কাঠালপাতা শব্দটির ঐতিহাসিক মর্যাদা কেবল ছাগলেই সীমাবদ্ধ নয়। সেই অনাদিকাল থেকে মানুষের সাথে কাঠালপাতার মৌন-মধুর সম্পর্ক। ছোটবেলায় কাঠালপাতাকে টাকা বানিয়ে দোকান-দোকান খেলা, বড়বেলায় তা ঘুষবাণিজ্যে পরিণত হবার নজিরও কম নয়। মানুষের পেশার সাথে সম্মান জড়িত বলে সব পেশাকেই যেমন মানবসেবার উজ্জল দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্ঠা করা হয়, তেমনি অপরদিকে টেবিলের নিচে পাল্লা দিয়ে কাঠালপাতা আদান-প্রদান করে মানবসেবার পশ্চাৎদেশে ডিনামাইটও সেট করা হয়। ছাগল যেমন কাঠালপাতা রেখে আমপাতা খায় না তেমনি উঠতি বয়সী ছেলেদের হাতে হুমায়ূণ ধরিয়ে দিলেই রসময়পূজার সমাপ্তি ঘটে না। বরং রাস্তার মোড়ের পেপার স্ট্যান্ডগুলোতে রসময়ের কাটতি হুমায়ূণকেও ছাড়িয়ে যায়। প্রাচীনকালে যখন চিকিৎসাবিদ্যা আতুড়ঘরে কিংবা বিদ্যা থেকে বিজ্ঞানের পরিমার্জন ঘটেনি তখন মানুষ ফোড়া কাটতে রাস্তার নাপিতের ধারেই যেত, কিংবা কসাই! নাপিতের হাতে থাকে কাচি আর কসাইয়ের হাতে ধারালো ছুরি। ফোড়া কাটতে যার যেটাতে সাচ্ছন্দ সেথায়ই যেত। কিন্তু দিন বদলে গেছে। চিকিৎসাবিদ্যা আতুড়ঘর থেকে বেরিয়ে বিজ্ঞানে পরিণতি লাভ করেছে আর নাপিত ও কসাইয়ের কাচি-ছুরি হাতে উঠে সৃষ্টি হয়েছে চিকিৎসকশ্রেণীর।
পেশার পাল্লায় নিসঃন্দ্যেহে রহস্যের রোশনাই ছড়িয়ে চিকিৎসাপেশা সর্বপ্রথমে অবস্থান করছে। শিক্ষাজীবনের "জীবনের লক্ষ্য" নামক রচনায় সর্বজনই চিকিৎসাপেশাকে বেছে নেয়। পরবর্তীতে তারা বিভাজিত হয়ে বিজ্ঞান-মানবিক-বাণিজ্যে চলে গেলেও চিকিৎসাপেশা বেছে নেয় বিজ্ঞানকে। মানবিক-বাণিজ্যের সাথে এমন বিমাতাসুলভ আচরণ মোটেও মেনে নেয়া যায় না বলেই কিনা মানবিকতা চিকিৎসাপেশা থেকে অভিমানে দূরে চলে আসে, রয়ে যায় শুধু অমানবিকতা। আর বাণিজ্যে অধ্যয়নরতগণ 'গৌরিসেনের কাঠালপাতার জাহাজে'র সন্ধানে পাড়ি জমায় অকূল পাথারে। "থাকিলে কাঠাল পাতা, নাহি কোন ঠেকা", বাণিজ্যের রীতি-নীতি না জানিলেও এ রীতিটি মানবিক-বিজ্ঞান সবাই শিখে নেয়। বেচারা মানবিক একলা চলো নীতিতেই রয়ে যায় আর বিজ্ঞানে বাণিজ্যের সংমিশ্রণে অমানবিক চিকিৎসাপেশা হয়ে উঠে আরও আধুনিক।
যুগে যুগে কসাইদের থেকে পেশা ছিনিয়ে নেবার এই ভয়ংকর খেলার ইতিহাস হাজার বছরের। আচার্য চাণক্য মুণি, সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সন্তান 'বিন্দুসারা'কে সম্রাজ্ঞীর পেট কেটে এনে দুনিয়ার আলো দেখিয়েছিলেন। সে হিসেবে চাণক্য মুণিকে ইতিহাস অনুসারে আধুনিক জনগণের পরিভাষায় 'প্রথম কসাই' বলা যায়। তার কিছুকাল পর মিশরীয় কসাইদের গুণগাণ দেখা যায় ইতিহাসে, তবে গুণ গুলো কেন দোষে পরিণত হল তার ইতিহাস খুজতে গেলে চোখে শুধু কাঠাল পাতাই দেখা যাবে। কারণ কাঠালপাতাই কসাইদের মানবিকতাকে পশ্চাৎদেশ দেখাবার স্পৃহা জুগিয়েছে।
