এরপর যা বললো রুবেল, তা শুনে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসতে লাগলো জলিলের। বিনিময়ে নগদ ২ লাখ টাকা, এলাকার চাঁদা তোলার দায়িত্ব, রুবেলের হেরোইন ব্যবসার পার্টনার……। বলা যায়, এক চোখে স্বপ্ন, আরেক চোখে ভয় নিয়ে রুবেলের বাসা থেকে টলতে টলতে বের হয়ে আসে জলিল।
এগুলো অবশ্য বেশ কিছুদিন আগের কথা। শেষ পর্যন্ত নিজের গরীবী হাল ঘুচানোর সিদ্ধান্তই নিয়েছিল জলিল। সিদ্ধান্তটা যে ভুল ছিল না তার প্রমাণ আজ হয়ে গেলো। একই দিনে দুই দুইটা খুশীর খবর। প্রথমটা একটু ছোট, আর দ্বিতীয়টার জন্য তো সে এতোদিন ধরে বসেই আছে। আজই এক নতুন খদ্দের জোগাড় হলো। একজনের কাছে একবারে এতো বড় হিরোইনের চালান সে কখনো বিক্রি করে নি। দেখে মনে হলো ছ্যাঁক খাওয়া কাস্টমার, সুতরাং একে ভাঙ্গিয়ে বেশ কিছুদিন আরামে চলা যাবে। আর দ্বিতীয়টা তো কপাল খুলে যাওয়ার গল্প। শৈলীকে অবশেষে রাজী করানো গেছে। এখন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এলাকার চাঁদাবাজির অর্ধেক রাজত্ব……আহ। জলিল শুধু ঘরের এপাশ থেকে ওপাশ পায়চারি করতে থাকে অস্থিরভাবে। কখন আসবে রুবেল?
অবশেষে একদিন
সকালে উঠেই পত্রিকাটা হাতে না পেলে কেমনটা যে লাগে। সুমনের একেবারেই টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত অভ্যাস। সকালে উঠেই পত্রিকা, তারপর দাঁত-টাত ব্রাশ করে, ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করেই দৌঁড়ে বাসের লাইনে। কিন্তু আজ তো পত্রিকা অফিসের দেরী করিয়ে দিবে দেখছি। অবশ্য পত্রিকায় থাকেই বা কি আজকাল। ৬০% রাজনীতি, ২০% অপরাধ, ৫% দুর্ঘটনা, ৫% ব্যবসা, ৫% খেলাধুলা আর অন্যান্য ৫%, এই তো হয়ে গেলো যেকোনদিনের একটা খবরের কাগজ। এইসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতেই দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে পত্রিকার মাথাটা উঁকি মারে। যাক, বেশী দেরি হয়নি।
‘এই যে, যা ভাবছিলাম তাই’, সুমনের গলা আনমনেই হঠাৎ চড়া হয়ে যায়।
সুমনের মা ভেতর থেকে ছুটে আসেন, ‘কি রে, কি হয়েছে?’
‘আর বলো না মা, দেশে মনে হয় ভালো কিছু ঘটেই না। দেখো তো আজকের পত্রিকার প্রথম পাতায় ছয়টা শিরোনামের মধ্যে চারটাই হলো এই…’।
সুমনের সামনে চকচকে কাগজে ঝকঝকে হরফে ছাপানো পত্রিকায় জ্বলজ্বল করতে থাকে চারটি শিরোনাম।
অতিরিক্ত হিরোইন সেবনে যুবকের মৃত্যু
মাকে খুন করে ছেলে পলাতক
গলায় ওড়না পেঁচিয়ে যুবতীর আত্মহত্যা
১০ পতিতা সহ হিরোইনসম্রাট আটক