বাচ্চাকাচ্চার প্রবেশ নিষেধ!
বাংলার বিলবোর্ড ও দেয়াল রাখিবো লাল- রাস্তাজুড়ে ভালোবাসার রঙের পোস্টার দেখে তাদের স্লোগান এমনই বলে মনে হল। এই লালের ভিড়ে পথচারীরা ম্যানহলে পড়ে, রিক্সাওয়ালা এক্সিডেন্ট করে, বাংলার আকাশে যখন লাল দূর্যোগের ঘনঘটা তখন কে দেবে আশা কে দেবে ভরসা! আশা ছিলো মনে মনে, ভালোবাসার রঙ মাখিবো তাহার মনে...........
কিন্তু আশা সেতো দুরাশা, ভালোবাসার রঙ না মাখতে পারলেও জজ মিয়ার নতুন ছবি ভালোবাসার রঙ তো দেখতে যাওয়া যায়। জজ মিয়ার নাম শুনে টাশকি খেলেও পরে পোস্টার দেখে ভুল ভাঙ্গলো এইটা জজ মিয়া না, জাজ মিডিয়া হবে। যাই হোক তারে উক্ত সিনেমার নাম বলতেই মুখ বাঁকায়ে বলে যে আমি ঐসব নীলছবি লালছবি দেখি না। আশা-ভরসা নিয়ে একাই রওনা হলাম বলাকা অভিমুখে। নীলক্ষেত পার হয়ে যখন লালছবি দেখার জন্য বলাকায় ঢুকলাম তখনই এক বন্ধুর সাথে দেখা। দুজনে টিকিট কেটে কিছু খাওয়া যায় কিনা ভাবতেই বন্ধু বলে উঠলো লাল দুধ খাবো! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম লাল দুধ মানে কি? আরে বোকা, স্ট্রবেরি মিল্কশেক খাবো! তাহলে তো রাস্তা পার হয়ে নিউ মার্কেট যেতে হবে বলতেই সে আমাকে আড়চোখে বিলবোর্ড দেখিয়ে বলে, এর আগেও বহুৎ বাংলা সিনেমা দেখছি মজা নেবার জন্য। তবে এইবার আসছি শুধুমাত্র পোস্টারের নায়িকাকে দেখতে। একেবারে ময়ূরীর স্লিম ভার্শন। আমি উপহাস করলাম, কই মোটা বাশ আর কই কচি আখ।
হলে ঢুকে আশে-পাশে কপোত কপোতীর সমাহার দেখে নিজেকে বড়ই অভাগা মনে হল। জাতীয় সঙ্গীতে সিনেমা শুরু হল। ঝকঝকে প্রিন্ট দেখে অবিভূত হয়ে গেলাম। জাজ মিডিয়ায় জজ মিয়াই থাকুক আর যাই থাকুক না কেন বাধ্য ছেলের মত একরাশ ধন্যবাদ দিলাম। সিনেমার শুরু হয় এক তরুণের নদীর পানিতে ঝাপের মধ্য দিয়ে । কোমরটা হালকা দুলিয়ে পানি থেকে মাথা তুলে ভেজা চুলের ঝাকানি দিয়ে ক্যাটরিনার মত সিডাকটিভ লুকে আমাদের দিকে যে তাকালো, তার ঠোটে হালকা গোলাপী লিপস্টিকের আলতো ছোয়া দর্শককূলে হাসির নহর বইয়ে দিলো- সেই এই সিনেমার নায়ক বাপ্পী। সাকিব খানকে হটিয়ে ঢালিউডকে বলিউড বানাবার স্বপ্ন নিয়ে আগমন ঘটেছিলো নিরব, ইমন ও নিলয়ের। ইমন তো লালটিপের নায়িকা চরিত্রে ভালোই মানিয়েছিলো, নিরবের অবস্থা তথৈবচ আর নিলয়ের তো বাংলালিংকের এ্যডে কোমর দুলাতেই দিন গুজার হয়। এই সিনেমার বাপ্পীকে নিয়ে আশা ছিলো যতটুকু তা এক ঝলকেই ধপ করে নিভে গেলো যখন সে মুখ খুললো! নাকি স্বরে এক লাইন সংলাপ শুনেই বুঝে গেলাম বরং নির্বাচনের মিছিলে নারী সেজে ঢং করা পুরুষেরাও এর থেকে এক ধাপ উপরে অবস্থান করে।
চৌধুরী সাহেব না থাকলে বাংলা সিনেমা অপূর্ণই রয়ে যায়। ট্রেডিশন অনুযায়ী গ্রামের শামসুদ্দীন ওরফে শামছু চৌধুরীর নাতি মাহী শাকিরার গানে ফেনা তোলা বাথটাবে শুয়েই উদাম নৃত্যে মত্ত। এই দিকে চৌধুরী গান বন্ধ করে দিলে মাহী শর্ত জুড়ে দেয় গান না ছাড়লে সারাদিন বাথটাবে শুয়ে থাকবে। নিউমোনিয়া হবে বলে চৌধুরী আবার গান ছেড়ে দেয়। তবে এই ঢেচকি মেয়ের নিউমোনিয়া হবে শুনলে নিউমোনিয়ার জীবাণুও শরমে আত্মহত্যা করত! গান ছাড়ার পর মাহী যখন বাথাটাবের ফেনা ঠেলে উঠে দাড়ালো সারা হলে তখন পিনপতন নিস্তব্দতা। পাশে বসেছিলো এক ছোকরা, সে আর চুপ না থাকতে পেরে বলেই উঠলো এ তো ময়ূরীর থেকেও বিশাল বক্ষা। আমি আর আমার দোস্ত তখন চক্ষু-কর্ন বিভাজনে স্ট্রবেরী মিল্কশেকের কল্পনায় বিভোর।