মানুষের সেবা করার মানসিকতা নিয়ে একজন ছাত্র চিকিৎসাবিজ্ঞানকে বেছে নেয়। ঠিক তেমনি রমণদেব ছাত্রজীবনের কৃতিত্বের অবদান স্বরূপ চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধ্যয়ণের সুযোগ পেয়ে গেল দেশের সবচেয়ে নামী চিকিৎসামহাবিদ্যালয়ে। কিন্তু প্রথম দিনেই তার যে অভিজ্ঞতা হল তাতে সে পরবর্তী জীবনে শুধু অন্ধকার বৈ কিছুই দেখতে পেল না। তাদের শিক্ষকগণ বক্তৃতা স্বরূপ সকল ছাত্রকেই চটি হতে দূরে থাকতে বলল। রমণ ছোট বেলা থেকেই নম্র-ভদ্র, শান্ত-শিষ্ট লেজব্যাতিত একজন। চটি বলতে ছোটবেলায় সে চটি জুতাকেই বুঝত। কিন্তু মামার সাথে একবার বাজারে যাবার পূর্বে চটি সম্পর্কে নব্য ধারণা লাভ করেছিল। রমণ তার মামাকে বন্ধুর সাথে বলতে শুনেছিল যে, তার রুমের তোষকের নিচেই চটিটা রাখা আছে। বাজারে যাবার পূর্বে যখন মামা রমণকে ডেকে বলল চটিজোড়া এনে দিতে, তখন রমণ তোষকের নিচে খুজতে যেয়ে একজোড়া নয় বরং একটি ছোট বইসদৃশ কিছু খুজে পেল। স্কুলের ফার্স্টবয় হিসেবে সর্বদাই বইয়ের প্রতি তার অসীম প্রেম বলেই কিনা সে বইটি খুলে দেখল। কিন্তু বইটিতে কিসব লিখা আর কিসবের ছবি দেয়া, রমণের মস্তিষ্কে কিছুই ঢুকল না। বসার ঘরে যেয়ে দেখে তার মামা আর বাবা একসাথে চা'পানে রত। রমণ কিছু না ভেবেই বলল, "বলি, চটিজোড়া কোথায় রেখেছ মামা? তোষকের নিচে তো এই ন্যাংটুছবির বই ছাড়া কিছুই পেলাম না। তুমি এত খারাপ, মামা!!" সেদিন বাবা কতৃক মামার পিঠে রামধোলাই জুটলেও রমণ বাবার কাছে চটি থেকে দূরে থাকার প্রতিজ্ঞা করেই ছাড়া পেয়েছিল।
চিকিৎসাবিজ্ঞানে মত মহান বিষয়ে পড়তে এসে বারবার এই নোংরা শব্দটি শিক্ষকদের মুখে শুনে রমণের চোখে-মুখে বিরক্তির আভা জ্বলজ্বল করে উঠল। ক্লাশ শেষে বের হবার সময়ই আশে-পাশের ছাত্র-ছাত্রীদের শুধু চটি নিয়েই আলোচনা করতে শুনলো। একজন তো বলেই ফেলল, সে নীলক্ষেত থেকে সব চটি কিনে এনেছে। আরেকজন এসে রমনকে জিজ্ঞাসা করল, কবে নীল ক্ষেত যাবে চটি কেনার জন্য! হেন কথা শুনে রমণের চোখে শুধু জল আসাই বাকি রইল, সেই সাথে নীলক্ষেতে তার সাথে ঘটে যাওয়া জঘণ্য বর্ণনাতীত ঘটনাটিও মনে পড়ে গেল।
সেদিন আকাশে মেঘ ছিল না, বাতাসে ধোয়ার উটকো গন্ধ ছিল না- সেদিন ছিল শুক্রবার। রমণ কিছু সাহিত্যপত্র কিনবার আশায় ফুরফুরে মেজাজে নীলক্ষেতের উদ্দেশ্যে রওনা হল। বাস থেকে নেমে বলাকা হলের ওভারব্রিজের নিচে ঢুকতেই একজন পেছন থেকে ডেকে বলল, 'স্যার!!' রমণ কিছুটা চমকালেও মানিব্যাগে হাত রেখে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, 'কি চাই?' রমণের অভিব্যাক্তি দেখে লোকটি বিগলিত হয়ে বলল, 'লাগবে নাকি? নীলবই, নীলসিডি! দেশী-বিদেশী সবই আছে!'
