তমার সাথে আমার সম্পর্কটা কতটা বন্ধুসুলভ সেটা বুঝতে নিচের ধাধাটিই ঢের বেশি
স্যার! আপনাকে একটা ধাধা ধরি। যদি পারেন তবে আজ পড়াবেন। আর যদি না পারেন তাহলে নাস্তা খেয়ে বিদায় নেবেন।
-না, ফাকিবাজি চলবে না। কাল তোমার আইটেম আছে। ধাধা বাদ দিয়ে বই খুলো।
জ্বি না। অত্যন্ত সহজ ধাধা, আমি জানি আপনি সেটার জবাবও জানেন। প্লিজ স্যার, প্লিজ। জাস্ট ট্রাই ওয়ান্স প্লিজ!
-আচ্ছা। কিন্তু ধাধার জবাব পেলে পুরো এক ঘন্টা চেয়ারে বসে থাকতে হবে। নো আহাজারি।
আচ্ছা, প্রমিজ। এবার শুনেন। কি সেই জিনিস? যাহা আমি পরিধান করি, সকল পূর্ণবয়স্ক সচেতন মেয়েরা পরিধান করে কিন্তু আপনি পরিধান করেন না। তবে অনন্ত জলিলের পরিধান করা উচিত! বলেন তো কি সেই পরিধেয়? এক্কেবারে সোজা জিনিস। জবাব দিন নয়তো নাস্তা করে ফুটেন। হি হি হি
-মানে, এইসব কি! আমি পারবো না এইসব আজে-বাজে ধাধার উত্তর দিতে।
আমার কথা শেষ হবার পূর্বেই তমা দৌড় দিলো। বিশ বছরের তরুনীর আচরণ কেন কিশোরীর মত হবে! আজকালকার মেয়েছেলের এই এক সমস্যা। এদের বয়স যত বাড়ে চপলতাও তত বাড়ে। তমার ধাধাটির জবাব আমি দিতে পারতাম কিন্তু অশ্লীল কথা আমি সেটা মুখে আনবো না। তমা এটা জেনে শুনেই পড়া ফাকি দিতে আমাকে এই ট্র্যাপে ফেলেছে। বড়লোকের মেয়ে হয়তো যাবে কোন ছেলেবন্ধুর সাথে ডেট করতে। আমার মত গরীবের কি আর তাতে বাধা দেয়া শোভা পায়। এসব ভাবা বাদ দিয়ে আমি নাস্তা খেতে শুরু করলাম। এই টিউশনির প্লাস পয়েন্টই হলো নাস্তা। সপ্তায় তিনদিন আমাকে আসতে হয়। ওরা যদি আমাকে প্রতিদিনও আসতে বলে তবুও আমি আসবো, শুধুই এই নাস্তার লোভে। মেডিকেল হোস্টেলের খাবারের সাথে তুলনায় এ যেন বেহেস্তি খাবার আমার জন্য। তমার পড়া হচ্ছে না ভালো, ও নানাভাবে ফাকি দিয়ে চলছে দিনের পর দিন। হাবভাবে মনে হচ্ছে এই টিউশনি আর থাকবে না। তাছাড়া ইদানিং মনে হচ্ছে এক পর্যায়ে নিজ থেকেই ছেড়ে দিতে হবে। কারণ সামান্য, তমার প্রতি আমার দূর্বলতা। তমা যতক্ষণ সামনে বসে থাকে ততক্ষণ মনে হয় স্বর্গে আছি। ওদের স্টাডিরুমের এসির ঠান্ডা বাতাস আর সাইডটেবিলে রাখা তাজা ফুলের গন্ধ স্বর্গীয় অনুভূতিটাকে আরও পোক্ত করে তুলে। তমাকে তখন পরী মনে হয়। যে সে পরী নয়, জাদুরাজ্যের মায়াবী পরী। আমার স্বর্গীয় দিবাস্বপ্নটি মাংসের সমুচায় শেষ কামড়ে ভেঙ্গে গেল। এবার উঠতে হবে।
আমি তমার নেক্সট আইটেমের জন্য দরকারী কিছু নোট লিখে বের হবার জন্য উঠলাম। ঠিক তখনই বিকট চিৎকারের শব্দ কানে এল। তীক্ষ্ণকন্ঠটি তমারই হবে আমি নিশ্চিত। সাথে সাথেই তমার মায়ের বিলাপের শব্দ ভেসে এল। বুঝতে পারছিলাম না, ভেতরে যাব নাকি চলে যাব। এই পরিস্থিতে চলে যাওয়াটাও কি ঠিক দেখাবে?