এফডিসির শর্তাবলী মেনে বাপ্পী মাহীকে প্রপোজ করা মাত্রই দুই টাকার ছ্যাকামাইসিন বড়ি গলাধঃকরণ করে ফেলে। পরদিন সকালে বাপ্পী শরীরচর্চা করছিলো বাশবাগানের ধারে। তার সুগঠিত উন্নত বক্ষে দেখে বুঝতে পারলাম সে আইডল হিসেবে জলিলকেই ফলো করে। তবে জলিলকে ফলো করতে যেয়ে বুক যতটা ফুলেছে, হস্তপেশী ততটাই ক্ষীণ রয়ে গেছে। বাপ্পীর বুকঝাকানো ব্যায়াম দেখেই কিনা মাহী পা ফসকে পাহাড় থেকে পড়ে যেয়ে লতা-পাতা আকড়িয়ে পশ্চাৎদেশ দুলাতে থাকে ডিরেক্টের নির্দেশে। ক্যামেরাম্যান নিচ থেকে ক্যামেরা ফোকাস করে ভাজখোলা আনন্দ দেখিয়ে ষোলকলা পূর্ণ করলো। মাহীর চিৎকারে বোল্টের গতিতে বুক দুলিয়ে বাপ্পী দৌড়ে এসে মাহীকে বাচালে এডিটিংময় প্রেমের গান শুরু হয়। সিংগার মটরবাইকে বাপ্পীকে পেছনে বসিয়ে ইউরোপের রাস্তায় মাহীর বাইকচালনা দেখে শিউর হলাম নিশ্চিৎ নীলক্ষেতের কোন ফটোশপের দোকনে এর এডিটিং করা হয়েছে। গান শেষে বাপ্পী প্রেমের পরীক্ষা দিতে মাহীর বাসায় টেপ রেকর্ডার চুরি করতে যেয়ে ধরা পরার ভয়ে খড়ের গাদায় লুকায়। মাহীর চাচা খড়ের ওপর দিয়ে আদিযুগের বল্লম দিয়ে খুচিয়ে পশ্চাৎদেশের বারোটা বাজালেও কিছুক্ষণ পর বাপ্পী অক্ষত পশ্চাৎদেশ নিয়ে বেরিয়ে এসে প্রমাণ করলো সিনেমা পরবর্তী দর্শকের বিস্বাদ টুপুরামা খেতে সে প্রস্তুত। আহত বাপ্পীকে মাহী বাচাতে গেলে তাদের প্রেমের শুভসূচনা ঘটে।
পর্দার পটপরিবর্তন হয়ে হাসপাতালে ডাক্তার নাসরিনকে দেখা যায় পালস দেখার মেশিনে রোগীকে শক দিয়ে পাগল বানাতে। এরূপ গাজাখোরী প্রযুক্তি পরিচালক কোথা থেকে আমদানী করলো বলতেই বন্ধু বলে উঠলো, ডাক্তার নাসরিন কিনখাগীমা মেডিকেল কলেজ থেকে এম বি বি এস ডিগ্রী নিয়ে আসছে, ইটস পম গানা! কোনমতে হাসি চেপে রাখতেই দেখলাম মাহীর বিশাল সম্পদের উন্মোচন। অন্য কিছু ভাববেন না- ইহা মাহীর সম্পত্তি নয়, সম্পদ।
ঘটনার ঘনঘটায় মাহীকে ধরতে অমিত হাসানকে পাঠায় মাহীর বাবা-মায়ের হত্যাকারী মিজু আহমেদ। অমিত হাসান নষ্ট লিভার সারাতে কৌটা থেকে বের করে যে বড়ি খেলো সেটাকে স্কয়ার ফার্মার প্যারাসিটামল বলেই মনে হলো। দূরারোগ্য লিভার রোগে প্যারাসিটামলের কার্যকারিতা আবিষ্কারের জন্য শাহীন সুমনকে অতি শীঘ্রই চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ দেয়া হবে বলে মনে হলো। অমিত হাসানের থেকে বাচতে মাহী বাপ্পীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। এরপর দু'বান্ধবী মিলে নীলগিরিতে পালায়। নীলগিরিতে গিয়ে অমিত হাসানের গুন্ডাদের পাল্লায় পরে ওরা। অথচ ওদের বাচানোর জন্য পরিচালক ঘণ বনে আগে থেকেই খাদ বানিয়ে রেখেছিলো বলে রক্ষা। ঝোপের নিচে মাহীকে লুকিয়ে বাপ্পী গুন্ডাদের দেখে নিতে উঠতে গেলেই মাহী, বাপ্পীর টিশার্টে হেচকা টানে নিচে নামিয়ে আনলো, বুকে বুক, চোখে চোখ, নাকে নাক- পুরো মাখামাখি অবস্থা, দর্শক সকলের চক্ষু কোটর থেকে বের হয়ে যায় যায় অবস্থা! এইতো সিরিয়াল কিসার হাশমির পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাপ্পী ঢালিউডে নবযুগের সূচনা করবে। মাহীর ঠোট বাপ্পীর ঠোটে লাগলো বলে, এক সেকেন্ড, দুই সেকেন্ড, তিন সেকেন্ড..................চরম মুহূর্তে মাহী বলে উঠলো "ফি আমানিল্লাহ" বাপ্পীর আশাভঙ্গ হলো আর তাবৎ দর্শক দুয়োধ্বণি দিতে লাগলো। পরহেজগার নায়িকা দেখে বলে উঠলাম মাশাআল্লাহ!!