কথাগুলো বলার সময় কিছু বিক্রির আশায় লোকটির চোখে আনন্দ ঝিলিক দিচ্ছিল দেখে রমণ আর না করতে পারলো। নীলরং এর কোন সাহিত্যপত্রিকা ভেবেই সে বিদেশী ভালো একটি নীলবই চেয়ে বসল। নীলরঙা সুদৃশ্য মোড়কে বইটি হাতে পেয়েই রমণের মন ভরে গেল। টাকা দিয়ে বইয়ের দোকানে ঢুকবার আগেই ভাবলো খুলে দেখা যাক ভেতরে কি জিনিস। যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু নীলবই খুলে রমণ যা দেখতে পেল তাতে তার মাথায় রক্ত চড়ে গেল। নীল মোড়কের ভেতরে বইটি যে চটি ছাড়া কিছুনা সেটা আর বুঝতে বাকি রইল না। বইটি ফুটপাতে ফেলে ঘৃণাভরা একদলা থুথু ছিটাতে ভুলল না। সেই সাথে বুঝে নিল, নীলবইয়ের সাথে নীলক্ষেতের নামকরণের ইতিহাস কিভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িত। এর আগে বেগুনবাড়িতে যেয়ে বেগুন না দেখে কিংবা ধনবাড়িতে জঙ্গল দেখে নামের সাথে এলাকার সাদৃশ্য খুজে পায়নি রমণ। তাই নীলক্ষেতে নীলবই পেয়ে রাগ হলেও মনে মনে বেশ মজাই পেল।
হঠাৎ পেছন থেকে এক সুকন্ঠীর ডাকে রমণের ভাবনায় ছেদ পড়ল। পেছনে তাকিয়ে দেখে, এতো ওদের পাড়ারই সবিতা। কুশলাদি শেষ হবার পরই রমণ সবিতাকে কোথায় যাবে বলতেই দু'পা এগিয়ে এসে সেকেন্ডে দু'বার চোখের পাতা মিটমিট করতে করতে সুমিষ্ট হাসি দিয়ে সবিতা বলল, 'নীলক্ষেতে চটি কিনতে যাবো! তুমিও যাবে আমার সাথে?' একথা শুনেই রমণের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। "কি আধুনিক মেয়েরে বাবা, নীলক্ষেতে নাকি চটি কিনতে যাবে", ভেবেই রমণও আন্তরিকতাস্বরূপ না করতে পারলো না। দুজনে মিলে রিক্সা করে নীলক্ষেতের পথে রওনা হল সবিতার জন্য চটি কেনার উদ্দেশ্যে। পথিমধ্য সবজি বিক্রেতার ভ্যান দেখে রিক্সা থামিয়ে সবিতা বাসার জন্য কিছু সবজি কিনতে নামল। রমণ রিক্সায় বসে দেখছিল সবিতা এক কেজি আলু, এক কেজি শসা আর এককেজি বেগুন কিনে নিল। কিন্তু বেগুণ দেখে রমণের মনে পড়ে গেল বর্ষাকালে বেগুণে পোকা হয় তাই আচমকা চিৎকার দিল, "এই সবিতা, বেগুন নিও না! বর্ষায় বেগুন ভর্তি পোকা থাকে!" কোথা থেকে রমণকে ধন্যবাদ দিবে পোকার কথার কথা মনে করিয়ে দেবার জন্য, বরং সবিতা কটমট করে রমণের দিকে তাকিয়ে বলল, পোকা সুদ্ধ সিদ্ধ করে খাবো। রমণ খিচড়ে মেজাজে ভাবল,"পোকওয়ালা বেগুন সিদ্ধ করে খাবে আধুনিক মেয়ে! আমার কি!"
