এইবার ঈদের ছুটি পাইয়াই নানাবাড়িতে কাটাইবো বলিয়া মনস্থির করিলাম। তবে নানাবাড়ি যাইবার পূর্বেই গলদে একখান টিকিট কম পড়িয়া গেল। তাই সবাইরে বাসে তুলিয়া দিয়া আমি লোকাল বাসে উঠিয়া বসিলাম। এমনিতেই রোজা রাখিয়া তপ্ত রোদে দেহের সকল লবণ-পানি ঘামস্বরূপ খোয়াইয়া বাসে সিট ম্যানেজ করিয়া রাণীক্ষেত আক্রান্ত মুরগার মত ঝিমাইতেছিলাম। এমতাবস্থায় আমার পাশের সিটে এক লোক আসিয়া ঠ্যাং তুলিয়া বসিল। তাহাতে আমি ঈষৎ বিব্রতবোধ করিলেও কপালদোষ মানিয়া নিলাম কিন্তু সমস্যা তো অন্যখানে। তাহার কোলে দু'দুটা স্বাস্থবতী মুরগী বসিয়া কক্ কক্ করিতেছিল। বাসে মুরগী কেন তুলিয়াছেন সুধাতেই মুখ ঘুরাইয়া চক্ষু উল্টাইয়া জবাব দিলেন, আমার সিটে মুরগী-ছাগল সব বসিবে, তাহাতে আপনার কি সমস্যা? মুরগীর সহিত 'ছাগল' শব্দ শুনিয়া আমার মেজাজ এইবার সপ্তমে উঠিল। ছাগলটারে কষিয়া গদাম দিবার বাসনায় দাড়াইতেই দেখিলাম ইহা মনুষ্য প্রজাতির ছাগু নহে, পশু প্রজাতির ছাগল। অবলা জানোয়ারে দয়া করে যে জন সেজন সেবিছে ঈশ্বর। তবে আমার এক দোস্তের কথা মনে পড়িয়া গেল যে কিনা অবলা প্রাণীরেও ছাড় দিত না। তাহার নাম ছিল অরণ্য আনোয়ার, কিন্তু তাহার স্বভাবহেতু স্যার একদিন রাগবশত 'জঙ্গলে জানোয়ার' বলিয়া ডাকিয়াছিলেন। ইহার পর অরণ্যকে সবাই জঙ্গলে জানোয়ার বলিয়াই ডাকিত। যাহার নামই জঙ্গল তাহার কর্ম তো জংলী হইবেই। মুরগী-ছাগল-বিড়াল-কুকুর দেখিবামাত্র এক ঘা না দিলে তাহার মন ভরিত না। এই বাসে অরণ্য থাকিলে পাশে বসা লোকটির আচ্ছা শায়েস্তা করিতে পারিত। লোকাল বাসে হেন অবস্থা দেখিয়া নিজেরে চিপায় পড়া মুরগা বলিয়াই মনে হইল। এইভাবেই বহু বন্ধুর পথ পার হইয়া আবুলরে শাপবাণে জর্জরিত করিয়া ৪ ঘন্টার পথ ৭ ঘন্টায় শেষ করিয়া হাঃ নিশ্বাস ছাড়িলাম।
বাড়ি আসিয়াই ভাবিলাম এইবার সরিষার তেল নাকে দিয়া ঘুমাইয়া দিন পার করিবো। তবে সরিষার তেলের ঝাঝ দেখিয়া আর নাকে ঢালিবার সাহস কুলাইলো না, সেই ঝাঝের ভয়েই ঘুম আসিয়া পড়িলো। হঠাৎ চিৎকার-চেচামেচি শুনিয়া ঘুম ভাঙিয়া গেল। গিয়ে কিছুই বুঝিতে পারিলাম না শুধু এক কাজিনরে আইফোন আইফোন বলিয়া বিলাপ করিতে দেখিলাম। এক মাস আগে আইফোন কিনিয়া তাহার পা মাটিতে পড়িতে দেখিনাই। সেই ফোন কাউরে ধরতেও দেয় না সে, আমাদের দেখিলেই ফোন বাহির করিয়া কথা বলা শুরু করিত। আজ আইফোনের জন্য তাহার বিলাপ শুনিয়া মনটা একেবারে শান্ত হইয়া গেল। পরে দেখা গেল তাহার ফোন পাওয়া গেছে খাসির মাংসের তরকারীর পাতিলে। টেবিলে চার্জরত অবস্থায় ফোন যে কখন খুলিয়া নিচে রাখা তরকারীর পাতিলে পড়িয়া গিয়াছিল, তাহা কেহই দৃষ্টিপাত করে নাই। তবে মাংসের তৈল কিছুটা জমিয়া ছিল বিধায় তাহার আইফোন এই যাত্রায় বাচিয়া গেল। আইফোনের কিছু হয়নাই দেখিয়া আমার মনটাই আবার খারাপ হইয়া গেল। সকল আইফোনওয়ালাদের অভিশাপ দিয়া আবার ঘুমাইতে