বয়স কম করে হলেও ষাট কিংবা ততোর্ধ্ব হবে। এ বয়সে নাতী-নাতনী নিয়ে খুনসুঁটিতে মেতে থাকবার কথা তাঁর। দিন কাটাবার কথা আরাম আয়েশ করে। তবে তেমন কপাল নেই বয়োবৃদ্ধ লোকটির। পড়ন্ত বয়সেও তাই নিরন্তর খেঁটে যাচ্ছেন দু’মুঠো আহারের যোগান দিতে।
গল্পটি ... জেলার ... উপজেলার মোল্লাপাড়া গ্রামের মো. হাসেন আলীর। পেশায় তিনি একজন আইসক্রীমওয়ালা। এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে দৌড়ঝাঁপ আর ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের কাছে আইসক্রীম বিক্রি করাই তাঁর একমাত্র কাজ।
বুধবার দুপুরে .. ইসলামিয়া সিনিয়র মাদরাসার মূল প্রবেশ পথ থেকে খানিকটা সামনেই দেখা মেলে তাঁর। কথা হয় ষাটোর্ধ্ব এই জীবন সংগ্রামীর সাথে।
আলাপচারিতায় জানা যায়, স্বাধীনতার পর সুনামগঞ্জের গামারতলা গ্রাম থেকে পিতা মো. কানু শেখ ও মা আতরজান’র সাথে পার্বত্য এলাকায় আসেন হাসেন আলী। তখন তিনি টগবগে যুবক। কয়েক বছর পর বাবা মারা যাওয়ায় মাকে নিয়ে .... মোল্লাপাড়ায় স্থায়ীভাবে বসতি গাড়েন। এর মাঝে সংসারও বাঁধেন তিনি। ছোট্ট সংসারের একে একে জন্ম নেয় ৪ মেয়ে ও ২ ছেলে। বড় হয় হাসেন আলীর পরিবারের ছোট্ট পরিসর। বর্তমানে একজন ষোড়শী কন্যা ছাড়া বাকী সবারই বিয়ে দিয়েছেন তিনি। তবে বিয়ের পর আর বৃদ্ধ পিতামাতার খবর রাখেনা ছেলে-মেয়েরা। তিন মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে। আর দুই ছেলের মধ্যে এক ছেলে ঘরজামাই এবং অন্য ছেলেও বিয়ের পর থেকে লাপাত্তা। তাই নিরুপায় হয়ে ছোট মেয়ে আর সহধর্মিনীর আহার জোগাতে জীবনের এই পড়ন্ত বেলাতেও বিশ্রামের সুযোগ নেই হাসেন আলী নামের পুরুষ মানুষটির।
.. বাজারের গৌতম কোম্পানীর আইসক্রীম/বরফ তৈরীর কারখানা থেকে বাকীতে আইসক্রীম নিয়ে বাজার, বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা, স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার সামনে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন তিনি। সারাদিন বিক্রির পর গড়ে ২৫০-৩০০ টাকা আয় হয় তাঁর। এই সামান্য আয় দিয়েই দুর্মূল্যের বাজারে কোনরকমে খেয়ে পড়ে থাকেন পরিবারের অপর দুই সদস্য নিয়ে। শুধু বেঁচে থাকাই হয় এতে, তবে অল্প আয়ে ভবিষ্যত কিংবা কোন স্বপ্ন হয়না।
এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কোনরকমে মাথা গুজবার জন্যে একটি ঘর তুলেছেন। তবে সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পরও রাতের বিছানায় চোখ লাগেনা তাঁর। চোখের কোণে জড়ো হয় দুশ্চিন্তা। টাকার অভাবে ঘরে থাকা উপযুক্ত ষোড়শী কন্যার বিয়ে দিতে না পারার আক্ষেপ।
‘‘পোলা-মাইয়ারা খোঁজ-খবর লয় না। তয় অসুবিধা নাই। আল্লা হাত-পা দিছে, যতোক্ষণ শরীলে শক্তি আছে, কাজ কইরা খামু আমি কারও কাছে হাত পাতি না, চুরি-ডাকাতি করি না, দালালি করি না। কারও ধারেপাছে নাই। আল্লায় যদ্দিন বাঁচায় রাহে মান-সম্মান লইয়া বাঁচতে চাই।’’
কথাগুলো বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন হাসেন আলী। ছলছল চোখে আকাশের বুকে তাকিয়ে চোখের জল লুকানোর বৃথা চেষ্টা করলেন তিনি।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:০৮