সবজি কিনেই রিক্সায় উঠে নীলক্ষেতে নামল ওরা। দোকানে ঢুকেই রমণ দেখল আশে পাশে অনেকেই বই কিনছে। ভিড়ের মাঝে দোকানদারগুলো খুব ব্যাস্ত। রমণ অনেক ডেকেও কাউকে পেল না। এর মাঝেই হঠাৎ সবিতা চিৎকার করে উঠল, 'মামা, ফার্স্ট ইয়ারের চটি দিবেন নাকি অন্য দোকানে যাবো?' সবিতার চিৎকার শুনে একটি বার-তের বয়সী এসে বলল, 'আপা কার চটি নিবেন?' রমণ এবার মেজাজ ধরে রাখতে পারলো না। এই ছোট ছেলে এসে চটির কথা বলে! দিল একটা থাপ্পর বসিয়ে। সবিতা এই কান্ড দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। এগিয়ে এসে রাগত স্বরে রমনকে জিজ্ঞাস করল, 'ছেলেটিকে মারলে কেন?' 'এইটুকু ছেলে চটির গল্প করে, কত বড় বেয়াদব! একে মারবো না তো কি করব?',রমণের সহজ জবাব। এ কথা শুনে সবিতা দুনিয়ার মায়া ভুলে আকাশ-পাতাল কাপিয়ে হাসতে লাগলো। সবিতার হাসি দেখে রমণ চরম বিরক্ত হল। আধুনিকতার নামে কিভাবে মানুষ সভ্যতার সীমা অতিক্রম করছে সেটা আজ নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছে সে। রমণের বিরক্তি দেখে সবিতা হাসি থামিয়ে এসে বলল, 'এই চটি সেই চটি নয় রে বোকা, এই চটি হল গাইড বই। আমাদের গাইডগুলোকে চটি বলে এটা তুমি জানোনা রমণ?' সবিতার মুখে চটির নতুন অর্থ জেনে রমণের বোধদয় হল। কিন্তু এই সহজ মানে না জানার কারণে আজ সে চরম বিব্রত হল সবিতার সামনে। এতক্ষণ ধরে সবিতাকে কতটা বাজে ভেবেছিল চিন্তা করে রমণ আর লজ্জায় সবিতার দিকে তাকাতেই পারছিল না। সবিতার চটি কেনার মধ্য দিয়েই রমণের জীবনে একটি চরম বিব্রতকর অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল সেদিন।
এরপর কত দিন গেল, রাত গেল, বর্ষা গেল, শীত গেল, পাশের বাড়ির চৈতির বিয়ে হয়ে বাচ্চা হল! সবিতা রমণকে ছ্যাকা দিয়ে শফিকের হাতে ধরে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করল। কত-শত বন্ধুগণ নিজের আসল রং দেখিয়ে দিল। কিন্তু বিপদের দিনে রমণকে সঙ্গ দিল এই চটিবই গুলোই। সকল বাধা-বিপত্তি পার হয়ে, চরাই-উৎরাই অতিক্রম করে বগলতলে চটি নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অধ্যয়ন সমাপ্ত করল রমণ। ওয়ার্ডে রোগীর বেডের পাশে দাড়িয়ে সকল অতিমানবিকতা অতিক্রম করে আজ তার উপলব্ধি হল, "একমাত্র চিকিৎসাবিদ্যাই মানবিক, যা কিনা চটিকে দিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান আর সুমহান মর্যাদা।" চটি পড়েই তো রমণের মত শত-সহস্র ছাত্র মেডিকেলের গন্ডি পার হচ্ছে। আর সাধারণ মানুষেরা কিনা এই চটিকে ঘৃণার চোখে দেখে! গর্বে বুক ফুলে উঠে, সম্মানে চোখ বুঝে আসে, শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে রমণের। সকল চটিলেখককে স্বশ্রদ্ধ সম্মান জানিয়ে রমন জোর গলায় বলে উঠে, "আমি একজন চিকিৎসক এবং আমি চটি পড়ি।" সদ্য ভর্তি হওয়া পাশের বেডের কিশোর ছেলেটি ব্যাথায় কাতরানো অবস্থায়ও হেসে উঠে। রমণও হেসে হেসে ছেলেটিকে বলে,"বোকা ছেলে, এই চটি সেই চটি নয়!"
বি: দ্র: এটি একটি নিতান্তই সরলরম্য। বিষয়বস্তু কাউকে উদ্দেশ্য করে নয়। গল্পের শিরোনাম দেখে যারা লুঙ্গি ফেলে হুরমুড়িয়ে ঢুকেছেন আমার ব্লগে, তাদের জন্য করুণা রইল।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২১