ভেতরের ঘরে একনাগারে কেদে চলছে তমা ও তমার মা। তমার ছোট ভাই সম্ভবত তাদের সান্তনা দেবার চেষ্ঠা করছে। আমি স্টাডি রুমেই বসে ভাবতে রইলাম। কি হতে পারে! তমার বাবা বাসায়ই নেই তমা শুরুতেই বলেছিল। সেজন্যই ও আজকে বের হবে। কার সাথে বেরুবে সেটাও বলল। ওদেরই মেডিকেল কলেজের একটি ছেলে। তমার ভাষায় ছেলেটি নাকি দেখতে খুব হ্যান্ডসাম। হবেইতো। প্রাইভেট মেডিকেলে ভর্তি হয় বড়লোক বাপের ছেলে। বড়লোকের কালো ছেলেরাও এসি গাড়িতে বসে থেকে ফর্সা হয়ে যায়। সুতরাং এই ছেলেও হ্যান্ডসাম, কালো হলেও হ্যান্ডসাম। নাক বোচা থাকলেও হ্যান্ডসাম। বেটে হলেও হ্যান্ডসাম। ধুর! আমি একি অকর্মার ভাবনা ভাবছি। কি যে হয়েছে আমার বুঝি না। এর আগেও তমা যখন ছেলেটির কথা বলেছিলো তখন বুকের কোণে চিনমিনে কিছু একটা অনুভব করেছিলাম। কেন আমি সেই ছেলেটির প্রতি হিংসা বোধ করছি? সে বড়লোকের ছেলে বলে নাকি তমা তাকে পছন্দ করে দেখে। জবাব আমার মন জানে কিন্তু আমি না জানার ভান করি। গরীবের নজর সর্বদা সামলে রাখতে হয়। সৃষ্টিকর্তা সকল গরীবের জন্য চাদকে বানিয়েছেন। যখন কোন গরীবের সুন্দরী নারী দেখতে মন চাইবে, সে তখন চাদের দিকে তাকাবে। চাদের সৌন্দর্য্যে সে মোহিত হবে। তাতে বড়লোকের সুন্দরী মেয়ের প্রতি বাসনা কাটিকুটি হবে। তাই তমার কথা মনে এলে চাদের দিকে তাকাতে হবে। চাদ না পেলে মনে মনে চাঁদ কল্পনা করে সেদিকে তাকাতে হবে। আর বলতে হবে, হে চাঁদ! তুমি সুন্দরী তাই চেয়ে থাকি। হে চাঁদ, তাই বলে ভেবোনা আমি তোমার প্রেমে পড়েছি। আমি তোমার কলংকের কথা জানি। মনে রেখো গরীবেরা কলংক ছুঁয়ে দেখে না।
ভেতরের কান্নার আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেছে। হয়ত কোন দ্বিতীয় ধাপের আত্মীয় মারা গেছে সেজন্য কান্না অল্পতেই শেষ। আত্মীয় একটু দূরের হলেই কান্নার আওয়াজ ও সময় ক্রমান্বয়ে কমে যায়। হঠাতই ওদের কাজের বুয়াটি কান্না পরবর্তী ফোলা চোখে ঘরঝাড়ু দিতে ঢুকলো। আমার খুব মায়া হল বুয়ার জন্য। এরা গরীব মানুষ, তবু এদের মনভরা মায়া। মালিকের আত্মীয় মারা গেলে এরা মালিকের থেকে বেশি কাদে। আমি মায়াভরা কন্ঠে বুয়াকে আলতো করে বললাম,
আপু, কে মারা গেছে? তমা কি ঠিক আছে?