জঙ্গলে মারামারির বিরতিতে প্রেমের গান শুরু হল। চিত্রায়ন চমৎকার সব লোকেশনে হলেও নৌকায় উল্টানো জার্মানীর পতাকা দেখে ঠাওর করলাম সিনেমার শ্যুটিং ফুটবল বিশ্বকাপের সময়ই হয়েছে। তবে নর্তন-কুর্দনে মাহী সফল হলেও বলিউডি নায়ককে অণুকরন করতে যেয়ে বুক খুলে দিলেও দর্শকের মন ভরাতে পারেনি। গান শেষে বাপ্পীকে দৌড়াতে দেখা গেলো কোমরে এক বিশাল ছুরি ঝুলিয়ে কিন্তু সেই ছুরির ব্যাবহার দেখা গেলো না। বিরক্ত হয়ে বন্ধু বলে উঠলো, কেশগুচ্ছের হিন্দি অনুবাদ করলেই বুঝে যাবি ছুরিটা ঘণ জঙ্গলে কি কাটার জন্য নিয়ে আসছে। যেহেতু জঙ্গল ঘণ তাই বাঘ থাকতেই হবে, তবে বাঘটিকে যে ডিসকোভারি চ্যানেলের ফুটেজ থেকে মেরে দিয়েছে সেটা জানতে পারলে চ্যানেল কতৃপক্ষ মামলা দিবে কিনা ভাবতেই আইটেম গান শুরু হল। অমিত হাসানের টাকা চুরি করে তার ছোটভাই আসিফ নীলগিরির বনে এভাবেই আমোদ ফূর্তি করছিলো আইটেম নায়িকা বিপাশার সাথে। তবে এখানে বলিউডের বিপাশা বসুর সাথে দুধের শিশুর সম্পর্ক খুজতে গেলে আশাহত হবেন। নাচ শেষ করে ফেরার সময় অমিতের কাছে ধরা পরে আসিফ অক্কা পায় এবং পরিণতিতে বাপ্পীকে ধরে ফেলে অমিতের গুন্ডা। শুরু হয় সিনেমার ক্লাইমেক্স, গানার ডাক্তার নাসরিনকে মেরে মিজু আহমেদ মাহীর সম্পদের দখল নিতে এসে মারা পরে অমিতের হাতে। সাথে সাথে অমিতের লিভারে ব্যাথা শুরু হলে সে প্যারাসিটামলের কৌটা বের করতেই বাপ্পী কেড়ে নিয়ে মাটিতে পিষে ফেলে। ফলাফল ভিলেনের মৃত্যু, মারামারি শেষ হবার পর পুলিশের আগমন এবং নায়ক নায়িকার মধুর মিলন।
খরচ বাঁচাতে পুরো সিনেমায় বাপ্পীর জন্য পারসোনার মেকাপম্যান ভাড়া করা হয়নি সেটা বাপ্পীর সুরত মুবারক দেখেই বুঝা যায়। এদিকে গায়ের রঙ নিয়ে উদ্বিগ্ন বাপ্পী মুখে পাউডার মেখে ফরসা হলেও তার কালো হাত পা সামান্য পয়সার অভাবে ফরসা হলো না। বাপ্পীর ভবিষ্যৎ যে কতটা আলোর মুখ দেখবে সেটা মুখ ও গায়ের রঙে তফাৎই বলে দেয়। তাছাড়া ক্যামেরাম্যান পুরো সময় মাহীর সম্পত্তিতেই ফোকাস রেখেছে। শাহীন সুমনের ডিরেকশন বলে কথা। তাতে দর্শক পয়সা উসুল করলেও মাহীর কতটুকু উসুল হলো তা পরবর্তী সিনেমায়ই জানা যাবে। ততদিন পর্যন্ত মাহীর জন্য শুভকামনাই রইলো।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২১