গেলাম। কিন্তু তাহা কি আর সম্ভব নচ্ছার ভাগিনার যন্ত্রণায়। ভাগিনার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হইয়া টিভি দেখিতে গেলাম। যাইয়া দেখি চলছে স্টার জলসা আর সকলে চোখের পাতা না ফেলিয়াই স্থির হইয়া তাকাইয়া আছে টিভি পর্দায়। ভাবিলাম বাহিরে যাওয়াটাই শ্রেয়। বাসা হইতে বাহির হইতেই ভেতরে জোর গলায় নারীকন্ঠের চিৎকার কর্ণকুহরে বাজিয়া উঠিলো। বুঝিলাম ঠিক সময়েই কারেন্ট চলিয়া গিয়াছে। নারীগণরে স্টার জলসা হইতে বঞ্চিত করিয়া সরকার কতগুলো ভোট হারাইয়া ফেলিল তাহা গুনিতে যাইয়া দেখি কিশোর বয়সী কিছু ছেলে হাতে খাতা লইয়া থ্রিকুয়ার্টার প্যান্ট পড়িয়া কোথা যেন যাইতেছে। একজনরে জিজ্ঞাস করিয়া জানিলাম তাহারা কোচিংয়ে যাইতেছে। এইভাবে কোমরের নিচে প্যান্ট ঝুলাইয়া পশ্চাৎদেশের খাজ বাহির করিয়া মফস্বলের ছেলেদের কোচিংগমনে একটা ব্যাপারই বুঝিলাম, সরকার সফলভাবেই দেশকে ডিজিটালাইজেশনের পথে নিয়ে যাইতেছে। এই কিশোরদের মধ্য থেকেই হয়ত বাহির হইয়া আসিবে ভবিষ্যতের আবুলগণ। তাহা যেন আর দেখিবার হায়াত না হয় এই চাওয়াটাই সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করিলাম।
ঈদের দিন নামাজ পড়িয়া শুইয়া-বসিয়াই কাটাইলাম। পরদিন বিকালে সবাই মিলিয়া দূর সম্পর্কের এক নানার বাড়ি দাওয়াত খাইতে গেলাম। সেইখানেও স্টার জলসার কেরামতি দেখিবার সৌভাগ্য মিলিল। নানার সহিত কথা বলিয়া জানিতে পারিলাম তিনি রিটায়ার্ড করিবার পর স্টার জলসাই তাহার অলস সময়ের একমাত্র বন্ধু। বাহিরে ঘুরিতে যেতে পারেন না সুধাইলে তিনি শুরু করিলেন, আগে নানা উৎসব-পার্বণ-বিবাহের দাওয়াত আসিত। রিটায়ার্ড করিবার পর সকল অনুষ্ঠানে গিফট লইয়া যাওয়া সম্ভবপর না হওয়াতে খালি হাতেই দাওয়াত খাইতেন বেশিরভাগ। গিফটছাড়া দাওয়াতে যান বুঝতে পারিয়া এখন দাওয়াতের পরিমাণও আশংকাজনক ভাবে কমিয়া গিয়াছে। তবে কিছুদিন পূর্বে পাড়ার সকলে মিলিয়া স্টার জলসার 'মা' নাটকের নায়িকা ঝিলিকের বিবাহ ঠিক হইয়াছে জানিয়া পিকনিকের আয়োজন করিয়াছিল। 'ঝিলিক' নানারও খুব প্রিয় চরিত্র তাই তিনি সেই পিকনিকে চান্দা দিয়া হইলেও অংশ লইয়া দেশোদ্ধার করিয়াছিলেন। তবে তাহারা ধুম মাচাইয়া পিকনিক করিলেও আদতে ঝিলিকের বিবাহ হয়নি বলিয়া নানা'র মন ভালো যাইতেছে না। পাত্রপক্ষের কাছে ঝিলিকরে দেখাইয়া নাকি তাহার মা অন্য বোনের বিবাহ দিয়া দিয়াছে। ঝিলিকের নাম শুনিয়া নানীও আগাইয়া আসিলেন। ঝিলিকের জন্য তাহার প্রশংসাবাণী মুখনিঃসৃত ঝর্ণার ন্যায় বহিতেছিল। আমার আর সহ্য হইল না। মুখ ফুটাইয়া বলিয়াই ফেলিলাম, এমন বস্তাপচা কাহিনীর 'ঝিলিক' দেখেন কেন? ঈদে তো বাংলাদেশের অনেক চ্যানেলেই ভালো নাটক হইতেছে সেগুলো দেখেন, দেশের পয়সা দেশেই রাখেন। আমার মুখে এমন শুনিয়া নানী কাদিয়াই দিলেন আর নানার চোখ টলমল করিয়া উঠিল। এমন সময় পেছন হইতে লং কামিজ পরুয়া