>আল্লাগো, আপ্নে আমারে আপু ডাইকেন নাতো সার। নাম ধইরেই ডাকেন। আমার নাম সোনাবানু। হগলে আমারে বানু ডাহে। খালি তমাআফা মাঝে মইদ্দে সোনাবানু ডাকে আর মিটিমিটি হাসে। আপ্নেও আমারে বানুই ডাকেন!
আচ্ছা বানু, তুমি তো বললে না ভেতরে কি হয়েছে? কেউ কি মারা গেছে?
>হ গো। আর কইয়েন না। মরছে ভালা হইছে। আপদ বিদায় হইছে। কয়দিন যা জ্বালানি জ্বালাইলো। জীবনডা তামা তামা কইরা দিছে এক্কেরে!
কে উনি?
>আররে সার, কতন মরছে!
কতন কে? এমন মানুষের নামও হয় নাকি?
>হা হা হা হা, কি যে কন সার। মানুষ হইবো কেন। তমাফার বিলাই মরছে, কতন হইলো বিলাইয়ের নাম।
ও এচ্ছা, তমার বিড়াল 'কুটনে'র কথা বলছ!(নিজেকে সামলে নিলাম)
>জ্বে
তাহলে তুমি কি বিড়ালের জন্য কাদলে এতক্ষণ!
>হ, বড়ই দুঃশ্চিন্তায় আছি গো সার। এই বিলাই আমারে খুব জ্বালাইছে। দুইদিন আগে ঝাটা দিয়ে দিছিলাম বাড়ি, মরার বিলাই করলো কি! আমারে দিলো কামড়। শুনছি বিলাই কামড়ানির সাতদিনের মইদ্দে মরলে নাকি যারে যারে কামড়ায় হেরাও মরে। আমিও মনে হয় মইরা যামু। এই দুঃখে কান্দি গো সার।
এইসব ভ্রান্ত ধারণা। তোমার কিছুই হবে না। তোমার খালুকে বলে ইঞ্জেকশন দিয়ে নিবে। বুঝলে?
>সত্য সার! আমার কিছছু হইবো না?
সোনাবানুর কথার জবাব দেবার আগেই হনহনিয়ে তোমার প্রবেশ। তমা এক ধমকেই বানুকে রুম থেকে তাড়িয়ে দিলো। আমি মনে মনে ঠিক করছিলাম তমাকে কিভাবে সান্তনা দেয়া যায়। বড়লোকরা মানুষের চেয়ে পশুপাখিকে বেশি মায়া করে। বিষয়টা আমার বড্ড বিরক্ত লাগে। তবুও এই মেয়ের ফোলা চোখ আমায় কষ্ট দিচ্ছে। হার্টে চিনমিনে ব্যাথা হচ্ছে। ওকে স্বান্তনা দিতেই হবে। আমি কিছু বলতেই তমা বলে উঠল,
স্যার। কুটনটা মারা গেছে। সামান্য সর্দি লেগেছিল। আজকে পশু হাসপাতালে নিয়ে যাবার কথা ছিলো। কিন্তু তার আগেই মারা গেছে। আপনি ভাবছেন আমি মানুষের থেকেও পশু ভালোবাসি। কথাটা একদম মিথ্যা। আমি কাদছিলাম কারণ ওকে বাচাবার জন্য আমি বিশেষ কোন চেষ্ঠা করিনি। সামান্য আলসেমির জন্য ওকে নিয়ে যায়নি পশু হাসপাতালে। আমার সামান্য আলসেমি একটা প্রাণ হত্যার জন্য দায়ী। সেজন্য কাদলাম। কষ্ট লাগছে।
>কেদো না। পৃথিবীর সব প্রাণীই একদিন মারা যাবে।(এরপর কিছু বলার খুজে পাচ্ছিলাম না, অথচ ওকে সান্ত্বনা দেয়া খুব দরকার)
স্যার শুনেন। আজ একটা কথা বলবো। আমার মনটা খারাপ। কারণ আমার পছন্দের সব জিনিস আমাকে ছেড়ে চলে যায়। তাই আমি চাই না আমি আর কিছু হারাই। আপনাকে আমি যে ছেলেটির সাথে ডেট করতে যাব বলেছিলাম সেই নামে কেউ নেই। আজ আমার খুব কাছের এক বান্ধবীর জন্মদিন। ওর বাসায়ই যাবার কথা ছিলো। কুটন মারা গেছে তাই ঠিক করেছি যাবো না।
>তাহলে সেই হ্যান্ডসাম ছেলেটি বলে কেউ নেই?