কাজের বুয়া আসিয়া অনেকটা চিল্লাইয়া কহিলো, 'আমরা তো ইসটার পেলাস দেহি না, বাংলা সিরিয়াস দেহি! আগে হেন্দু চ্যালেন দেকতাম দেইখা আপনি কতা হুনাইছিলেন। এহন ঝিলিকের নামে বদনাম করতেছেন।' আমি অবাক হইয়া বুয়ার দিকে তাকাইয়া ছিলাম। ঘটনার ঘণঘটা কাটাইবার জন্য কহিলাম, 'বুয়া তুমার জামা তো বড়ই সৌন্দর্য্য, এগুলা তো ঢাকার মেয়েরাও পড়িয়া ফ্যাশন করিয়া বেড়ায়।' "আমরা গরীব হইছি তো কি, আমরাও ফ্যাশন জানি", বলিয়া বুয়া আনন্দে আটখানা হইয়া বিদায় নিল। নানা-নানীরে কোনমতে বুঝ দিয়া শান্ত করিয়া অন্য রুমে চলিয়া গেলাম।
সেই নানার বাসা হইতে বিদায় লইয়া আরেক মামার বাসায় গেলাম। সেইখানেও হুলুস্থূল। ক্লাস এইট পড়ুয়া মামাতো বোনের বান্ধবী প্রেমিকের সাথে পালাইয়া গিয়াছে। আর বান্ধবীর মা আসিয়া সেই বোনরে জেরা করিতেছে। সমস্যা সেই খানে নয়, আমার মামী খেপিয়াছেন স্টার জলসার নাটক 'টাপুর টুপুর' দেখাতে ব্যাঘাত ঘটিয়াছে বলিয়া। তাহাদের তর্ক চলিতেছিল সাথে যুগিল মামার বাসার বুয়া, যে নিজেও কিনা 'টাপুর টুপুর' দেখিতে পারে নাই বলিয়া বিশাল ক্ষিপ্ত। তর্কের মাঝে বুয়া বলিয়া উঠিলো, "বাড়ি-ঘোড়া আর নারী, যাহার হস্তে পরিবে তাহারই" এই প্রবাদ শুনিয়া আর সাহসে কুলাইলো না ঘরে ঢুকিবার তাই চলিয়া আসিলাম। তবে নব্য শোনা প্রবাদের সত্যতা যাচাই করিবার প্রয়োজন পরিলো না বরং চোখেই দেখিয়া আসিলাম।
পুরো ছুটিই স্টার জলসার যন্ত্রণায় মাটি হইবার পথে। কি মধু লুকাইয়া আছে জলসায় মনে প্রশ্ন জাগিলো। মনের জ্বালা মেটাইবার জন্য "মা" এবং "টাপুর টুপুর" দেখিতে বসিয়াছিলাম একদিন। তাহাতে চরম বিরক্ত হইলে মামী আমারে স্টার প্লাসের 'গোপী' দেখিবার পরামর্শ দিলেন। আশে পাশের মানুষ হইতে জানিতে পারিলাম গোপীও নাকি সমান জনপ্রিয়। এক শিক্ষিত যুবকের গলায় তাহার মা'র মূর্খ নারীরে বিবাহস্বরূপ ঝুলাইয়া দেওয়া লইয়াই এই নাটকের কাহিনী। ইহা একবার দেখিয়াই আমার সারা জীবনের নাটক দেখিবার শখ মিটিয়া গিয়াছে। এমন জঘণ্য অভিনয় দাদাবাবুদের তাহাতে বমি আসাই বাকি রহিলো। অথচ এই জঘন্য জিনিসই কিনা অমৃতের মত গিলিতেছে মানুষ। একদা বাকের ভাইয়ের মুক্তির জন্য মিছিল হইয়াছিল আর আজিকে ঝিলিকের বিয়ের জন্য পিকনিক হয়। দেশ সত্যই আগাইয়া গিয়াছে অনেক। তবে সেই আগানোটা হইতেছে ভারতের দিকে। দেশের সংস্কৃতি ভুলিয়া জনগণ বিষযুক্ত অমৃত গিলিতেছে যাহা পেটে যাইয়াই বিষক্রিয়া শুরু করিয়া দিয়াছে। দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে স্টার জলসার অবদান চক্ষুগোচর হইল। ডিজিটাল বাংলাদেশ এগিয়ে যাক। জয়তু স্টার জলসা!!
বি:দ্র: লেখক স্টার জলসা কিংবা অন্য কোন ভারতীয় ডেইলি সোপের ঘোর বিরোধী। কেহ আসিয়া ঝিলিক কিংবা গোপীর প্রশংসাবাণ ছুড়িলে সংগে সংগে তাহা খোয়ারবদ্ধ করা হইবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ৮:৩০