জ্বি, কেউ নেই। আর আপনাকে যে ধাধাটি বলে বিব্রত করেছি সেটার জবাব খুব সোজা। কানের দুল। আমি কানের দুল পরি, সব মেয়েরাই পরে। আপনি পরেন না। কিন্তু অনন্তের পরা উচিত কারণ সে হিট নায়ক। হিট নায়কদের কানের দুল না পরলে ভাল্লাগে না।
>আচ্ছা(তমার এই দুঃখের মাঝেও হাসি পেল। কিন্তু কোনমতে হাসি আটকে রাখলাম)
এবার চুপ করে শুনেন। আমার বলা সেই হ্যান্ডসাম ছেলেটি আপনি। আমি ওর কথা বলেছি আপনাকে পরীক্ষা করার জন্য। সেই ছেলেটির নাম শোনার পর আপনার চোখে অব্যাক্ত কষ্ট ও হিংসার মিশ্রণ দেখেছি আমি। সুতরাং আপনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। আপনাকে আমার ভালো লাগে। আমি আপনাকে হারাতে চাই না- এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে তমা আমার দিকে তাকালো। এই দৃষ্টি আগ্রাহ্য করা যায় না। এ যে এক সদ্য তারুণ্যে পা দেয়া তরুণীর প্রেমের আহবান। আমি সফলভাবে ওর দৃষ্টি কাটিয়ে অন্য দিকে তাকালাম।
হয়তোবা হারানোই তোমার ভাগ্যে লিখা। শুধু একথাটি বলেই আমি তমাদের স্টাডিরুম থেকে বের হয়ে আসলাম। বুকের বামপাশে চিনমিনে ব্যাথাটি বেড়েছে। আজকে আবার চাদের দিকে তাকাতে হবে। গরীবের প্রেমিকা চাঁদ। তমা আমাকে হারালো এটা ওর দূর্ভাগ্য নয়। আমার দূর্ভাগ্য যে আমি তমাকে সচেতনভাবে হারালাম। আজকের দিনটি ওর জন্য একটি বিশেষ মৃত্যুদিবস হিসেবেই থাক। ভালোবাসার মৃত্যু দিবস। টিউশনিটা ছুটে গেল ভেবে দুঃখ লাগছে না। মোবাইলের সিমটা চেঞ্জ করতে হবে ভেবে দুঃখ লাগছে। নতুন সিমের দাম একশত টাকা। এই একশত টাকা মাসের হিসেবে ব্যালেন্স করতে হবে। আরও ভাবছি চাদের দিকে তাকিয়ে বুকের চিনমিনে ব্যাথাটাও ব্যালেন্স করতে হবে। গরীবের দৃষ্টি ওপরে তুলতে নেই। তাতে সুখ কমে, ব্যাথা বাড়ে। সুতরাং নিচের দিকে চেয়েই চাদকে কল্পনা করছি। মায়ের মুখটি ভাসছে চাদের সাথে সাথে। বড় ডাক্তার হতে হবে, মাকে ঢাকা শহর ঘুরাতে হবে যে!